শৈশব : যে স্মৃতি নীরবে কাঁদায় নীরবে হাসায়
লিখেছেন লিখেছেন প্যারিস থেকে আমি ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৪:৫৪:৩৮ বিকাল
শৈশব । কতনা মধুর কিছু সময়ের সমষ্টি । জীবনের যত সুখ, আনন্দ, অভিমান,গুমরামুখ,পেঁচারমুখ সবকিছুর সংমিশ্রনের নামই যেন শৈশব । হাসি-কান্না,খেলাধুলা,সাঁতারকাটা,অযথা দৌড়াদৌড়ি,সাইকেল চালানো,রিক্সার পেছনে চুপিচুপি চড়তে থাকা,ঢিল মেরে পাখি শিকার,ক্লাস ফাঁকি দেয়া,বাবার হাতে কানমলা,স্যারের দেয়া শাস্হি গ্রহনে কান ধরে উঠবস করা ইত্যাদির সমষ্টির নাম শৈশব । অনেকের জীবনে শৈশবটা আবার অনেক বিষাদের । সফলতা আর ব্যার্থতা দিয়েই শৈশবের সমাপ্তি । তাইতো এখন মনে হয় আবার যদি শৈশবে ফিরে যাওয়া যেত তাহলে জীবনের ছোটছোট ভুলগুলো শুধরিয়ে নিজেকে একজন প্রকৃত মানুষে পরিনত করতে চেষ্টা চালাতাম।
কত কিছুইনা জড়িয়ে আছে এই শৈশবে । কিছু স্মৃতি মনে হলে একান্ত মনে হাসি । ভাবি,কতই না বোকা ছিলাম !কিছু স্মৃতি মনে হলে খুবই খারাপ লাগে,আবার কিছু মধুর স্মৃতি মনে হলে ইচ্ছে করে দৌড়িয়ে শৈশবে ফিরে যাই । সময় যতটা গড়াচ্ছে জীবনটা বিষাদ হচ্ছে আর শৈশবটা আপন হচ্ছে । কেননা শৈশবেই সকল আপনজন কাছে ছিলো,যারা আস্তে আস্তে ইহজগত ত্যাগ করছে । যার কারনে শৈশবটা এখন কাঁদায় ।
কত স্মৃতিই জমা হয়ে আছে জীবনে । সবকিছু কি আর সকলের সাথে শেয়ার করা যায় ? তারমধ্য থেকে দুটু স্মৃতি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো । তবে বলে রাখি শৈশবে আমি খুব দুষ্টু ছিলাম না । যদিও মাঝেমধ্যে অন্যদের সাথে নিয়ে প্রতিবেশির বাড়ির নারিকেল, আঁখ,বরই চুরি করে খেয়েছি । দিনে ও রাতে উভয় অবস্হাতেই চুরি করেছি । অনেকের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি এবং দেশে গেলে বাকিদের কাছ থেকেও ক্ষমা চেয়ে নেব । এখানে বলা আবশ্যক,দুষ্টু না হলেও আমি আর আমার ইমিডিয়েট ছোটভাই প্রায়ই মারামারি করতাম । যদিও দুই ভাই এখন প্যারিসে আছি ।
স্মৃতি-১ : ক্লাস অষ্টম শ্রেনির সান্মাষিক পরীক্ষায় নকলের দায়ে মিছেমিছি অধ্যক্ষের হাতের বেতের মার খাওয়া এখনো মনে হলে খুব খারাপ লাগে । হুজুরের প্রতি নিজে না চাইলেও কেন জানি ঘৃনা চলে আসে মনে । এখনো প্রশ্ন জাগে কেন মিথ্যা অভিযোগে আমি হুজুরের হাতে মার খাব । পরীক্ষা দিচ্ছি,নকলের ধারেকাছেও আমি নেই । অধ্যক্ষ মহোদয় পরীক্ষার হলের বাহিরে হাটাহাটি করছেন । হঠাৎ করে বাহির থেকে একটি নকলের কাগজ নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন এবং প্রশ্ন করলেন জানালা দিয়ে কে এই কাগজ নকল করে বাহিরে ফেলেছে । আমি যেহেতু নকল করিনি তাই নীরব থাকাই স্বাভাবিক । তাছাড়া কেও কি নকল করে বলবে যে সে নকল করেছে,বিধায় সকলেই নীরব । হুজুর এখন সকলের খাতা দেখতে শুরু করেছেন এবং খাতার লেখার সাথে নকলকৃত কাগজের লেখা মিলাতে লাগলেন । কিভাবে যেন আমার একটি লেখার সাথে ঐ কাগজের লেখাটা মিলে গেলো । আর যাই কোথায় । হুজুর বললেন আমি নকল করেছি । আর আমি যথাসাধ্য নিজেকে নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা করছি । কিন্তু কে শুনে কার কথা । হুজুর পিয়নকে দিয়ে একটি বেত আনালেন এবং আমার উপর চড়াও হলেন । আমাকে হাত পাততে বললেও আমি হাত পাতিনি ।এতে করে আমার শরীরের উপর দিয়ে একটা কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেলো । রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে আমি পরিক্ষা না দিয়ে হলের বাহিরে চলে গেলাম । শেষে অপর একজন হুজুর যিনি আমাকে খুবই মহব্বত করতেন তিনি আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরীক্ষার হলে নিয়ে গেলেন এবং পরীক্ষা দিতে বললেন । তিনি আমাকে বুঝাতে চাইলেন,হুজুররা মারলে,শরীরের যে অংশে মার লাগে সেই অংশ বেহেস্তে যাবে । কথাটা কতটুকু সত্য ?
স্মৃতি-২ : আমরা ছিলাম যৌথ পরিবার । চাচার শাসনে বড় হয়েছি । চাচাকে আব্বা বলেই ডাকতাম । আজ চাচা নেই, তার জন্য মন থেকে দোয়া আসে শুধু এই কারনে যে তিনি মানুষ করার জন্য চেষ্টা করেছেন । খুব ভয় করতাম চাচাকে । তিনি আবার ভাই বোনের মধ্যে আমাকেই বেশি মহব্বত করতেন । তাই বলে শাসন কম ছিলোনা । তখন কোন ক্লাসে পড়ছি মনে নেই । সপ্তম বা অষ্টম শ্রেনী হতে পারে । একদিন ক্লাস ফাঁকি দিয়েছি । কিভাবে যেন চাচা শুনে ফেলেছেন । সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,লেখাপড়া করবো নাকি গরু রাখবো । বোকার মত বলে ফেললাম, গরু রাখবো । তিনি বললেন,ঠিক আছে আগামী কাল সকালে গরু নিয়ে মাঠে যেতে হবে এবং দিন শেষে বিকালে বাড়ি ফিরবো । পরদিন আমি তাই করলাম । সকালে গরু নিয়ে মাঠে চরাতে গিয়ে বিকালে ফিরেছি । ফেরার পর খাওয়া দাওয়া করে খেলতে যাব ঠিক এই সময়ে আবার ডাক পড়েছে চাচার । কাছে গেলাম,তিনি জিজ্ঞেস করলেন আবার, পড়াশুনা করবো নাকি গরু রাখবো । আমি সেই আবার বোকার মত গরু রাখবো বলে সম্মতি জানালাম । তখনো আমি বুঝতে পারিনি যে সেই মুহুর্তে আমার উপর এক পশলা ঝড় বয়ে যাবে । যেমনি বলেছি গরু রাখবো,তখনি আমাকে তার গায়ের গামছা দিয়ে ঘরের বারান্দার একটি ফিলারে বেধে নিয়ে মার শুরু করলেন । আমিও মারের শুরুতে কান্নাকাটি শুরু করে মরার মত হয়ে পড়ে রইলাম । যাতে করে চাচি এসে এই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করেন । যতবারই এধরনের বিপদে পড়েছি ততবারই একটু কৌশল করলেই চাচি এসে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন । যদিও এখন বুঝি আমার কোন কৌশল ছিলোনা,ছিলো তাদের মহব্বত । যার কারনে একজন শুরু করলে আরেকজন দৌড় দিয়ে এসে উদ্ধার নাটক । সেদিন চাচা বলেছিলেন,তাকে গরু রাখতে দিলাম যাতে বুঝতে পারে যে গরু রাখার চেয়ে পড়াশুনার কাজ আরামের এবং সে পড়াশুনা করে । পড়াশুনা ঠিকমত করবো এই কথা দিয়ে সে যাত্রা চাচি আমাকে উদ্ধার করলেন । সেই কাহিনী নিয়ে এখনো বাড়ির সকলে হাসাহাসি করেন । এমনকি আমার স্ত্রীকেও সেই কাহিনী জানিয়ে দেয়া হয়েছে । আজ খুব মনে পড়ছে আমার চাচাকে । তিনি ২০১১ সালের মার্চের ২৭ তারিখে ইহজগত ত্যাগ করে তার প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়েছেন । কতটা দুর্ভাগ্য আমাদের । আমি আমার চাচার জানাজা পড়তে পারিনি । ইয়া আল্লাহ তুমি আমার চাচাকে মাফ করে দিও । তাকে তুমি জান্নাতের মেহমান করে নিও । আমাদের সকল ভালো আমলগুলো যেন তার জন্য মাগফিরাতের উছিলা হয় ।
বিষয়: বিবিধ
২০৩১ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার চাচার দুষ-ত্রুটি ক্ষমা করে উনাকে জান্নাত দান করুন ।আমীন।
অনেক ধন্যবাদ এমন লেখাটি উপহার দেবার জন্য।
আপনার চাচাজীকে যেন আল্লাহ পাক ক্ষমা করেন এবং জান্নাত নসীব করেন-আমীন।
শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন।
তবে মনে হয় গরু চড়ালে খারাপ হতোনা!!
শিক্ষিত হয়ে এখন করতে হচ্ছে অন্য মানুষের চাকরি। গরু চড়ান বা রাখালগিরি তা জানলে হয়তোবা স্বাধিন রাখাল এর জিবন কাটাতে পারতাম!!
স্কুলে এই ধরনের অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। অনেক শিক্ষক দেখেছি যারা নতুন ক্লাসে প্রথমেই যেই জিনিসটা ছাত্রছাত্রিদের শিখাতে চাইতেন সেটা হচ্ছে শিক্ষকদের ভুল ধরাও নাকি ভুল। এভাবে শিক্ষকদের শ্রদ্ধার নামে অন্ধ অনুসরন এর শিক্ষা দেওয়া হয়। আর শিক্ষকদের মধ্যে সৃষ্টি হয় ডিক্টেটর সুলভ মানসিকতার।জিবনের শুরুতেই একজন শিক্ষা পায় অন্যায় এর প্রতিবাদ করা বেয়াদবি বা অন্যায়!! এভাবে শিক্ষা পেয়েই আমরা এখন হারিয়ে ফেলেছি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যাক্তির অন্যায় এর প্রতিবাদ করার সাহস। এখন তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত আমলা শ্রেনি পরিশ্রমি সাধারন মানুষদেরকে নিজেদের ক্রিতদাস মনে করেন উচ্চ ডিগ্রির গর্বে। অথচ তাদের মতে অশিক্ষিত সেই সাধারন মানুষটি হয়তোবা একজন অতি সফল কৃষক। আপনারা বাইরে আছেন। দেশের দূতাবাসগুলির মেধাবি! কর্মকর্তাদের আচরন নিশ্চয়ই দেখেছেন। এভাবেই এখন আমরা পরিনিত হচ্ছি একটি জিবন্মৃত জাতিতে।
স্মৃতি বেদনা মধুর।
ধন্যবাদ।
যেমন দেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থা।
ভাই আপনার শৈশব ষ্মৃতি পড়ে ভালো লাগলো।
প্রতিবেশির বাড়ির নারিকেল, আঁখ,বরই চুরি করে খাওয়া কি দুষ্টামির মধ্যে পড়ে
ভালো লাগলো আপনার শৈশব ষ্মৃতি
মন্তব্য করতে লগইন করুন