তুই,তুমি এবং আপনি
লিখেছেন লিখেছেন প্যারিস থেকে আমি ০৩ আগস্ট, ২০১৪, ০৬:২০:১৫ সন্ধ্যা
আজ থেকে অনেক বছর পুর্বে মায়ের পক্ষে মায়ের প্রবাসী ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখতে গিয়ে অনেক যায়গায় তুই শব্দ ব্যবহার করেছিলাম । যেহেতু মায়ের ছোট ভাই, সেহেতু তুই লিখতে হবে এরকম একটি ধারনা থেকেই তুই এর ব্যবহার। চিঠিটা লেখা শেষ করে মাকে পড়ে শুনাতে গিয়েই মা ভুলটি ধরিয়ে দিলেন।বললেন, ছোট ভাই/বোন হলেও চিঠিতে তুই লিখতে নাই,লিখতে হবে তুমি । সেই প্রথম শিখলাম তুই'র ব্যবহার মায়ের কাছ থেকে ।
তারও অনেকদিন পর যখন ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে জড়িত হলাম তখন এক প্রিয় দায়িত্বশীলের সামনে ছোট ভাইয়ের সাথে তুই করে কথা বলছি শুনে দায়িত্বশীল ডেকে নিয়ে বললেন, ছোট ভাই হলেও তাকে তুই করে কথা বলতে নেই । ছোট ভাই/বোনকে তুমি করে কথা বললে সে তোমাকে আপনি করে কথা বলবে । দ্বিতীয়বার শিখলাম ছোটদের তুই'র বদলে তুমি'র ব্যবহার।
সেই থেকে শুরু , বয়সে ছোট বা খুব কাছের মানুষকে তুমি করে বলা । আর বড়দের বা অপরিচিতদের হরহামেশা আপনি আপনি ।
কিছুদিন পুর্বে কাজের যায়গায় মোবাইলে ছোট ভাইয়ের সাথে তুমি করে কথা বলছি শুনে এক কলিগ জিজ্ঞেস করলেন সে আমার বড়ভাই কি না । জানতে চাইলাম কেন এমন প্রশ্ন । বললেন, একটু আগে যে তুমি করে কথা বলেছো । বুঝতে পারলাম সমস্যাটা কোথায় ।
তুই,তুমি এবং আপনি এই শব্দগুলো আমাদের ব্যবহারিক জিন্দেগীতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত । বাংলাদেশ ভারত পাকিস্হান সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এই শব্দগুলো এক সাথে ব্যবহার করা হয় । ফ্রান্স সহ ইউরোপের অনেক দেশেই তুমি ও আপনি শব্দদুটি ব্যবহার হয় । আবার ইংরেজি ও আরবীতে শুধু ইউ এবং ইনতে এক শব্দ দিয়ে তুমি/আপনি'র ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এই শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা ভালবাসা,আন্তরিকতা ও শিষ্টাচারের পরিচয় দিয়ে থাকি । সাধারনত খুব কাছের মানুষ,পরিচিতজনদের আমরা তুই এবং তুমি দিয়ে সম্ভোধন করি । আবার অনেক সময় আপনি বলেও সম্ভোধন করি । সন্তান তার প্রিয় বাবা মাকে, স্ত্রী তার প্রিয় স্বামীকে আপনি করে সম্ভোধন করে থাকেন । অনেকে তুমি করেও করে থাকেন। বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষই তুমি ও তুই ব্যবহার করে থাকেন । যেখানে ছোটরা বড়দের আপনি বলে সম্ভোধন করে সেখানে বড়রা ছোটদের তুমি করেই সম্ভোধন করে । আবার যেখানে ছোটরা বড়দের তুমি করে সম্ভোধন করে সেখানে বড়রা ছোটদের তুই করে সম্ভোধন করে । ভাই বোনদের মধ্যে তুই ,তুমি'র সম্ভোধন হয় অধিকহারে।
বর্তমান সময়ে কিছু অধুনা (তাদের দৃষ্টিতে) পরিবারে তুই এর হয়ে থাকে । দেখা যায় ছোট বড় ভাই/বোনের কোন পরিচয় নেই সবাই একে অপরকে তুই বলে সম্ভোধন করছে এবং নাটক সিনেমাতে তার ব্যবহার সবচেয়ে বেশী । একে অপরে খুব খুবই আপনজন এরকম বুঝাতে গিয়ে এই তুই'র ব্যবহার চলে। কিন্তু কেন ? তুমি এবং আপনি'র মধ্যে কি প্রেম-প্রীতি ভালবাসা নাই ? মানুষতো এই তুই শব্দটা দিয়ে একে অপরে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ব্যবহার করে থাকে । যে শব্দটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যে ব্যবহার হয় সে শব্দ কিভাবে প্রেম-প্রীতি ভালবাসার বন্ধন হতে পারে ।
এই তুই শব্দটা যখন কোন গরিবের মুখে শুনি তখন আমরা অনেকেই নাক ছিটকাই । কিন্তু কোন পয়সাওয়ালা বড়লোকদের মুখে শুনলে তা হয়ে যায় আধুনিক বচন। একবার ভেবে দেখুন তুই সাধারনত আমরা ছোট বুঝাতে সম্ভোধন করি। তাহলে যেসকল পরিবারে একে অপরে সবাই তুই সম্ভোধন করে তারা কি আসলে সকলেই ছোট মানসিকতার ?
তুমি সম্ভোধনটা সব সময় যেন মানুষকে কাছে টানে। যেসকল পরিবারে মায়া মমতার বন্ধন সুদৃঢ় সেসকল পরিবারে বেশীরভাগ সময় তুমি ব্যবহার হয়ে থাকে । আর যেখানেই তুমি আছে সেখানে আপনি'র ব্যবহারও সচরাচর শুনা যায়। আপনি ব্যবহারের মাধ্যমেই কিন্তু আমরা একে অপরকে সম্মান করে থাকি । আমার কাছে যদি দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ হয়ে থাকেন আমার বাবা মা, তাহলে আমাকেতো প্রথমেই আমার বাবা মাকে দিয়েই আপনি শুরু করা দরকার। আমি যখন আপনি করে আমার বাবা মা কে সম্ভোধন করে সম্মানিত করবো তখন তারা আমাকে তুমি বলে সম্ভোধন করবেন তখন কিন্তু আমারই মর্যাদা বৃদ্ধি পেল । যখন অন্যরা শুনবে আমার বাবা মা'ই আমাকে তুমি করে বলছে,তখন অন্যেরা আমাকে তুই করে বলার সাহস পাবেনা।
অনেকে আবার বন্ধু বান্ধবের মধ্যে তুই সম্ভোধনে সাচ্ছন্দবোধ করেন। আসলে বন্ধু বান্ধবরা একে অপরকে নিজের থেকে বেশী মর্যাদা দিতে চায় না বলেই তুই সম্ভোধন করে । খোজে দেখুন যে সকল বন্ধু বান্ধবের মধ্যে তুই'র ব্যবহার হয়ে থাকে তাদের মধ্যে কলহ বেশী দেখা যায়, যারা তুমি'র ব্যবহার করে তাদের থাকে । তুমি বলার মাধ্যমে একে অপরের সাথে যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টি হয় , সেই সম্পর্ক তুই সম্ভোধনকারীদের মধ্যে কম থাকে ।
বাবা মা,ভাই বোন, প্রিয়জনদের তুমি বলাতেও দুষের কিছু দেখিনা। কিন্তু কেন আমরা তুই'র মধ্যে নিয়ে আসবো ? তুই শব্দটাকে রেখে দেইনা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ব্যবহারের জন্য।
বিষয়: বিবিধ
২২৯২ বার পঠিত, ৪৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর আপনি তো ভাই আমাকে ও আপনি বলেন যা আমাকে লজ্জা দেয় ।
সব থেকে এটা ভাললাগছে যে গরীব কেউ যদি তুই বলে তাহলে সেটা দোষের হয়ে যায় আর বড়লোক যদি কেউ তুই বলে সেটা দোষ ধরা হয়না।
হ্যা ঠিক !
আমি সিডরের সময় কারিতাস থেকে দক্ষিনবঙ্গে ছোটখাট একটা দ্বায়িত্ব পাই ।
আমার দ্বায়িত্ব ছিল ,সিডরে বাড়ি ক্ষয় ক্ষতি লিপিবদ্ধ করা অর্থাত্ কতগুলো ঘরবাড়ি ভেঙ্গেছে।
আমার যাওয়া আসা ছিল আর্মিদের সাথে ।
একদিন আর্মির একজন সেনা আমার জরিপের সময় এক মুরব্বিকে জিজ্ঞেস করল ,ঐদিকে কেমন ক্ষতি হয়েছে বলতে পারবি ?
আশ্চর্যের বিষয় হল এইযে মেজর সাহেব ও ঐ সেনাকে জিজ্ঞেস করলানা তুমি ঐ বয়স্ক লোকটাকে তুই সম্বোধন কেন করলে ?
আর পুলিশ বা সেনা সদস্যদের আচরনে মনে হয় ওরা খুবই নিচু পরিবারের সন্তান।
আসলেই এই সম্বোধন এর ব্যবহার আমাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রাকছে।
একদম ঠিক বলেছেন।
অনেক সুন্দর লেখা। জাযাকাল্লাহ খইর
ধন্যবাদ ভাই এরকম একটা পোস্ট করার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন