একজন প্রবাসীর বিয়ে:
লিখেছেন লিখেছেন প্যারিস থেকে আমি ১২ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৮:১৮:১৩ সকাল
আলম সাহেব যে বয়েসে বিদেশে পাড়ি জমালেন সেই বয়সটাই ছিলো বিয়ের জন্য উপযুক্ত।কিন্তু কিভাবে করবেন ? বিয়ের জন্য যে অনেক টাকা পয়সার দরকার।তাছাড়া বউ খাওয়ানোর জন্য যে কিছু স্হায়ী উপার্জনের ব্যবস্হাও থাকা চাই।তার যে কোনটিই নেই।না আছে বিয়ের খরচের টাকা,আর না আছে বিয়ের পর বউ খাওয়ানোর মত কোন স্হায়ী উপার্জনের ব্যবস্হা।তাই বিয়ের চিন্তা মাথায় না ঢুকিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানোর ধান্ধা।
একদিন তিনি সত্যিই পাড়ি জমালেন ইউরোপে,তাও আবার ফ্রান্সে।যেখানে বৈধ হওয়ার অন্যতম পন্হা হলো রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা।আর রাজনৈতিক আশ্রয় পেলে বাংলাদেশে যাওয়া দশ বছরের জন্য নিষিদ্ধ।কিন্তু কি আর করা, যেহেতু বৈধ হওয়ার এটাই সহজ পন্হা তাই তিনিও রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেন এবং পেয়েও গেলেন।আর যেহেতু ফ্রান্সে বৈধ হয়ে গিয়েছেন,তাহলে বিয়েটা তড়িৎ করে নেয়াই ভালো।এদিকে আবার প্রবাসে আসার পর থেকেই যে বিয়ের পোকা মাথায় ঢুকে আছে।কবে বৈধ হবেন,আর কবে বিয়ে করতে পারবেন।
বৈধ যেহেতু হয়েই গিয়েছেন তাহলে আর দেরী করা কেন।ঘোষনা হয়ে গেলো আলম সাহেব বিয়ে করবেন,তার জন্য পাত্রী দেখতে হবে।পাত্রী দেখার দায়িত্বও দিয়ে দিলেন পরিবারের উপর।শুধু তিনি তার চাহিদা জানিয়ে দিলেন।
-কনের পরিবার যেন হয় এলাকার একটা পরিচিত পরিবার।
-কনের পরিবার যেন হয় একটা দীনি পরিবার।(আওয়ামী পরিবার কোন অবস্হায়ই না)
-কনে যেন হয় নামাজী এবং দীন ও দুনিয়া সম্পর্কে সম্যখ অবগত।
-কনে পরিবার যেন খুব বড় লোক না হয়,আবার এতটা দরিদ্রও যেন না হয় যে মেয়ের জামাইর কাছে হাত পাতে।
উপরোল্লেখিত চাহিদানুযায়ী কনে দেখতে গিয়ে আলম সাহেবের ছোট ভাই জানালো যে,মেয়েরা সাধারনত বাপের বাড়িতে খুব বেশী নামাজ কালাম পড়েনা,তবে বিয়ের পর ঠিকই পড়ে।
আলম সাহেব জানিয়ে দিলেন,কনে এমন হতে হবে যে স্বামীর বাড়ি এসে নামাজ অন্যদের শিখাবে,পড়াবে।
সে অনুযায়ী কনে খুজা হচ্ছে কিন্তু পরিবারের লোকজন কোন পাত্রী মিলাতে পারছেনা। একদিক হলে অন্যদিক হয়না।
একদিন আলম সাহেবের এক প্রবাসের রুমমেট প্রস্তাব দিলো যে, তার এক আত্বীয় আছে চাহিদার সাথে অনেক কিছুই মিলে যাবে শুধু মেয়েকে পছন্দ হবে কি না।কেননা মেয়ে উজ্জল শ্যামলা।
আলম সাহেব বললেন,ঠিকানা দিন,মা ও বোনদের পাঠিয়ে দেখবো তাদের পছন্দ হয় কিনা।
রুমমেট জানালেন,তার আগে দেখি মেয়েটি রয়েছে কিনা বা এখন তাকে তার পরিবার বিয়ে দিবেন কিনা।
ঠিক আছে তাড়াতাড়ি যেনে নিন।
আলম সাহেবের ঐ কথায় রুমমেট প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলেন দেশে কনের বাড়িতে এবং বিয়ে দিতে সম্মত হলে আলম সাহেবের পরিবারের সদস্যদেরকে মেয়ে দেখার পারমিশন চাইলেন।
মেয়ের বাবা রুমমেটের কাছ থেকে আলম সাহেবের সম্পুর্ন বায়োডাটা নিয়ে তাকে অপেক্ষা করতে বললেন।
এই সময়ের মধ্যে আলম সাহেব মেয়ের পরিবার সম্পর্কেও জেনে নিলেন।তার চাহিদা অনুযায়ী অনেকটাই মিলে গেছে এখন যদি পরিবারের লোকজনের মেয়ে পছন্দ হয়,বিশেষ করে মা'র।আর মেয়ের বাবাও যদি বিয়ে দিতে রাজি হন তাহলে আর দেরী হবেনা আশা করা যায়।
কিন্তু মেয়ের বাবা সময় নিতে থাকলেন।
কিছুদিন যাওয়ার পর আলম সাহেব রুমমেটকে ডেকে বললেন, তারা যদি মেয়ে বিয়ে দিতে চায় তাহলে যেন মেয়ে দেখার সুযোগ দেন।আর যদি না চান,তাহলেও যেন জানিয়ে দেন।এতে করে অন্যত্র কনে খুজা হবে।একজনের জন্যতো আর অপেক্ষা করে বসে থাকা যাবেনা।
এই কথায় কাজ হলো এবং মেয়ে দেখার সুযোগ দেয়া হলো।
মেয়ে দেখতে গেলেন আলম সাহেবের মা,চাচা,ছোট দুই ভাই এবং ছোট বোন।
সকলের মেয়ে পছন্দ হলো শুধু সবচেয়ে ছোট ভাইটি ছাড়া।তার কথা হলো ভাইয়ের জন্য আরো সুন্দর মেয়ে চাই।
যেহেতু মা'র পছন্দ হয়ে গেছে তাহলে আর কোন কথা নেই।আলম সাহেব জানিয়ে দিলেন এখানেই বিয়ে হবে।তাছাড়া আলম সাহেবের চাচারও কিন্তু খুব পছন্দ হয় মেয়েকে। আলম সাহেবের বাবা বেচে নেই তাই চাচার গুরুত্ব অপরিসীম।
মেয়ে দেখে ফেরার পথে আলম সাহেব ফোন দিলেন ইমিডিয়েট ছোট ভাইকে মেয়ে সম্পর্কে জানার জন্য। সে মোবাইল রিসিভ করেই দিয়ে দিলো চাচার হাতে।চাচা উচ্ছসিত কন্ঠে সাফ জানিয়ে দিলেন যে মেয়ে তাদের সকলের পছন্দ হয়েছে তাই তিনি মেয়ের বাবাকে কথা দিয়ে আসছেন যে বিয়ে হবে।
আলম সাহেব কি বলবেন চাচাকে।লজ্জায় তিনি কোন কথা বলতে পারছেন না।যে চাচার সামনে দাড়াতে ভয় পেতেন সেই চাচার সাথে বিয়ের কথা, কিভাবে সম্ভব! তাই তিনি শুধু এতটুকু বললেন,ঠিক আছে আপনাদের পছন্দ হলে ভালো।
বিয়ের কথাবার্তা এগিয়ে চলছে।বিয়ের আকদ্ হবে টেলিফোনে।তবে আলম সাহেব দেশে গিয়ে অনুষ্টান করে বউ ঘরে তুলবেন।
একদিন মেয়ের বাবার পক্ষ থেকে প্যারিসে থাকেন একজন আলম সাহেবের কাছে মোহরানার প্রস্তাব করলেন এবং বড় একটা অংক শুনালেন আলম সাহেবকে।
আলম সাহেব শুধু এতটুকুই বললেন, আমি আপনাদের মেয়ে দেখিনি, আগে থেকে আপনাদের সম্পর্কে জানাশুনাও ছিলোনা, শুনেছি দীনদার পরিবার,তাই মোহরানাতেও দীনদারি রক্ষা করতে হবে। (বর্তমান সময়ে মোহরানা হয়ে পড়েছে শুধু লোক দেখানো, যে কার মেয়ের কত টাকা মোহরানায় বিয়ে হয়েছে।এটা যে আদায় করতে হয় না জানেন বর পক্ষ আর না জানেন কনে পক্ষ।তাছাড়া ইউরোপিয়ান হলেতো আর রক্ষা নাই।১৫/২০ লক্ষ টাকার নিচে কোন কথা নাই।)
আলম সাহেবের বেলায় অবশ্য তা হয়নি। মোটামোটি দীনদারী রক্ষা করে একটা অংক সাব্যস্ত করা হয়।
সব আনুষ্টানিকতা শেষে একদিন আকদ হয়ে গেলো।
ও হে , আকদের আগে একদিন আলম সাহেব মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলতে চাইলেন। নিজে দেখেন নি,তাই বলে দু'একটি কথাও কি বলবেন না। কথা শুরু হলো মেয়ের সাথে।
§ আসসালামু আলাইকুম ।
মেয়ের জবাব, ওয়া আলাইকুম আসসালাম ।
§ আপনি কেমন আছেন ?
জবাব, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি।
হ্যালো,হ্যালো,হ্যালো,পুত,পুত,পুত। আর কোন কথা নেই।লাইনটা কেটে গেলো। বিয়ের পর জানা গেলো যে লাইনটা ইচ্ছে করেই কাটা হয়েছে।
তবে আলম সাহেবের ঐ একটি কথায় মেয়েকে পছন্দ হলো। সাধারনত বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছি'র সাথে আলহামদুলিল্লাহ বা আল্লাহর রহমতে ভালো আছি বলেনা।
আকদের সাড়ে ৪ মাস পর আলম সাহেব দেশে গেলেন।যাওয়ার পরদিনই কনে পক্ষ বিশাল ইফতারি নিয়ে বরের বাড়িতে হাজির। উদ্দেশ্য অনুষ্টানের দিন তারিখ ঠিক করা। সিদ্ধান্ত হলো ঈদের ২ দিন পর অনুষ্টান করেই বিয়ের ষোলকলা পূর্ন করবেন। অনুষ্টান হবে আবার উভয় পরিবারের যৌথ উদ্যোগে কোন কমিউনিটি সেন্টারে। এদিকে ঈদের এখনো ১৪ দিন বাকি।এতদিন বিয়ে করা বউ থাকবে তার বাপের বাড়িতে এটা কিভাবে সম্ভব? কিন্তু আলম সাহেব নিজেইতো বর,তাই তিনি কিছু বলতেও পারছেন না। সিলেটে এই একটা কালচার এখনো বিদ্যমান,বর কিছু বলতে পারবেন না । আসলে নিজের বিয়ে সম্পর্কে কিছু বলা যায়ওনা একান্ত বন্ধুবান্ধব ছাড়া।
অনুষ্টান হতে যেহেতু এখনো ১৪ দিন বাকি তাহলে আলম সাহেব কালই যাবেন বউ দেখতে। তিনি গেলেন,বউ দেখলেন। ফিরে আসার পর অনেকেই জানতে চাইলেন,কনে কেমন দেখলে ? পছন্দ হয়েছে কি না ?
আলম সাহেব জবাবে বললেন, আমিতো আর কনে দেখতে যাইনি। তাছাড়া পছন্দ অপছন্দের কথা কেন।আমি গিয়েছি আমার বিয়ে করা বউকে দেখতে।তাকে পছন্দ হয় কি না,তা আমি দেখিনি।এমন কথায় সবাই নিশ্চুপ।
অনুষ্টানের দিন ঘনিয়ে এলো।এর মধ্যে চাচা জানালেন অনুষ্টানের খরচ যেন আলম সাহেব এক তৃতীয়াংশ দেন। শুনে আলম সাহেব চাচাকে একটি হাদীস জানিয়ে দিলেন। হাদীসটি হলো, বিয়েতে বর পক্ষ যেন কনে পক্ষ থেকে বেশী খরচ করে। বিশেষ করে বর পক্ষ যেন ওয়ালিমা করে। যেহেতু অনুষ্টান একসাথে হচ্ছে তাই এখানে বর পক্ষের আর্থিক অংশ গ্রহন বেশী দরকার। আলম সাহেবের কথায় চাচাও নিশ্চুপ।
এভাবেই অনুষ্টানও হয়ে গেলো। আলম সাহেবের বউ ঘরে এলো। বাসর ঘরে যাওয়ার পূর্বে আলম সাহেবের দুলা ভাই এসে আলম সাহেবকে কিছু কান মন্ত্র দিলেন। দুলা ভাই এটাও বললেন, আজ রাতেই যেন বউয়ের কাছ থেকে মোহরানা মাফ করিয়ে নেন। এমন কথা শুনে আলম সাহেব তাদের অজ্ঞতার কথা বিবেচনা করে কোন কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন,ঠিক আছে সেটা দেখা যাবে।
বিয়ের পরদিন আলম সাহেবের এক মামা দুবাই থেকে ফোন করে আশির্বাদ জানালেন এবং আলম সাহেবকে নসিহত করলেন। নসিহতটা এরকম, বউকে ভালোবাসবে কিন্তু কখনো মুখে বলবেনা এবং বুঝতে দেবেনা। এতে করে বউ সব সময় আনুগত্যশীল হয়ে থাকবে ।
এটা কিভাবে সম্ভব আপনারাই বলেন। বউকে ভালোবাসবেন অথচ মুখে বলবেন না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি,বুঝতে দেবেননা যে তিনি তার বউকে কতটা ভালোবাসেন। এভাবে কি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক দৃঢ় হয়। এভাবে কি মজবুত হতে পারে স্বামী-স্ত্রীর মায়ার বাঁধন।
তবে আলম সাহেব বিয়ের পরদিনই তার বউকে জানিয়ে দিয়েছেন, সে যেন তার প্রতি ভালোবাসার কমতি দেখলে আদায় করে নেয়।কিন্তু কখনো যেন তার মা'র ভালোবাসায়, ভাইবোনের ভালোবাসায় হস্তক্ষেপ না করে। আজ তাদের সুখি সুন্দর পরিবারে একটাই শুধু আক্ষেপ এখনো তাদের কোন সন্তান হয়নি। সকলের প্রতি দোয়ার অনুরোধ জানিয়ে বউকে নিয়ে একটি কবিতা দিয়ে শেষ করছি বিয়ের গল্প।
রাত ১২ টায় ঘরে ফিরি আমি
প্রতিদিন কাজের শেষে
বউ আমার দরজা খুলে দেয়
মুখে একগাল হেসে।
-
আমায় বলে কাপড় পাল্টাও
এসো ধোয়ে মুখ হাত
একটু পরেই আমার মুখে
বউ তুলে দেয় ভাত।
-
আজ কতদিন হয় আমি
খাইনা আমার হাতে
বউ আমার মুখে ভাত দেয়
প্রতিদিন রোজ রাতে।
-
এমন লক্ষি বউ ভাগ্যে জুটে
কপাল ক'জনার আছে
আর কিছুই বললাম না এখন
লোকে কি বলে পাছে।
(কবিতাটি লিখেছিলাম ২৪ মে ২০১৩ তে, ব্লগার লালসালুর বিয়ের পর ছড়ার মন্তব্য ছড়া হিসাবে।)
বিষয়: বিবিধ
৫৪৩৭ বার পঠিত, ১১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এখনো রয়ে গেছে
বিয়ের রেশ।
দোয়া করি, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাতে উনাদের মনের আশা পূর্ন করেন।
ভালো লাগল, "বউকে ভালোবাসবেন অথচ মুখে বলবেন না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি,বুঝতে দেবেননা যে তিনি তার বউকে কতটা ভালোবাসেন"।
আমার বউ আমাকে বলে, "সবাই তোমাকে ভালো বলে বলে পাম দিচ্ছে, ওদের কথায় কান দিবানা, শুন, আমি যতদিন না পর্যন্ত তোমাকে ভালো বলব, ততদিন তুমি ভালো হতে পারবেনা। হুমমমমম। মনে রাখিও।
হা হা হা।
কনে যেন হয় নামাজী এবং দীন ও দুনিয়া সম্পর্কে সম্যখ অবগত।
আমার ও একই কাম্য মা বাবাকে জানিয়ে দিয়েছি
লেখাটা ভাল লাগল
আল্লাহ যেন আলম সাহেবের শেষের আশাটিও পূর্ণ করেন।
তারপরও আপনাকে আলম সাহেবের জায়াগায় দাড় করিয়ে পড়তে খুব গর্ব বোধ করছি -- ধন্যবাদ --
আপনার সাথে পরিচিত হতে পারলে ভাল লাগত ।
দুয়া রইলো আপনাদের দুজনের জন্য আল্লাহ তাআ'লা যেন আপনাদেরকে বেশি করে সুন্দর, মেধাবী, উম্মাহ'র লিডারশীপ দিতে সক্ষম এমন সন্তান দান করেন, আমীন
তবে: (লক্ষি বউ) বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না।
কেননা সম্ভবত এটা ইসলামী আকীদা বিরোধী। তবে কোন আলেমের নিকট থেকে জেনে নিলে ভাল হয়।
আল্লাহ যেন আলম সাহেবের শেষের আশাটিও পূর্ণ করেন।
আমরা কিভাবে সদস্য হতে পারি ?
মিষ্টি চাড়া শুভেচ্ছা নাই!
দোয়া রইলো আলম সাহেবের পরিবারের জন্য। আল্লাহ যেন ভালোবাসা আর ভাললাগায় পূর্ণতা দিয়ে দেন।
কপাল ক'জনার আছে
আর কিছুই বললাম না এখন
লোকে কি বলে পাছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন