ফ্রান্সে বাংলাদেশী কমিউনিটি কতটা শক্তিশালী
লিখেছেন লিখেছেন প্যারিস থেকে আমি ২৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০৯:৫৯:১৬ রাত
ফ্রান্স পৃথিবীর পরাশক্তিধর দেশ গুলির মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্হীতিশীলতায় এখনো ফ্রান্স অন্য যেকোন দেশের তুলনায় অনেকটা অগ্রগামী। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরনেও ফ্রান্স একটি অনুকরনীয় দেশ। মানুষের মানবাধিকার বলতে যা বুঝায় তার সবটুকুনই আপনি দেখতে পাবেন এই ফরাসী দেশে।তাইতো পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নির্যাতিত, নীপিড়িত, নিগৃহীত মানুষগুলো ছুটে আসে এই দেশে, আশ্রয় নেয় নিজের জীবনের, পায় নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা ।
বাংলাদেশ থেকেও মানুষ অহরহ আসছে এই মানবাধিকারের দেশে। একটা সময় ছিলো যখন বাংলাদেশীরা ফ্রান্সকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে চলে যেত অন্য দেশে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে।বলা হয়ে থাকে ৮০ র দশক থেকেই ফ্রান্সে বাংলাদেশীদের আগমন শুরু হয়।মুষ্টিমেয় মানুষ ফ্রান্সে থাকলেও বেশীর ভাগই চলে যান অন্য কোন দেশে।২০০০ সালের পর থেকে এখানে বাংলাদেশীদের অবস্হান শুরু হয় এবং তা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে।কত হাজার বাংলাদেশী এখন ফ্রান্সে আছেন তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারনা করা হয় ৪০ হাজারের অধিক বাংলাদেশী বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাস করছেন। আজ থেকে ৭/৮ বছর পূর্বে যার পরিসংখ্যান ছিলো মাত্র ১০ হাজারের কাছাকাছি। এই ৭/৮ বছরের ব্যবধানে এখানে বাংলাদেশী এত হারে বাড়ার অন্যতম কারন এখন আর বাংলাদেশীরা ফ্রান্সকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করেনা, বরঞ্চ ফ্রান্সকেই নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্য প্রথম পছন্দ হিসাবে বেচে নেয়।বাড়ছে বাংলাদেশী পরিবারও। যারাই রাজনৈতিক আশ্রয় বা অন্য কোন পন্হায় এদেশে থাকার বৈধতা পাচ্ছেন তারাই দেশ থেকে তাদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আসছেন ফ্রান্সে।এখানে বাংলাদেশীদের বৈধ হওয়ার অন্যতম পন্হা হলো রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা।বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা দেশের জন্য অমংগল জনক হলেও তা ফ্রান্সের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দেয়।শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশী বাংলাদেশী ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে বৈধ হয়েছেন এবং হচ্ছেন এবং সহজ প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে সকলেই তাদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আসছেন।এতে করে দিন দিন বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়ছে ফ্রান্সে।
এত বাংলাদেশী এখানে বসবাস করলেও বাংলাদেশীদের মধ্যে এখনো কোন শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে উঠেনি।সত্যিকার অর্থে একটি শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে তোলার জন্য কোন সমন্বিত উদ্যোগ আছে বলেও মনে হচ্ছেনা।জানিনা শক্তিশালী কমিউনিটি বলতে কি বুঝায়? যদি কয়েক হাজার মানুষের বসবাসকেই শক্তিশালী কমিউনিটি বলে তাহলে বলতে পারেন এখানে একটা শক্তিশালী কমিউনিটি আছে। আর যদি বলেন, না, শুধু কয়েক হাজার মানুষের বসবাসকে শক্তিশালী কমিউনিটি বলেনা, শক্তিশালী কমিউনিটি বলতে আরোও অনেক কিছুর সমষ্টিকে বুঝায় তাহলে আপনি নির্ধিদ্ধায় বলতে পারেন ফ্রান্সে বাংলাদেশীদের কোন শক্তিশালী কমিউনিটি নেই।শুধু এতটুকু পারেন যে ফ্রান্সে একটা বাংলাদেশী কমিউনিটি আছে।
এই কমিউনিটির প্রত্যেকেই আছেন যে যার মত করে। এখানে আছে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের শাখা। যদিও তাদের মধ্যে আছে আবার অনেক গুলো গ্রুপ।তারা তাদের দলীয় কর্মসুচীর বাইরে আর কোন কর্মসুচী নিতে পারেননা।সাধারন বাংলাদেশীদের জন্য কোন কর্মসূচী নিয়েছেন বলে এখনো দেখতে পাইনি। আর দলীয় কর্মসূচী পালন করতে গেলেও তাদের গ্রুপে গ্রুপে হামেশাই মারামারি লেগে যায়।যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচার থেকে বের হতে পারছেন না। এখানে আছে অনেকগুলো আঞ্চলিক সমিতি। তারা তাদের এলাকার মানুষ ছাড়া আর কিছু চিন্তাও করতে পারেনা,যেন অন্য এলাকার মানুষকে নিয়ে চিন্তা করাটাও নাজায়েজ।এসমস্ত আঞ্চলিক সমিতি আবার গড়ে উঠে একটা গোপন ও না বলা শপত নিয়ে। সেটা হলো এই যে, সমিতির প্রধান কাজ হলো নিজ এলাকার কেও যদি অন্য এলাকার কারো দ্ধারা কোন প্রকার আক্রান্ত হন তাহলে নিজ এলাকার মানুষকে সেল্টার দেয়া। এটা একটা ভালো কাজ হলেও অনেক সময় এই সেল্টার দেয়াকে কেন্দ্র করে অন্য এলাকার সাথে মারামারি বেঁধে যায়।এখানে আছে কিছু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। কেও কেও প্রতি বছর একটা মেলা বসিয়ে বাংলাদেশ থেকে কিছু নাম করা শিল্পী এনে কোন একটা পার্ক ঠিকই মাথিয়ে তোলেন। বাংলাদেশীদের কিছু বিনোদন দেয়া হলো আবার মঞ্চে উঠে গরম বক্তব্য দিয়ে নিজেকে কমিউনিটি ব্যক্তিক্ত হিসাবেও পরিচিতিটা হয়ে গেলো। অনেকে আবার সর্ব ইউরোপীয় নেতা হওয়ার জন্য ছুটে চলছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।জানিনা কি কাজ করছেন ইউরোপে বসবাসরত বাংলাদেশীদের জন্য বা কি তাদের কর্মসুচী। তাদের এই দৌড়ঝাপ যদি হয় মানুষের জন্য তাহলে আমার মত হাজারও সাধারন মানুষের জানার অধিকার আছে কি তাদের কর্মসূচী এবং তা ফ্রান্স থেকেই শুরু করা দরকার।সর্ব ইউরোপীয় কমিউনিটি গড়তে দৌড়াচ্ছেন ইউরোপের নানান দেশে অথচ আপনি যে দেশে বাস করছেন সে দেশে নেই একটা শক্তিশালী কমিউনিটি।
এখানে প্রতি বছর একটা মেলা, প্রতিবছর একটা খেলাধুলার টুর্নামেন্ট, প্রতি বছর কিছু ওয়াজ মাহফিল কিংবা রামাদ্বানে ইফতার মাহফিল, রাজনৈতিক কিছু কর্মসুচী ছাড়া আর কিছুই আপনার চোখে পড়বেনা।আর নিজকে জাহির করার জন্য পয়সার বিনিময়ে কিছু টিভি সাংবাধিকদের দিয়ে কমিউনিটির প্রোগ্রাম সাজিয়ে টিভি চ্যানেলে প্রচার করা যেন প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। কে কার চেয়ে বেশী নিজকে টিভিতে দেখাতে পারলেন এই যা।(এখানে গজিয়ে উঠা টিভি সাংবাধিকদের ব্যাপারে লিখবো অন্যদিন)অনেক সময় দেখা যায় অনেকের নামের পেছনে লকব দেয়া থাকে তিনি কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব।কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় তিনি কমিউনিটির জন্য কি করেছেন বা কমিউনিটিতে তার অবদান কি তাহলে উত্তর দিতে গিয়ে অনেকেই হিমশিম খাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।
এখানে নেই সকল বাংলাদেশীদের কোন প্লাটফর্ম।একজন বাংলাদেশী ফ্রান্সে আসার পর নানাবিধ সমস্যার মধ্যে পড়েন।তার এই সমস্যায় কোন সংস্হা বা সমিতি এগিয়ে আসেনা।তার নিজেকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হয়। অনেকেরই আত্বীয় স্বজন থাকায় সমস্যা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারলেও অনেকেই আবার হিমশিম খান।কে দেখবে তার এই সমস্যা ? এখানে এসে একজন বাংলাদেশী রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য প্রথমেই তার দরকার পড়ে একটা ডমিসিলের বা ঠিকানার।কিন্তু বাংলাদেশীদের এমন কোন সংস্হা নেই যা থেকে একটা ডমিসিল দিয়ে একজন ভাইকে সাহায্য করা যায়। এখানে নেই বাংলাদেশীদের দ্ধারা পরিচালিত ভাষা শিক্ষার কোন প্রতিষ্টান যা থেকে ফ্রি ভাষা শিক্ষা করা যায়।অথচ এটাও বাংলাদেশীদের জন্য বিরাট এক সমস্যা। এখানে নেই কর্ম সংস্হানের কোন ব্যবস্হা। অথচ অন্যান্য সকল কমিউনিটিতে এগুলো রয়েছে। আরোও অনেক সমস্যা রয়েছে আমাদের। কিন্তু এর সমাধান কে করবে? এ সমস্ত সমস্যা কাটিয়ে উঠে সম্ভাবনার দ্ধারকে উন্মোচন করতে প্রথমেই দরকার একটা প্লাটফর্মের । শুধুমাত্র দলীয় সংকির্ণতার কারনেই এখানে কোন প্লাটফর্ম হচ্ছেনা বা কেও উদ্যোগ নিচ্ছেন না।
বিশ্বাস করেন আমি কাওকে ছোট করার জন্যে লিখছিনা। এখানে অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ আছেন যারা এই কমিউনিটিকে অনেক দুর নিয়ে যেতে পারেন।যদি তারা দলীয় ও মানসিক সংকির্ণতার উর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র মানুষের কল্যানে কাজ করতে পারেন।যদি তারা সকল বাংলাদেশীদের এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে পারেন, শামিল করতে পারেন এক মোহনায়।
বিষয়: বিবিধ
২২১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন