নারী অধিকার: শুধু অঙ্গীকার নয়,কার্যকর পদক্ষেপ কাম্য
লিখেছেন লিখেছেন বাক্সবন্দী বিবেক ০৯ মার্চ, ২০১৩, ০১:২৮:৪০ দুপুর
মানব সভ্যতার শুরু থেকে মূলত পুরুষ দ্বারা সমাজ শাসিত হয়ে আসছে। আর পুরুষ শাসিত এ সমাজে নারীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার। তারা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে সমাজের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে।বঞ্চনাহীন সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীদের দীর্ঘদিনের লড়াই সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে আজ সমাজ তাদের অধিকার নিয়ে ভাবছে। তার পরও তারা এখনো তাদের
ন্যায্য অধিকার পাননি।
১৯০২ সালে নেদারল্যান্ডসের হেগে নারীর বিবাহ,বিবাহ বিচ্ছেদ,অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে ধারাবাহিক সম্মেলন ও ১৯০৭ সালে স্টুটগার্ডে সমাজতান্ত্রিক নারীদের সম্মেলনের মাধ্যমে নারী নেত্রী ক্লারা জেৎকিন কর্তৃক ০৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের আহবান এবং ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেন হেগেনে আবারও বিষয়টি উত্থাপনের মাধ্যমে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এক ধাপ এগিয়ে যায়।
বিশ্বের সচেতন নারী সমাজের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিশ্বব্যাপী নারীর পশ্চাদপদতা ও বৈষম্য নিরসনের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ ১৯৪৬ সালে কমিশন অন দি স্টেট অব ওমেন নামে একটি কমিশন প্রতিষ্ঠা করে। এ কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নারীর তৎকালীন আর্থসামাজিক অবস্থা সমন্ধে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রণয়ন করা।পরবর্তীতে নারীর মর্যাদা কমিশনের কার্যক্রম ও সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ০৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। যা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
নারীর বিরুদ্ধে চলমান বৈষম্যের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৬৭ সালের ৭ নভেম্বর নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ ঘোষনা পত্র গ্রহণ করে। অতঃপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য বিলোপকারী আন্তর্জাতিক কনভেনশন গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালের ১ মার্চ থেকে উক্ত সনদে স্বাক্ষর প্রদান শুরু হয় এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক রাষ্ট্র কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ০৩ সেপ্টেম্বর থেকে কনভেনশনটি কার্যকর হয়।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ০৬ নভেম্বর খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে ২, ১৩ (ক)এবং ১৬ (১)(গ)ও (চ)ধারা রিজার্ভ রেখে এই সনদে স্বাক্ষর করেন। যদিও পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে গঠিত কমিটির সুপারিশক্রমে ১৯৯৭ সালের ২৪ শে জুলাই বাংলাদেশ সরকার উক্ত সনদের ১৩ (ক)এবং ১৬ (১)(চ)ধারা থেকে রিজার্ভেশন প্রত্যাহার করে নেন।
সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীরা যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে সেই ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান এবং অর্থনৈতিক,সামাজিক,সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী আইন প্রণয়ন,সংস্কার করতে পক্ষ রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করা সিডও সনদের মর্মবাণী।পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর সমতা বিধান,ন্যায় পরায়ণতা ও ক্ষমতায়ন করার লক্ষ্যে একটি দিক নির্দেশনা প্রণয়নও এ সনদের একটি অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ইহা নারীর মুক্তির সনদ।তাই একে নারীর বিল অব রাইটস বলা হয়ে থাকে।
সিডও সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রসমূহকে দুই বছরের মধ্যে নারীর বর্তমান অবস্থা,নারী উন্নয়নে চিহ্নিত বাঁধাসমূহ সম্পর্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রিপোর্ট পেশ করতে হয় এবং চার বছর পর আবার অগ্রগতি জানিয়ে রিপোর্ট পেশ করতে হয়।
৩০টি ধারা সম্বলিত সিডও সনদের ধারা ১-৬ এ নারী ও পুরুষের বৈষম্যের ব্যাখ্যা,রাষ্ট্রসমূহের সংবিধান ও প্রচলিত আইনসমূহে নারী-পুরুষের সমতার নীতি অনুসরন,নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করন,নারী পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাময়িক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রথার ইতিবাচক পরিবর্তন এবং নারী পাচার রোধে রাষ্ট্র কর্তৃক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
আবার ৭-৯ ধারায় রাজনৈতিক অঙ্গীকারসমূহ যথা: রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে জীবনে নারীর সমান অংশগ্রহনের ব্যবস্থা,আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারীর সমান অংশগ্রহনের ব্যবস্থা এবং নারী ও তার সন্তানের জাতীয়তা নির্ধারণ সংক্রান্ত অধিকারসমূহ বর্ণিত হয়েছে।
এ সনদের ১০-১৪ ধারায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারসমূহ যথা: শিক্ষা,কর্ম,স্বাস্থ্যসেবা, পরিবারপরিকল্পনা,অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে।
এ ছাড়া,১৫ ও ১৬ ধারায় নারীর সামাজিক ও পারিবারিক যথা: রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও পরিবার গঠনে নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং অবশিষ্ট ধারাসমূহে এ সনদে বর্ণিত অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদ স্বাক্ষর ও অনুমোদন করার পরবর্তী সময়ে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নসহ নারী উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশ-১৯৭৩ সংশোধন করে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে তিন জন নারী সদস্য সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাছাড়া,উপজেলা পরিষদে একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সরাসরি নির্বাচনের ব্যাবস্থা করেছে।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহন বৃদ্ধি ও উৎসাহ প্রদান করতে প্রতিটি সরকারী,আধাসরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে নারীর জন্য কোঠা নির্ধারিত করেছে। মাতৃত্বকালীন সময়ে পূর্ণ বেতনসহ ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া কন্যা শিশুকে স্নাতক শ্রেণী পর্যন্ত বিনা বেতনে অধ্যয়নের সূযোগ প্রদানসহ তাদের উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে আসছে। সর্বোপরি পাঠ্যক্রমে নারী আধিকার বিষয়ক আইন অন্তর্ভূক্ত করে নারীর প্রতি পজেটিভ মনোভাব গঠনে সচেষ্ট রয়েছে।
নারী নির্যাতন,তালাক,যৌতুক দাবী,এসিড নিক্ষেপ,ধর্ষণ,বাল্য বিবাহ,পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা, পাচার,রাস্তা ঘাটে উত্তক্ত করা,অভিভাবকত্ব,কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও বৈষম্য করা ইত্যাদি প্রতিরোধে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম করাসহ বিশেষ আইন প্রণয়ন করেছে এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে পর্যবেক্ষন ব্যবস্থা চালু করেছে। এ ছাড়া,বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের মাধ্যমে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান এবং অপরাধীর নিকট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে তা ভিকটিমকে প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তাছাড়া,সন্তানের নাগরিকত্ব নির্ধারনের ক্ষেত্রে মায়ের নাগরিক পরিচয়ে সন্তান তার নাগরিকত্ব লাভ করবে বলে আইন প্রণয়ন করেছে।
বাংলাদেশ সরকার সিডও সনদ বাস্তবায়ন তথা নারী উন্নয়নে আইন প্রণয়নসহ বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা শুধু কাগজে কলমে থেকে গেছে। বাস্তবে তার প্রতিফলন আমরা খুব কমই দেখতে পাই। আইনে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ থাকলে ও বাস্তবে আমরা দেখতে পাই দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারের গোচরেই বেশ কিছু পতিতালয় রয়ে গেছে। আইন অনুযায়ী পতিতাদের সরকাররে পূনর্বাসন করার কথা। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে উদাসীন ভূমিকা পালন করছে।
নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ,খুন,অপহরণ,পাচার,এসিড নিক্ষেপ,ফতোয়াবাজি,প্রতারণা,লাঞ্ছনা ইত্যাদি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনে বাংলাদেশ সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ ব্যপারে দেশে বেশ কিছু আইন প্রণীত হলেও সেসব আইন বাস্তবায়ন খুবই দূর্বল ও অকার্যকর। ফলে দিনে দিনে নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ,খুন,অপহরণ,পাচার,এসিড নিক্ষেপ,ফতোয়াবাজি,প্রতারণা,লাঞ্ছনা ইত্যাদি বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি,মাতৃত্বকালীন ছুটি,দিবা যত্নকেন্দ্র, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিতকরণের কথা বলা থাকলেও নারী শ্রমিকরা ন্যূনতম মানসম্পন্ন কর্মপরিবেশ পায়না। বরং কর্মক্ষেত্র তারা অহরহ ধর্ষণসহ নানাবিধ যৌন হয়রানির শিকার হয়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যায়। বিচার চাইতে গেলে চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। এমন কি শিক্ষা ক্ষেত্রেও নারীরা শিক্ষক ও সহপাঠী কর্তৃক বিভিন্নভাবে ধর্ষন ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে।
তাছাড়া, তথ্য প্রযুক্তর উন্নয়ন, যোগাযোগের নতুন নতুন সরঞ্জাম আবিষ্কারের ফলে নতুন নতুন রূপে নারী নির্যাতন সংঘটিত হওয়ায় এবং দেশে প্রচলিত আইনের কার্যকর প্রয়োগের অভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ না হয়ে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে নারীরা সর্বদা বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। একজন মা দশ মাস গর্ভে ধারণ করে প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করে একজন সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মায়া মমতা দিয়ে লালন পালন করে তাকে বড় করে তোলে। কিন্তু অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে উক্ত মা তার অভিভাবক হন না,অভিভাবক হন তার বাবা। আবার উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষ সমান অংশ লাভ করেন না। একই মা-বাবার সন্তান হওয়া সত্বেও এক জন ছেলে এক জন মেয়ের চেয়ে দ্বিগুন সম্পত্তি পায়। সিডও সনদ অনুযায়ী পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ সবক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেও বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে এখনো নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করে চলেছে।
নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশকে অনেক পথ পারি দিতে হবে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার শুধু অঙ্গীকার করলেই শুধু চলবে না। শুধু সভা সমাবেশে বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে তা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সরকারকে তা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক হতে হবে। এ জন্য সিডও সনদের সাথে সংগতি রেখে বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ সহ নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। আবার,শুধু আইন প্রণয়ন করে বসে থাকলে চলবে না, তার কার্যকর প্রয়োগের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং সকল ক্ষেত্রে তা কঠোরভাবে পালন করতে হবে। একই সাথে সমাজের সকল স্তরে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহনের মাধ্যমে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের মনোভাব গঠন করতে হবে। তবেই নারী তার পূর্ন অধিকার ভোগ করতে পারবে এবং সমাজে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিষয়: বিবিধ
১০৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন