জীবন জুড়ে হরতাল
লিখেছেন লিখেছেন মুক্ত আকাশ ১২ মার্চ, ২০১৩, ১০:১৭:২১ রাত
ছোটবেলায় হরতাল জিনিসটাই ছিল মহা আনন্দের। হরতাল শব্দটা শুনলে বুকের ভেতরে একটা তিরতিরে মিষ্টি অনুভুতি ছড়িয়ে পরতো। হরতাল মানে ছুটি। হরতাল মানে স্কুলে যাওয়া নেই, কান ধরে উঠ বস করা নেই। নেই পিটি স্যারের সপাং সপাং বেতের বাড়ি। আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! কি কারনে হরতাল, তাতে কার লাভ কার ক্ষতি- সে ভাবতে বয়েই যেত।
থাকতাম মুল শহর থেকে মাইল খানেক দূরে, মফস্বলে। সেখানে হরতালের তেমন কোন উত্তাপ ছিলনা। তবে শহরে এলে রোমাঞ্চকর অনুভুতি হত মাঝে মাঝে। একদিক থেকে শুনতাম স্লোগান দিতে দিতে মিছিল আসছে “দোকান পাট খুলবেনা, গাড়ির চাকা ঘুরবেনা, হরতাল হরতাল”। তারপর হঠাতই পটকার শব্দ, পুলিশের লাঠি হাতে দৌড়াদৌড়ি। যে দুয়েকটা দোকান খোলা থাকতো, ঝুপঝাপ তার সাটার নেমে যেত। কেউ ছাগল নিয়ে কেঊ সাইকেল নিয়ে সুড়সুড় করে ঢুকে যেত দোকানের ভিতরে। বাইরে সাটার বন্ধ, ভিতরে মানুষের ফিসফাস আওয়াজ। তার সাথে ছাগলের ব্যা ব্যা শব্দ। কেমন অন্য রকম উত্তেজনা, থ্রিলিং!
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরিক্ষার আগে “হরতাল” ভালই ভুগিয়েছিল। তখন চোখ বন্ধ করে মুখস্থ করতে হত বাংলা ভাষায় আসা বিদেশী শব্দ কোনটা কোন ভাষার। কিন্তু কিছুতেই মনে রাখতে পারতামনা, হরতাল শব্দটা কি তামিল, গুজরাটি নাকি তুর্কি। MCQ পদ্ধতির পরীক্ষা। তাতে option থাকে চারটি। স্বভাবতই খালি প্যাচ লেগে যেত।
বিশব্বিদ্যালয় জীবনে হরতালের অনুভুতি ছিল মিশ্র। একদিকে ছোটবেলার মত সেই ছুটির আনন্দ। হরতাল মানে ক্লাস নেই, পরীক্ষা নেই। আমাদের মত ফাকিবাজদের এইতো চাই। অন্যদিকে হরতালে দেশের ক্ষতি, দশের ক্ষতি-নিজেকে ভাবিয়ে তুলতো। খালি ভাবতাম “এভাবে আর কতকাল?”
কর্মজীবনে এসে অনুভুতি আরেক রকম। হরতাল মানে কর্মস্থলে নিরাপদে পৌছানোর শংকা। হরতাল মানে যানজটমুক্ত ঢাকা, একটানে অল্প সময়ে আরামে ঘোরাফেরা। যে পথ পাড়ি দিতে অন্য দিন লাগে দেড় দু ঘন্টা, হরতালে অনায়াসেই সে পথ পৌছে যাই ১৫-২০ মিনিটে।
বাসায় ফিরে টিভির সামনে বসলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। পিকেটাররা কোথাও ভেংগে দিয়েছে বাস, কোথাও জ্বালিয়ে দিয়েছে দরিদ্র মানুষের এক মাত্র অবলম্বন “সিএনজি অটোরিক্সা”। কোথাও লাঠির আঘাতে নিরীহ রিকশাচালক, সিএনজিচালকের কপাল বেয়ে দরদর করে ঝরে পড়ছে রক্ত, ঘামের মত। কখনো টিভির স্ক্রিনে দেখা যায় আহত পুলিশের করুন মুখ, হাসপাতালের বেডে নির্বাক শুয়ে। পাশে বসে অসহায় চোখে মমতাময়ী স্ত্রী হাত বোলাচ্ছে মাথায়। আবার কখনো পুলিশের গুলিতে নিষ্প্রান দেহ পড়ে আছে পথের পাশে। ফিনকি দিয়ে আসা ছলাত ছলাত রক্তের স্রোত ঢেঊ খেলে যায় পিচ ঢালা পথে। আহ!
মাথায় খেলে যায় সেই পুরোনো প্রশ্ন “এভাবে আর কতকাল?”। আর কতকাল এভাবে রক্ত ঝরবে? আর কতকাল হিংস্র শ্বাপদের মত আমরা ঝাপিয়ে পড়বো একে অন্যের উপর? সে রিকশাচালক, সিএনজি দ্রাইভার, বাসের মালিক, পুলিশ, পিকেটার- সবাইতো এদেশেরই মানুষ। ক্ষমতার পালাবদলের খেলায় একের প্রতি অন্যের কী নির্মম আক্রোশ! ক্ষমতা বদলায়, বদলায় টিভির স্ক্রীনে হাস্যোজ্জল মুখের ছবি। শুধু বদলায়না এ সব মানুষের ভাগ্য, বদলায় না চিরচেনা এসব চালচিত্র।
এ যেন আমাদের নিয়তি। ক্ষমতার পালাবদলে এভাবে সাধারন মানুষ মার খাবে, মরবে। এ থেকে কোন নিস্তার নেই, নেই পরিত্রান। মনে পড়ে দাউদ হায়দারের কবিতার লাইন “জন্মই আমার আজন্মের পাপ”
মনের ভেতর প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় বারেবার। এভাবে আর কতকাল? তবে কি এদেশে “জন্মই আমার আজন্মের পাপ”?
বিষয়: বিবিধ
১২৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন