মিডিয়ার তেলেসমাতিঃ পর্ব-১

লিখেছেন লিখেছেন মুক্ত আকাশ ০৮ মার্চ, ২০১৩, ১১:০০:২০ রাত

বছর দুয়েক আগে হুট করেই মাথায় ঝোক চাপল সাংবাদিক হব। ছোটবেলা থেকে লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিল। তখন জেগ জেগে স্বপ্ন দেখতাম, একদিন অনেক বড় লেখক হব। টুকটাক লেখালেখিও চলছিল এক সময়। আস্তে আস্তে সে ইচ্ছে মরে আসে সময়ের সাথে সাথে। তবে লেখালেখির সেই ভুত থেকে সাংবাদিকতার দিকে ঝোকটা বাড়ে।তাছাড়া টিভি চ্যানেল বাড়ছিল দিনকে দিন ব্যাংযের ছাতার মত।বন্ধু বান্ধবদের অনেককেই দেখি হাস্যোজ্জল মুখে ক্যামেরার সামনে।

এক সময় ভর্তিও হয়ে গেলাম একটা সাংবাদিকতা প্রশিক্ষন কোর্সে। কোর্সের শুরুতে ভাইভা হয়েছিল। মৌখিক।আমি বরাবরই মৌখিক ভাইভাতে দুর্বল।তবে, কেমন করে জানি সে ভাইভাতে প্রথম হয়ে ছিলাম।কোর্স শেষের পরিক্ষাতেও তাই।সহপাঠি শাওকি হাসতো “আপনি ভাই একটা বোরিং মানুষ।আমরা সবাই কী দারুন অবস্থান পাল্টালাম। আর আপনি সে এক জায়গায় আটকে গেলেন।“

শেষমেষ অবশ্য সাংবাদিক আর হতে পারলামনা।আত্মীয় স্বজনরা ভয় দেখিয়েছিলেন “ব্যাটা দুদিন পরে না খেয়ে মরতে হবে”।খাওয়া দাওয়ার প্রতি আগ্রহ ব্যাপক ছিল।তাই ঝটপট পেশা বদলাতে হল। পেশা আমার যাই হোকনা কেন, কোর্স করতে গিয়ে মিডিয়ার অনেক কিছু জানা হল।নাড়ি নক্ষত্র আর হাড়ির খবর-সবই।

মিডিয়া অনেক শক্তিশালি মাধ্যম।মানুষের মন মগজ চিন্তা চেতনা এমন কি আবেগ অনুভুতিও নিয়ন্ত্রন করে মিডিয়া। বেচারা পাঠক দর্শক অনেক সময় বুঝতেও পারেন না তিনি মিডিয়ার দাসে পরিনত হয়েছেন। মিডিয়ার সুতোর টানে মানুষ কলের পুতুলের মত হাসে, নাচে, কাদে।

কথাগুলো একটু রুড় শোনাচ্ছে?আসুন দেখে নেই মিডিয়ার কিছু তেলেসমাতি।

জনতা/ক্যাডার

ধরুন কোন জায়গায় দু পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। হতে পারে দুটো ছাত্র সংগঠনের মধ্যে কিংবা দু দল গ্রামবাসীর মধ্যে।বিপরীত মেরুর দুটো পত্রিকা হাতে নিন, কিংবা দুটো চ্যানেলে চোখ রাখুন। এক পক্ষের মিডিয়া প্রচার করবে “অমুক দলের ক্যডারদের সাথে জনতার সংঘর্ষ,ধাওয়া পালটা ধাওয়া”। “ক্যাডার” শব্দ শুনলে মনে হয় অস্ত্রধারি সন্ত্রাসী।আর জনতা শুনলে মনে হয় কোন নির্দিষ্ট দলের নয়, বরং সাধারন কিছু মানুষের সমষ্টি। ক্যাডার শুনলেই আপনি ক্যাডারদের উপর ক্ষেপে যাবেন, সমালোচনামুখর হয়ে উঠবেন। কিন্তু জনতা শব্দটি আপনাকে উত্তেজিত করেনা,স্বাভাবিক রাখে।ক্যাডারদের কাজ আপনার কাছে জঘন্য, নিন্দনীয় মনে হয়। কিন্তু জনতার কাজ আপনার কছে খারাপ মনে হয়না মোটেও।

একটা উদাহরন দেই। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত আওয়ামীলীগ সংঘর্ষ, বিরোধের খবরে গোটা দেশ সরগরম। কিছুদিন আগে জামায়াত্যের ডাকা হরতালের আগের রাতে বাসে আগুন দেয়া হয়। এতে একজন পুড়ে মারা যায়। জামায়াত বিরোধি মিডিয়া সেটিকে নিয়ে অনেক মানবিক রিপোর্ট করে।পক্ষান্তরে জামায়াত ঘরানার মিডিয়াগুলো এটাকে অনেকটা গুরুত্বহীনভাবে প্রচার করে।

আবার টাঙ্গাইলে জামায়াতের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন একটা দোকানে আগুন দেয়া হয়। এতে আগুনে পুড়ে মারা যান একজন।জামায়াত বিরোধী এক পত্রিকায় রিপোর্ট ছাপা হয় “টাংগাইলে জামায়াতের মালিকানাধিন দোকানে জনতার আগুন, নিহত এক”। আবার জামায়াত ঘরানার মিডিয়াগুলোতে আসে “আওয়ামী ক্যাডারদের হামলা, আগুনে পুড়ে মারা গেছে একজন।“

পাঠক খেয়াল করুন। দুটো ঘটনাই কিন্তু অত্যন্ত মর্মান্তিক, নৃশংস, হৃদয়বিদারক। আগুনে পুড়ে নিরীহ মানুষের এমন মৃত্যু যে কোন মানুষের মন মনন বোধ বুদ্ধিকে আহত করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু অবস্থা ভেদে পাঠকের, দর্শকের অনুভুতি হয়েছে দু রকম। একই ঘটনায় আক্রমনকারীরা কোন মিডিয়ার চোখে “জনতা” আবার কোন মিডিয়ার চোখে “ক্যাডার”।

তান্ডব/বিক্ষুদ্ধ জনতাঃ

আরো দুটো উল্লেখযোগ্য শব্দ হল “তান্ডব” ও “বিক্ষুদ্ধ জনতা”। ধরুন, দু পক্ষের মাঝে সংঘর্ষ হল। তার জের ধরে এক পক্ষ অন্য পক্ষের বাড়িতে হামলা চালালো, আগুনে পুড়িয়ে দিল সব।একই ঘটনা, কিন্তু দু পক্ষের মিডিয়া রিপোর্ট করবে দুভাবে। যেমন এক পুক্ষের রিপোর্ট হবে এ রকম “অমুক জেলায় অমুক দলের ক্যাডার বাহিনীর তান্ডব, গাড়ি ভাঙচুর, ২০ টি বাড়ি আগুনে ভস্মিভুত”। আবার সে একই বিষয়ে ভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্ট হবে এমন “অমুক জেলায় বিক্ষুদ্ধ জনগন সড়ক অবরোধ করেছে, গুড়িয়ে দিয়েছে অন্তত ২০ টি বাড়ি”

আপনি যখন পড়বেন বা শুনবেন “তান্ডব” তখন আপনার অনুভুতি কেমন হবে?আপনি নিশ্চয়ই ক্ষভে ফেটে পড়বেন। কিন্তু যখন শুনবেন “বিক্ষুদ্ধ জনতা” খেয়াল করবেন আপনার কাছে খুব একটা খারাপ লাগবেনা। অথচ গোটা বিষয়টাই কিন্তু অন্যায়, নিন্দনীয় এবং মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়।

মিডিয়ার ছবি

হরতালে কিংবা বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের সাথে হরহামেশাই বিভিন্ন দল বা গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে বিক্ষোভকারিরাও যেমন আহত হয়, তেমনি পুলিশ ও হয় রক্তাক্ত। মিডিয়ার এ ক্ষেত্রে ভুমিকা কি? বিক্ষোভাকারিদের পক্ষের পত্রিকা বা চ্যানেলে দেখবেন অসংখ্য রক্তাক্ত ছবি।কারো মাথা ফাটা, কারো সারা শরীরে রক্ত ঝরছে। আবার কাউকে পুলিশের লোকজন পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে বিরোধী মিডিয়ার ছবি দেখবেন ভিন্ন। “বিস্ফোরিত বা অবিস্ফোরিত ককটেল” “রাস্ত জুড়ে ভাঙ্গা ইট পাটকেল” “আহত পুলিশ সদস্যের ছবি”তে ভরে যাবে পত্রিকার পাতা, চ্যানেলের রিপোর্ট।

এ ভাবেই মিডিয়াগুলো আমাদের আবেগ অনুভুতিকে নিয়ন্ত্রন করে।

(চলবে)

বিষয়: বিবিধ

১৬৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File