শোক, শোকাহত এবং তদন্তের রাজনীতি
লিখেছেন লিখেছেন অনুক্ত ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৪৫:১৬ দুপুর
আপনি নিশ্চয় ফুলের গন্ধ পেয়েছেন, গন্ধ পেয়েছেন দামি পারফিউমের। হয়তো রেস্টুরেন্টে বসে দামি খাবারের ঘ্রাণে আপনার নাকে সুড়সুড়ি জেগেছে। কিন্তু আপনি কি কখনো মানুষের পচাঁ লাশের গন্ধ পেয়েছেন? গরীবের ঘাড়ে পারা দিয়ে তো গাড়ি বাড়ি ও নারীর ঘ্রাণ ঠিকই নিচেছন, যান না একবার সেই গরীব মানুষ গুলোকে দেখতে যারা রানা প্লাজার নিচে চাপা পড়ে কেমন নির্বাক চেয়ে আছে। হ্যাঁ আমি সাভার রানা পস্নাজার নিচে চাপা পড়া , নিলুফা, রেশমা, নুরেছা , আসমা, হাবিল , কাশিমসহ নাম না জানা গরীবদের কথা বলছি। যাদের হ্রদয়ে কোণে একটা ছোট্ট স্বপ্ন ছিল স্বামী ও সমত্মান নিয়ে দুবেলা ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার। তাদের স্বপব ছিল না আমার , আপনার মত গাড়ি, বাড়ি, নারী ও কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স করার। যেই স্বপ্ন গুলো বাসত্মবায়ন করতে আমরা প্রতিদিন গরীবের জীবন নিয়ে খেলা করি।
গত ২৭ বছরে আমাদের এই খেলায় ৭ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে । যার উলেস্নখ্য যোগ্য কিছু তথ্য তুলে ধরা হল:
১৯৯০ সালে মিরপুরে সারাকা গার্মেন্টস অগ্নিকান্ডে নিহত ৩২ জন, ২০০৪ সালে অগ্নিকান্ডে ও পদদলিত হয়ে ৭৩ জন, ২০০৫ সালে বাইপাইলে স্পেকট্রামে ভবনধসে নিহত ৬৪ জন এবং তেজগাঁ ফিনিক্স ভবন ধসে নিহত ২৭ জন, ২০১০ সালে হামীম গ্রম্নপে অগ্নিকান্ডে নিহত ২৯ জন, ২০১২ সালে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টস ১২৪ জন আর ২০১৩ সালে ৩৫০ ( এটা লেখা পর্যমত্ম) সূত্র দৈনিক ইত্তেফাক ২৫.৪.১৩ । এসব তথ্য সরকারী হিসাব মতে , তবে সাধারণ জনগণ মনে করেন, এই সংখ্যাটা আরো অনেক বেশী। এই প্রতিটি ঘটনায় আমরা শুনেছি প্রধানমন্ত্রি, রাষ্টপ্রতি ও বিরোধী দলীয় নেত্রীদের শোক ও সমবেদনার বানী। একটি শোক ও সমবেদনার বানী কি পারবে আব্দুলস্নাহ নামের ঐ ছোট্ট ছেলেটির মায়ের অভাব পূরণ করতে। যে মা রানা পস্নাজায় সারারাত কাজ করে এসে তার মুখে চুমো খেত, শোক বানী কি পারবে বৃদ্ধ পিতামাতার আয়ের একমাত্র উৎস তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে,শোক ও সমবেদনার বাণী কি পারবে আমার বিধমা বোনের মুখে হাসি ফুটাতে। জানি তা কখনো পারবে না কেননা শোক বানীর মধ্যে কোন বাসত্মব শোক নেই আছে মিথ্যা শামত্মনার বানী আর রাজনৈতিক কেীশল। তা না হলে দোষীদের খুজে বের করার পরির্বতে কিভাবে একজন মন্ত্রি বলে এটা মেীলবাদীরা পিলার নাড়াচাড়া করে ভেঙ্গেছে। হায়রে দেশ , হায়রে গনতন্ত্র, হায় রক্তচোষা রাজনীতিবিদ। আমরা কবে পাবো ওমর(রাঃ) মত শাসক নাকি পাব না কোন দিন?
শোকের বানী প্রচার হলো ঘোষনা হলো শোক দিবস। আমরা জামায় লাগালাম কালো কাপড় । এই লোক দেখানো নীতিটা কোথা থেকে আমদানি করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় এত বড় দুর্ঘটনার পরও আমত্মরিক ভাবে আমরা শোকাহত নই। কারণ অমত্মর বা বিবেক নামের জিনিটি আমাদের দেহের ভিতর আর জীবিত নেই সে মারা গিয়েছে লোভ আর লালসায় চাপা পড়ে। সাভারের রানা পস্নাজার ধ্বংস স্ত্তপ দেখার জন্য আমি গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক ভাবে হেমায়েতপুর থেকে সাভার ৫ টা গাড়ী ভাড়া কিন্তু বাসের কনেট্রকটার ১০ টাকা করে নিচ্ছে। আমার সফর সঙ্গী গাড়িতে উঠে বললেন ভাড়া ৫ টাকা তুমি ১০ টাকা নিচ্ছে কে ? হায়রে দেশ কারও ঘর পুড়ে আবার কেউ ঐ আগুনে আলু পুড়ে। শোকের এই দিনটিতে কোন গাড়ির মালিক তার একটা গাড়ি ফ্রী করে দেয়নি গরিব মানুষদের লাশের সন্ধান করতে আসা ঐ দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য। কোন রাজনৈতিক দলও এই কাজটি করেনি। অথচ দলিয় সভা/সমাবেশে ফ্রী গাড়ীর অভাব থাকে না। আমরা শোকাহত এই কথাটি লিখে কত যে ব্যানার, ফেস্টুন ও বিজ্ঞাপণ দেয় বিভিন্ন নামি দামী প্রতিষ্ঠান। তার কোন হিসাব নেই। লক্ষ লক্ষ টাকা নষ্ট হচ্ছে এই লোক দেখানো রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে গিয়ে। অথচ একটি প্রতিষ্ঠান যদি ঐ টাকা একটি আহত/ নিহত পরিবারকে সহযোগীতা করত তাহলে একটি পরিবারের কিছুটা দু:খ লাঘব হত। কিন্তু এসব কাজ আমরা করিনা এজন্য যে, হাসিনা/খালেদা’র ভালোবাসা পেতেই আমরা বেশি ব্যসত্ম, সৃষ্টিকর্তার নয়। জাতির জাগ্রত বিকেব ও দর্পন বলি যে সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমকে তারাও অনেক সময় বলি হয়ে যায় এই প্রভুদের খুশি করতে।
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, পিলখানা, নিমতলি, মিরশরায়, সাগর-রম্ননি ও তাজরীন ফ্যাশন সহ সব ঘটনায় তৈরী হয় তদমত্ম কমিটি। অপরাধীদের ধরতে আল্টিমেটাম দেয় ৪৮ ঘন্টার, ৪০ ফিট নিচ থেকে আসামী ধরা সহ চমৎকার আশাবাদী বক্তব্য শুনে আমরা জনগণ সবসময় আশায় বুক বাধি। কিন্তু সব আশা তাসের ঘরের মত ভেঙে যায়। ঘন্টা, দিন, মাস এরপর সব স্বাভাবিক। জনগণ জানে না কোন তদমত্ম রিপোটের ফলাফল। তদমত্ম কমিটিতে যাদের নাম আওতাভুক্ত করা হয় তারা বেশ কয়েকদিন তাদের চেহারা মিডিয়ার মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজনদের সহ দেশ-বিদেশর মানুষকে দেখাতে পেরে পুলকিত হন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করেন না। টাকা নামক জিনিসটিকে বাপ ডাকতে ডাকতে নিজের বিবেককে বিক্রি করেছেন কোন ক্ষমতারধর ব্যক্তির কাছে ? তাজরীন ফ্যাশনের ঘটনার পর সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর নিরাপত্তা পরীক্ষা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা জনাব মাইন উদ্দিন খন্দকার ঐ কমিটির একজন সদস্য। গত ২৫ এপ্রিল বিবিসির সাংবাদিক উনাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনারা কতটি ফ্যাক্টরী ভিজিট করেছেন? জবাবে তিনি বললেন ৫-৭টি । যেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার ফ্যাক্টরী রয়েছে সেখানে উনারা ৫-৭ টি পরির্দশন করে থেমে গেলেন কেন জাতি তা জানতে চায়? তিনি বলেছেন আমরা রানা পস্নাজা পরীক্ষা করিনি । তবে কি আমরা বলতে পারি না রানা পস্নাজা ধসে পড়ার পেছনে ঐ কমিটিও দায়ী। এসব লোক দেখানো দতমত্ম কমিটির কোন দরকার আছে বলে সাধারণ জনগন মনে করে না। আমরা গরীবরা বিত্তশালীদের জন্য পরিশ্রম করবো ,ঘাম জড়াবো আর প্রয়োজনে মরব । আমাদের মূল্য তো মাত্র ২০০০০/= টাকা। বিত্তশালীদের সুখের জন্য মরায় যে আমাদের কর্তব্য জনাব।
রানা প্লাজার ধংসস্ত্তপের নিচে চাপা পড়া একটা মেয়ের পায়ের ছবি ছেপেছিল একটি পত্রিকা। সেখানে লেখা ছিল মেয়েটি কার দিকে তাক করে রেখেছে তার পা ? আমি মনে করি এই পা দিয়ে মেয়েটি লাথি মারছে আমাকে ,আপনাকে ? লাথি মারছে ঐ ভবন মালিক রানাকে যে, জোর করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কাজে পাঠিয়েছিল, মৃত বোনটি লাথি মারছে ঐ সব মালিকদের যারা গরীবের রক্তচোষে ফ্যাক্টরীর মালিক হয়েছে, লাথি মারছে ঐ প্রকৌশলীকে ও রাজউক কর্মকর্তাদের যারা টাকার কাছে বিক্রি করেছেন নিজেদের মনুষতববোধ। ঐ পা তাক করে আছে ক্ষমতাসীন প্রতিটি ব্যক্তির দিকে যারা ব্যর্থ হয়েছে সীমামেত্ম ফেলানীর ইজ্জত ও জীবন বাঁচাতে। পাঠক ঐ পা সম্পর্কে অধ্যাপক আলী রিয়াজ লিখেছেন,
তোমার কঙ্কনের ধ্বনি বেজেছে মায়ের আঙ্গিনায়,
তোমার সংসারে
তোমার উধ্বমুখী হাত উঠেছে প্রার্থনায়
সে গতকাল ছিলো
......................
আগামীকাল তোমার কঙ্কনের ধ্বনি বাজবেনা আঙ্গিনায়
তোমার সংসারে
এখন তোমার পা উদ্ধত বাংলাদেশের দিকে।
বোন ক্ষমা করো আমায়, ক্ষমা করো আমাদের, আমরা পারিনি তোমার স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিতে।
আসুন শোক,শোকাহত আর তদমেত্মর রাজনীতি বাদ দিয়ে এগিয়ে যাই নীতির পথে ও মানুয়ের কল্যাণের পথে আর জীবন সাজাই পরকালের জন্য।
বিষয়: বিবিধ
২৭০৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন