হে আল্লাহ ! আমাদের শান্তিময় এই সিলেট মহানগরীকে যারা অশান্তির বিষে নীল করেছে, তাঁদেরকে তুমি ক্ষমা করিও না।

লিখেছেন লিখেছেন হিফজুর রহমান ০১ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৪৪:৩৩ সকাল

১৯৯৮-২০০০ সাল। আমি তখন এমসি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। থাকি কলেজের পাশেই নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের আঁধার এমসি হোস্টেলে। কলেজে তখন সব দলের সহাবস্থান ছিল। মাঝেমাঝে টুকটাক কিছু হইলেও সিলেট মহানগরের নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে সুন্দর সমাধান হইয়া যাইত। ফলে সিলেটে সব সময়ই সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকত। কলেজের পাশের হোস্টেলটি ছিল সম্পূর্ণ শিবির নিয়ন্ত্রিত। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় থাকলেও এই হোস্টেলের দিকে একবারের জন্যও কুনজর দেয়নি। এর অনেকগুলা কারণ ছিল। শিবিরের আন্ডারে থাকলেও খোদ ছাত্রলীগ-নেতৃবৃন্দও এই হোস্টেলে থাকতে নিরাপদ বোধ করতেন। আমি স্মৃতির বাকসো হাতড়াই। মনে পড়ে, শিবিরের তখনকার ডাকসাইটে কলেজ সভাপতি সৈয়দ নকীব হোসেইন থাকতেন পঞ্চম ব্লকে। তার লাগোয়া পূর্বপাশের চতুর্থ ব্লকে থাকতেন ছাত্রলীগের একটি গ্রুপের কলেজ সভাপতি সদা-হাস্যোজ্জ্বল বেলাল ভাই। এই ব্লকে আরো ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা মুক্তার ভাই, শিবির নেতা এরাক ভাই এবং কামাল আহমদ আম্বিয়া ভাই সহ আরও অনেকে। মাঝ খানের দ্বিতীয় ব্লকে থাকতেন আরেক কিংবদন্তি ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ ভাই। আর তখনকার ছাত্রলীগের সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রুপের কলেজ সভাপতি ফয়েজ ভাই এবং মহানগর শিবির নেতা গোলজার আহমদ হেলাল ভাই থাকতেন প্রথম ব্লকে। হোস্টেলে এত্ত লিডার থাকলেও যারা সেই সময় এমসি হোস্টেলে ছিলেন তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, সেখানে পড়ালেখা এবং খেলাধুলার অপূর্ব সমন্বয় ছিল। একটি দিনের জন্যও কোন মারামারি, হাতাহাতি, ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। আমরা বিকেল হলেই হোস্টেলের বিশাল মাঠে খেলাধুলায় মেতে উঠতাম। আর সন্ধ্যার পরপরেই স্টাডি। এর কোন ব্যত্যয় দেখিনি। হোস্টেলের এমন সুন্দর শান্তিপূর্ণ পরিবেশের জন্যই ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়াদের জন্য এমসি কলেজের তখন কদর ছিল দেশব্যাপি। স্মৃতির পাতার সেই সময়টা নিয়ে নির্দ্বিধায় 'সোনায় মুড়ানো দিনগুলি' লিখে ফেলা যায়!

যাইহোক, ২০০০ সালের জুন অথবা জুলাই মাসে আমাদের পাশের সরকারী কলেজ ক্যাম্পাসে তুচ্ছ এক কারণে ছাত্রলীগের সাথে শিবিরের মারামারি হয়। মহানগর নেতৃবৃন্দর হস্তক্ষেপে কয়েকদিনের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনার নাটকীয় সমাপ্তি ঘটে। এইসব ঘটনাও এমসি হোস্টেলের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করতে পারে নি।

শাবি জীবনেও টানা পাঁচবছর হলে ছিলাম। শাহপরান হলে। তখন চারদলীয় জোট ক্ষমতায়। আল্লাহর কি অপার মহিমা। সেই খানে ও কোন মারামারি দেখি নাই। ছাত্ররাজনীতি জনিত গণ্ডগোলের কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এক দিনের জন্যও বন্ধ হইসিল বইলা মনে পড়েনা।

এর পর কলি কাল আইল। আর কি যে হইল দেশটায়!

স্বাধীনতার চেতনার ফেরিওয়ালারা ক্ষমতায় আইল। একে একে শাহপরান হলে আগুন জ্বলল। ছাত্রদের কাঁথা-বালিশ-বই-খাতা-নোট-ডেস্কটপ-ল্যাপটপ-সার্টিফিকেট-মার্কশিট সহ সব কিছু পুড়ে গেল। শত শত ছাত্র একদম নিঃস্ব হয়ে গেল। তাঁদের সারা জীবনের স্বপ্ন আওয়ামী হায়েনাদের আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে কয়লা হইল। তাঁদের মা বাপের আশার প্রদীপখানি যেন দপ করে নিভে যাওয়ার উপক্রম হইল।

আরও কিছুদিন পর। আওয়ামী হায়েনাদের দল তখন আঘাত হানল এমসি হোস্টেলে। জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক-মনুষত্ব সব কিছু বিসর্জন দিয়ে শত বছরের ঐতিহ্যে লালিত কবি গুরু রবি ঠাকুরসহ অনেক নামিদামি মানুষের স্মৃতিবিজড়িত এমসি হোস্টেলে হামলা চালিয়ে সব কিছু তছনছ করে দিল। আক্ষরিক অর্থেই পেট্রল ঢাইলা আগুন ধরাইয়া দিলো শতবর্ষী এই মানুষ গড়ার সুতিকাগারে। হোস্টেলের মসজিদ-বিল্ডিং-ঘর-দরজা-জানালা-খাট-টেবিল-চেয়ার-স্থাবর-অস্থাবর-জীব-জড়-গাছপালা-তরুলতা কোনকিছুই সেদিন আওয়ামী নরপশুদের আগুন হতে মাফ পায়নি। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের দাউদাউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পৈশাচিক দৃশ্য সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ টিভিতে লাইভ দেখল। সেদিন আসলে শুধু একটি হোস্টেল পুড়েনি, বরং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই হোস্টেলের ছাত্রদের হৃদয় পড়েছে। আমাদের কলিজা পুড়ে ছাই হয়েছে। স্বজনহারা মানুষের মত ডুকরে ডুকরে কাইন্দা বুক ভাসাইছেন অগণিত মানুষ।

আমার শহরে আবারো আগুন! এইবার একদম মানুষের বাসগৃহে। বসতবাড়িতে। ভিতরে মানুষ রেখে আবারো পেট্রল ঢাইলা আগুন ধরাইয়া দিলো আওয়ামী পশুর দল। বাচ্চাদের চিৎকারে নিশ্চয় আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। মানুষের ভিটে-মাটিতে আগুন দিয়া শেখ হাসিনা মধ্যযুগীয় সমুস্ত বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। প্রাচীন যুগের জংলী মানুষও একে অন্যের ঘরে আগুন দিত না। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করত না।

মজলুম মানুষের নেতা ডাঃ সায়েফ আহমদ এবং হাফেজ আব্দুল হাই হারুন সহ যেসব নেতৃবৃন্দের ঘরবাড়ি পুড়েছে তাঁদের কোন ভাষায় শান্তনা দিব হে মাবুদ। কিভাবে তাঁদের ধৈর্য ও সবরের কথা বলি। রাগে-ক্ষোভে-ঘৃণায় আমাদের চোখে আজ আগুন জ্বলছে। আমাদের হৃদয় পুড়ছে।

হে আল্লাহ ! আমাদের শান্তিময় এই সিলেট মহানগরীকে যারা অশান্তির বিষে নীল করেছে, তাঁদেরকে তুমি ক্ষমা করিও না।

বিষয়: বিবিধ

১০২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File