মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসা শাহিন

লিখেছেন লিখেছেন প্রজাপতি ২৪ মে, ২০১৩, ০১:০৪:৪৬ রাত



ভাই একটু উঠেন। ও ভাই কি হইছে? আমি পারছি না তো। ও পুলিশ ভাই আমাকে একটু বাঁচান।
এই রকম অনেক কথাই শাহিন শুনতে পায় শুয়ে শুয়ে। আরামে শুয়ে আছে তা নয়; বরং উপছে পড়া মানুষের চাপে শাহিন মাটিতে লুটে পড়ে। আর কিছু মানুষ তার উপরে। জীবন যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে শাহিন। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও বাঁচার চেষ্টার কমতি নেই। একের পর এক মানুষ লাফিয়ে পড়ছে অন্যের উপর। এদিক ওদিক করে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। তারপরও সম্ভব হচ্ছে না।

কেউ চিৎকার করছে। হাউমাউ করে কান্না করছে বাঁচার আকুতি নিয়ে। শাহিনেরও কম চেষ্টা নেই। উঠতে পারছে না এতগুলো মানুষকে ধাক্কা দিয়ে। গুলির আওয়াজ, বারুদের গন্ধ, টিয়ারসেল এর ধোঁয়ায় নাক মুখ জ্বালাতন করছে। অস্থির লাগছে।

মানুষ এদিক ওদিক ছুটছে। কেউ খুঁজে পাচ্ছে না গন্তব্যের রাস্তা। আর ওমনি গুলি আসছে, মানুষ লুটিয়ে পড়ছে। শাহিনের গায়ের উপর পড়ে থাকা অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ছে। এতগুলো মানুষের চাপ সহ্য করা অনেক কষ্টের; তারচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শাপলা চত্বরে পড়ে থাকা। এই মানুষগুলো যদি শাহিনের উপরে পড়ে না থাকতো তাহলে শাহিন শাপলা চত্বরের ইতিহাস হয়ে থাকতো। আর জানা হতো না শাহিনের এই নির্মম কাহিনী। কি হয়েছিল শাহিনের? কি রকম যুদ্ধ করেছিল সে? কত কষ্ট করে বের হয়েছে সে?

অনেক সাধনার পর বের হলো মানুষের নিচে চাপা পড়া শাহিন। আর একটু থাকলে শাহিনকে গুলি খেয়ে মরতে হতো না, বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতো না। মানুষের চাপায় পিষ্ট হয়ে যেত। কি অবাক কাণ্ড! এতো মানুষ শুয়ে আছে! কিছু মানুষ দিক বিদিক ছুটাছুটি করছে। কারো পায়ের আঘাতে, হাতের আঘাতে অন্যজন রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। আর উঠতে পারছে না। উঠার শক্তি নেই। একের পর এক মানুষ খুঁজছে নিরাপদ স্থানের সন্ধান। আর শাহিন খুঁজে পেল নতুন এক জীবন। এখন আরও ভয়াবহ অবস্থা। কোথায় যাবে কোন দিকে যাবে? শুধু অন্ধকার। মনে হচ্ছে মানুষ ছুটছে আর ছুটছে। দৌড় দিবে যে সেই শক্তিও নেই। পুরো শরীর ব্যথা। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতের চিহ্ন। ড্রেনের মধ্যে পড়ে পায়ে আঘাত লাগছে প্রচুর। হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে হবে। যেতে হবে শাহিনকে ।

শাপলা চত্বরের দক্ষিণ দিকে মানুষের জোয়ার চোখে পড়ল। কেউ কাউকে রক্ষা করছে না। মনে হচ্ছে কেয়ামতের ময়দান। শাহিন মানুষের উপর দিয়ে যেতে লাগলো। নিজের অজান্তে কাউকে ধাক্কা দিতে হয়েছে। আবার কেউ কামড়ের শিকার হয়েছে। কত যন্ত্রণার মধ্যে শাহিন পার হলো। জুতা, ব্যাগ, জামা-কাপড়, মোবাইল, টাকা পয়সাসহ অজস্র জিনিস পড়ে আছে। তার পাশে শুয়ে আছে অনেক মানুষ। এই মানুষগুলো আর ঘুম থেকে উঠবে না। আর জাগবে না। এদের উঠার ক্ষমতা শেষ।

কিছুক্ষণ হাটার পর একটি বিল্ডিং এর কাছাকাছি আসলো। অনেক উঁচু দেওয়াল। এতো উপরে উঠা সম্ভব না। তারপরও উঠতে হবে। যে আসছে সেই লাফ দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। কেউ কেউ উঠতে পারছে। শাহিনও কয়েকবার চেষ্টা করল । তারপর সফল হলো। অন্য সময় হলে হয়তো উঠতে পারত না।

সামনে একটা ঘর। মানুষগুলো ওখানে জমাট হচ্ছে। ছোট্ট একটা ঘরে এতো মানুষ কখনও জায়গা হবে না। জীবনের মায়ায় আজ সবাই এই পরিস্থিতি মেনে নিচ্ছে। তাই সেও মেনে নিল। জুতা কোথায় হারিয়ে গেছে নিজেও জানে না। শুধু জানে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলো আজ। গায়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে। শরীর নুয়ে পড়ছে । পুরো শরীর ব্যথা করছে অনেক দুর্বল লাগছে। এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে।

অন্যদিকে ঘরের মালিক হিন্দুওয়ালা ক্ষেপে উঠছে। এতো মানুষ তার ঘরে আসবে কেন? ভাগ্যিস ঐ ঘরে কেউ থাকে না। তা না হলে সমস্যা আরও সৃষ্টি হতো। তবুও বাড়ির মালিককে কোনোভাবে থামিয়ে রাখা হয়েছে। মানুষের ভিড়ের মধ্যে নিঃশ্বাস নেওয়ার কোনো উপায় নেই। এদিক ওদিক শুধু ঢেউ খেলছে। আর বাহিরে চলছে গুলি, টিয়ার সেল, বোমা, সাউনড গ্রেনেড এর তীব্র আওয়াজ। পুরো এলাকা প্রকম্পিত হচ্ছে। বের হওয়া খুবই বিপজ্জনক । এই জায়গাও নিরাপদ নয়।

কিছুক্ষণ পর কিঞ্চিৎ আওয়াজ কমছে। কিছু মানুষ হাত উঁচু করে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে সবার মনে সাহস সঞ্চার হলো। এক এক করে বের হলো। হাত উঁচু করে রওয়ানা হলো গন্তব্যের দিকে। সারিবদ্ধ ভাবে চলে যাচ্ছে। মনে প্রচণ্ড ভয় আর শঙ্কা। কখন যে বুলেটের আঘাতে লুটে পড়েতে হয় মাটিতে । এদের তো বিশ্বাস নেই। এরা হায়েনার দল। এরা রাতের অন্ধকারে মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। আতঙ্ক, ভয় মনের মাঝে চাপা রেখে ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে শাহিন বাসায় ফিরল। মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসা শাহিনকে এখনও তাড়া করে ফিরছে ফেলে আসা অতীত।

কবিতার কয়েকটি লাইনে তারই প্রতিধবনি হচ্ছে এইভাবে -

ছুটছে যশ-খ্যাতি আর সুনাম-সুখ্যাতির পিছন,

আকাঙ্ক্ষা চারিদিকে মুখরিত হবে তাদেরই জয়গান।

তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও আরাধনা,

শুধুমাত্র তাদের কাম্য হলো মানুষের বন্দনা ।

আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হবে তাদের নামের শ্লোগান,

কুণ্ঠা নাই তাতে শান্তি-স্বস্থি সবকিছু দিতে বিসর্জন।

সম্পদ লাভে আশ্রয় নেয় সকল নীচতা ও হীনতার,

আদর্শ কায়েম করতে পারে নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার।

পৃথিবীতে চলছে যা কিছু নৈরাজ্য, অনাচার, অশান্তি,

এদের বিবেকহীন কর্মকান্ড টেনে আনছে এসব পরিণতি।

দুনিয়াবী কাজের ব্যস্ততায় তারা করতে পারে না প্রার্থনা,

ভুলে বসে আছে তাদেরও যে ভোগ করতে হবে মৃত্যু যাতনা।

বিষয়: বিবিধ

২৭৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File