ইসলামী পুনর্জাগরণের রূহানী পদ্ধতিঃ হাসান আল বান্না এবং তাঁর চিন্তাধারা – এন্ড্রু বুসো পঞ্চম পর্বঃ উপসংহার
লিখেছেন লিখেছেন মির্জা ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৭:৪০:১২ সন্ধ্যা
হাসান আল বান্নার পৌত্র তারিক রামাদ্বান ‘আল-মা’ছুরাতের’ ইংরেজি অনুবাদের মুখবন্ধে লিখেছেনঃ
“ইমাম হাসান আল বান্নার রহস্য ছিল তাঁর ঈমানের বৈশিষ্ট্য এবং আল্লাহর সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। তাঁর সাথে যারই সম্পর্ক ছিল সেই তা উপলব্ধি এবং অনুভব করতে পারত। তিনি প্রথম দিককার সাহাবাদের মত আল্লাহর রাসূলের (দ) দেখানো পথে জীবনযাপন করতেন। ইমাম হাসান আল বান্না বুঝেছিলেন, মুসলিমরা যদি তাদের হৃদয়, ব্যাক্তিগত প্রচেষ্টা, চেতনা এবং স্মৃতির জন্য যা অপরিহার্য তা পুনরোদ্ধার না করতে পারে তাহলে তাদের কোন ভবিষ্যত নেই।”
“এ পৃথিবী একটি ফাঁদ এবং অনেকসময় এমন হয় যে, প্রলোভন সূক্ষ্মভাবে বিভিন্ন ইসলামী কার্যক্রম যেমনঃ দাওয়াহ, শিক্ষা, ভাতৃত্ব, বক্তৃতা ইত্যাদিতে নিয়োজিত ব্যাক্তিদের আক্রমণ করতে পারে। বিভিন্ন ইসলামী অঙ্গীকার, কার্যক্রম এবং প্রকল্পে ডুবে থেকে শেষে যা হয় তা হচ্ছে তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তথাঃ আল্লাহর জন্য ব্যাক্তিগত সময় দেয়া, তাওহীদের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সংবদ্ধ থেকে আল্লাহকে চেনা, তাঁকে স্মরণ করা, আত্মশুদ্ধিতে নিয়োজিত থাকা, নিজের কাজের হিসাব নেয়া, ক্বুরআনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে লেগে থাকা, সালাত আদায় করা, রোযা রাখা, দু’আ করা এসবের কথা ভুলে যায়। প্রতিটি দিন আর প্রতিটি রাতের জন্যই এসব জিনিস জরুরী।”
নিজের জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়ার এ শিক্ষা রামাদান তার পিতা সাঈদ রামাদান থেকে পেয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। সাঈদ রামাদান হচ্ছেন হাসান আল বান্নার জামাতা এবং তিনি তথাকথিত ‘ক্ষুদে হাসান আল বান্না’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তারিক রামাদান তাঁর ‘Islam, The West and The Challenge of Modernity’ বইতে তাঁর পিতা থেকে এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেনঃ “আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার কয়েকমাস পূর্বে তিনি আমাকে বলেন, “আমাদের সমস্যা হচ্ছে রূহানী সমস্যা। যদি কেউ আমার কাছে মুসলিম বিশ্বের প্রয়োজনীয় সংস্কার, ভূ-রাজনৈতিক কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করতে আসে, আমার প্রথম প্রশ্ন হবে সে তার ফযরের সালাত যথাসময়ে আদায় করেছে কিনা।”” শাইখ যাকারিয়া আস সিদ্দীকি ‘আল মা’ছুরাত’ এর ভূমিকায় বান্নার চিন্তাধারার উত্তরাধিকারী হওয়ার দাবীদারদের মধ্যে দেখতে পাওয়া এ ধরনের রূহানী সংকটের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমি এমন একটি পরিবেশে বেড়ে উঠেছি যেখানে ছিল তিলাওয়াত এবং যিকিরের প্রাচুর্য। আমার এলাকায় ইখওয়ানের সদস্যরা ফযর এবং আসর সালাতের পর আল ইমাম আল মুর্শিদ হাসান আল বান্না রচিত ওয়াজিফা পড়ার জন্য একত্রিত হতেন, তাঁর উপর আল্লাহর রহমত এবং ক্ষমা বর্ষিত হোক।…আমার মধ্যে তা হতে একধরনের তেজস্বীতা প্রবাহিত হত। সেই তেজস্বীতা যেন প্রতিটি তাসবীহ, তাহলীল এবং তাকবীরের সাথে বেড়েই চলত।…অথচ আজকাল ইসলামী আন্দোলনের সদস্যদের মধ্যে আল মা’ছুরাত পড়ার প্রতি এক ধরনের অবহেলা লক্ষ করা যায় যা বোধগম্য নয়। সম্ভবত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ এবং বিশেষজ্ঞদের বদলে নবীনদের দলীয় এবং সিন্ডিকেটভিত্তিক লড়াইয়ে টেনে আনাই তাযকিয়াতুন নফসের উঁচুস্তর থেকে পদস্খলের কারণ ব্যাখ্যা করে।…আমরা আমাদের ইসলামের বাস্তবতা এবং আমাদের শক্তির রহস্য সম্বন্ধে বেখবর থেকে যাব যদি না আমরা আমাদের সময়গুলোকে সালাহ, সিয়াম, ইনফাক্ব, ক্বুরআনকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা, যিকির এবং বিভিন্ন উপলক্ষে দু’আর মাধ্যমে ভরিয়ে তুলতে না পারি। তাই আমাদেরকে যিকিরের আসরে এবং যৌথভাবে আল মা’ছুরাতের পঠনের দিকে ফিরে যেতে হবে। ক্বুরআন এবং দু’আকে আমাদের আত্মার খোরাকে পরিণত করতে হবে আল্লাহর পথের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য”
রামাদান এবং সিদ্দীকি উভয়ের কাছ থেকে এই হৃদয় নিংড়ানো কথাগুলোই বলে দেবে কেন আমি এই প্রবন্ধে যা বলেছি তা ইংল্যান্ডের মুসলিমদের কাছে তাত্ত্বিক কথাবার্তা মনে হবে। কেননা, তারা এ দেশে এমন কোন রূহানী পন্থার অভিজ্ঞতা লাভ করেনি যা এই তাত্ত্বিকতার সাথে যায় যদিও তারা এখানে হাসান আল বান্নার দাওয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত দলসমূহের ঐতিহাসিক উপস্থিতি এবং কার্যক্রম সম্বন্ধে অবগত আছে। এটাই সম্ভবত মুসলিম বিশ্বের চাইতে এখানে এসব দলের অপেক্ষাকৃত কম সফলতা এবং এসব দলের বহু প্রথম দিকের সদস্যদের বিতর্ক বা রূহানী সঙ্কটের কারণে দলত্যাগের কারণ (যদিও আমি স্বীকার করি, অনেকক্ষেত্রে দলের নয়, ব্যাক্তির ত্রুটিই দলত্যাগের কারণ)।
একই সময়ে ইংল্যান্ডে যে কেউই দেখতে পাবে যে, আল বান্নার চিন্তাধারার সাথে সম্পর্কযুক্তরাই কিছু সুখকর ও সংহত ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনশক্তি ও অত্যন্ত অগ্রসরমান কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে। (ইসলামী ফাউন্ডেশন, মার্কফিল্ড ইনস্টিটিউশন এবং সদাপ্রসারমান ইস্ট লন্ডন মসজিদ, যেটা এখন লন্ডন মুসলিম সেন্টার হিসেবে পরিচিত, এসবের কথা মাথায় রেখে বলছি)। তাই আমরা আশাবাদী যে, আইনমান্যকারী ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম তৈরী এবং প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতির এমন চমৎকার রেকর্ডের সাথে সাথে এসব বিস্তর সম্পদকে কাজে লাগিয়ে হাসান আল বান্না এবং তাঁর উত্তরসূরীদের রেখে যাওয়া সুগভীর রূহানী কর্মসূচীকে ইংরেজি ভাষা এবং জীবনে হাজির করতে হবে। অন্যান্য সুন্নী দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ত লোকজন দ্বারা কিছু আধুনিক ও প্রাচীন বইয়ের অনুবাদকর্ম সাধিত হওয়ার মাধ্যমে এ ধরনের প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই আনুকূল্য লাভ করেছে।
যখন কেউ ইউরোপে মুসলিমদের ধর্মনিষ্ঠতার সবচেয়ে আশাবাদী মূল্যবিচার করতে যান, যেমনটি তারিক রামাদান তাঁর বই ‘To be an European Muslim’ বইতে করেছেন, তিনিই খেয়াল করেন যে, ইউরোপে মুসলিমদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা ধর্মের অপরিহার্য দিকগুলোর ব্যাপারে অজ্ঞ। এর মানে হচ্ছে বিবাদমান গ্রুপগুলো, তা রাজনৈতিক, সূফী কিংবা সালাফী যেই হোক না কেন, দশকের পর দশক তাদের কনফারেন্স, কর্মসূচী, ম্যাগাজিন এবং প্রকাশনার পরেও একটি ব্যাপক জনভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন যা মুসলিমদের মধ্যে ধর্মানুরাগিতার সৃষ্টি করবে। ‘হাসান আল বান্নার চিন্তাধারা এবং দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর (এবং তাঁর উত্তরসূরীদের) অবস্থানের স্পষ্টতঃ ভারসাম্যমূলক অবস্থানের প্রকৃত বাস্তবায়ন পাশ্চাত্যে হয়নি’ – আমার এ প্রস্তাবনা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে, এ চিন্তাধারার প্রকৃত উপস্থাপন এবং অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে, আল্লাহর রহমত্ মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশকে তাদের ধর্মবোধ পুনরোদ্ধারে উৎসাহিত করা এবং বিবাদমান বিভিন্ন গ্রুপের ধর্মীয় ব্যাক্তিদের মধ্যে বিবাদ কমিয়ে আনার ব্যাপারটি কেউ চিন্তা করতে পারেন।
আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর নৈকট্য অর্জনের তীব্র রূহানী অভিজ্ঞতার উৎকর্ষতা অজ্ঞতাসূলভ কর্মকান্ড দমন করার একটি নিশ্চিত অস্ত্র, যেসব কর্মকান্ড আমাদের দেশকে দুর্ভাগ্যক্রমে অনিরাপদ করে তুলেছে। আমাদের আশাগুলো সময়োপযোগী নাকি ইতিহাস আরেকটি সুযোগ হারানোর কথা লিপিবদ্ধ করবে, (যেমনটি কিনা শাইখ নাদওয়ী বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মিশরে একটি সুযোগ হারানোর কথা বর্ণনা করেছেন) তা আমাদের জানার কথা না। এরপরেও এ দেশে একটি ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া এ দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। এ দেশে শান্তি আনয়ন করা এমন একটি ব্যাপার যাতে আমাদের আশাহত হওয়ার কোন সুযোগ নেই। ইবনে আতিয়াল্লাহ ‘হিকাম’ এ বলেছেন, “আল্লাহ তাকে তার কামনা থেকে রক্ষা করবেন অথবা বিস্মৃতির গহবর থেকে তাকে টেনে তুলবেন – এটি যদি কারো কাছে আশ্চর্যকর ঠেকে তবে সে আল্লাহর সামর্থ্যকে দুর্বল প্রতিপন্ন করল এবং “আল্লাহ সবকিছুর উপরে শক্তিমান (ক্বুরআনঃ ১৮:৪৩)।”” একইভাবে বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে এবং আমাদের নিজেদের অন্তরগুলোতে যে বিতৃষ্ণকারী নেতিবাচক দিক লক্ষ করা যায় তা কাউকে যেন আল্লাহর অদম্য শক্তি সম্বন্ধে বেখবর না করে তোলে যা সবচেয়ে নিকৃষ্ট অবস্থাকেও সবচেয়ে উৎকৃষ্ট অবস্থায় পরিণত করে দেবার সামর্থ্য রাখে এবং সেইসাথে মুসলিমদেরকে এ যুগের সম্মানে পরিণত করে দেবার। এবং আল্লাহর জন্য তা কোন কঠিন বিষয় নয়।
এন্ড্রু বুসোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি লন্ডন অধিবাসী। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স থেকে আইন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এছাড়াও তিনি শাইখ ইকবাল আজামী এবং শাইখ আকরাম হুসাইন নাদওয়ীর ছাত্র। এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড বেইসড “স্প্রিং ফাউন্ডেশন” নামে একটি চ্যারিটি অরগ্যানাইজেশনের এডভাইসারি বোর্ডে আছে। এ সংগঠন মূলত ইসলামী স্টাডিজের ছাত্রদের স্কলারশীপ দিয়ে থাকে।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন