ইসলামী পুনর্জাগরণের রূহানী পদ্ধতিঃ হাসান আল বান্না এবং তাঁর চিন্তাধারা – এন্ড্রু বুসো ৪র্থ পর্বঃ মানহাজ (দ্বিতীয় অংশ)

লিখেছেন লিখেছেন মির্জা ২৯ আগস্ট, ২০১৪, ১০:০২:১২ সকাল

যেকোন বিশুদ্ধ ইসলামী রূহানী ধারার ক্বুরআনকেই সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়ার কথা। হাসান আল বান্নাও তাঁর অনুসারীদের তিলাওয়াহ এবং ক্বুরআনের অর্থের উপর চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে ক্বুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক গঠন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। হাসান আল বান্নার অনেক শিষ্য ক্বুরআনের ব্যাখ্যার জন্য নিজেদের জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করেছেন। তাঁদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুব তাঁর ‘ফি যিলালিল ক্বুর’আন’ এর জন্য বিখ্যাত। এছাড়া মুহাম্মাদ আল গাযালী এবং সা’ঈদ হাওয়াও ক্বুরআনের তাফসীর লিখেছেন। শাইখ ক্বারদাওয়ী তাঁর ‘Approaching The Sunnah’ বইয়ে ক্বুরআনের বাণীকে আধুনিক যুগের উপযোগী করে তুলে ধরার জন্য সাইয়েদ কুতুব এবং মুহাম্মাদ গাযালীর প্রশংসা করেছেন। তাছাড়া যয়নব আল গাজালী তাঁর বই ‘Return of The Pharaoh’-এ সাইয়েদ কুতুবের লেখা পড়ার কথাও বর্ণনা করেছেন। যয়নব আল গাজালীর আত্মজীবনী বর্ণনা থেকেই বুঝা যায়, তাঁর রূহানীয়াতের উপর সাইয়েদ কুতুবের ব্যাক্তিত্ব, তাঁর নন-ট্রেডিশনাল তাফসীর এবং ‘Milestone’ বইয়ের প্রভাব কতটা গভীর ছিল। যয়নাব আল গাজালীর বর্ণনা থেকে এও জানা যায় যে, তাঁর সময়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যরা তাফসীর ইবনে কাছিরও পড়তেন। আমার মত হচ্ছে, যারা আধুনিক তাফসীরগুলো থেকে উপকৃত হতে চান তাদের উচিত পাশাপাশি ক্লাসিক্যাল তাফসীর কিংবা আধুনিককালে ক্লাসিক্যাল তাফসীরগুলোর আদলে রচিত তাফসীরগুলো পড়া।

এস.এম আল বান্নার বর্ণনা থেকে জানা যায়, হাসান আল বান্না ‘ইয়াহইয়া উলুমুদ্দীন’ কে শিক্ষা সিলেবাসে রেখেছিলেন। এছাড়াও হাসান আল বান্না ক্বুর’আন ও হাদীছ থেকে বিভিন্ন দু’আ নিয়ে ‘আল মা’ছুরাত’ নামে একটা দু’আর সংকলনও তৈরী করেছিলেন যেটা মুসলিম ব্রাদারহুডের সদস্যদের সকাল ও সন্ধ্যা একাকী কিংবা জামায়াতবদ্ধভাবে পাঠ করতে হত। যয়নাব আল গাজালীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাঁর সময় ইখওয়ানের সদস্যরা মুনযিরীর ‘আল তারগীব ওয়াল তারহীব’ আর ইবন্যিল কায়্যিমের ‘যা’আদুল মা’আদ’ পড়তেন যে দুটো বই ছিল ইসলামী নৈতিকতা ও রূহানীয়াতের উপর রচিত। শাইখ সা’ঈদ হাওয়া তাঁর ‘জুনদুল্লাহ’ বইতে আখলাক গঠনের জন্য ইমাম গাজ্জালীর ‘ইহইয়া’ এবং কুশাইরীর ‘আর-রিসালা’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়াও তাছাড়া সা’ঈদ হাওয়া নিজেও ইবনে আতিয়াল্লাহর ‘হিকাম’ এর একটি ব্যাখ্যা লিখেছেন। তাঁর প্রস্তাবিত বইয়ের লিষ্টে তাঁর এই ব্যাখ্যাকর্মও ছিল। শাইখ ইউসুফ আল ক্বারাদাওয়ী তাঁর ‘Approaching The Sunnah’ বইয়ে সুন্নাহর উপর কৃত কাজগুলোর একটি বিস্তৃত তালিকা দিয়েছেন যেগুলো দাওয়াত, দিকনির্দেশনা এবং তাযকিয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এ তালিকার কিছু বই ইতোমধ্যেই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে গিয়েছে যেমনঃ ইমাম নববীর ‘রিয়াদুস সালেহীন’, ইবনে রজব হাম্বালীর ব্যাখ্যাসহ ইমাম নববীর চল্লিশ হাদীছ এবং শাহ ওয়ালীউল্লাহ দিহলাওয়ীর ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ (শাইখ ক্বারাদাওয়ী এর প্রথম খন্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন যেখানে বিভিন্ন হাদীছের ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রজ্ঞা ও গূঢ় অর্থ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে)। এছাড়াও শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ আল মুহাসিবীর ‘রিসালাহ আল মুসতারশিদীন’ একটি সংস্করণ বের করেন।

একটি প্রাণবন্ত ইসলামী জাগরণের প্রকৃতি হচ্ছে আলিমদের সবচেয়ে যথার্থ মতগুলোর অনুসরণ করা। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা শুধুমাত্র ক্বুরআন-সুন্নাহর দাস হয়ে থাকা এবং এ ধরনের দাসসুলভ মানসিকতা অন্য কোন আলেমের প্রতি না দেখানো। শাইখ ক্বারদাওয়ী তাঁর ‘Approaching The Sunnah’ উল্লেখ করেন যে, ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ তাঁর অন্তরের খুব নিকটবর্তী একজন আলিম হলেও তিনি ইবনে তাইমিয়াহকে অন্য যেকোন আলেমের মতই বিবেচনা করেন, সর্বক্ষেত্রে তাই তিনি ইবনে তাইমিয়াহর অনুসরণ করেন না। সেজন্য তিনি বলেন, “আমি ইবনে তাইমিয়াহকে ভালোবাসি কিন্তু আমি তাইমিয়ী না।”; যেমন কিনা ইমাম যাহাবী বলেছিলেন, “ইবনে তাইমিয়াহ আমাদের হৃদয়ের নিকটবর্তী প্রিয় একজন আলেম কিন্তু সত্য আমাদের নিকট ইবনে তাইমিয়াহর চাইতেও অধিকতর প্রিয়।” আর সেজন্যই রূহানীয়াতের উপর এসব বইগুলো প্রাণবন্ত ও গতিশীল ইসলামী জাগরণের স্পিরিটের আলোকে ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই শিখাতে হবে। শাইখ ক্বারাদাওয়ী তাঁর ‘Priorities of Islamic Movement in The Coming Phrase’ বইতে উল্লেখ করেন যে, হাসান আল বান্না নিজেও কখনো নিজেকে নির্ভুল দাবী করেন নি আর তিনি নিজের মতের ব্যাপারে কঠোরও ছিলেন না। কোন ব্যাপারে তাঁর কোন অনুসারী তাঁর সাথে দ্বিমত করলে অসন্তুষ্ট হন নি। আসলে একজন প্রকৃত আলেম ইমাম শাফিঈর “আল্লাহ তাঁর নবীদের ছাড়া আর কাউকে স্বর্গীয়ভাবে ভুল থেকে রক্ষা করেন নি।” এ উক্তির যথার্থতা খুব করে বোঝেন।

সূফীদের বইগুলো পড়ার সময় ক্রিটিকাল মনোভাব নিয়েই পড়তে হবে। যেমন শাইখ ক্বারাদাওয়ী পাঠকদের ‘ইহইয়া উলুমুদ্দীন’ পড়ার সময় এতে ব্যবহৃত হাদীছগুলোর উপর যাইনুদ্দীন আল ইরাকীর আলোচনাও পড়ে নেয়াটা জরুরী মনে করেন কেননা এই বইয়ে ইমাম গাজ্জালী উপস্থাপিত অনেক হাদীছই অত্যন্ত দুর্বল (যঈফ), কিছু হাদীছের আবার কোন উৎস পাওয়া যায় না, আবার কিছু কিছু হাদীছ বানোয়াটও (মাওজু’) বটে। তেমনিভাবে শাইখ ক্বারাদাওয়ী আল মুনযিরীর ‘আল তারগীব ওয়াল তারহীব’ বইটিকে শুধুমাত্র এর খ্যাতির কারণে এর ভেতরের সবকিছু গ্রহণ করা না হয় এ ব্যাপারে ছাত্রদের সতর্ক করে দেন কারণ এতে অনেক দুর্বল এবং অতি দুর্বল হাদীছ রয়েছে। এজন্যই শাইখ ক্বারাদাওয়ী নিজেই এই বইয়ের একটি সংস্করণ বের করেন যেখানে শুধুমাত্র এর সহীহ এবং হাসান হাদীছগুলো রাখা হয়েছে। এজন্য আবার এটা মনে করা ঠিক হবে না যে, রূহানী ব্যাপারগুলোতে দুর্বল হাদীছ ব্যবহার করার স্বপক্ষে যে মত আছে সেটার ব্যাপারে শাইখ ক্বারাদাওয়ী বেখবর। শাইখ ক্বারাদাওয়ী তারগীব এবং অন্তর আল্লাহভীতিতে নমনীয় করার ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীছ ব্যবহারের উপর ইমাম ইবনে হাজারের তিনটি শর্ত বর্ণনা করেন (যে শর্তগুলোর পুনরাবৃত্তি পরবর্তীতে ইমাম সুয়ূতীও করেছেন) এবং এটাও বলেন যে, অনেক ক্ষেত্রে এ তিনটি শর্তও ঠিকভাবে অনুসরণ করা হয় না। এরপর তিনি এ ব্যাপারে কিভাবে এগোতে হবে সে ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। আগ্রহীরা আরো জানতে তাঁর ‘Approaching The Sunnah’ পড়ে দেখতে পারেন।

অনেক তাত্ত্বিক বিষয়গুলোর প্রতিও এ ধরনের ক্রিটিকাল দৃষ্টিভঙ্গী আরোপ করা যায়। পাশ্চাত্যের একজন সুপরিচিত সূফীপন্থী লেখক টি জে উইন্টার (যিনি আব্দুল হাকিম মুরাদ ও কারিম ফেনারী নামেও পরিচিত) তাঁর ‘Disciplining The Soul/Breaking Two Desires’ নামে ইমাম গাজ্জলীর একটি রচনার অনুবাদের ভূমিকায় বলেছেন, সূফীদের ভক্তিমূলক জীবনীগুলোতে যে অনেক বাড়াবাড়ি বিদ্যমান সেটার স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে ইমাম গাজ্জালীর ‘আল ইহইয়া’ বইটি। টি জে উইন্টার তাঁর কৃত ‘ইহইয়া’ এর অনুবাদে এমন একটি ঘটনা বর্ণনা করেন যেটার ব্যাপারে ইমাম ইবনুল জাওযী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ঘটনাটি এরূপ, একবার এক (সূফী) শাইখ সম্পদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা দূর করার জন্য নিজের সমস্ত সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। রিয়া ও আত্মতুষ্টিতে ভোগার ভয়ে তিনি অন্যকে সেই বিক্রয়লব্ধ অর্থ না দিয়ে তা সাগরে ফেলে দেন। উইন্টার বলেন, ইবনুল জাওযী এ ঘটনার নৈতিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু জাবিদী ইমাম গাজ্জালী বর্ণিত এ ঘটনাকে সমর্থন করেন আর উইন্টারও জাবিদীর সাথে এব্যাপারে একমত পোষণ করে বলেন, এ ঘটনার শিক্ষা কোন সাধারণ নীতিমালা প্রদান করা নয় বরং এটা দেখানো যে, অনেকসময় একজন শাইখের তত্ত্বাবধানে থাকা একজন কিভাবে ধর্মীয়ভাবে প্রশংসিত একটি কাজের উপরে তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর ভরসা করার মত বাধ্যতামূলক কাজকে আগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন। আবার ইমাম কুরতুবী সূরা বাক্বারার ২৮৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় গাজ্জালীর সূফীতত্ত্বের কিছুটা সমালোচনা করেন। কিছু সূফীগণ নিজেদের এবং নিজেদের পরিবারের জন্য যথেষ্ট সম্পদ না রেখে যাবতীয় সম্পদ পরিত্যাগ করেন এবং পরে আবার ভাই ও বন্ধুদের দানশীলতার উপরই নির্ভর করেন; সম্পদশালী ও অত্যাচারীদের থেকে সাহায্য নেন। এসব সূফীদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম কুরতুবী বলেন, “এ ধরনের কাজ নিন্দনীয় এবং হারাম।………… আল মুহাসিবী এ সম্বন্ধে অনেক আলোচনা করেন, আল গাজ্জালীও এটার প্রশংসা করেন। আল মুহাসিবীর দোষ এ ব্যাপারে আল গাজ্জালীর চাইতে কম কেননা গাজ্জালীর ফিক্বহের জ্ঞান তুলনামূলকভাবে বেশী কিন্তু তাসাওউফের জগতে প্রবেশই তাঁকে এ ধরনের মত গ্রহণে বাধ্য করেছে।” এর পর কুরতুবী এ ব্যাপারে ইবনুল জাওযীর একটি লম্বা আলোচনা উদ্ধৃত করেন। অনেকেই নবাগতদেরকে এ ধরনের বিতর্কিত বিষয় পরিহার করে রূহানীয়াত অর্জনের যে পন্থা আছে তার মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে নজর দেয়ার জন্য বলে থাকবেন। আর এই মৌলিক বিষয়গুলো ইবনে কুদামাহর ‘মুখতাসার মিনহায আল কাসিদীন’ এর মত বইয়ে পাওয়া যাবে। এই বইটি মূলত ইবনুল জাওযী কর্তৃক সংশোধিত ‘আল ইহইয়া’ এর সংক্ষেপিত অংশ। আসলে, এ ধরনের মতপার্থক্য আলেমদের জন্যই নির্ধারিত। তাই ইমাম গাজ্জালীর এবং তার ‘আল ইহইয়া উলুমুদ্দীন’ এর ব্যাপারে অতিরিক্ত নেতিবাচক ধারণা পোষণ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ গাজ্জালী এবং তাঁর এই বই উভয়ই উম্মাহর কল্যাণের কারণ হয়েছে এবং আমরা এই উভয়ের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।

বৈধ মতপার্থক্যের ব্যাপারে সহনশীলতা প্রদর্শন আর কোন বিতর্কিত বিষয়ে একটি মত পোষণ করা এবং সে অনুযায়ী রায় প্রদান করা একই বিষয় নয়। হাসান আল বান্না তাঁর ‘আল মা’ছুরাত’ এর মুখবন্ধে দলবদ্ধভাবে যিকির করাকে সমর্থন এবং উৎসাহিত করেছেন যদিও এই ব্যাপারটিতে সুন্নী আলেমগণ মতপার্থক্য করেছেন। একইভাবে যিকিরের তালে নাচের ব্যাপারেও শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ বেশ দৃঢ়তার সাথে নিজের মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “যিকিরে যদি ছন্দের সাথে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাড়ানো, সুরেলা ভক্তিমূলক স্তুতিগান, যিকিরের তালে নাচা, শরীরকে সামনে পেছনে হেলানো-দুলানো, লাফানো, জোরে জোরে শরীর মোচড়ানো ইত্যাদি সব কর্মকান্ড অন্তর্ভুক্ত থাকে তবে এ ধরনের যিকির হারাম। মানুষের সুস্থ প্রকৃতি এ ধরনের কাজ অপছন্দ করে, আল্লাহভীতির বোধ থেকে তা অনেক দূরে।” এর পর আবু গুদ্দাহ তাঁর মতের সমর্থনে ইবনে হাজার, কুরতুবী এবং আহমেদ তাহতাওয়ীর উদ্ধৃতি দেন। এ ধরনের মত যে শুধু ইখওয়ানের আলেমদের মধ্যেই দেখা যায় তা নয়। আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহর মত রক্ষণশীল ঘরানার আরেকজন সিরীয় আলিম সাঈদ রামাদান আল বুতীও তাঁর ‘ফিক্বহুস সীরাহ’ গ্রন্থে সূফীদের যিকিরের মজলিসে শরীর সামনে পেছনে হেলানো দুলানোর সাথে নাচের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি এ ধরনের নাচকে হারাম আর যদি নাচের সাথে এ ধরনের অঙ্গসঞ্চালন না থাকে তবে তা কমপক্ষে ‘মাকরূহ’ বলে মত দেন। বুতী তাঁর নিজের সমর্থনে ইজ্জুদ্দীন আবদুস সালাম, ইবনে হাজার, ইবনে আবিদীন এবং কুরতুবীর উদ্ধৃতি দেন। সবশেষে তিনি বলেন, “যদি আলোচনা অনেক লম্বা হওয়ার আশঙ্কা না থাকত তাহলে আমি এ ব্যাপারে অন্যান্য অনেক ইমামের মত উদ্ধৃত করতাম।” এরপরেও তিনি কিছু সংখ্যালঘু ফক্বীহদের এ ব্যাপারটি সামান্য মতভিন্নতাসহ মেনে নেওয়ার ব্যাপারটিকে উল্লেখ করে তাঁদের ব্যাপারে বলেন, “একইসাথে আমি তাঁদের মর্যাদা এবং সৎ উদ্দেশ্যের ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে চাই। তবে তাঁদের পান্ডিত্যের প্রশংসা ও মূল্যায়ন করার মানে এটা নয় যে তাঁদের সাথে একমত হওয়ার জন্য আমি সুস্পষ্ট দলীলের বিরুদ্ধে যাব বা রূপকভাবে ব্যাখ্যা করে সেগুলোর আসল উদ্দেশ্যকে বিকৃত করব।” এ ধরনের মানসিকতা ইখওয়ান ঘরানার আলিমদের প্রশংসনীয় গুণাবলীর মধ্যে একটি।

যদিও আল বান্না এবং ক্বারাদাওয়ীর ব্যাপারে বলা যেতে পারে যে, সূফীগণ এবং তাসাওউফ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণভাবে ইতিবাচক, কিন্তু তাঁরা কোন সূফী তরীক্বা অথবা এসব তরীক্বার কোনটির মুর্শিদদের দিকে ঝুঁকে পড়েন নি। তাঁরা এটাও মনে করতেন না যে, ইসলামী রূহানীয়াতের সর্বোচ্চ পর্যায় কেবল সূফী তরীক্বাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হাসান আল বান্না নিজেই ইখওয়ানের রাজনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে কাজ করেছেন। মজার ব্যাপার হল, তাঁকে ‘আমীর’ (নেতা) এর পরিবর্তে ‘মুর্শিদ’ (পথপ্রদর্শক) ডাকা হত, যেটি কোন সূফী তরীক্বার প্রধানের জন্য ব্যবহৃত হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর (প্রধানদেরকে মুর্শিদ ডাকার) এ ধারা ইখওয়ানের মধ্যে এখনো বহাল আছে। যায়নাব আল গাজালী এবং ইখওয়ান সম্বন্ধে তাঁর বিবরণ নিয়ে আলোচনা করার সময় আমি এদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে, ইখওয়ান তাদের রূহানী তারবিয়াতের পদ্ধতি দ্বারা যদি সূফী তরীক্বাদের চেয়ে উন্নত আল্লাহভীরু মানুষ নাও তৈরী হয়, অন্তত সমমানের তাক্বওয়াসম্পন্ন লোক অবশ্যই তৈরী হচ্ছে বলে মনে করত। মুহাসিবীর লেখা ‘আল মুসতারশিদীন’ বইয়ের ব্যাখ্যায় শাইখ আবদাল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ বিখ্যাত ফক্বীহ ইমাম শাতিবী এবং তৎকালীন একজন বিখ্যাত সূফী ও ইবনে আতিয়াল্লাহর ‘আল হিকাম’ বইয়ের একটি জনপ্রিয় ব্যাখ্যাগ্রন্থের রচয়িতা ইবনে আব্বাস আল রান্দীর মধ্যে বিনিময়কৃত একটি পত্রের অংশ তুলে ধরেন। শাতিবী ইবনে আব্বাস আল রান্দীকে জিজ্ঞাসা করেন, রূহানী পথের একজন পথিকের জন্য কোন তরীক্বা এবং তারবিয়াহর শাইখকে অনুসরণ করা এবং তার নির্দেশনা অনুযায়ী চলা বাধ্যতামূলক কিনা অথবা, তার জন্য কোন তরীক্বার শাইখকে অনুসরণ না করে কেবল জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে এবং জ্ঞানী ব্যাক্তিদের থেকে উপকৃত হয়ে এ পথে চলা অনুমোদনযোগ্য কিনা। এর জবাবে ইবনে আব্বাস আল রান্দী যা বলেন তার সারাংশ হচ্ছে:

“এ পথের সব পথিকদের জন্য তারবিয়াহর শাইখের অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। কেবল যাদের বুদ্ধিবৃত্তি সীমাবদ্ধ এবং নফস অনুগত নয়, তাদের জন্য শাইখ অনুসরণ করা জরুরী। কিন্তু যার বুদ্ধিবৃত্তি যথেষ্ট এবং প্রকৃতিও বশবর্তী, তার জন্য কোন শাইখকে অনুসরণ করা জরুরী নয়। এ পথের প্রত্যেক পথিকের জন্য যেটা বাধ্যতামূলক তা হচ্ছে, কোন শাইখ ঠিক করে নেয়া যিনি কিনা তাকে শিক্ষা দিবেন।”

একই সময়ে আমি এটাও মনে করি না যে, ব্রাদারহুড মানুষের প্রয়োজনের খাতিরে সূফী শাইখ ঠিক করে নেয়ার বিরোধী। আপত্তি তখনই আসতে পারে যখন কোন শিক্ষানবীশ এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে নিজ সম্প্রদায় এবং সমাজের প্রতি যে ইসলামিক দায়বদ্ধতা আছে তা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এ ধরনের সম্পর্কে একজন সূফী শাইখকে কেবল রূহানী প্রশিক্ষক হিসেবেই দেখা হয় না, বরং রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অধিকারী হিসেবেও ভাবা হয়, যেটা আসলে নাও হতে পারে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত গৌরবান্বিত ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও এর পর থেকে সূফী তরিক্বাগুলো সাধারণত বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় নি ব্রাদারহুডের মত। বরং তারা অনেকটা বিচ্ছিন্নভাবে রূহানী শিক্ষা প্রদানে নিয়োজিত থেকেছে। তারিক রামাদান তাঁর ‘To be a European Muslim’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে, ‘ইসলামী’ দেশগুলোতে এবং ইউরোপে সূফীরা অনেকাংশেই অরাজনৈতিক। তবে যদি এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে তবে রাজনৈতিক ময়দানে পারদর্শিতা দেখানোর শর্তে সূফীদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাল ধরার বিষয়টি চিন্তা করতে পারেন যেকেউই।

তাছাড়াও সামাজিক জাগরণের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সীমিত ক্ষেত্রে সূফীদের কাজ করার সুযোগ করে দেয়ার মানে হচ্ছে তাদেরকে তাদের অনপরিহার্য বিশেষ স্বভাব বৈশিষ্ট্যসহ মেনে নেয়া এবং তাদেরকেও অন্যদের ক্ষেত্রে একই মনোভাব দেখানো। প্রথমোক্তটির উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, সূফীদের তাদের সিলসিলা রাসূল (দ) পর্যন্ত কোন ধরনের বিচ্ছিন্নতা ছাড়া পৌঁছানোর দাবীর প্রতি ব্রাদারহুডের সহনশীলতা দেখানো; যদিও হাদীছ বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধরনের সিলাসিলা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। সুপরিচিত অনুবাদক এবং গবেষক জিব্রীল হাদ্দাদ একটি আর্টিকেলে দেখিয়েছেন, পূর্ববতী ইমামদের এ বিষয়ে মতৈক্য আছে যে, হাসান আল বাসরী (রাহঃ) সরাসরি আলী, ইবনে আব্বাস অথবা আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে সরাসরি কিছু শুনেননি যেটি কিনা ইয়াহইয়া ইবনে মা’ঈন, ইবনে আল মাদিনী, আবু জুর’আ, আলী ইবনে যিয়াদ, আবু হাতিম, ইবনে আবি হাতিমের ভাষ্যমত এবং এই সিলসিলা মুরসাল। আর এটাই হাদ্দাদের মতে ইবনে হাজার, যাহাবী, আল ইরাক্বী, সাখাওয়ী এবং অন্যদের মত। আর হাদ্দাদ এটিও উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম সুয়ুতী এবং আহমাদ গুমারী হাসান আল বাসরী এবং আলীর (রাঃ) মধ্যে যে সংযোগ দেখানোর চেষ্টা করেছেন তা চূড়ান্ত নয়। তাছাড়া হাদ্দাদ নিজের নকশবন্দী তরীক্বা নিয়ে কথা বলার সময়ও ন্যায়বিচার করেছেন। নকশবন্দী তরীক্বার সিলসিলা আবু বকর (রাঃ) মধ্য দিয়ে যাওয়ার দাবী করা হয়। হাদ্দাদ একই আর্টিকেলে বলেছেন, “সনদের বিচারে বক্বরী নকশবন্দী সিলসিলায় অপেক্ষাকৃত বড় বিচ্ছিন্নতা রয়েছে।” হাদ্দাদ আরো বলেন, “ইমাম আস সাখাওয়ী ছিলেন একজন শাদিলী এবং তিনি বলেন তিনি এমন এক সনদ বর্ণনা করেছেন যা হাসান হয়ে আলী(রাঃ) পর্যন্ত পৌছেছে, এটি এজন্য নয় যে এই সনদ বিচ্ছিন্ন বরং এর বারাকাহর জন্য তা করা হয়েছে।” মূলত, যেকোন রূহানী প্রশিক্ষণের মূল হচ্ছে আল্লাহর রহমতে আল্লাহওয়ালা মানুষ তৈরীতে এর কার্যকরিতা, যদিও রূহানী সদস্যগণ কোন অসত্য ধারণাতে বিশ্বাস করে। যতক্ষণ পর্যন্ত এর ফলে দ্বীন দুর্বল না হচ্ছে এবং ধর্মভীরু মানুষ তৈরী হচ্ছে, কেনই বা আমরা এসব নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হব? হাসান আল বাসরী এবং আলী (রাঃ) এর মধ্যে এ বিতর্কিত সংযোগ এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

এন্ড্রু বুসোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি লন্ডন অধিবাসী। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স থেকে আইন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এছাড়াও তিনি শাইখ ইকবাল আজামী এবং শাইখ আকরাম হুসাইন নাদওয়ীর ছাত্র। এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড বেইসড “স্প্রিং ফাউন্ডেশন” নামে একটি চ্যারিটি অরগ্যানাইজেশনের এডভাইসারি বোর্ডে আছে। এ সংগঠন মূলত ইসলামী স্টাডিজের ছাত্রদের স্কলারশীপ দিয়ে থাকে।

বিষয়: বিবিধ

১৭৮৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File