ইসলামী পুনর্জাগরণের রূহানী পদ্ধতিঃ হাসান আল বান্না এবং তাঁর চিন্তাধারা – এন্ড্রু বুসো ৩য় পর্বঃ মানহাজ (১ম অংশ)
লিখেছেন লিখেছেন মির্জা ২৬ আগস্ট, ২০১৪, ০৫:৪২:০৮ সকাল
এটা সুস্পষ্ট যে, রূহানীয়াতের জন্য জ্ঞান আবশ্যক। জ্ঞান ছাড়া কেউই তার কর্তব্য কিংবা লক্ষ্যস্থল সম্বন্ধে অবগত হতে পারে না। জ্ঞানই হচ্ছে একমাত্র পন্থা যার মাধ্যমে কেউ আধ্যাত্মিকতাকে নিজের পক্ষপাতদুষ্ট-ভ্রমমূলক মাপকাঠি বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ এবং সঠিক মাপদন্ড, সুন্নাহ অনুসারে যাচাই বাছাই করে নিতে পারে। আর এজন্যই আমরা দেখতে পাই যে, হাসান আল বান্না তাঁর অনুসারীদের জন্য আক্বীদা এবং শারী’আহ সম্বন্ধীয় পুস্তকাদি পড়া বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন।
আক্বীদার ব্যাপারে হাসান আল বান্নার অবস্থান তাঁর বই ‘আল আক্বাইদ’ থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। এই বই পড়লে প্রতীয়মান হয় যে, এছাড়া তাঁর অন্যতম ভাবশিষ্য শাইখ ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ীর মতও এটাই যে, হাসান আল বান্নার আক্বীদাগত অবস্থান হচ্ছে ‘সালাফী’, ‘আশ’আরী’, ‘মাতুরিদী’ এসব লেবেল এবং তদসম্বন্ধীয় বিতর্কের প্রয়োজন ছাড়াই পুরোদস্তুর সুন্নী অবস্থান। এ ব্যাপারে হাসান আল বান্নার অবস্থান মূলত ইমাম নববীর অবস্থানের অনুরূপ। ‘উমদাত আস সালিক ওয়া উদ্দাত আন নাসিক’ বইতে এ ব্যাপারে ইমাম নববীর মত পাওয়া যাবে। তাঁর মতে, আল্লাহর কিছু সিফাতের প্রকৃতির ব্যাপারে যে বিতর্ক চলে আসছে সে ব্যাপারে নিরাপদ অবস্থান হচ্ছে সালাফদের অবস্থান আর তা হচ্ছে এসব সিফাতের উপর কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আরোপ না করে, প্রকৃত জ্ঞানকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়া এবং সেইসাথে আল্লাহকে সবধরনের সৃষ্টিগত সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে মনে করা। কিন্তু কখনো যদি অপব্যাখ্যা ও বিদ’আত রোধে এসব সিফাতের কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে আলেমরা এই কাজ করতে পারেন। আগেরকার আলেমদের থেকে আক্বীদার ব্যাপারে যে মতামত এসেছে, সেগুলোকে এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই দেখা উচিত। আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।
শাইখ ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ী তাঁর ‘কাইফা নাতা’আমালু মা’আ আস সুন্নাহ আন নাবাবীয়া’ (নবীর সুন্নাহর সাথে আমাদের আচরণ কিরূপ হওয়া উচিত) বইতে যদিও আল্লাহর সিফাতসমূহের ব্যাপারে শাইখ ইবনে তাইমিয়াহর সাথে একমত পোষণ করেছেন, কিন্তু আবার তাঁর ‘Priorities of Islamic movement in the coming phase’ বইতে মুসলিমদের প্রতি অতীত থেকে চলে আসা এসব অপ্রয়োজনীয় এবং সময় বিনষ্টকারী বিতর্কের অবসান ঘটানোর আহবান জানিয়েছে। এসব অনর্থক বিষয়ের একটি দিক হচ্ছে আক্বীদাগত বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সালাফ এবং খালাফদের মতবিরোধ সংক্রান্ত বিতর্কের সৃষ্টি করা, অপর দিক হচ্ছে আল আযহার, দেওবন্দ, ক্বারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মেনে চলে আসা আশ’আরী-মাতুরিদী মাযহাব খন্ডন করা।
আমার উস্তায শাইখ ইক্ববাল আযামী (দেওবন্দ থেকে ফারিগ এবং শাইখ আবুল হাসান নাদাওয়ীর ব্যাক্তিগত অনুলেখক) ইমাম তাহাবীর লেখা ‘আক্বীদা তাহাবী’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। আক্বীদার উপর লেখা এই বইটি হচ্ছে মুসলিমদের জন্য নূন্যতম ভাষায় লেখা অথচ যথেষ্ট একটি বই। হাসান আল বান্না ও ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ীর মতে মুসলিমদের জন্য যে প্রয়োজনীয় আক্বীদা শিক্ষার প্রয়োজন, এই বইটি তার চাহিদা মেটাতে পারে। শাইখ আযামীর মতে, সাধারণ মুসলিমদের জন্য ‘আক্বীদা আত তাহাবীর’ কোন ব্যাখ্যা পড়ার প্রয়োজন নেই কারণ এই বইটির ভাষা যথেষ্ট স্পষ্ট। সেইসাথে বইটি সালাফী থেকে আশ’আরী, বিভিন্ন সুন্নী গ্রুপকে কোন প্রকার বিতর্কের অবকাশ ছাড়াই একটি সঠিক ভিত্তির উপরে একত্রিত করতে পারে। এখানে হাসান আল বান্না এবং শাইখ ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ীর চিন্তাধারার সাথে শাইখ আযামীর চিন্তাধারার সাযুজ্য পাওয়া যায়।
শাইখ ক্বারদাওয়ী, সাইয়্যিদ সাবিক্ব, সা’ঈদ হাওয়া কিংবা যাইনাব আল গাজালীর সময়কার ইখওয়ানের যে গ্রুপ ছিল, হাসান আল বান্নার এসব ভাবশিষ্যদের প্রতি লক্ষ্য করলে ফিক্বহের ব্যাপারে ইখওয়ানের একটি দৃষ্টিভংগী সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। আর সেটা হচ্ছে, একজন সাধারণ মুসলিম যেখানেই কোন যোগ্যতাসম্পন্ন আলেম পাবে তাকেই অনুসরণ করবে। এর পরোক্ষ অর্থ অনেকটা এরকম যে, একজন সাধারণ মুসলিমকে কোন একটি বিষয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রচলিত চার মাযহাবের একটিকে অনুসরণ করতে হবে। কেননা, বেশীরভাগ আলিমই চার মাযহাবের যেকোন একটিকেই অনুসরণ করে থাকেন। এ অবস্থায় চার মাযহাবের যেকোন একটিকে অনুসরণ করাটা কোন দোষের কিছু না, বিশেষ করে যখন ইজতিহাদ করার যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নেই। সা’ঈদ হাওয়া তাঁর বই ‘জুনদুল্লাহ’ তে সাধারণ মানুষদের চার মাযহাবের যেকোন একটি মাযহাবের মাধ্যমিক পর্যায়ের বোধগম্য ফিক্বহের বই পড়ার কথা বলেছেন। এরপরেও যদি ইজতিহাদ করার যোগ্যতা সম্পন্ন কোন বড় আলেম বা মুফতী পাওয়া যায় তবে তাকেও অনুসরণ করা যেতে পারে যদিও তার কোন কোন মত প্রচলিত মতের বিরোধী হয়। এসব ক্ষেত্রে সেই মুফতী হয়তোবা তারজিহ (পূর্ববর্তী মতসমূহের মধ্যে যেকোন একটি মত গ্রহণ করা যদিও তা চার মাযহাবের বিরুদ্ধে যায়) কিংবা ইজতিহাদের মাধ্যমে নিজের মত গঠন করেন। আযহারী আলেমদের মধ্যে যারা ‘তারজিহ’ এবং ‘ইজতিহাদ’ করেছেন তাদের মধ্যে সাইয়্যিদ সাবিক্ব এবং ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ী অন্যতম। ‘Priorities of Islamic Movement in the coming Phrase’ বইতে শাইখ ক্বারদাওয়ী নিজের এই অবস্থানকে ‘মাযহাবী গোঁড়ামী এবং লা-মাযহাবিয়া এই দুই চরমপন্থার মাঝামাঝি’ হিসেবে তুলে ধরেছেন।
শারী’আহ এবং ফিক্বহের উপর হাসান আল বান্না ও তাঁর শিষ্যদের যে অবস্থান সেটা ৯০ দশকের মাঝ থেকে পাশ্চাত্যের মুসলিমদের মধ্যে চলে আসা ক্লেদাক্ত মাযহাবী বিতর্কের অনেক উর্ধ্বে এবং গভীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন। এই ধরনের মাযহাবী বিতর্কে মূলত আলেমদের মতামত সংক্রান্ত জটিলতাকে অতিসরলীকরণ করে সাধারণ জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়। এর ফলে বিতর্কের এসব জটিল বিষয়গুলোতে কোন গভীর আলোচনা না হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র কিছু স্বস্তা বুলিই কপচানো হয়। অপরকে খালিস ‘সুন্নীপথের’ দিকে হেদায়াত করার নামে অহেতুক মুসলিমদের ঐক্যই দুর্বল করা হয়।
আক্বীদা এবং ফিক্বহের ব্যাপারে হাসান আল বান্না এবং তাঁর ভাবশিষ্যদের যে সামগ্রিক দৃষ্টিভংগী সেটার একটা মূলতত্ত্ব বা ভিত্তি থেকে থাকবে এবং সেটাকে অবশ্যই ইসলামের মূলধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। সেই মূলতত্ত্বটি শাইখ ক্বারদাওয়ী তাঁর বই ‘Priorities of Islamic Movement the Coming Phrase’ এ এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, “এমন একটি ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে ইসলামী পুনঃজাগরণী চিন্তাধারা কখনো হস্তক্ষেপ করার চিন্তা করতে পারে না। সে ক্ষেত্রটি হচ্ছে আল ক্বাত’ইয়াত (সুস্পষ্ট)। এটা হচ্ছে সে ক্ষেত্র যেখানে ইসলাম আক্বীদা, ইবাদাহ ও আহকামের কিছু ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধান দিয়ে দিয়েছে।” ক্বারদাওয়ী তাঁর ‘Islamic Awakening Between Rejection and Extremism’ এ এসব ক্বাত’ইয়াত নিয়েও আলোচনা করেছেন। ইমাম নববীর ভাষায় এসব বিধান হচ্ছে ‘মা ইউ’লাম মিনাদ দ্বীন দারুরাতান’ (যা ইসলামের আবশ্যিক অংশ হিসেবে সুপরিচিত)। এসব বিধান ছাড়াও আরেকধরনের বিধান রয়েছে শাইখ ক্বারদাওয়ীর ভাষায় যেগুলো হচ্ছে যান্নী (পুরোপুরি স্পষ্ট নয়)। এই হুকুমগুলোর ক্ষেত্রে বৈধ পন্থায় ইজতিহাদের ফলে যে মতবিরোধের সূচনা হয় সেটাতে কোন ক্ষতি নেই। কারণ এই ক্ষেত্রে সাহাবীদের যুগ থেকে মতবিরোধ চলে আসছে।
শাইখ ক্বারদাওয়ী হাসান আল বান্নার সাথে এ ব্যাপারে একমত যে, ইসলামের অপ্রাথমিক বিষয়গুলোতে মতবিরোধ কিছু কারণে অবশ্যম্ভাবী। তাই মুসলিমদের উচিত প্রাথমিক বিষয়গুলোর উপর একত্রিত হওয়া এবং অপ্রাথমিক বিষয়গুলোতে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধকে সহনশীল পর্যায়ে রাখা যাতে এই মতবিরোধের কারণে মুসলিমদের ঐক্যে কোনরূপ ফাটল না ধরে। ‘Islamic Awakening Between Rejection and Extremism’ বইতে শাইখ ক্বারদাওয়ী বলেছেন, “ইসলামী আইনের খুব সামান্য অংশই রেওয়ায়েত এবং অর্থের দিক দিয়ে ক্বাত’ইয়াতের মধ্যে পড়ে, এর পিছনে অবশ্যই কোন গভীর প্রজ্ঞা কাজ করছে।” সেজন্যই শাইখ ক্বারদাওয়ীর নেতৃত্বে ‘European Council for Juridical Opinions and Research’ সংস্থাটি পুরোপুরিভাবে উপরোল্লিখিত মূলভিত্তির উপরেই চলছে। এখানে বিভিন্ন মতবিরোধকে সাদরে গ্রহণ করা হয়। শাইখ ক্বারদাওয়ী তাই সবসময়ই এ সংস্থায় তাঁর মত প্রাণবন্ত (যেমন ফায়সাল মালাওয়ী, আবদুল্লাহ জুদাই) এবং রক্ষণশীল (যেমন, সুহাইব হাসান, ইসমাইল কাশলভী) উভয় ধরনের আলেমদের অংশগ্রহণকেই উদুদ্ধ করেছেন। শাইখ তাক্বী উছমানীকেও অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
উপরোল্লোখিত মূলতত্ত্বগুলোর ব্যবহারিক দিকটিই মূলত হাসান আল বান্না এবং তাঁর চিন্তাধারাকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে।
এন্ড্রু বুসোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি লন্ডন অধিবাসী। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স থেকে আইন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এছাড়াও তিনি শাইখ ইকবাল আজামী এবং শাইখ আকরাম হুসাইন নাদওয়ীর ছাত্র। এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড বেইসড “স্প্রিং ফাউন্ডেশন” নামে একটি চ্যারিটি অরগ্যানাইজেশনের এডভাইসারি বোর্ডে আছে। এ সংগঠন মূলত ইসলামী স্টাডিজের ছাত্রদের স্কলারশীপ দিয়ে থাকে।
বিষয়: বিবিধ
১৬০৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে প্রশ্ন করার দরূন কিছু মনে নিবেন না আশা করি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন