ইসলামী পুনর্জাগরণের রূহানী পদ্ধতিঃ হাসান আল বান্না এবং তাঁর চিন্তাধারা – এন্ড্রু বুসো; ২য় পর্বঃ হাসান আল বান্না

লিখেছেন লিখেছেন মির্জা ১৯ আগস্ট, ২০১৪, ১১:৪৩:১৯ রাত

হাসান আল বান্না এমন এক সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যখন মুসলিম বিশ্ব এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। আর তাঁর জন্মস্থান মিশর ছিল সে সময়ে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর একটি। শাইখ আবুল হাসান আন নাদওয়ী তাঁর ‘Western Civilization, Islam and Muslims’ বইতে মিশরকে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন যে, পুরো বিশ্ব উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে এসে মিশরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার ব্যাপারে যথার্থ ছিল। নাদওয়ীর মতে, মিশর এসময় পাশ্চাত্যে বিকশিত হওয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং পূর্বে বিকশিত হওয়া ইসলামের নৈতিক ও রূহানী শিক্ষা এ দুটোর সমন্বয় নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী দেশ ছিল। উল্লেখ্য যে, ইসলামী ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত এই নৈতিক ও রূহানী দিকটি মিশর ইতিমধ্যেই নিজের মধ্যে বিশাল পরিসরে আত্তীকরণ করে নিয়েছিল। নাদওয়ী এ ক্ষেত্রে মিশরের দুটি সুবিধা চিহ্নিত করেন। প্রথমটি হচ্ছে, আরবী ভাষা ও সাহিত্য এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্বের চর্চা ও শিক্ষা প্রসারে মিশরের অগ্রসরতা। সেইসাথে ছিল এসবের প্রচার ও বিস্তারের অবারিত সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান থাকা এবং ইসলামী বিশ্বের অন্যতম জ্ঞানপীঠ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নাদওয়ীর নিজ ভাষায়, মিশরের জনগণের যেকোন প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারাকে আপন করে নেয়ার সহজাত প্রবণতা। কিন্তু, “বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অন্যান্য সংঘটক সম্মিলিতভাবে সেসময় মিশরকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাশ্চাত্যের উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করতে দিচ্ছিল না” এ ব্যাপারে শাইখ নাদওয়ীর চুপ থাকাটা দুঃখজনক। এই প্রবন্ধটি এর উপর বিস্তারিত আলোচনার স্থান নয়। ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ এর ব্যাপারে শাইখ নাদওয়ীর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল খুবই ইতিবাচক। খুবই জটিল এবং ঘোলাটে একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হাসান আল বান্না দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েও, তাঁর মৃত্যুর সময় শুধু মিশরেই এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫ লাখের মত ছিল বলে হাসান আল বান্নার ‘আল মা’ছুরাত’ এর ইংরেজি অনুবাদে এস এম হাসান আল বান্নার ভূমিকা থেকে জানা যায়। আর সহানুভূতিশীল আর মিশরের বাইরের অন্যান্য আরব দেশে ছড়িয়ে যাওয়া এর শাখার সদস্যরা তো আছেই। যদিও নাদওয়ী ইখওয়ানের সক্রিয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঢুকার সিদ্ধান্তকে যথাসময়ের পূর্বেই নেয়া একটি পদক্ষেপ মনে করতেন, এরপরেও নাদওয়ী সেসময়ে নিষেধাজ্ঞা ও জুলুম নিপীড়নের ফলে ইখওয়ানের প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থার ব্যাপারে আক্ষেপ করেছেন এবং এ ব্যাপারটিকে আরব এবং মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। নাদওয়ীর মতে, ইখওয়ান ছিল আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং দ্রুত বর্ধনশীলশীল একটি ইসলামী আন্দোলন। আরবের শীর্ষ ইসলামী চিন্তাবিদদের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেলে পশ্চিম এশিয়ায় ইসলামী পুনঃজাগরণ ঘটানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকরী সংগঠন হতে পারত ইখওয়ান, এমনটাই ধারণা ছিল শাইখ নাদওয়ীর। শাইখ নাদওয়ী তাঁর ‘Islamic Studies, Orientalists and Muslim Scholars’ বইতে হাসান আল বান্নার চিন্তাধারার সরাসরি উত্তরসূরীদের মধ্যে কয়েকজনের লিখিত বইয়ের প্রতি তাঁর নিজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরেন। তাঁর নিজের ভাষায়, “আরো তিনটি অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাষা অনন্য কর্ম হচ্ছে ড. মুস্তাফা আস সিবাঈ’র ‘আল মার’আতু বাইনাল ফিক্বহি ওয়াল কানুন’ (ফিক্বহ ও ইসলামী আইনের আলোকে নারী), মুস্তাফা আহমাদ আয যারক্বার ‘আল মাদখালুল ফিক্বহীল ’আম’ এবং আব্দুল ক্বাদির আওদাহর ‘আত তাশরী’উল জিনা’ঈল ইসলামী মুক্বারনা বিল কানুনিল ওয়াজা’ঈ’, যেগুলো মূলত লেখকদের চিন্তার গভীরতা প্রকাশ করে।” নাদওয়ী ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে জামালুদ্দীন আফগানী এবং মুহাম্মাদ আবদুহর পুনঃজাগরণবাদী চিন্তাধারার আরো উন্নত সংস্করণ বলে মনে করতেন। যদিও নাদওয়ীর মতে, জামালুদ্দীন আফগানীর চিন্তাধারা ছিল অতি রাজনীতি কেন্দ্রিক ছিল আর মুহাম্মাদ আবদুহ ছিলেন নাদওয়ীর কাছে, অতি রক্ষণশীল এবং আরব বিশ্বে মডার্নিষ্ট আন্দোলনের অগ্রদূতদের একজন, যা তাকে নাদওয়ীর চোখে ভারতীয় উপমহাদেশের স্যার সাইয়েদ আহমেদ খানের সমকাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।

আমি শাইখ নাদওয়ীর বিচার-বিশ্লেষণের উপরে ভরসা করেছি দুটি কারণে। প্রথমত, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ আলিম এবং ইতিহাসবিদ। দ্বিতীয়ত, ইখওয়ানের আন্দোলনের প্রতি শাইখের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী, যে আন্দোলনের সদস্য তিনি অবশ্যই ছিলেন না। আর এ ব্যাপারটাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে যে, শাইখ নাদওয়ী ইসলামী পুনঃজাগরণের শর্ত হিসেবে রূহানী পুনঃজাগরণকে আবশ্যক মনে করতেন। শাইখ নাদওয়ীর চারখন্ডে লেখা ‘Saviors of Islamic Spirit’ বইটি বিশেষ করে এর শেষ আড়াইখন্ডে মুসলিমদের প্রতি রূহানী দিকগুলো উন্নত করার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করার নাদওয়ীর আহবানই হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কেউ অবশ্য এটা দাবী করতে পারে না যে, ইখওয়ানের রূহানী প্রশিক্ষণের যে পদ্ধতি ছিল তার খুঁটিনাটি সবকিছুর প্রতিই ছিল শাইখ নাদওয়ীর পূর্ণ সমর্থন। কিন্তু যেহেতু নাদওয়ী ইখওয়ানকে ইসলামী পুনঃজাগরণ ঘটানোর জন্য কার্যকর একটি সংগঠন বলে মনে করতেন, অতএব এ থেকেই বুঝা যায় যে, তিনি ব্যাপকভাবে ইখওয়ানের রূহানী প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর বিপক্ষে ছিলেন না।

হাসান আল বান্না ছিলেন তাঁর সময়কার বিভিন্ন চিন্তাধারার একটি জলজ্ব্যান্ত ফসল। কিন্তু, তিনি এর কোনটির প্রতিও ঝুঁকে পড়েছিলেন, এমন দাবী কেউ করতে পারবেনা। এর ফলে তিনি এমন একজন স্বাধীনচিন্তাসম্পন্ন একজন নেতা হতে পেরেছিলেন যিনি তাঁর চারপাশের চিন্তাধারা থেকে বেখবর ছিলেন না। তিনি এসবের মধ্য থেকে যেটা উপকারী সেটা গ্রহণ করেছিলেন এবং যেটা পরিহার করার সেটা পরিহার করেছেন। এজন্যই ইখওয়ানের পঞ্চম কনফারেন্সে তাঁর এরূপ ঘোষণা শুনে কেউ অবাক হয়নি যে, “আমাদের আন্দোলন একটি সালাফী দা’ওয়াহ, একটি সুন্নী পথ এবং একটি সত্যিকার তাসাওউফ”। এরপরেও হাসান আল বান্নার উপর তাঁর পিতা শাইখ আহমাদ আল বান্নার প্রশিক্ষণের প্রভাব কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। শাইখ আহমাদ তাঁর ছেলের ছোটকাল থেকেই তাঁর ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষার জন্য একটি বিশাল সিলেবাস প্রণয়ন করেন। শাইখ আহমাদ আল বান্না ছিলেন একজন হাম্বালী মাযহাবের অনুসারী আযহারী আলেম। শাইখ নাদওয়ী তাঁর ‘Islamic Studies, Orientalists and Muslim Scholars’ বইতে অত্যন্ত প্রশংসার সাথে শাইখ আহমাদ আল বান্না দ্বারা কৃত মুসনাদ আহমাদ বিন হাম্বাল এর পুনঃবিন্যাস এবং ব্যাখ্যার কথা উল্লেখ করেন এবং তাঁর এ কাজ এ যুগের চাহিদা মেটাতে সক্ষম বলে উল্লেখ করেন। এটাও বলেন যে, “দুঃখজনক ব্যাপার হল তাঁর এ কাজটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায় কিন্তু এরপরেও তা ২২ খন্ডে প্রকাশিত হয়।”

মূলত হাসান আল বান্নার উপর তাঁর পিতা দ্বারা কৃত লালনপালন এবং প্রশিক্ষণের ফল এই হয়েছিল যে, হাসান আল বান্না নিজে আযহারী আলেম না হলেও তাঁর চিন্তাধারা এবং আন্দোলন সবসময়ই কর্তৃত্বশীল উলামা এবং বিশেষ করে আল আযহারের আলেমদের (যেমনঃ মুস্তাফা আস সিবা’ঈ, আব্দুল ক্বাদির আওদাহ, আব্দাল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ, সায়্যিদ সাবিক্ব, মুহাম্মাদ আল গাযালী, আবদুল্লাহ ইউসুফ আযযাম, ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ী) দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। আল আযহারের আলেমদের প্রতি হাসান আল বান্নার দৃষ্টীভঙ্গী বর্ণনা করে শাইখ ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ী তাঁর ‘Priorities of Islamic Movement in the Coming Phase’ বইয়ে বলেন, “হাসান আল বান্না সবসময়ই আল আযহারের আলেমদের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী ছিলেন। আল আযহারের আলেমদের মধ্যে তাঁর অনেক ভালো বন্ধুও ছিল। একবার তানতায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে আমি তাঁকে আযহারী আলেমদের সম্বোধন করে বলতে শুনেছি, “হে আলেমগণ, আপনারা হচ্ছেন ইসলামের নিয়মিত সৈনিক। আর আমরা হচ্ছি আপনাদের পিছে অবস্থিত সংরক্ষিত সেনাবাহিনী।”” আল আযহারের প্রতি ইখওয়ানের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়, হাসান আল বান্নার একনিষ্ঠ অনুসারী যায়নাব আল গাজালীর বই ‘Return of the Pharaoh: Memoir in Nasir’s Prison’ এ। যেখানে তিনি সবরকমের দাওয়াহ এবং ইসলামী শিক্ষামূলক কর্মসূচীগুলোর ব্যাপারে আযহারী আলেম শাইখ মুহাম্মাদ আল আওদানের সাথে পরামর্শ করতেন বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও, শাইখ আওদান ইখওয়ানের সাথে যায়নাব আল গাজালীর সম্পৃক্ততার কথা জানতেন এবং এটাকে শাইখ আওদান স্পষ্টভাবে সমর্থনও করতেন। শাইখ ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ী তাঁর ‘Priorities of Islamic Movement in the Coming Phase’ বইতে, তাঁর সমচিন্তার অধিকারীদের কাছে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন কর্তৃত্বশীল ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমনঃ আল আযহার, তিউনিসিয়ার আয যাইতুনিয়া, মরক্কোর আল ক্বারউইনিয়াহ এবং ভারতের দেওবন্দকে নিজেদের পক্ষে আনার গুরুত্ব তুলে ধরেন। অবশ্য শাইখ ক্বারদাওয়ী এটাও বলেন যে, “তবে এটি সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় যারা দুনিয়ার বিনিময়ে নিজেদের দ্বীনকে বিক্রয় করে দিয়েছে এবং জালিম ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের মুখপাত্র ও অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মুখোশ জনগণের সামনে উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য অবিরাম সচেষ্ট থাকতে হবে যাতে জনগণ তাদের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে পারে।” (অবশ্য শাইখ ক্বারদাওয়ী সেসব আলিমদের পৃথক করেছেন যারা তাদের দুর্বলতা এবং ভয়ের কারণে সত্য প্রকাশ থেকে নিবৃত্ত থাকেন কিন্তু তাদের থেকে কখনো অন্যায় ও মিথ্যার সমর্থনও পাওয়া যায় না।)

যাইহোক এটাও পরিস্কার যে, হাসান আল বান্নার উপর তাঁর পিতার প্রভাব শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়েই ছিল না, আধ্যাত্মিক দিক দিয়েও তা ছিল সুস্পষ্ট। এর প্রমাণ পাওয়া যায় হাসান আল বান্নার স্মৃতিচারণ থেকে, যেটি যাকারিয়া সিদ্দিকী হাসান আল বান্না রচিত ‘আল মা’ছুরাত’ এর অনুবাদের এর শুরুর দিকে উদ্ধৃত করেছেন। হাসান আল বান্না বলেন, “আমি প্রতিদিন সকালে এবং সন্ধ্যায় আহমাদ যাররুকের ওয়াজিফা পাঠ করতাম। আমার পিতা এর উপর একটি সুন্দর ব্যাখ্যাও লিখেন। সহীহ হাদীছ থেকে তিনি ওয়াজিফার প্রায় প্রত্যেকটা দু’আর সমর্থনে উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন।” এই আহমাদ যাররুক ছিলেন একজন বিখ্যাত মালিকী ফক্বীহ এবং সূফী। এ থেকে পিতা-পুত্র দুজনের উপরেই সূফীবাদের প্রভাব প্রতীয়মান হয় এবং যেটার প্রতিফলন পুত্রের জীবনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল এবং যেটার ভাবধারাকে তিনি তাঁর আন্দোলনেও অন্তর্ভুক্ত করে যেতে চেষ্টা করেন।

আন্দোলনের কর্মীদের প্রতি হাসান আল বান্নার যেসব দিকনির্দেশনা আছে সেগুলো পাঠ করলে জানা যায় যে, তিনি জ্ঞান আহরণ, যেটা রূহানীয়াতের ভিত্তি, এবং আমল আস সালিহ, যেটা রূহের পরিপুষ্টি সাধনে ভূমিকা রাখে, এই দুটি জিনিসের উপর জোর দিতেন। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে তিনি ক্বুরআনের অর্থের উপর চিন্তাভাবনা, সীরাতে রাসূল (দ), সালাফদের জীবনী, হাদীছ, আক্বীদা এবং ফিক্বহ এগুলোর উপর পড়াশোনা করাকে আবশ্যক ঘোষণা করেন। আর আমল আস সালিহ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশনা ছিল বিস্তৃত। তাঁর ভাষায়, “দিনে অন্তত এক পারা করে ক্বুর’আন পাঠ করতে হবে……যাতে সর্বোচ্চ এক মাসে এবং সর্বনিম্ন তিন-চারদিনে ক্বুরআন অন্তত একবার খতম হয়।” তাছাড়াও অন্যান্য দিক নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা, সত্যবাদী হওয়া, স্ব-নির্ভরশীল হওয়া, সাহসী এবং সচ্চরিত্রবান হওয়া। এছাড়াও আছে, সবসময় বিশুদ্ধ হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তন করা, সমাজ থেকে উঠে যাওয়া কোন সুন্নাহর পুনর্জীবনের জন্য কাজ করা, সমাজে প্রতিষ্ঠিত অনৈসলামিক রীতিনীতির মূলোচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করা, প্রতিনিয়ত আল্লাহকে স্মরণ করা, আন্দোলনের মহান কাজে তাহাজ্জুদের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা, সুন্নাহ অনুযায়ী মাসে তিনদিন নফল রোযা রাখা, অন্তরে এবং জিহবা দ্বারা প্রতিনিয়ত আল্লাহর যিকর করা, রাসূলের (দ) শিখানো দু’আ গুলো প্রতিনিয়ত আওড়ানো, কৃত গুনাহগুলোর জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, ঘুমানোর আগে সারাদিনে করা নিজের ভালো ও মন্দ কাজের হিসাব নেয়া সংক্ষেপে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ মেনে চলা।

যে কেউই ইসলামী রূহানীয়াতের বিভিন্ন দিক যেমন ফানা, বাক্বা, রূহানীয়াতর উঁচু স্তরের চেতনা, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁর উপর নির্ভরতা এসব নিয়ে তত্ত্বকথা বলতে পারে। কিন্তু এরকম চমৎকারিত্ব শুধুমাত্র বক্তার আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে, তাঁর ব্যাক্তিগত জীবনে এর প্রতিফলন হয়তোবা নাও দেখা যেতে পারে। আল্লাহ আমাদের এ থেকে রক্ষা করুক। ইসলামী রূহানীয়াত শুধুমাত্র আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না, কিংবা এটি স্রেফ মরমীবাদ এবং কারামতের সমষ্টিও নয়, যেমনটি কিনা আজকাল পাশ্চাত্যে ভাবা হয়। ইসলামী রূহানীয়াত মূলত সকল ওহী নির্দেশিত সকল ভালোগুণের বাস্তব প্রতিফলন। হাসান আল বান্নার উপর লেখা বইগুলো ছাড়াও এর তাঁর প্রশিক্ষণের প্রভাব আর যে বইতে ফুটে উঠেছে সেটি হচ্ছে, যায়নাব আল গাজালীর ‘Return of the Pharaoh: Memoir in Nasir’s Prison’। এ বইয়ে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মিশরের জেলগুলোতে ইখওয়ানের কর্মীদের উপর নির্মম অত্যাচারের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এ অত্যাচার ছিল শুধুমাত্র তাদের আরব-সোভিয়েত-সমাজতন্ত্রকে প্রত্যাহার করার কারণে। এই বইয়ের বর্ণনা সম্ভবত হাসান আল বান্নার রুহানী প্রভাবের সবচেয়ে বড় সাক্ষী এবং বিবৃতিদাতা, যদিও অনেকে এই মহিয়সীর রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে মতপার্থক্য পোষণ করতে পারেন। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন। বাস্তব ও সক্রিয় জীবন থেকে অনেক দূরে নিজ ছোট কক্ষে একাকীত্বে বাস করে প্রশান্তির সাথে নিজের আধ্যাত্মিক স্তরগুলোর কথা বর্ণনা করা যেতে পারে। কিন্তু মানুষ এবং পশুদের চরমতম অত্যাচারের মুখেও আল্লাহর উপর নিশ্চয়তার সুধা অনুভব করা নিঃসন্দেহে যেকারো দৃষ্টি আকর্ষণ করার যোগ্য। যায়নাব আল গাজালীর বইয়ের ঘটনাবলী বাস্তব, এটি কোন ভাবপ্রবণ রচনা নয়। রূহানীয়াতের অসাধারণ কিছু তত্ত্বকথার উপর ভিত্তি করে এই বইয়ের প্রামাণিক ও বাস্তব কাহিনীগুলো ফুটে উঠেছে। ঈমান, ইখলাস, তাওয়াক্কুল, সাবর, মাহাব্বাহ, ফানা, বাক্বা, যাওক্ব ইত্যাদিই হচ্ছে সেসব তত্ত্ব। যেগুলো ক্বুশাইরীর ‘রিসালাহ’, ইবনে আতা’ঈল্লাহর ‘হিকাম’ কিংবা আল গাজালীর ‘ইহইয়া’ খুঁজলে যেকেউ পেয়ে যাবে। সেজন্যই রুহানী উন্নতির এই পুনঃজাগরণবাদী এবং প্রাণবন্ত পদ্ধতির উপর আমাদের দৃষ্টিনিবদ্ধ করা যথার্থ কেননা এর ফলপ্রসূতার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

[চলবে]

এন্ড্রু বুসোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি লন্ডন অধিবাসী। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স থেকে আইন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এছাড়াও তিনি শাইখ ইকবাল আজামী এবং শাইখ আকরাম হুসাইন নাদওয়ীর ছাত্র। এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড বেইসড “স্প্রিং ফাউন্ডেশন” নামে একটি চ্যারিটি অরগ্যানাইজেশনের এডভাইসারি বোর্ডে আছে। এ সংগঠন মূলত ইসলামী স্টাডিজের ছাত্রদের স্কলারশীপ দিয়ে থাকে।

বিষয়: বিবিধ

১৭০৮ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

256140
২০ আগস্ট ২০১৪ রাত ১২:১০
আহমাদ আল সাবা লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ অসাধারণ এই লেখাটির জন্য। ইসলামী আন্দোলনের মুসলিম বিশ্বে ইখওয়ানুল মুসলিমিনের অবদান অনেক গভীরে। বিশেষত তারা যেসব ইসলামী স্কলার তৈরি করেছেন এই সংগঠনের ভেতরে থেকে তাঁর তুলনা হয় না- কারাদাওয়ী, আস-সিবাই, সাইয়িদ সাবিক , সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মাদ কুতুব। আল্লাহ আপনাকে উত্তম জাজা দিন।
২০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৪:২৭
199771
মির্জা লিখেছেন : ওয়া ইয়্যাকা
২০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৬:৫৯
199784
কাহাফ লিখেছেন : আমিন..........।
256188
২০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০২:৩৬
সুশীল লিখেছেন : গভীর পান্ডত্যের লেখা মনে হচ্ছে। চলুক
২০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৪:২৭
199772
মির্জা লিখেছেন : কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
256212
২০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৬:৫৯
কাহাফ লিখেছেন : নিজের প্রয়োজনেই এমন লেখা পড়া হয়,ধন্যবাদ ভাই আপনাকে।
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৪৪
200529
মির্জা লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য।
256214
২০ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:১৪
মনসুর আহামেদ লিখেছেন : চমৎকার লেখা ,ইখওয়ানের কর্মীদের উপর নির্মম অত্যাচারের ভয়াবহতা আজও হচ্ছে। পৃথিবীর কোথায় সূর্য উদয় হলেও। পরক্ষনে মনে হয়, মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। জানি না আশার আলো কতদুরে। যে সব ইসলামী স্কলার তৈরি হয়েছে।
এদের দ্বারা কোন ইসলামী বিপ্লব হবে কিনা।
জানি না। আল্লাহ জানেন মাএ।
২১ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৪৭
200532
মির্জা লিখেছেন : বিপ্লবের জন্য কেবল প্রায়োগিক কর্মই যথেষ্ট নয়; তাত্ত্বিকতা, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনারও প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে ইসলামী বিপ্লবের জন্য তো সেগুলোর প্রয়োজন আরো বেশী। এক্ষেত্রে আলেমদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File