ইসলামী পুনর্জাগরণের রূহানী পদ্ধতিঃ হাসান আল বান্না এবং তাঁর চিন্তাধারা – এন্ড্রু বুসো ১ম পর্বঃ ভূমিকা
লিখেছেন লিখেছেন মির্জা ১৭ আগস্ট, ২০১৪, ০৯:৫১:২০ সকাল
যদিও আমি হাসান আল বান্নার সাথে দূরতম সম্পর্কিত কোন সংগঠনের সাথে জড়িত না, এরপরেও তাঁর পরিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং বর্তমান পৃথিবীতে তাঁর যে সুগভীর প্রভাব আছে সেটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ আমার নেই। হাসান আল বান্না এখনো কেন এতটা প্রাসঙ্গিক সেটার অন্তর্নিহিত কারণ জানতে হলে তাঁর এবং তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তাধারার উপর গভীরভাবে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। নৈতিক ও বাস্তবিক বিশৃংখলায় জর্জরিত আমাদের এই যুগের আশু চিকিৎসার প্রয়োজন। আল-বান্না হচ্ছে সে সময়ের ব্যাক্তি যখন বিভিন্ন ব্যাক্তি এবং গ্রুপ বিশুদ্ধ ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের সে পর্যায়ে শুধুমাত্র আল-বান্নাই সম্ভবত তাঁর অন্তর্দৃষ্টি এবং কাজের মেধা ও গুরুত্ব দ্বারা সবচেয়ে স্বতন্ত্র স্থান দখল করে নিয়েছিলেন যা কিনা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বর্তমান ইসলামপন্থীদের মধ্যে অনেকেই আলবান্নার উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদের দাবী করে থাকেন। যদিও “ইসলামপন্থী” শব্দটা একটা আতংক সৃষ্টিকারী শব্দ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং এই শব্দের ব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। একজন নিরপেক্ষ ইংরেজ হিসেবে আমি হাসান আল বান্নার চিন্তাধারাকে ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক পর্যায়ে উপকারী বলে মনে করি। দা গার্ডিয়ান পত্রিকায় সুমাস মিল এর লেখা একটি আর্টিকেল অনুযায়ী, ব্রিটিশ পুলিশের সিনিয়র ব্যাক্তি এবং মুসলিম কমিউনিটিতে সন্ত্রাসবাদ দমনে নিয়োজিত স্পেশাল ব্রেঞ্চ এর লোকজনও এটাই মনে করেন যে, হাসান আল বান্নার চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত মধ্যপন্থী ইসলামী সংগঠনগুলো চরমপন্থা দমনে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিষেধকের ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই এসব সংগঠনগুলো হাসান আল বান্নার চিন্তাধারা যতটা নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারে ততই তা আমাদের জন্য স্বস্তির বিষয়।
মূলত, হাসান আল বান্না এবং তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু উত্তরসূরীর অনুসৃত রূহানী পন্থা হচ্ছে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের বিস্তৃত গন্ডীর আওতাভুক্ত এমন এক পন্থা যেটার আছে বিভিন্ন বিতর্কিত এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধা করার অসাধারণ এবং অনন্য ক্ষমতা। যে পন্থা মূলতই যুক্তিগ্রাহ্য, পান্ডিত্যপূর্ণ এবং ইসলামের মূল উৎসগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আসলে এই বিষয়টিই হাসান আল বান্না এবং তাঁর কর্মপন্থার সুগভীর প্রভাবের মূল কারণ ব্যাখ্যা করে। অবশ্যই তাঁর প্রতিটি মতের সাথে একমত হওয়া জরুরী নয়, কিন্তু আমরা তাঁকে এবং একইসাথে তাঁর এবং তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরসূরীদের যেসব বিষয়ের সাথে মতপার্থক্য করা যায়, সেগুলোকে বুঝার মাধ্যমে উপকৃত হতে পারি। শাইখ ক্বারদাওয়ী, হাসান আল বান্না দ্বারা এতটা প্রভাবিত হয়েছেন যে, তিনি তাঁর “Priorities of Islamic Movement in the Coming Phase” বইতে লিখেছেন যে, “শাইখ মুহাম্মাদ আল গাজ্জালী হাসান আল বান্নাকে চতুর্দশ ইসলামী শতকের মুজাদ্দিদ মনে করার ব্যাপারে সঠিক ছিলেন।” এটি মূলত আবু দাউদ এবং মুস্তাদরাক আল হাকিম এর সেই হাদীছের সূত্র ধরে, যেখানে বলা হয়েছে, “আল্লাহ প্রতি শতকের শুরুতে উম্মাহর মধ্যে এমন একজনকে পাঠাবেন যিনি কিনা এর দ্বীনকে পুনরজ্জীবিত করবেন।” শায়খ ইউসুফ আল ক্বারদাওয়ীর তাঁর “Approaching The Sunnah” বইতে বলেছেন, এই হাদীছ একাধিক মুহাদ্দিছের মতে সহীহ।
আমি এই লেখায় শুধুমাত্র হাসান আল বান্নার রূহানী চিন্তাধারার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করব। কেননা যেকোন সঠিক বিশুদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস অবশ্যই রূহানী বিষয়গুলোর উপর সবসময় বেশী জোর দিবে এবং একে সবার উপর অগ্রাধিকার দিবে। ইসলামের দাওয়াতও প্রাথমিকভাবে রূহানী। কিতাবুল্লাহও এরই সাক্ষী দেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর কিতাবে বলেনঃ
“নিশ্চয়ই মানুষ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু তারা ব্যতীত যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্য ও ধৈর্য্যের দিকে আহবান করে।” [সূরা আসর]
অতএব দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বাসই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত করার প্রাথমিক ভিত্তি। কিন্তু ঈমানদারদের উপর আল্লাহর আইন মেনে চলারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ আমাদের এটাই শিক্ষা দিয়েছেন যে, তাঁর কিতাব, যা বিশ্বাস ও আইন উভয়টাই প্রণয়ন করে, হচ্ছে অন্তরের নিরাময়। আল্লাহ বলেনঃ
“হে মানবজাতি, তোমাদের জন্য তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে উপদেশ যা অন্তরের জন্য নিরাময়স্বরূপ এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথপ্রদ্রর্শক এবং রহমতস্বরূপ।” [ক্বুরআন: ১০:৫৭]
আমরাও এটাও জানতে পারি যে, ঈমান আনার যোগ্যতা নিজেই একটি সুস্থ রূহানীয়াতের চিহ্ন। “তারা কি পৃথিবীতে বিচরণ করে না যাতে তারা অনুধাবন করার জন্য উপযোগী হৃদয় এবং শ্রবণশক্তি লাভ করতে পারে? বস্তুত চর্মচক্ষু তো অন্ধ হয় না, বক্ষস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়ে থাকে।” [সূরা হাজ্জ্ব: ৪৬] প্রত্যেককেই নিজ অন্তরের পরিশুদ্ধিতার জন্য আল্লাহর উপর নির্ভর করতে হয়। যা অর্জন করার সরাসরি ফল হচ্ছে, আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদের (সাঃ) মাধ্যমে যে ফরয ও ওয়াজিব পাঠিয়েছেন সেগুলোর প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া। “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন” [ক্বুরআন: ১৩:২৭]। আবার সবার এটাও মাথায় রাখা উচিত যে, “আল্লাহ পরম দয়াশীল এবং করুণাময়।” [ক্বুর’আন: ৫৯:২২] এবং “তোমার রব কখনোই তাঁর বান্দাদের প্রতি অবিচার করেন না” [ক্বুরআন: ৪১:৪৬] সেজন্য যেকারোরই কাজের সাথে তার আধ্যাত্মিকতার গভীর এবং স্বতন্ত্র একটি সম্পর্ক রয়েছে যা কিনা ইব্রাহীম (আঃ) এর দু’আর মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে উঠে। “হে আল্লাহ, আমাকে পুনঃরুত্থান দিবসে লাঞ্ছিত করো না, যে দিন সম্পদ এবং সন্তানাদি কোন কাজে আসবে না। কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহর কাছে আসবে সে ব্যতীত।” [ক্বুরআন: ২৬:৮৩-৮৯]। আধ্যাত্মিকতার পার্থিব উপকারিতার কথাও মানুষকে জানানো হয়েছে। “যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রাখ আল্লাহর স্মরণেই আছে অন্তরসমূহের জন্য প্রশান্তি” [ক্বুরআন: ১৩:২৮]
[চলবে]
এন্ড্রু বুসোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি লন্ডন অধিবাসী। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স থেকে আইন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এছাড়াও তিনি শাইখ ইকবাল আজামী এবং শাইখ আকরাম হুসাইন নাদওয়ীর ছাত্র। এছাড়াও তিনি ইংল্যান্ড বেইসড “স্প্রিং ফাউন্ডেশন” নামে একটি চ্যারিটি অরগ্যানাইজেশনের এডভাইসারি বোর্ডে আছে। এ সংগঠন মূলত ইসলামী স্টাডিজের ছাত্রদের স্কলারশীপ দিয়ে থাকে।
বিষয়: বিবিধ
১৫৭০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন