হুরপরী, কোরআন ও ফ্ল্যাট পৃথিবী

লিখেছেন লিখেছেন মির্জা ২৫ এপ্রিল, ২০১৩, ০৪:০১:৩০ রাত

ব্লগের বিশিষ্ট বিদূষী (!) ব্লগার সম্মানিতা হুরপরী প্রায়ই ইসলাম নিয়ে জ্ঞানগর্দভমূলক (!) পোষ্ট দিয়ে থাকেন। উনার সাম্প্রতিক পোষ্ট “ডিম্বের সন্ধানে ডাঃ জাকির(জোকার) নায়েক এবং রাশেদ খালীফা।” – এ সূরা নাযিয়াত এর ৩০ নম্বর আয়াতঃ

وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَٰلِكَ دَحَاهَا

অর্থঃ এরপর তিনি পৃথিবীকে করেছেন ‘দাহা’।

এই ‘দাহা’ শব্দের অর্থ ড. যাকির নায়েক এবং রাশেদ খলিফা করেছেন ‘ডিম্বাকৃতি দিয়েছেন’। কিন্তু বেশীরভাগ অনুবাদকগণই এর অনুবাদ করেছেন, ‘বিস্তৃত করেছেন’। তাই জাকির নায়েকের ‘ডিম্বাকৃতি দিয়েছেন’ অনুবাদকে হুরপরী কোরআনের অনুবাদ নিয়ে ধানাই পানাই বলে অভিহিত করেছেন। সেইসাথে //আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে যতই contradict করুক না কেন কোরআনের বিকৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। যা লেখা আছে তাই মেনে নিতে হবেই।// এ কথা বলে সূক্ষ্মভাবে এটাও ইংগিত করেছেন যে, কোরআনের দেয়া তথ্য পৃথিবীর আকৃতির ব্যাপারে আধুনিক বিজ্ঞানের দেয়া তথ্যের সাথে সাংঘর্ষিক।

পয়েন্ট ১ – কোরআনে পৃথিবীকে গোলক বলা হয়েছে এটা প্রমাণের জন্য কি আদৌ ডিম্ব খুঁজে আনার প্রয়োজন আছে?

এর উত্তর হচ্ছে না। পৃথিবী যে সমতল না বরং গোলক তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত নিম্নের আয়াতটিতে দেয়া আছেঃ

يُكَوِّرُ اللَّيْلَ عَلَى النَّهَارِ وَيُكَوِّرُ النَّهَارَ عَلَى اللَّيْلِ

অর্থঃ “তিনি রাত্রিকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত (wrap) করেন এবং দিবসকে আচ্ছাদিত (wrap) করেন রাত্রি দিয়ে।” [৩৯:৫]

এখানে আচ্ছাদিত করা যে শব্দটি কোরআনে ব্যবহৃত হয়েছে তা হচ্ছে ‘كوّر’ যার অর্থ হচ্ছে গোলাকারে ঘুরানো। (مبالغة বা নিবিড়তা/ প্রচন্ডতা অর্থে)

যখন বলা হয়, "كوّر العمامة علي رأسه" তখন এর মানে দাঁড়ায়ঃ “সে পাগড়িটি অনেকবার তার মাথায় বাঁধল”। যখন বলা হয়, كوّر شيء তখন এর মানে দাঁড়ায়, “সে জিনিসটি গোলাকারভাবে পেঁচালো/বাঁধল”

এর মানে দাঁড়ায়, কোরআনের মতে, রাত ও দিনের আবর্তন পুরো পৃথিবী জুড়ে চলা একটি যুগপৎ অবিরাম প্রক্রিয়া, অনেকটাই মাথায় পাগড়ি বাঁধার মত। আর এটি তখনই সম্ভব যখন পৃথিবী গোলাকৃতি হবে। পৃথিবী ফ্ল্যাট হলে রাত ও দিনের আবর্তন হঠাৎ হঠাৎ হত।

কোরআনের মতে পুরো পৃথিবীর আকার যদি ফ্ল্যাট হত তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা “يكوّر”এর জায়গায় ‘يُبَدِّلُ’ বা ‘يُبْدِلُ’ ব্যবহার করতেন, যার অর্থ হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে/হঠাৎ পরিবর্তন করা।

তাহলে কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় যে পৃথিবীকে (أرض) কে বিস্তৃত, বিছানা ইত্যাদি বলা হয়েছে [যেখান থেকে অনেকেই কোরআনে পৃথিবীকে ফ্ল্যাট বলা হয়েছে ভুল ধারণ করে থাকেন] এর অর্থ কি?

কোরআনে أرض শব্দটি এসেছে ৪৬১ বার। যে আয়াতগুলোতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তার বেশীরভাগেই আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহর কতৃত্বের কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ ৭:১১০, ১৪:১৩, ২০:৫৭, ২০:৬৩, ২৬:৩৫, ২৮:৫৭। আবার কিছু কিছু আয়াতে রূপকভাবে পৃথিবীর জীবনকে বুঝানো হয়েছে। যেমন, ৯:৩৮। আবার, أرض ব্যবহৃত যেসব আয়াতে পৃথিবীর আকার ও প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে সেগুলোকে দুভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের আয়াতে أرض শব্দটিকে নদী, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদির সাথে ব্যবহার করা হয়েছে। এসব আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে পৃথিবীকে কিভাবে মানুষের জন্য উপযোগী এবং উপকারী হিসেবে তৈরী করা হয়েছে সে বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এসব আয়াতে কোরআন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে পৃথিবীর ততটুকু অংশের দিকে যা একজন দর্শকের চোখে ধরা পড়ে তথা ভূ-পৃষ্ঠ (Land Surface)। এসব আয়াতে পুরো পৃথিবীর আকারের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। অন্যদিকে কিছু আয়াত আছে যেগুলোতে পৃথিবীকে সূর্য, চন্দ্র, কক্ষপথ, মহাবিশ্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব আয়াতে পৃথিবীকে পুরো একটি ইউনিট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এসব আয়াত থেকে পৃথিবীর আকার, অবস্থান এমনকি গতি সম্বন্ধেও গুরুত্বপূর্ণ সূক্ষ্ম ইঙ্গিত পাওয়া যায় যেমনঃ ২১:৩০, ৩৯:৫, ৩৫:৪১ ইত্যাদি

অতএব, দেখা যাচ্ছে সূরা নাযিয়াতের ৩০ নং আয়াতে ‘দাহা’ এর অর্থ ‘ডিম্বাকৃতি দান করেছেন’ না দিয়ে ‘বিস্তৃত করেছেন’ ধরলেও তেমন কিছু আসে যায় না। মজার ব্যাপার হল জনাবা হুরপরী যেসব অনুবাদ দিয়েছেন তার মধ্যে Ali Unal এর অনুবাদেও ‘ডিম্বাকৃতি দান করা’ এর ব্যাপারটা এসেছে। [And after that He has spread out the earth in the egg-shape (for habitability)] এমনকি মদীনা ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের প্রফেসর মরহুম মুহাম্মাদ মোহর আলীও (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর কোরআনের অনুবাদে এ আয়াতের অর্থ জাকির নায়েকের মতই করেছেন।

دحا শব্দের অর্থ আরো কয়েকটি অর্থ আছে যেগুলো পৃথিবীর উপর প্রয়োগ করলে এটি সম্পূর্ণভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের দেয়া তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কিন্তু সেগুলো বিস্তৃত আকারে আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। তবে دحا শব্দের ধাতুগত মূল دح থেকে উৎপন্ন অনেক শব্দই গোলাকার অর্থ প্রকাশ করে। যেমনঃ

১) اندح بطنه اندحاحا أي اتسع অর্থঃ তার পেট গোল ও বড় হয়ে গেলো

২)হাদীছে এসেছেঃ كان لأسامة بطن مندح أي متسع অর্থঃ উসামা গোল ও বড় পেটের অধিকারী ছিল

৩) رجل دحدحُ اي قصير غليظ البطن অর্থঃ দাহদাহুন ব্যাক্তি হচ্ছে সে যে খাটো, গাট্টা গোট্টা এবং বড় ও মোটা পেটের অধিকারী।

৪) الدحداح هو المستدير الململ অর্থঃ দাহদাহ হচ্ছে সে, যে গোলগাল, গাট্টাগোট্টা।

তাছাড়া, دحا শব্দটি পরোক্ষভাবেও ‘ডিম্বাকৃতি দান করা’ হতে পারে যেহেতু, دحا শব্দটির Noun of Place and Time مدحًي শব্দের অর্থ হচ্ছে উটপাখির ডিম পাড়ার স্থান।

পরিশেষে কেউ যদি বলতে চায়, আল্লাহ কোরআনে কেন সরাসরি আয়াত নাযিল করেন নি, যে তিনি পৃথিবীকে গোলাকার হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে এটার জবাব হল, কোরআন কোন বিজ্ঞানের গ্রন্থ নয়। কোরআন কোন বৈজ্ঞানিক থিওরী ও ইকুয়েশনও দিতে আসে নি। কোরআন এসেছে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিতে। যেমনঃ মানব জীবনের উদ্দেশ্য কি? সে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য চলার পথে জীবনের সর্বক্ষেত্রে যেসব মূলনীতি ও আইন দরকার সেগুলোর সন্ধান দিতে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় আবিস্কার করার বিষয়টি আল্লাহ মানুষের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেনঃ

قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ بَدَأَ الْخَلْقَ ۚ ثُمَّ اللَّهُ يُنشِئُ النَّشْأَةَ الْآخِرَةَ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

অর্থঃ “বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুর্নবার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।” [২৯:২০]

বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়টিও মানবসভ্যতার আদিকাল থেকে চলে আসছে। বিজ্ঞানের এ ক্রমযাত্রায় এর তথ্যভান্ডারে হয়ে আসছে সংযোজন-বিয়োজন। এটি স্বভাবতই, মানুষের সীমাবদ্ধতার ফসল। তেমনি কেউ যদি প্রশ্ন করে, কোরআনে এতসব কিছু আগে থেকেই থাকলে, মুসলিম বিজ্ঞানীরা সবকিছু আগে থেকেই আবিস্কার করল না কেন? এর দুটো জবাব রয়েছে। প্রথমতঃ যেকোন আবিস্কারের জন্য প্রয়োজন, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, গণনা। শুধু ভাষা/স্টেটমেন্টের উপর ভরসা করে কোনকিছু আবিস্কার করা যায় না। দ্বিতীয়তঃ কোরআন যেহেতু বৈজ্ঞানিক থিওরী দিতে আসে নি, তাই এইসব নবআবিষ্কৃত তথ্যগুলোও কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কোরআনে এসব তথ্য এমনভাবে দিয়েছেন, যাতে সব যুগের মানুষের কাছেই কোরআন গ্রহণযোগ্য থাকে। কোরআনের দেয়া সূক্ষ্মভাবে দেয়া বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোর মর্মার্থ বুঝতে হলে ক্লাসিক্যাল আরবি এবং প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টস দুটোরই জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

ব্যবহৃত গ্রন্থসমূহঃ

১) لسان العرب لابن منظور

২) Arabic-English Lexicon: Edward Lane

৩) The Qur'an and The Orientalists - Dr. Muhammad Mohar Ali

৪) linguisticmiracle.com

বিষয়: বিবিধ

৫৫৪৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

362575
১৫ মার্চ ২০১৬ রাত ০৯:১০
আবূসামীহা লিখেছেন : হুরপরীরা মনোরঞ্জনের কাজ করে। তারা এত বিজ্ঞান আর ভাষাতত্ত্ব ক্যামনে বুঝবে!!!!
Thumbs Up
২২ মার্চ ২০১৬ রাত ০৯:২৭
301190
মির্জা লিখেছেন : হে হে। কতদিন পরে যে ঢুকলাম ব্লগে। ঢুকেই দেখি আপনার কমেন্ট, উস্তায।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File