উন্মাদিনী কাল (প্রথম আলোর নগ্নতা)!!

লিখেছেন লিখেছেন কুরআনের সৈনিক ১৯ এপ্রিল, ২০১৩, ০৯:৪৪:১৪ সকাল

মতির হলুদ আলো আবারো এটি লিখলো এতদিন আলুর এই নউজটি চোখেই পড়েনি। আমরা কোন দেশে বাস করি।



হলুদ ্আলু এখন বিনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উলঙ্গ করে দেখছি বাংলা চটি সমগ্র প্রকাশ করছে। এতদিন তো সানি লিওন,শারলিন চোপড়ার কাহিনী লিখতো এখন একেবারে বাংলা মুক্তিযুদ্ধের চটি সামগ্র লিখবে।। প্রথম আলো

null

একটা সিগারেট দে। সিগারেট দে কইলাম। লক্ষ্মী ভাই আমার!’ পরনের জামাটাকে কি কামিজ বলা যায়? হয়তো ছেলেদের শার্ট ছিল অথবা মেয়েদের কামিজ? ঠিক কি ছিল তা এত দিন পর কে বলবে। মূল রংটা কি অফ হোয়াইট টাইপের কিছু একটা ছিল? এখন সেই সাদার ওপর অনেকটা ময়লা কালচে ও থিকথিকে আভা ধারণ করে গোটা জামাটাকে একটা কোঁচকানো বিন্যাস দিয়েছে। না, হাঁটুর নিচে সালোয়ার বা সায়া টাইপের কিছু নেই। একটি গোটা জামাই শুধু পরনে। স্তন না অতি ভারী, না অতি শীর্ণ। চুলগুলো একটা আরেকটার ওপর জটা পাকিয়ে। স্নান করেনি কত বছর?

‘দিবি না সিগারেট? আমি কইলাম সব স্লোগান কইতে পারি! ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার/ তুই রাজাকার! ন-তে নিজামী, তুই রাজাকার/ তুই রাজাকার! জ্বালো-জ্বালো-আগুন জ্বালো! তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা...কি রে ভাইয়ারা, পারতাছি না? এইবার দে...এই পাগলিডারে একটা সিগারেট দে।’

জাদুঘরের সামনেই পুলিশ আর কালো পুলিশের (র‌্যাব) কাঁটার তার দেওয়া এই ঘেরের ভেতরেই এখন সবাই আসে। স্লোগান দেয়। শুরুতে তা ছিল বারডেম হাসপাতালের উল্টা দিকে। মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক চাচির ছবি বড় করে টাঙানো। লম্বা একটা পতাকা ঝুলত বাতাসে আসমান বরাবর। আর লোক আর লোক। গাড়িতে করে মানুষ আসছে। আসছে টিভির লোকজন। কাঁধে তাঁদের বিশাল সব ক্যামেরা। টিএসসি থেকে পাবলিক লাইব্রেরি জাদুঘর হয়ে ওপারে ফুলের দোকান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর এদিকে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মোড় পর্যন্ত শুধু লোক আর লোক। সকাল থেকেই থাকে। দুপুরের পর বিকেল থেকে আরও মানুষ। ক্যামেরাম্যান। লম্বা লম্বা ট্রলিতে উঠে ছবি তুলছেন সবাই। মুখে পতাকা আঁকা, মাথায় পতাকা বাঁধা ভাইয়েরা, আপারা। আর শুধু স্লোগান। শুধু স্লোগান। শাহবাগে সত্যি বলতে এমন আজব ব্যাপার সে কখনোই দেখেনি। দেখতে দেখতে কত কী হলো! আগে শাহবাগে তার সকালটা শুরু হতো ফুলের দোকানের সামনে ফুলের পাপড়ি ঝাড়ু দিয়ে। ভিক্ষা চেয়ে। সেখান থেকেই সে হেঁটে হেঁটে চলে যেত কখনো টিএসসি, দোয়েল চত্বর হয়ে হাইকোর্ট। রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তা গত দুই মাস সে শাহবাগেই ঠাঁই নাড়া। কত ফুল, গান-বাজনা, মাইক হাতে আপাদের স্লোগান, মোমবাতিতে ম্যাচের ঘষায় ম্যাজিকের আলোতে সারা শহরে তারাবাতি জ্বলল। এই ভাই-আপাদের অনেকে একটা মাস রাস্তাতেই থাকল আর রাস্তাতেই ঘুমাল...ভ্যানগাড়ির মতো কী একটা নাকি ভাতরুমে (বাথরুমে) যায়। তারপর ধীরে ধীরে মানুষ কমতে থাকে। আবার মাঝেমধ্যে বাড়ে। তখন মনটা কেমন করে। গত একটা মাস খুব ভালো গেছে। মাইকে গানের সঙ্গে সে-ও গান গেয়েছে। মাঝরাতে গান। ভোররাতে গান। তারপর মাঝখানে কদিন লোক একদম কমে গেল। আজ আবার মানুষ আসছে।

‘কি রে ভাইয়া, সিগারেট দিলি না?’

‘দিচ্ছি-দিচ্ছি!’ সদ্যই ধরানো একটা ৫৫৫ টান না দিয়েই সাদি বাড়িয়ে দেয় পাগলির দিকে।

লম্বা, শ্যামলা আর এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের সাদিকে দেখতে কঠোর পুরুষ মনে হলেও আদতে নরম। রক্ত-সংঘর্ষ-ভাঙচুরকে তার ভয়। গিটারে অব্যর্থ হাত। জর্জ হ্যারিসন হওয়ার স্বপ্নে বিয়ে করা হয়নি। বিজনেসম্যান বাবা সফল পুত্র-কন্যাদের ভেতর সাদিকেই ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এদিকে লালচে ফরসা, প্রায়ই পাঞ্জাবি পরা, স্নিগ্ধ চেহারার অনুপমকে দেখলে মনে হয় জীবনেও গীতবিতান আর রজনীগন্ধা ছাড়া দুই হাতে কিছু ধরেনি। বাস্তবের অনুপম এক-এগারোর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আর্মির হাতে ছাত্র পেটানোর প্রতিবাদে হাতে আধলা ইট নিয়ে আর্মি ট্রাকের পেছনে ছুটেছিল। এখন বিজ্ঞাপনী এজেন্সির কপিরাইটার। সঙ্গে মোস্তাফিজও ছিলেন। বেঁটে-খাটো, শীর্ণ মোস্তাফিজ মুঠোফোন কোম্পানিতে কাজ করলেও সুযোগ পেলেই ক্যামেরা হাতে দেশের সব বন-বাদাড়ে ছুটে বেড়ান।

সাদির হাত থেকে সিগারেট নিয়ে আনন্দে দুটো সুখ টান দেয় পাগলি। মাথার ওপর চাঁদ ঝকঝক করছে।

‘অই আপারা! আইজ ইমরান ভাই কই? ইমরান ভাই আসব না? লাকি আপা কুনখানে? আমি লাকি আপার মতো স্লোগান দিতে পারি। তোরা শোন্। শুইনা আমারে ১০টা টাকা দে।’

পাগলি সিগারেট হাতে এদিক-সেদিক কোথাও গেছিল! কাঁটাতারের এপারে ফুটপাতের ডিভাইডারের সামনে আবার এসে দাঁড়ায় সে, ওদের ছোট গ্রুপটার সামনে। হাসি হাসি মুখে গলা তুলে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে, ‘জ্বালো জ্বালো-আগুন জ্বালো! গ-তে গোলাম আযম/ তুই রাজাকার, তুই রাজাকার! নিজামী গেলি কই? আইতাছি তর বাপেরা! সাকা গেলি কই? আইতাছি তর বাপেরা! সাঈদী তর কবর হবে/ পাকিস্তানের মাটিতে! জামাতের বিবির/ বাচ্চারা শিবির! দে-১০টা টাকা দে!’

শ্রাবস্তী ব্যাগ খোলে। বন্ধুদের হট্টগোলের আড়ালে এক কোনায় বসে ১০টা টাকা দেয় সে পাগলিকে।

‘তোর মনটা খুব নরম রে আপু। তুই আর একদিন আমাকে টাকা দিছিলি না?’

হ্যাঁ, একেই টাকা দিয়েছিল বৈকি শ্রাবস্তী। গত পরশু বিকেলে।

‘আইজ রাতের খাওয়া হবে রে আপু। কি কিনমু জানিস? একখান বনরুটি, একটা কলা আর এক কাপ চা।’ পাগলি এবার শ্রাবস্তীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।

‘তুই কী সুন্দর সাজছিস রে আপু!’

‘কী নাম তোমার?’

‘আমার নাম...’ পাগলি তার জটা আর উকুনভরা চুলে হাত চুলকায়।

‘নাম একটা ছিল মনে কয়। অহন মনে নাই। আমি এই শাহবাগের পাগলি। শাহবাগেই থাকি। আমারে তোর মতো সাজায় দিবি আপু?’

শ্রাবস্তী অবাক হয়, ‘কি সাজবে তুমি?’

‘তোর মতো কাজল আর লিপস্টিক দিয়া দে আমারে। আছে না তোর ব্যাগে?’

‘না-নেই তো!’

‘তাইলে তোর চিরুনিটা দিবি? আমার মাথায় ময়লা নাই।’

‘আমার কাছে ত’ চিরুনিও নাই!’ মিথ্যা বলে শ্রাবস্তী।

‘ওহ্...’ পাগলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘থাক। একদিনে বেশি চাইতে নাই। তুই ত’ ১০টা টাকা দিলিই। আসি রে আপু...আসসালামু আলাইকুম!’

শেষ মুহূর্তে হাসিমুখে কপালের কাছে সালামের ভঙ্গিতে হাত জড়ো করে পাগলি তার কাঁধে বেশ কিছু টুকরো কাগজভরা পলিথিনের ব্যাগটি নিয়ে শাহবাগ জাদুঘরের সামনে থেকে রাস্তার ওপারে ফুলের দোকানের পাশ হয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যেতে থাকে। মুঠোফোনে বাসা থেকে মেসেজ আসছে। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা। আলিয়ঁস ফ্রঁসেস থেকে রাত আটটায় পরীক্ষা শেষ করে এখানে চলে এসেছিল আজ। ২৫ মার্চের রাত বলে কথা! এখন রিকশা নিয়ে বাসায় যেতে সাড়ে নয়টা বাজবে।

পাগলি বিদায় নিতে না-নিতে আলোচনা ততক্ষণে নানাদিকে বিসর্পিল মোড় নিয়েছে। ব্লগারেরা কি আসলেই নাস্তিক ছিল, সাঈদীকে চাঁদে দেখা নিয়ে দাঙ্গা, ধুমধাম মন্দির ভাঙা হচ্ছে প্রতিদিন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বনাম হেফাজতে ইসলাম, রুশি বাম বনাম পিকিং বাম, পিকিং বামদের কার্যক্রম অতিবিপ্লবের ঝোঁকে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে চলে যায় না তো, শুধুই যুদ্ধাপরাধের বিচার কি জাতীয়তাবাদী আবেগ নাকি তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দরের দাবিও থাকা প্রয়োজন? শাহবাগ বসন্ত কী বিপ্লব না বিপ্লবের পূর্ব লক্ষণ?

‘আচ্ছা-একটা ব্যাপার...’ ইতস্তত নরম গলায় শ্রাবস্তী বলে, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার না হয় আমাদের করতেই হবে। নাহলে বাংলাদেশ পাপমুক্ত হবে না। আমার পিসি ফোন করেছিলেন। ওনাদের উপজেলায় আজও দুইটা মন্দির ভেঙেছে। তা-ও না হয় মানলাম। লাশ পড়ছে। মানলাম। কিন্তু বিচারের পরে...ধরো, এই পাগলি...ও কি খেতে পাবে?’

‘এটা তোর খুব রাজাকার মার্কা কথা হইল। এটা তো পিকিং বাম মার্কা কথা।’ মোস্তাফিজ খেপে উঠল। সাদির মুখ অকারণে লাল হলো। সাদি পিকিংপন্থী। সে কারণেই একই বন্ধু গ্রুপে থেকেও রুশপন্থী শ্রাবস্তীর সঙ্গে তার কথা নেই আজ কয়েক বছর। এদিকে জিনস-ট্রাউজার পরা, সিগারেট খাওয়া ‘টমবয়’ মোহসীনাও কিন্তু পিকিং বাম। বন্ধুরা একসময় মস্কাইট-রাবীন্দ্রিক-পাঞ্জাবি পরা অনুপমের সঙ্গে অপর মস্কাইট-রাবীন্দ্রিক-শাড়ি আর টিপের শ্রাবস্তীকে কল্পনা করে কলাভবনের সামনের গাছে অনুপম+শ্রাবস্তী এবং আপাত রুক্ষ ও পিকিং বাম সাদির সঙ্গে আপাত কঠিনা ও পিকিং বাম মোহসীনার নাম অর্থাৎ সাদি+মোহসীনা লিখে দুষ্টুমি করেছিল। অনুপমের সঙ্গে পরিচয়ের আগে মোহসীনার প্রেম ছিল তার কাজিনের সঙ্গে। সেখানেই বিয়ে। একটি বাচ্চা নিয়ে আপাতত ব্রেকআপ। ডিভোর্সের মামলা চলছে। ইতিমধ্যে অনুপমও বিয়ে করেছে যথারীতি। তবু আজ রাতে বউকে বাসায় রেখে ক্যাম্পাসের পুরোনো বান্ধবীকে বাসায় পৌঁছে দেবে না কি সে? মনের দুঃখে মোস্তাফিজ একাই অর্থাৎ বউকে ছাড়াই সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় বাউল বাউল মুখে। সাদি জর্জ হ্যারিসন হওয়ার স্বপ্নে কোনো দিন চাকরি করবে না। তাই কোনো দিন কোনো মেয়েকেই সে বিয়ে করবে না। বিয়ে না করলেও প্রেম করেছে বেশ কিছু গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে। সব কয়টাই ব্রেকআপ। শ্রাবস্তীর সঙ্গে যত দিন তার কথা হতো, তত দিন রুশ আর পিকিং বাম পন্থার মতাদর্শিক ঝগড়া চলত। একপর্যায়ে তাদের কথা বন্ধ হলো। অথচ আজও ক্যাম্পাসে হঠাৎ দেখা হলে দুজনেরই বোধ করি অবস্থা হয় সেই এর্নেস্তো কার্দেনালের কবিতার পঙিক্তর মতো। ‘কেঁপে উঠি তোমার ক্ষণিক দৃষ্টিতেই!’ সাদি তার একটিও স্বীকৃত গার্লফ্রেন্ডকে অন্য ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে রাগ করে না। অথচ বাক্যালাপ বন্ধ শ্রাবস্তী আজও কোন্ ছেলের সঙ্গে কথা বলে, সেটা সে পর্যবেক্ষণ করে শ্যেন দৃষ্টিতে। আবার সাদি যেমন জর্জ হ্যারিসন হওয়ার স্বপ্নে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় না, শ্রাবস্তীও মহাশ্বেতা দেবী হওয়ার স্বপ্নে শেষ পর্যন্ত বিবাহ ইচ্ছুক কোনো যুবককে ভালোবাসে না। সচেতন অবচেতনে বেছে বেছে তাদের জন্যই সে দুঃখবিলাস করে যারা বেকার, ভবঘুরে বা অন্য কোনো সঙ্গিনীর সঙ্গে দায়বদ্ধ। দূর থেকে হালকা বিরহবোধ, উদাসীন রবীন্দ্রসংগীতের সুর আর মনের ছটফটে ইচ্ছা একদিন ঢাকার বাইরে গিয়ে বিশাল কোনো উপন্যাস তথা অশ্বডিম্ব সে প্রসব করবেই! কাজেই বিয়ে করা চলবে না। ওরে মধ্যবিত্ত সুবিধাবাদী, গত বছর তবে এক নির্জন মফস্বলে গিয়ে দিনে গড়ে ২০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ আর পানির অভাবে পালিয়ে এলি কেন? এখন বুড়ো বয়সে শৈশবের সংগীতচর্চার অভ্যাস পুনরুদ্ধার করাই শুধু আর তোমাকে দিয়ে হবে।

‘আহ মোস্তাফিজ...ঝগড়া করিস না! শ্রাবস্তী, অর্থনৈতিক মুক্তি বা সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন পরে। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই বড় প্রশ্ন। আমরা অঙ্ক পরীক্ষার দিনে অঙ্ক আর বাংলা পরীক্ষার দিনে বাংলা পরীক্ষা দিই।’ অনুপম রেফারির রায় দেয়।

লোকেন বোসের জার্নাল ২০১৩ (শ্রাবস্তীর ডায়েরি থেকে):

‘অমিতা সেনকে সুবল কী ভালোবাসে?

অমিতা নিজে কী তাকে?

অবসরমতো কথা ভাবা যাবে,

ঢের অবসর চাই;

দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে

সমাহিত হওয়া চাই;’

আজ সকালে একটা মারাত্মক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল। তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ-বন্দরের দাবিতে একটি লংমার্চে আমিও ছুটছি। বন্দরে বন্দরে থামছি। নদীমাতৃক দক্ষিণ বাংলার সব বন্দর। মংলা-হুলারহাট-শিকারপুর। মংলায় গেছিলাম বটে ২০০৩-এ লংমার্চের সময়। শৈশবে হুলারহাট আর শিকারপুরে। স্টিমারের ভ্যাঁপো আর যে বন্দরেই থামছি সেখানেই অনেক মানুষ স্লোগান দিতে দিতে ছুটে আসছে। হাতে তালি দিয়ে তারা স্লোগান দিচ্ছে, ‘ফাঁসি- ফাঁসি-সবাই বলো ফাঁসি-আরও জোরে ফাঁসি!’ তারপর ঘুম ভাঙল রক্ত দেখতে দেখতে। আমার দুই হাতে রক্ত...আমার দুই ঊরুর ভেতরে রক্ত...সব রক্তে মাখামাখি...ঋতুচক্রের সময় প্রতিটি মেয়ের যেমন হয়... আমার মাথাটা ঘুরছিল। আর খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমি আমার মৃত মা-বাবা আর জীবিত ভাইবোনদের সেই মিছিলের ভেতর খুঁজতে চাইলাম। কিন্তু কাউকেই পেলাম না। তারপর টের পেলাম, আমার গায়ে একটি জামা আছে বটে কিন্তু আমার পা ও ঊরু অনাবৃত। আমার দুই পা থেকে রক্ত গড়িয়ে নামছে আর আমার দুই হাত কারা বেঁধে রেখেছে শিকলে। আমার গায়ে একটি ছেঁড়া জামা অবশ্য আছে। জামাটা...জামাটা খানিকটা কাল রাতের পাগলিটার মতো না? আমি কি আমিই? নাকি অনেক রাত অবধি ফেসবুকে বন্ধুদের শেয়ার করা একাত্তরের সেই যে বীরাঙ্গনা...পাগলির মতো দেখতে...দুই হাত ওর শিকলে বেঁধে রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী আর রাজাকাররা.. ছেঁড়া, ময়লা জামার নিচ থেকে বের হয়ে আসছিল তার অনিন্দ্য কোমল নারীমাংসই বটে...আমি কি সেই বীরাঙ্গনা? দূর...তখন তো জন্মই হয়নি আমার...তবে আমি কী করে সে হব? আমাদের ধমনিতে শহীদের রক্ত...কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বলছিল এখন নতুন স্লোগান দিতে হবে...আমাদের ধমনিতে বীরাঙ্গনার রক্ত...না, আমি বীরাঙ্গনা না...আমি ধর্ষিতা হইনি...এই রক্ত কোনো দিন বৃথা যেতে পারে না! আমি আজও অক্ষত আছি...ভালো মেয়ে আছি...এই রক্ত কোনোদিন পরাভব মানে না...দ্যাখো, তোমরা...বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করো আমার শরীর! এই রক্ত কোনো দিন চোরাবালিতে হারায় না! আমার শরীরে তীব্র সার্চলাইট ফেলে তোমরা দেখতে পারো মেডিকেলি আমি আজও অক্ষত কি না...আমাদের ধমনিতে বীরাঙ্গনার রক্ত...না, আমি বীরাঙ্গনা নই...যে আমি অনার্য বাংলার ধানসিঁড়ি শ্যামলিমা...বেতফলের অরণ্যে লক্ষ্মীপ্যাঁচার ডানা ঝাপটানি, জলাঙ্গির কুয়াশাকীর্ণ নীলাভ সকাল...সেই আমার যোনি ও জরায়ুর ভেতর দিয়ে ছিঁড়ে-ফেড়ে মার্চপাস্ট করে যায়নি আর্যাবর্তের ৯০ হাজার পাঞ্জাবি-পাঠান-বালুচ সেনা...অথবা গেছে?...নাকি আমি সিটি করপোরেশনের সোডিয়াম লাইটের নিচে ঘুমিয়ে থাকা সেই পাগলিটা, যাকে যখন-তখন তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে পুলিশ, র‌্যাব কিংবা মাস্তান? সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ ঘাসের ওপর নিরুপায় শুয়ে আর সারা দেহে পুলিশের তীক্ষ্ন দাঁত-নখ বিঁধতে বিঁধতে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর থেকে ভেসে আসা গান শুনি বুঝি আমি: ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল?’ নাকি এটা বাঁশখালী? হুম্...আমি ঢাকার সুবিধাপ্রাপ্ত হিন্দু নারী। চাইলেই আমাকে ধর্ষণ করা যাবে না। তবে আমি যুদ্ধাপরাধের বিচার চাই...হত্যা ও ধর্ষণের বিচার চাই...অর্ডার-অর্ডার-নোট দ্য পয়েন্ট...একুশ শতকের মানবাধিকার ফাঁসির বিরোধী... আহ্...কী রক্ত! রক্তের ঘ্রাণ চারপাশে! আমার ঘুম ভেঙে গেল...জেগে দেখলাম সালোয়ার মাখামাখি রক্তে। বিছানার চাদরে রক্ত।

বিষয়: বিবিধ

৪৯৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File