জামায়াতকে কোন পথে নিষিদ্ধ করা সম্ভব। (জামায়াত কথন-১)

লিখেছেন লিখেছেন শাবাব মুস্তাকী ১১ মার্চ, ২০১৩, ১০:০২:১৬ সকাল

বাংলাদেশে সরকারী দল আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য চিন্তা ভাবনা করছে। আবার কখনো কখনো পিছিয়ে আসছে।

পক্ষে হোক আর বিপক্ষে হোক জামায়াতকে আসলে কিভাবে নিষিদ্ধ করা সম্ভব বা নিষিদ্ধ করার আসলেই কোন পথ আছে কিনা সেটা নিয়ে সাধারন জনগনের মধ্যে মাঝে মধ্যেই আলোচনা চলে।

গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। জামায়াত তেমনই একটি রাজনৈতিক দল। তবে তাদের দাবী হচ্ছে তারা নিছক রাজনৈতিক দল নয় বরং তাদের কিছু আদর্শিক কর্মসূচী আছে।

অপরদিকে বিরোধীদের বক্তব্য হচ্ছে জামায়াতকে গনতান্ত্রিক দল হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। তারা ধর্মকে উপজীব্য করে রাজনীতির মাঠে প্রভাব ফেলছে। এবং তাদের এমন কিছু কর্মকান্ড আছে যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানও জনগনের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। এজন্য মাঝে মাঝেই জামায়াত নিষিদ্ধের দাবী ওঠে।

প্রশ্ন হচ্ছে আসলে সরকার জামায়াতকে কিভাবে নিষিদ্ধ করবে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে আপাতত সরকারের সামনে তিনটি পথ রয়েছে।

প্রথম পথটি হলো স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে সরাসরি প্রজ্ঞাপন জারি করে নিষিদ্ধ করা। বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। ২০০৯ সালে হিজবুত তাহরীর কে এভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে দেশের অভ্যন্তরীন চরমপন্থী দলকে এভাবে নিষিদ্ধ করার উদাহরন আছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারায় হত্যা, আঘাত, সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করা অথবা চেস্টা করা অথবা ইন্ধন দেয়াকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বলা হয়েছে এবং এসব কাজে জড়িত থাকলে সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ আছে। সেই সংগঠনকে আর্থিক সহযোগীতা করলে কোন প্রতিস্ঠানও নিষিদ্ধ করার সুযোগ আছে। এমনকি প্রচার ও প্রকাশনা

বন্দ করা যাবে।

দ্বিতীয় পথটি হলো আইনের পথ। আইনের পথ দুই রকমে হতে পারে। প্রচলিত আদালতে বিভিন্ন অভিযোগ দায়ের করে নিষিদ্ধের আবেদন করা অথবা এজন্য বিশেষ কোন ট্রাইবুনাল গঠন করা।

তৃতীয় পথ হচ্ছে রাস্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারী করে সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে পাশ করিয়ে নেয়া।

এছাড়া আরেকটি বিকল্প উপায় হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষনা করা।

উপরের পথগুলো পর্যালোচনা করা যাক। প্রথম যে উপায় বলা হয়েছে সেটা আসলে জনবিচ্ছিন্ন, কর্মসূচীবিহীন, গোপন সংগঠনের ক্ষেত্রে যত সহজে করা যায় একটি সৃসংগঠিত, গনমুখী, সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল, দীর্ঘদিনের পুরনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে করা মোটেই সহজ নয়। খুব সস্তায় এ কাজ করতে গেলে বরং সুস্পস্ট হঠকারীতা প্রকাশ পায়। গনতান্ত্রিক অধিকার হরনের প্রশ্ন ওঠে, সংবিধান লংঘনের অভিযোগ করা যায় সর্বোপরি জনগনের প্রতিক্রিয়া তো আছেই। দেশের সকল মানুষ, সকল রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃকিত সংগঠন , সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়, মিডিয়া, ছাত্র সমাজ একমত হলেই এটা কেবল সম্ভব। জেএমবির ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিলো। তৃতীয় বিশ্বের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও বড় ব্যাপার।

জামায়াতকে এই পথে নিষিদ্ধ করা বড় ধরনের ঝুকিপূর্ণ কাজ। সংসদে প্রতিনিধিত্ব যতটুকুই থাকুক সাংগঠনিক শক্তির বিচারে এ দলের অবস্থান যথেস্ট মজবুত। রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতি, প্রত্যেকটি অঙ্গনেই তাদের জনভিত্তি রয়েছে।সুশীল সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়, মিডিয়াতে কমবেশি তাদের সমর্থন আছে।

মজার বিষয় হচ্ছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ ধারায় সন্ত্রাসের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তাতে শুধু জামায়াত কেন বাংলাদশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকেই সন্ত্রাসের অভিযোগে নিষিদ্ধ করা যায়। এমনকি বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলো ইদানীং যে ধরনের কর্মসূচী পালন করছে তাকেও সন্ত্রাসের সংজ্ঞায় ফেলে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা যায়।

পাশাপাশি আরো স্মরণ রাখা দরকার যে স্বাধীন বিচার বিভাগ অযৌক্তিক মনে করলে এই নিষিদ্ধকরন যে কোন মুহুর্তে রহিত করতে পারে। মোট কথা এটি একটি হালকা আইন।

দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে আইনি পথ। এক্ষেত্রেও মুল হাতিয়ার হচ্ছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন। বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় সন্ত্রাসী অথবা দেশবিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগ আনার সুযোগ আছে। তবে আইনের পথ অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদী এবং ঝামেলাপূর্ণ হযে থাকে। যেহেতু বিষয়টা রাজনৈতিক স্পর্শকাতর সেহেতু দীর্ঘমেয়াদী পথে গেলে এর রেজাল্ট পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাছাড়া কোন সরকার তার মেয়াদের মধ্যে সমাধান করতে না পারলে পরবর্তী সরকারের দৃস্টিভঙ্গি পরিবর্তন হতে পারে। নির্বাচন ইত্যাদি কারনে আদালতের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হলে বিচার কাজ গতি হারাবে। সময়ের সাথে বিচারকদের দৃস্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। অভিযুক্তর পক্ষ থেকেও বিভিন্ন ভাবে চেস্টা হবে।

এই ঝামেলা এড়ানোর জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করতে পারে সরকার। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য জারিকৃত সংশোধিত আদেশে যুদ্ধাপরাধের দায়ে রাজনৈতিক দলকে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই আদেশের সূত্র ধরে জামায়াতকে নিষিদ্ব করার জন্য আবেদন করা যায়। তবে বিশেষ ট্রাইবুনালেও সময় সাপেক্ষ এবং প্রমান নির্ভর।যুদ্ধাপরাধের সংগে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে যে বিচার কাজ চলছে তার জন্য বিধিমালা তৈরী, ট্রাইবুনাল গঠন, বিভিন্ন বিতর্ক, উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং সমস্যার সমাধান, তদন্ত কার্যক্রম এবং সবশেষে প্রত্যক্ষ বিচার কাজ শেষ করতে হলে ভাল একটা সময়ের প্রয়োজন হয়। সরকার যদি শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে চায় তাহলে এই পয়েন্ট সুবিধা জনক। বিচার হোক বা না হোক একটি ইস্যু হাতে থাকে।

রাস্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারী করে পরে সংসদে আইন পাশ করে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সবচেয়ে সহজ। পরবর্তী সংসদে সংখ্যাগরিস্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে এই অধ্যাদেশ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তা আইন হিসেবেই থাকবে। এই পথটি আপাতদৃস্টিতে সহজ মনে হলেও প্রথম পথের যে বাধা আছে তা এই পথের জন্যও প্রযোজ্য।

সবশেষে বলা যায়, সরকার যদি জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে চায় তাহলে যে কোনভাবে নিষিদ্ধ করতে পারে। তবে তার প্রতিক্রিয়া কি হবে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই নিষিদ্ধ করন কিভাবে গ্রহন করা হবে। এসব বিষয় সরকরের বিবেচনায় থাকে। একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আবার সাথে সাথেই ফেরত আসা যায়না।

জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে তাদের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া কি হবে, তাদের প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনীর পরবর্তী ভূমিকা কি হবে। সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর কতটুকু প্রভাব পড়বে। জামায়াতের লাভ হবে নাকি সরকারের লাভ হবে। তাদের জনশক্তি রাজনীতিতে কাদের সহযোগী হবে। নির্বাচনে তাদের কৌশল কি হবে। তাদের ভিন্ন নামে রাজনীতি করা কিভাবে প্রতিরোধ করা যাবে। ইত্যাদি সব কিছু বিবেচনা করেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে জামায়াত নিষিদ্ধ করা হবে কি না।

বিষয়: রাজনীতি

১৫১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File