শাহবাগ আন্দোলন, বিশ্বাসের ভাইরাস, আমাদের জাগ্রত তরুণ সমাজ

লিখেছেন লিখেছেন শাবাব মুস্তাকী ০৫ মার্চ, ২০১৩, ০১:০৯:৩৯ দুপুর

শাহবাগ আন্দোলন আসলে কি করতে চাচ্ছে--- তার চুড়ান্ত লক্ষ আসলে কি!

তিনসপ্তাহের অধিককাল পার হয়ে গেলেও এ প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ জানেননা। শাহবাগ আন্দোলনের উদ্দোক্তা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, আন্দোলনে সামনে থেকে এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করা নিবেদিত কর্মীবৃন্দ, কিংবা মোহগ্রস্থ হয়ে প্রতিদিন হাজিরা দেয়া তরুন তরুনী কারো কাছেই এর সুস্পস্ট জবাব নেই। আর চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে কিংবা স্রেফ কৌতুহলের বশে যারা ঘুরতে আসছে তাদের কাছে এর উত্তর না থাকাই স্বাবাবিক।

আদালতের একটি সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে যে মঞ্চের জন্ম সেখান থেকেও কিন্তু নেই সুস্পস্টে কোন বক্তব্য। শুরুতে ফাসি চাই অত:পর অমুকের গ্রেফতার চাই, অমুককে জবাই করতে চাই। তারপর দাবী ঘুরে গেল ব্যাংক বন্ধ করতে হবে। ব্যাবসা বানিজ্য বন্ধ করতে হবে। জ্বালাও, পেড়াও, হামরা, ভাংচুর, আগুন ইত্যাদি। পত্রিকাগুলো কেন তাদের সাপোর্ট করবেনা- সুতরাং পত্রিকা বন্ধ করতে হবে, টেলিভিশন বন্ধ করতে হবে।

এ পর্যন্ত থাকলেও হয়তো একে প্রতিবাদী তারুন্যের মঞ্চ হিসেবে পরিচয় দেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু এই মঞ্চ যেভাবে তার দ্বায়িত্বের পরিধি বাড়িয়ে চলছে তাতে বুদ্ধিমান মানুষ রীতিমত স্তম্বিত।

প্রতিবাদী তরুনরা এখন মিছিল করছে, স্মারকলিপি দিচ্ছে, সংসদের হাততালি নিচ্ছে। প্রতিবাদী তরুনরা সারাদেশে সফর করছে, যায়গায় যায়গায় বক্তুতা সমাবেশ করছে, হাত উচিয়ে প্রিয় দেশবাসী বলে গলা সাধছেন। শাহবাগী মঞ্চ এখন বিরোধীদলের হরতাল প্রতিহত করার দ্বায়িত্ব নিয়েছে, লাঠিসোটা হাতে পুলিশকে সহযোগীতার জন্য মাঠে নেমেছে।

আমি জানিনা তরুনরা আর কি কি করতে চাচ্ছেন।

আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো যে এরা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, কারো প্রতি বিশেভাবে বিদ্বেষপ্রসূত না হয়ে দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে নিজের বিবেকের তাড়নায় জেগে উঠেছে। হয়তো শুরুতে তাই ছিলো, এখন আর নেই।

বিরোধীতা করতে গিয়ে কেউ কেউ এইসব তরুনদেরকে সরাসরি নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী, দলবাজ, নেশাখোর, ব্যভিচারী, উশৃঙ্খল ইত্যাদি বলে ঝাল মেটাতে চাচ্ছেন তবে আমি তাদের পক্ষে নই। টেলিভিশন, পত্রিকায় আর ব্লগে তাদের যে ছবি আমি দেখেছি তাতে আমি তেমন মনে করিনা। প্রকৃতপক্ষেই তারা এদেশের সম্বাবনাময় জাগ্রত তরুন। তাদেরকে সুকৌশলে একটি উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের কাজে সফলভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে।

‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বলে একটা কথা মনোবিজ্ঞানীদের আলোচনায় পাওয়া যায়। জলাতঙ্কের জীবাণু দেহের ভিতরে ঢুকলে যেমন মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে যায়, ঠিক তেমনি মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া পরিকল্পিত বিশ্বাসগুলোও মানুষের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তৈরি হয় ভাইরাস আক্রান্ত মননের।

নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম (বৈজ্ঞানিক নাম Spinochordodes tellinii) নামে এক ফিতাকৃমি সদৃশ প্যারাসাইট আছে যা ঘাস ফড়িং-এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেললে ঘাস ফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এর ফলশ্রুতিতে নেমাটোমর্ফ হেয়ার-ওয়ার্মের প্রজননে সুবিধা হয়। অর্থাৎ নিজের প্রজননগত সুবিধা পেতে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম বেচারা ঘাস ফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে ।

আরেকটি মজার উদাহরন থেকে পুরো বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায় । ড্যানিয়েল ডেনেটের ‘ব্রেকিং দ্য স্পেল’ বইটি থেকে । আপনি নিশ্চয়ই ঘাসের ঝোপে কিংবা পাথরের উপরে কোন কোন পিপড়াকে দেখেছেন – সারাদিন ধরে ঘাসের নীচ থেকে ঘাসের গা বেয়ে কিংবা পাথরের গা বেয়ে উপরে উঠে যায়, তারপর আবার ঝুপ করে পড়ে যায় নিচে, তারপর আবারো গা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। ভালোভাবে কেউ খেয়াল করলে যে কারো কৌতুহর জাগবে যে এই অহেতুক চেস্টা করে পিপড়ার আসলে লাভ কি হচ্ছে। মনে হতে পারে এটা স্রেফ একটা বোকা প্রানীর বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু বিজ্ঞানীরা গবেষনা করে জানিয়েছেন এটা আসলে আরেকটা ভাইরাসের প্রভাব। পিপড়ার মগজে ল্যাংসেট ফ্লুক নামে এক ধরনের ভাইরাস থাকে। এই ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করতে পারে শুধুমাত্র তখনই যখন কোন গরু বা ছাগল একে ঘাসের সাথে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। সুতরাং পিপড়া যেন গরুর পেটে ঢুকতে পারে সেই সে জন্য পিপড়ার মগজকে প্ররোচিত করে বারবার তাকে দিয়ে এই অহেতুক কর্মটি করাতে থাকে। ফলে পিপড়া একসময় গরু বা ছাগলের নজরে আসে । এখানে পিপড়ার কোন লাভ নেই বরং লাভ সেই ভাইরাসের।

শাহবাগে জমায়েত হওয়া তরুনগুলোর মুখগুলোর দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ কত প্রকটভাবে মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলতে পারে, যার ফলে একজনকে জবাই করা,খতম করাকে একটি দ্বায়িত্ব পালনের অংশ মনে করে।



চিত্র: ল্যাংসেট ফ্লুক নামের প্যারাসাইটের কারণে পিঁপড়ের মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন পিঁপড়ে কেবল চোখ বন্ধ করে পাথরের গা বেয়ে উঠা নামা করে।

জলাতঙ্কের ধরনও এমনই। এ রোগের জীবাণু মস্তিষ্ক অধিকার করে ফেলে। এবং আচরণও পাগলা কুকুরের মতোই হয়ে উঠে। আক্রান্ত ব্যক্তি অপরকেও কামড়াতে যায়। অর্থাৎ, ভাইরাসের সংক্রমণে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এভাবে ভাইরাস তার বেচে থাকা নিশ্চিত করে।

আমাদের তরুন প্রজন্মের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া ‘ভাইরাসগুলোও‘ কি আমাদের সময় সময় এভাবে আমাদের অজান্তেই বিপথে চালিত করে না কি? আমরা আমাদের চেতনা রক্ষার জন্য লগি বৈঠা নিয়ে সাপের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যা করি্, অন্যের আর্থিক ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ব্যবসা প্রতিস্ঠানে হামরা চালাই, আগুন দেই, অন্যের মুখ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনে হত্যার আদেশ দেই...... ।



চিত্র: হিন্দু মৌলবাবাদীরা একসময় ভারতে রাম-জন্মভূমি মিথ ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ।

হিন্দু মৌলবাবাদীরাও একসময় ভারতে রাম-জন্মভূমি অতিকথনের ভাইরাস বুকে লালন করে ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। বিগত শতকের আশির দশকে মাইকেল ব্রে নামের কুখ্যাত এক খ্রিস্টান সন্ত্রাসী ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়ার গর্ভপাত ক্লিনিকগুলোতে উপর বোমা হামলার পর বাইবেলের বানীকে রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন আদালতে। এধরণের অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাস থেকে হাজির করা যাবে, ভাইরাস আক্রান্ত মনন কিভাবে কারণ হয়েছিল সভ্যতা ধ্বংসের। ইতিহাসের পরতে পরতে অজস্র উদাহরণ লুকিয়ে আছে – কিভাবে বিশ্বাসের ভাইরাসগুলো আণবিক বোমার মতই মরণাস্ত্র হিসেবে কাজ করে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে।

আওয়ামী লীগের শাহবাগ আন্দোলন এবং পরবর্তী সহিংস ঘটনা আর ব্যাপক প্রানহানী নতুন করে আমাদের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে দিয়েছে। পরিষ্কার করে দিয়েছে এই মনস্তাত্বিক ভাইরাসের প্রকটতা। আমরা কি জানিনা কোন্‌ সে ভাইরাস যা জলাতঙ্ক রোগীর মতো মস্তিষ্ককে অধিকার করে ফেলছে? আমরা কি জানি না এই উগ্র আত্নঘাতী ভাইরাস কিভাবে ছড়াচ্ছে? এখনো বহু অসুস্থ ভাইরাসাক্রান্ত মনন এভাবে শুধু শাহবাগে নয় সারাদেশে ওৎ পেতে আছে। সব দেখেও কি আমরা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব? এ ভাইরাস প্রতিরোধ না করতে পারলে এ ‘সভ্যতার ক্যান্সারে’ রূপ নিয়ে আমাদের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করবে বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ, এ ভাইরাসকে না থামিয়ে বাড়তে দিলে একসময় সারা দেহটাকেই সে অধিকার করে ফেলবে। এ প্রবন্ধের প্রথম দিকে দেয়া ল্যাংসেট ফ্লুক প্যারাসাইট আক্রান্ত পিঁপড়ের উদাহরণের মত মানবজাতিও একসময় করে তুলবে নিজেদের আত্মঘাতী, মড়ক লেগে যাবে পুরো সমাজে। তাই কি আমরা চাই?

কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই তা চাইতে পারেন না। এই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য গড়ে তোলা দরকার ‘এন্টিবডি’, সহজ কথায় তৈরি করা দরকার ভাইরাস প্রতিষেধকের। আর এই সাংস্কৃতিক ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে আমার–আপনার মত বিবেকসম্পন্ন প্রগতিশীল মানুষেরাই। দরকার সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার, দরকার খোলস ছেড়ে বেরুনোর মত সৎ সাহসের, দরকার আমার-আপনার সকলের সামগ্রিক সদিচ্ছার। আপনার আমার এবং সকলের আলোকিত প্রচেষ্টাতেই হয়ত আমারা একদিন সক্ষম হব সমস্ত অপপ্রচার এবং মিথ্যা-নির্ভর ‘প্যারাসাইটিক’ ধ্যান ধারণাগুলোকে তাড়াতে, এগিয়ে যেতে সক্ষম হব ভাইরাস-মুক্ত নীরোগ সমাজের অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে।

আমাদের সমাজে যারা তরুন সমাজ নিয়ে কাজ করছেন, তাদের মনন, বিবেচনাবোধ, সৌজন্যবোধ, শিক্ষা সংস্কৃকিত উন্নয়নের যারা কাজ করছেন তাদের বিবেককে আগে পরিশুদ্ধ করা জরুরী। তাদের কে বুঝতে হবে প্রানঘাতী বিভক্তিতে জড়িয়ে দিয়ে তাদের কোন লাভ হবেনা। তরুনরা আইনের শাসন প্রতিস্ঠার জন্য কাজ করবে, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার জন্য নয়। তরুনদেরকে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকরতে হবে অন্যায়কে বৈধতা দেয়ার ক্রিড়ানক তারা হতে পারে না। মোট কথা তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের জানাশোনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। একটি যুক্তিহীন বুদ্ধিহীন মিথ্যার উপর ভরসা করে যদি তারা অন্ধ হয়ে বসে থাকে তাহলে এ অবিচার একদিন তাদেরকে গ্রাস করবে। ইতিহাস তার চরম স্বাক্ষী।

বিষয়: বিবিধ

১৪৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File