শাহবাগের কান্না ; পেশী ফুলিয়ে শক্তিক্ষয় আর নয়।

লিখেছেন লিখেছেন শাবাব মুস্তাকী ০৭ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৫৭:০১ সকাল

যেকোন পরিস্থিতির শক্তির এবং দুর্বলতার দিক থাকে। যোগ্য নেতৃত্ব দুর্বলতাগুলোকে প্রথমে মোকাবেলা করে আর নজর দেয় শক্তিকে অটুট রাখার দিকে। শাহবাগের মুল শক্তি ছিল এর নন পার্টিজান চরিত্র, শক্তিকেন্দ্র হিসেবে তারুণ্য এবং ব্লগার নামের নতুন এক শক্তির অভ্যুদয়। এই শক্তিকে রক্ষা করা যায়নি। এটা ঠিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি শাহবাগে যুক্ত হবেই কিন্তু তাঁদের শোম্যান শিপ আন্দোলনের ঝুড়িতে নতুন কিছু যুক্ত করেনি বরং নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছ।

শাহবাগ পরিকল্পিত কোন সংহত শক্তি ছিলনা এবং এই প্রজন্মের রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে কোন অর্জিত অভিজ্ঞতা ছিল না সত্য। এছাড়াও কোন একটা আন্দোলনের সফল পরিনতির জন্য যেকোন এক বা একাধিক শ্রেণীর পূর্ণ সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। শাহবাগে শুরুতে কোন বিশেষ শ্রেণীর (রাজনৈতিক অর্থে) পূর্ণ সম্পৃক্ততা ছিলনা।

কিন্তু পরবর্তীতে এই আন্দোলনকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আন্দোলনের বাইরের যে চ্যালেঞ্জ সেটাকে মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত বুদ্ধিমত্তা তারা দেখাতে পারেনি। যুদ্ধাপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে অনড় তারুণ্যকে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রকাশ করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, পদ্মা সেতু, হল মার্ক, বিশ্বজিৎ হত্যা সহ আরও দাবী যুক্ত করার আহ্বান জানাল বি এন পি। কিন্তু তারুণ্য কে হাতের মুঠোয় নিয়ে একটি গ্রপ উল্টো জবাব দিল সেই আহবানের।

একই আহবান এবং বিশেষ করে শাহবাগকে যে কেউ ব্যবহার করতে চাচ্ছে সেই সতর্কবানী নিয়ে এগিয়ে এলো আমার দেশ পত্রিকা। প্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে আমার দেশের এই মন্তব্য কারো কাছে ভুল মনে হলে এর যুক্তিসিদ্ধ প্রতিবাদ করা যেতো। শাহবাগের উপরে সবগুলো পত্রিকা এবং টেলিভিশন চ্যানেলের পূর্ন সমর্থন ছিলো। বাঘা বাঘা সম্পাদক, কলামিস্টদের সুনজর ছিলো। সুতরাং তারা প্রবন্ধ নিবন্ধ সম্পাদকীয় দিয়ে মাহমুদুর রহমানকে বোকা বানিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু তা না করে শাহবাগ তেড়ে গেলো মাহমুদুর রহমানের দিকে। তখন থেকেই মুল ফোকাস থেকে সরে গেলো শাহবাগ। ফ্যাসিবাদের সত্যিকার প্রমান দিলো শাহবাগের কিছু উম্মত্ত তরুন। সুতরাং প্রথম ভুল হোল সেখানেই। ।

এর পরে এলো রাজীব ইস্যু। খুঁজে খুঁজে রাজীবকে কেন খুন করা হোল সেটা মাথা খাটিয়ে খুঁজে বের করার চাইতে, আবেগকে গুরুত্ব দেয়া হোল। আবেগের কাছে যুক্তি আর কল্পনাশক্তি পরাজিত হোল। রাজীব শাহবাগে এসেছিল; কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার কথিত লেখা শাহবাগের ঘোষণাপত্র। তার ব্যক্তিগত ব্যাপারকে চাইলেই আরাদা রাকা যেতো। কিন্তু তা না করে সরকারী তরফে অতিদ্রুত তার বাসায় গিয়ে, তাকে মৃক্তিযুদ্ধের শহীদ ঘোষনা করে, শাহবাগে তার জানাজার আয়োজন করে, বলা যায় যায় শাহবাগ তার সকল কাজের দ্বায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিলো।এই ভূখণ্ডের প্রতিক্রিয়াশীলরা সব সময় আত্মরক্ষার জন্য শেষ অস্ত্র হিসেবে নাস্তিক কার্ড ব্যবহার করেছে। সেই হিসেবে নাস্তিক কার্ড ব্যবহার কোন অভিনব আবিষ্কার নয়। এই নাস্তিক কার্ডের বিরুদ্ধে খুব সহজেই কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা যেত। ।

১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে যখন সব বিবেচনায় শাহবাগের কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করার ঘোষণা যৌক্তিক ছিল। একটি আন্দোলন যতই শক্তিশালী হোক সেটা শুরু হবার পরে সেটার আবেদন অক্ষুন্ন রেখে সেটাকে যথাসময়ে পরিসমাপ্তি ঘটানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সতস্ফুর্ততার শক্তি আর সীমাবদ্ধতা দুটোই আছে। একটা ম্যাচের কাঠির মাথায় যে বারুদের স্ফুলিঙ্গ, সতস্ফুর্ততা সেটার মতো। স্ফুলিঙ্গ সব সময় ক্ষণস্থায়ী, স্ফুলিঙ্গের সেই বিস্ফোরক আগুন সঞ্চারিত হয় তুলনামুলক সংহত কিন্তু আপাত দীর্ঘ ম্যাচের কাঠিতে। কাঠিতে আগুন থাকতে থাকতেই আগুন সঞ্চারিত করতে হয় যেখানে অগ্নিকুণ্ড তৈরি করা হবে সেখানে। ৫-১৫ ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগের স্ফুলিঙ্গ স্থায়ী ছিল। এবার দেখি তারপরে কী কী হোল?তখন রাজীবের পরিকল্পিত হত্যা এবং তার লাশ বাসার সামনে ফেলে রেখে আমাদের তাৎক্ষনিক আবেগকে ব্যবহার করে কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করার পথ থেকে সরে আসতে বাধা দেয়া হয়।

প্রথম থেকেই উচিৎ ছিল যেন জামাত ধর্মকেশাহবাগের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করাতে না পারে। সেই লক্ষ্যে যে সকল কৌশল গ্রহণ করতে হতো :

১। জামাত যেন ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোকে পাশে না পায়।

২। বি এন পি কে জামাত ত্যাগের জন্য তার ভিতরে তুলনামুলক প্রগতিশীল অংশের মাধ্যমে চাপের মধ্যে ফেলা।

৪। জামাতের তাণ্ডব আক্রান্ত অঞ্চলে সাহস ফিরিয়ে আনা।

৫। জামাতের সকল প্রচারণার কার্যকর জবাব দেয়া,প্রয়োজনে লিফলেট ছেপে, ভিডিও জার্নাল করে, বুকলেট ছেপে পাল্টা প্রচারনা জারি রাখা।

৬। শাহবাগের শক্তিকে সংহত করা।

এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য জামাত যে সমস্ত জায়গায় নাশকতা করেছে ঢাকা থেকে লং মার্চ করে সে জায়গায় গিয়ে জাগরণ সমাবেশকরা যেতে পারতো। আশপাশের জেলাগুলো থেকে সেখানে জমায়েত করা যেতে পারতো। এতে সে অঞ্চল গুলোতে আদর্শিক পুনর্দখল হতো। সকল রাজনৈতিক (বি এন পি সহ) দলকে আহ্বান জানানো যেত যেন তারা যুদ্ধাপরাধীদের বর্জন করে। আলেম সমাজের কাছে একটা খোলা চিঠি দেয়া যেত যেন উনারা জামাতের প্ররোচনায় শাহবাগ কে নাস্তিক বলে ভুল না করে। দুএকটি মাদ্রাসায় জাগরণমঞ্চের সমাবেশ করা যেতে পারতো। জামাতের তাত্ত্বিকদের তথ্যভিত্তিক সমালোচনা করা। দৈনিক পত্রিকা, ব্লগ, ফেসবুকে জামাতের ইসলাম বিরোধী রূপ প্রকাশ করে প্রচুর লেখা দেয়া যেত।একটি যুদ্ধাপরাধ এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করা যেতে পারতো,যেখানে জাগরণ মঞ্চের ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হতো এবং পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে একটি সংগঠিত লড়াইয়ের প্লাটফর্ম তৈরি হতো। গণ জাগরণ মঞ্চের চারপাশে রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ গড়ে তোলা যেত এবং গণ জাগরণ মঞ্চের ভিতরে বিলিন না হয়ে যেয়ে সেই শক্তি সমাবেশ তাঁদের নিজস্ব সম্পূরক কর্মসূচী নিয়ে এই লড়াইয়ে সামিল হতে পারতো। এর কিছুই হয়নি বরং অপরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক দলের অনুকরনে মিছিল, হরতাল, কিছু জামাতি প্রতিস্ঠানে হামলা, হামলার হুমকি, পত্রিকা ,টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধের হুমকি, আসিফ নজরুল, পিয়াস করিম, মাহমুদুর রহমানকে খতম করার হুমকি শাহবাগের প্রতি নির্মোহ জনগনের আগ্রহ ও সমর্থনকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে।

এর পরে আসলো হেফাজতে ইসলাম। জাগরণ মঞ্চ আবারো তাদের প্রতিরোধের ডাক দিল। জামাত সুকৌশলে একেক সময় একেক গ্রুপকে এগিয়ে দিচ্ছে আর যুদ্ধাপরাধের সর্বচ্চো শাস্তির দাবী পিছিয়ে পড়ছে। জামাত এটাই চায়। আন্দোলনকে রং এনিমির মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিতে চায় যেন আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়া যায়।

শাহবাগ কোন বিপ্লব করতে আসেনি। শাহবাগ একটি খুব সাধারণ রাষ্ট্রবিপ্লবের অসমাপ্ত ন্যায় বিচারের প্রশ্নকে সামনে এনেছে। এই দাবীতে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন মোবিলাইজ করা খুব অসম্ভব ছিল না। সেটাই হতো শাহবাগের সাফল্য। শাহবাগ বাংলাদেশের রাজনীতিকে ডিক্টেক্ট করতে পারতো, কিন্তু সেই শাহবাগ হতে চলেছে প্রচলিত রাজনীতির অনুগামী, মুখাপেক্ষী। শাহবাগের মতো সম্ভাবনার এই অবস্থান এবং সাম্ভব্ব্য পরিনতি বেদনাদায়ক।

বাংলাদেশকে নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও থেমেনেই। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কারজাই টাইপের সরকার আর নিরন্তর সংঘাতে দুর্বল বাংলাদেশ রাষ্ট্র মার্কিনীদের এবং তাদের দোসরদের দীর্ঘদিনের চাওয়া। সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক জামাতের কৌশল কী বাংলাদেশকে সেই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে?

সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বরং এখনই সময়, আন্দোলনের নির্মোহ মূল্যায়নের মাধ্যমে মেধার প্রয়োগ ঘটিয়ে শাহবাগকে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়া। গণ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আছে যাদের আর কৌশলপত্র প্রনয়নে অভিজ্ঞদের একসাথে নিয়ে আন্দোলনের রোড ম্যাপ তৈরি করা জরুরী। শাহবাগকে মেধার লড়াইয়ে জিততে হবে। আন্দোলনের ত্রুটি সংশোধন করে শ্রমজীবী মানুষকে যুক্ত করে মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক জাগরণের গণ্ডি ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস তৈরি করতে পারে শাহবাগ।

পিনাকী ভট্রাচার্যের প্রবন্ধ অবলম্বনে লিখিত

বিষয়: বিবিধ

১২৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File