সেকালের কলেরা এবং একালের গুম
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৭:১৫:০২ সন্ধ্যা
আজ থেকে অনেক দিন আগের কথা। ৬০ থেকে ৭০ বছর তো হবেই, তখন আমার জন্মও হয়নি। দাদা-দাদির মুখ থেকে শুনেছি, তখন নাকি কলেরা নামের এক ব্যাধি আসত যার বর্তমান নাম ডায়রিয়া। সেই মরণ ব্যাধি আসত গ্রাম থেকে গ্রামে পালা বদল করে। যে গ্রামে আসত সেই গ্রামের কমপক্ষে ১০-১৫ জন মানুষ মারা যেত। তখন মরণ ব্যাধি আক্রান্ত গ্রামের অনেকে তার নিজ নিজ সন্তান-সন্ততি নিয়ে অনেক দূর আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতেন। যখন গ্রাম থেকে কলেরা নামের মরণ ব্যাধি চলে যেত তখন ফিরে আসতেন। ওই সময় ব্যাধির নামটি পর্যন্ত মানুষ মুখে নিত না ভয়ে। কিন্তু আজকাল এই রোগ অর্থাত্ ডায়রিয়া অসুখ দেখা দিলে পাঁচ টাকা দামের এক স্যালাইন পানির সঙ্গে মিশিয়ে পান করলেই মহান আল্লাহর হুকুমে রোগমুক্ত হওয়া যায়। বর্তমানে সেই কলেরা রোগের মতো একটি নতুন রোগ দেখা দিয়েছে শহরে, বন্দরে, গ্রামে। যার ফলে রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা করতে পারছেন না। সেই মরণ ব্যাধির নাম হলো ‘গুম’। ওয়েভ কিংবা প্রিন্ট মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশে প্রায়ই একজন না একজন গুম হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৫৬ জন গুম হয়েছে। বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক ব্যক্তি গুম হয়েছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট জনেরা। শুধু গুম নয়, গুপ্তহত্যারও শিকার হতে হচ্ছে অনেক ব্যক্তিকে। আবার অনেক গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তি বেঁচে আছে, গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছে সে খবরও জানে না তার পরিবার। মাসের পর মাস এমনকি কয়েক বছর চলে যাচ্ছে, বিভিন্ন সময়ে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তির খবর এখনও পাওয়া যায়নি। আবার অনেক পরিবার জানে না তাদের গুম হয়ে যাওয়া মানুষটিকে কে গুম করল—আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী না সন্ত্রাসীরা? অধিকাংশ গুমের ঘটনা ঘটছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।
দেশের আলোচিত গুম হয়ে যাওয়া বিএনপি নেতা সিলেটের পরিচিত মুখ, ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদী ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ি চালক আনসার আলীকে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে গুম করা হয়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন মেধাবী ছাত্র আল মুকাদ্দাস এবং মু. ওয়ালীউল্লাহ, গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম, ঢাকা সিটির সাবেক কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম, সিলেটের ছাত্র নেতা দিনার ও জুনেদ, বরিশালের উজিরপুরের বিএনপি নেতা হুমায়ুন খান, ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সভাপতি নাজমুল ইসলামের মধ্যে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম ও নাজমুল ইসলামের লাশ পাওয়া গেছে। এছাড়া দেশের অনেক অঞ্চলের গুম হয়ে যাওয়া কিছু ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেলেও খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। যার ফলে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ। গুম হয়ে যাওয়া পরিবার সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেও তাদের স্বজনকে পাচ্ছে না, গুপ্তহত্যার বিচার পাচ্ছে না। আমরা দেখেছি, সিলেটের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলী যখন গুম হন তখন তার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সাহায্য চেয়েছেন ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার জন্য, প্রধানমন্ত্রীও সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু কথায়, সেটা শুধু মুখেই রয়ে যায়, বাস্তবে সাহায্যের নজির দেখা যায়নি। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন মেধাবী ছাত্রের পরিবার দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে যাচ্ছে অথচ তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ওই পরিবার দাবি করছে, গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি র্যাব পরিচয়ে ঢাকায় হানিফ এন্টারপ্রাইজের গাড়ি থেকে আটক করে নিয়ে গেছে তাদের। এদিকে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের খুনিদের আজ পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি প্রশাসন। তার নির্মম গুপ্তহত্যার পর আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশ সরকারের অনেক সমালোচনা করা হয়েছে। সময় সময় দেখা গেছে, গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের ফিরে পাওয়ার জন্য দেশে প্রতিবাদ স্বরূপ মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন, এমনকি হরতাল করা হয়েছে। আর এই প্রতিবাদী মানুষদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে খুনও হয়েছেন অনেকে। শুধু গুম নয়, দেশের এত করুণ অবস্থা যে নিজ বেডরুমেও শান্তিতে থাকতে পারছে না সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ, এমনকি সাংবাদিকরাও হয় গুম হচ্ছেন না হয় খুন হচ্ছে। নিজ বেডরুমে খুন হলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। তাদের খুনিদের গ্রেফতার করতে পারেনি সরকার।
ইলিয়াস আলী গুম হয়ে যাওয়ার পর দেশে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল তা দেশ পেরিয়ে বিদেশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশ, জাতিসংঘ, দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনসহ প্রভাবশালী অনেক সংগঠন ইলিয়াস আলীসহ সব গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার জন্য ও গুপ্তহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। দেশের পরিস্থিতি যখন জঘন্যতম অবস্থানে যাচ্ছিল তখন সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুন উচ্চস্বরে বলেছিলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা এতই ভালো যে গত ১০ বছর নাকি এরকম ছিল না। তার এই কথার প্রতিবাদ করেছেন দেশের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা। সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বদল করল, তারপরও গুমের ঘটনার একটিরও কূল-কিনারা হয়নি। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুন ও বর্তমান মন্ত্রী মখা আলমগীর সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই ভয়াবহ অবস্থায় দেশের মানুষ সাধারণ মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মৃত্যুর ডাক এলে যেমন কেউ রুখতে পারবে না, তেমনি গুম, গুপ্তহত্যা, জেল হত্যা, হানাহানি থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের রয়েছে। কিন্তু সেই অধিকার দিতে বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। গত ৪ বছরে যত নির্মম গুম ও হত্যাকাণ্ড হয়েছে, প্রত্যেকটির সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সরকারকে চাপ দিতে দেশবাসীকে ভূমিকা রাখতে হবে। অন্য দিকে দেশের এই করুণ পরিস্থিতিতে যারা নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না, তাদের বলতে চাই—আগামীতে আপনি কিংবা আপনার পরিবারের একজন গুম হবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? সময় থাকতে দল নির্বিশেষে এই মরণ ব্যাধির বিপক্ষে সোচ্চার হোন, দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলুন। দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়ি চালক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন মেধাবী ছাত্র আল মুকাদ্দাস এবং মু. ওয়ালীউল্লাহ, সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমদ দিনার, জুনেদ ও দেশের গুম হয়ে যাওয়া সব ব্যক্তির সন্ধান এবং গুপ্তহত্যার বিচারের দাবিতে এখনই দেশবাসীকে সোচ্চার হতে হবে। গুম হলো মানবতাবিরোধী কাজের অন্যতম একটি। সুতরাং বাংলাদেশের মাটিতে গুম ও গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না। অবিলম্বে গুম হওয়া সব বিরোধী নেতাকর্মী ও সাধারণ নাগরিককে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা সরকারকে চালাতেই হবে, গুপ্তহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত খুনিদের খুঁজে বের করতেই হবে। অন্যথায় গুম ও গুপ্তহত্যার নোংরা রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, তা বলার বাকি থাকে না।
http://www.amardeshonline.com/pages/printnews/2013/09/08/215510
বিষয়: বিবিধ
১৪৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন