পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক এর কলামগুলো (৩ ও ৪)
লিখেছেন লিখেছেন বাংলার সিংহ ০৬ মে, ২০১৫, ০৩:১৮:২৪ দুপুর
রাজনীতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পর্ক নিয়ে বোঝাবুঝি // মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক //
গত বুধবার ১১ মার্চ ২০১৫ তারিখে এই নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বোঝাবুঝির অভাব’ শিরোনামে প্রকাশিত কলামের ধারাবাহিকতাতেই আজকের এই কলাম। তবে আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখার আগে অল্প পরিসরে কিছু ভিন্ন কথা উপস্থাপন করছি। অতঃপর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আলোচনা। গত সপ্তাহের কলামটি পড়ে প্রচুর লোক ইন্টারনেটে, ফেসবুকে এবং এসএমএস-এর মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বহু লোক ফোন করেছেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বিশেষ ধন্যবাদ কারণ আজ প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় তিনি মতিঝিলের রাজপথে, গণমানুষের মহব্বতে এবং তাদের স্বার্থে অবস্থান করছেন। ওই ভৌগোলিক অবস্থান থেকেই তিনি কলাম পড়ে ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ১২ মার্চ ২০১৫ তারিখে। তার ওখানে (মতিঝিলের ফুটপাথ) রাজনৈতিক অতিথি হওয়ার জন্য দাওয়াতও দিয়েছেন। নয়া দিগন্ত পত্রিকার অফিস থেকেও বঙ্গবীরসহ আরো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির অভিনন্দনের কথা আমাকে জানানো হয়েছে। বিনয়ের সাথে অভিনন্দন গ্রহণ করছি। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠক কাদের সিদ্দিকীকে আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন, তার সাহসী কষ্টসহিষ্ণু অবস্থানের জন্য। তিনি সর্বদাই মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণের পক্ষে নয়া দিগন্ত, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও অন্যান্য পত্রিকায় তার লেখা কলামগুলো বস্তুনিষ্ঠ ও পাঠকপ্রিয়।
প্রসঙ্গ সাংবাদিক মুন্নি সাহা
মাসাধিক কাল আগে ১৩ ফেব্র“য়ারি ২০১৫ তারিখে বিখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজে রাত সাড়ে ৯টায় একটি টকশোতে উপস্থিত ছিলাম। উপস্থাপক ছিলেন সম্মানিত এবং সুপরিচিত সাংবাদিক মুন্নি সাহা। আলোচনার শেষ চতুর্থাংশে হঠাৎ করে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ওয়ান ম্যান ওয়ান পার্টি। তিনি আমাকে ও আমাদের পার্টিকে অযাচিতভাবে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অপমান করেছিলেন। আমি প্রতিবাদ করেছি সাথে সাথে, একপর্যায়ে দাবি করেছি তিনি যেন ক্ষমা চান। সম্মানিত সাংবাদিক মুন্নি সাহা তার ভুলের জন্য জাতির সামনে তাৎক্ষণিক ক্ষমা চান। অনেক অনলাইন পত্রিকা এবং অনেক ব্যক্তি, এটিএন নিউজের ওই লাইভ টকশো থেকে ওইটুকু দৃশ্য (৫১ সেকেন্ড) উদ্ধৃত করে ফেসবুকে শেয়ার করেন। ওই ৫১ সেকেন্ডের ভিডিওটি আমার টাইমলাইনে আমিও শেয়ার করেছি এবং আরো অগণিত ব্যক্তি ও অনলাইন পত্রিকা নিজেরাই শেয়ার করেছে। শুধু আমার ফেসবুক পোস্ট থেকেই প্রায় দুই লাখ বার ভিউ করা হয়েছে, মানে মানুষ দেখেছেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও তার লেখা কলামে প্রতিবাদ জানিয়েছেন আলোচ্য ঘটনার।
ছোট রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়া
ওপরের অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। এই কথাটা বললাম এ জন্য যে, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের রাজনীতি ও মিডিয়ার মধ্যে সম্পর্ক এমন যে, ুদ্র রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড, পরিচিতি ইত্যাদি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা খুব মুশকিল। কল্যাণ পার্টি একটি নিবন্ধিত দল; নিবন্ধনের সব শর্ত মেনেই চলছে। ঢাকা মহানগরের নয়াপল্টন এলাকায় মসজিদ গলিতে একটি দালানের ষষ্ঠ তলায় চারশত বর্গফুটের অফিস আছে কল্যাণ পার্টির; একই ফোরে বাংলাদেশ ন্যাপেরও অফিস আছে। ঢাকা মহানগরের মহাখালী এলাকায় কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যানের আলাদা কার্যালয় আছে এক হাজার ৫০০ বর্গফুটের। কল্যাণ পার্টিতে যুব সংগঠন আছে, ছাত্র সংগঠন আছে, মহিলা সংগঠন আছে। নিয়মিত মিটিং ও কাউন্সিল হয়। কল্যাণ পার্টিতে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক কর্মীর সমাহার কম নয়। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আলেম-ওলামা, ইঞ্জিনিয়ার তথা পেশাজীবীরা বিভিন্ন নিয়মে সম্পৃক্ত আছেন। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মেকানিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুশতাক হোসেন ১৩ মার্চ ২০১৫ দিনের শেষে রাত্রি ১১:৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করলেন ৬৮ বছর বয়সে। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি। সাড়ে ছয় বছর আগে আমাদের বয়স যখন মাত্র বারো মাস তখন ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে আমাদের ৩৬ জন প্রার্থী ছিল। সাহসের সাথে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি এবং বিনয়ের সাথে পরাজয় স্বীকার করেছি। মরহুম কর্নেল মুশতাক লাকসাম থেকে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু ওইসব প্রার্থী বা অন্যান্য নেতাকর্মী বা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা, দেশবাসীর সামনে পরিচিত হবেন কোন নিয়মে? তাদের নিজ নিজ এলাকার মানুষ চেনে, কিন্তু তারা জাতীয় ভিত্তিতে পরিচিত নন। তারা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে যায়, শান্তিপূর্ণ মিছিলে যায়, গঠনমূলক আলোচনা সভায় যায়, নিজ নিজ এলাকায় সময় দেয়। কিন্তু দেশবাসীর কাছে কথাগুলো বা ঘটনাগুলো উপস্থাপন করার সুযোগ ও মাধ্যম স্বাভাবিকভাবেই দু®প্রাপ্য ও খুবই কঠিন। কিছু দিন আগে সরকারের অনুমতি নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করেছিল। আজ থেকে কয়েক দিন আগে টেলিভিশনের টকশোতে ওই পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনলাম, ‘সোহরাওয়ার্দীতে আমরা যতবড় মিটিং করেছি, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ করলে টিভিগুলো কম্পিটিশন দিয়ে দেখাত; অথচ আমরা ছোট বলে কেউ পাঁচ সেকেন্ড দেখাল, কেউ দেখালই না, কোনো টিভি বলল আবার কোনো টিভি বললও না।’ প্রায় চার মাস আগে, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। প্রেস ক্লাবের বড় হলে ৬০০ থেকে ৭০০ লোকের মিটিং ছিল। স্টেজ ভরা বিভিন্ন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা ছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ। ২০টা টিভি সংবাদে দেখিয়েছে। মুন্নি সাহার টিভিও দেখিয়েছে। কিন্তু শুধু এক দিন বা পাঁচ-সাত দিন দেখলেই, জাতির সামনে সব নেতাকর্মীর পরিচিত হওয়া বা রিকগনিশন পাওয়া মুশকিল, এটাও সত্য। আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। আমাদের যত সদস্য, ততধিক শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। আমাদের বড় কষ্ট আর্থিক কষ্ট। মেধার অভাব বা পরিশ্রমের অভাব আমাদের কষ্ট নয়। আমরা সবার সহযোগিতা চাই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ও জনসংখ্যা
ওপরের অনুচ্ছেদের আলোচনার ধারাবাহিকতায় বলতে চাই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টিও বাংলাদেশের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে অতি সচেতন এবং সোচ্চার। সর্বস্তরের বিশেষত জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদেরা এই সমস্যা অনুধাবন করলে ভালো। এই প্রসঙ্গে অল্পকিছু লিখব আজকের কলামে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০০ ভাগের ১ ভাগের অর্ধেকের কিছু বেশি তথা শূন্য দশমিক পাঁচ পাঁচ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের দশ ভাগের এক ভাগ হলেও বিরাজমান সমস্যাটি আমাদের দেশের অন্য দশটি সমস্যার মতো নয়; অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আয়তন দেখলে হবে না, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভূমি চাষের যোগ্য নয় বা আবাসযোগ্য নয়, এটাও মনে রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা এক শতাংশের কম হলেও, তাদের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেন এই আলোচনাটাই অতি সংপ্তিভাবে গত কলামে এবং এই কলামে করছি। সম্ভবত আরো দুই-একটি কলাম লিখতে হবে।
সাংবাদিক ম. হামিদ এবং আগুন
আমরা আজ থেকে ২৬ বছর ১১ মাস পেছনে ফিরে যাই। রমজান মাস চলছিল। তারিখটি হলো ২৪ এপ্রিল ১৯৮৮; সময় হলো তারাবিহর নামাজের পর রাত ৯টা। তৎকালীন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সুপরিচিত সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ আমার অফিসে বসা ছিলেন। আমি খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার। তিনি গিয়েছিলেন, ক্ষুদ্র একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বা প্রামাণ্য চিত্র বানাতে। ম. হামিদ গল্পচ্ছলে যা বলেছিলেন সেটা হুবহু উদ্ধৃত করতে পারছি না, কিন্তু অনেকটা এ রকম ছিল : ‘আপনারা আর্মির লোক সব দিকে ভয়ের কথা ছড়াইতে থাকেন। কয়েক দিন ধরে পড়ে আছি, আপনাদের সাথেই তো চলাফেরা করছি, কই কোনো মারধর, গোলাগুলি বা আগুন তো নেই।’ আমার উত্তর : ‘হামিদ ভাই, এইরূপ প্রার্থনা করবেন না, আল্লাহ যেন আপনার এ রকম কোনো প্রার্থনা কবুল না করেন। গোলাগুলি ও আগুন দেখার শখ ভালো না।’ সম্মানিত পাঠক, বিশ্বাস করতেও পারেন, না-ও করতে পারেন। বাংলা ভাষার দুইটি শব্দ যথা : কাকতালীয় বা ঘটনাক্রমের সাথে আপনারা পরিচিত। এ রকমই কাকতালীয় ঘটনা। আমার কথা শেষ হওয়ার দুই-চার মিনিটের মধ্যেই প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ কানে এসে গেল। জনাব ম. হামিদকে বললাম, আপনি জিতে গেছেন, আপনার প্রার্থনা কবুল হয়েছে, এখন আপনাকে নিয়ে গোলাগুলি এবং আগুনের স্থলে যাবো। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সঙ্গী-সাথী নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলাম। আমার অফিস থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে কুমিল্লা টিলা নামক বাঙালি গ্রামে আক্রমণ এবং আগুন দিয়েছে শান্তিবাহিনী। গ্রাম পুড়ে গেল, এক ডজন মানুষ আগুনে এবং গুলিতে মরে গেল, অনেক ডজন জখম হলো। পরের দিন এবং তার পরের দিন এবং অব্যাহতভাবে আমাদের চেষ্টা ছিল, যেন অন্যত্র বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রামে প্রতিশোধমূলকভাবে কোনো আক্রমণ না করে। ২৪ এপ্রিলের ঘটনার পর থেকে পরবর্তী ১০-১২ দিন, প্রায় প্রতিদিন শান্তিবাহিনী খাগড়াছড়ি জেলার কোনো-না-কোনো বাঙালি গ্রামে আক্রমণ করছিল এবং আগুন দিচ্ছিল। সাংবাদিক ম. হামিদ ভাইয়ের ক্যামেরার দ্বারা দারুণ উপকার পাওয়া গেল। তিনি অনেক সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করতে পারলেন এসব সহিংসতা প্রসঙ্গে। ২৫ এপ্রিল তারিখে তিনি ছবি এবং কিছু বক্তব্য খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম থেকে আকাশ পথে ঢাকা পাঠালেন। বাংলাদেশের মানুষ ২৫ তারিখ দিনের শেষে রাতের সংবাদে এই নৃশংসতা দেখল। পরবর্তী তিন চার দিন সন্ধ্যাতেই, এইরূপভাবে খাগড়াছড়ি থেকে সচিত্র সংবাদ, বিটিভিতে দেখানো হয়েছে। বাঙালি এবং উপজাতি অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মৌখিক সাক্ষাৎকারসহ সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পারল যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক একটা জায়গা আছে এবং সেখানে একটা সমস্যা আছে। এই সুবিধাটা পাওয়া গিয়েছে, ঘটনাক্রমে খাগড়াছড়িতে টেলিভিশন ক্যামেরা থাকায়, যখন লোমহর্ষক ঘটনাগুলো ঘটছিল। সে জন্য বলতে বাধ্য যে, উপলব্ধি হয়েছে ভালো কিন্তু বড় মূল্য দিয়ে উপলব্ধি অর্জন করতে হয়েছে।
সমস্যার ব্যাপ্তি অনুধাবন
তখনকার আমলে কেউ বলতেন, এটা মিলিটারি প্রবলেম বা আর্মির সমস্যা। কেউ বলতেন, এটা ভারত সৃষ্টি করেছে। কেউ বলতেন, রাজনীতিবিদেরা এটাতে কোনোমতেই জড়িত না। সেই ২৪ এপ্রিল বা তৎপরবর্তী ঘটনাগুলো মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্ঘাত নিরসনের প্রক্রিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, ইতিবাচকভাবে। বাংলাদেশের জনমানুষের মানসপটে শান্তিবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সরকার সংলাপের মাধ্যমে বিরাজমান পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান চায়, অপরপে শান্তিবাহিনী আক্রমণের মাধ্যমে সমাধান চায়- এরূপ ধারণা মানুষ মিডিয়া থেকে পায়। ৫ মে ১৯৮৮ তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ খাগড়াছড়ি জেলায় ও জেলা সদরে গিয়েছিলেন। হেলিকপ্টার থেকে এবং মাটিতে সব দেখে ও শুনে আমাদের ওপর অনেক বিরক্ত ছিলেন। অনেক বকাঝকা করলেন। বললেন, এত মানুষ কেন মরছে আমাকে বুঝাও। বোঝার জন্য তিনি ২০ মিনিট সময় দিয়েছিলেন। আমি বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, ২০ মিনিটে বলা যাবে না! আমি দুই ঘণ্টা সময় চেয়েছিলাম, আমার আবেগঘন আবেদনে রাজি হয়ে তিনি এবং অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দুই ঘণ্টা ধরে আমার কথা শুনেছিলেন। শুনে তিনি বলেছিলেন, আমি এর অর্ধেক কথাও জানতাম না। না জানার কারণ, প্রেসিডেন্টের কাছে এত কথা কে বলবে? অথবা এত কথা শোনার সময় প্রেসিডেন্টের কি আছে? শুনলেন তো এমনভাবেই শুনলেন যে, প্রেসিডেন্ট আমাদের আদেশ দিলেন বঙ্গভবনে এসে এই কথাগুলো শুনাতে। ৮ মে ১৯৮৮ বিকেলে ইফতারের আগে দুই-তিন ঘণ্টা সময়। দুই মিনিট বললেন প্রেসিডেন্ট; পাঁচ মিনিট বললেন তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আতিক; পাঁচ মিনিট বললেন তৎকালীন চট্টগ্রামের জিওসি জেনারেল সালাম। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট বললাম আমি কর্নেল ইবরাহিম বীর প্রতীক। আধা ঘণ্টার মতো সময় প্রশ্ন এবং উত্তরের জন্য নির্ধারিত ছিল। কাদের সামনে বললাম? সরকারের ক্যাবিনেটে যতজন মন্ত্রী ছিলেন তারা, যতজন সচিব ছিলেন তারা, ঢাকায় যতজন জেনারেল ছিলেন তারা, ঢাকায় জ্যেষ্ঠ ব্রিগেডিয়ার, পুলিশের আইজি এবং আরো চার-পাঁচজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ অফিসার প্রমুখ। প্রেসিডেন্ট এবং সেনাপ্রধান অভয় দিয়েছিলেন যে, তুমি স্পষ্টভাবে সব কথা বলবে, ভয় পাবে না। কারণ আমরা চাই সরকারের নীতিনির্ধারক মহল সমস্যাটি সম্পর্কে অবহিত হোক।
সমস্যার দায়িত্ব হস্তান্তর
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ছোটকালে ক্যাডেট কলেজে পড়ার আমল থেকেই উপস্থিত বক্তৃতা এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। আশির দশকের মাঝখানে তিন বছর বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মেধাবী মাঝারি চাকরিপর্যায়ের অফিসারদের অপরিহার্য প্রশিণ প্রতিষ্ঠান স্টাফ কলেজের প্রশিক ছিল। অর্থাৎ ইবরাহিমের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এরূপভাবে কথা গুছিয়ে উপস্থাপনের উদাহরণ যথেষ্ট ছিল। ওই ৮ মে ১৯৮৮ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটিকে মিলিটারিদের প্লেট (বাসন বা থালা) থেকে বেসামরিকদের প্লেটে হস্তান্তর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদপে ছিল। এটা যে শুধু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সমস্যা নয়, এটা যে বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সমস্যা (তথা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, নৃতাত্ত্বিক, জাতিগঠন, অর্থনৈতিক ইত্যাদি) এই কথাটা উপস্থাপন এবং এই কথাটার গ্রহণযোগ্যতা শক্তভাবে শুরু হয় ৮ মে ১৯৮৮ তারিখ থেকে। ৮ মে ১৯৮৮ তারিখের পরবর্তী এক মাসের মধ্যে, সরকারের পাঁচটি ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন সচিব খাগড়াছড়ি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং একটি করে রাত কাটিয়েছিলেন। ইংরেজিতে কথা আছে- সিইং ইজ বিলিভিং অর্থাৎ দেখলেই বিশ্বাস হয়। খাগড়াছড়িতে সফর করে, ছোট বড় মানুষের সাথে কথা বলে, সচিব মহোদয়রা পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজেদের ধারণা পোক্ত করতে পেরেছিলেন।
নতুন অভিজ্ঞতা
আমি ওপরের দুই-তিনটি অনুচ্ছেদে বোঝাতে চেয়েছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যাটির স্বরূপ নির্ধারণের প্রক্রিয়ার শুরু কী প্রকারে হয়েছিল। তাহলে পাঠকদের মধ্যে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো-না-কোনো প্রকারে কোনো-না-কোনো সময়ে চাকরি করেছেন, তাদের মনে প্রশ্ন থাকবে, এত দিন এটা কী প্রকারের সমস্যা ছিল। বস্তুত ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরে শান্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রমণের মাধ্যমে যেই বিদ্রোহ বা যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছিল তার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছিল বা তার প্রকৃতি উন্মোচিত হতে দু’চার বছর লেগে গিয়েছিল। পাঠক অনুগ্রহপূর্বক ১৯৭৬-৭৭-৭৮-এর বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীগুলোর আকার-আকৃতি ও সাংগঠনিক অবস্থানের কথা খেয়াল করুন। নতুন দেশ নতুন বাহিনী। তার মধ্যে ১৯৭৫-এর ঘটনাবলি। ওই আমলের সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে এইরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এইরূপ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। অর্থাৎ এক দিকে শান্তিবাহিনী তাদের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড বা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, অপর দিকে বাংলাদেশ সরকার সেটা মোকাবেলা করার কলাকৌশল বা প্রক্রিয়ামাত্র রপ্ত করা শুরু করেছে। ঘটনাক্রমে ১৯৭৬-৭৭-৭৮ সালে যিনি বাংলাদেশ সরকারের কর্ণধার ছিলেন, সেনাবাহিনীরও কর্ণধার ছিলেন তিনি। অতএব তিনি তার কনিষ্ঠ সহকর্মীদের মূল দায়িত্বটি দিয়েছিলেন কলাকৌশল ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করার। মেহেরবানি করে খেয়াল করুন যে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ থেকে মাত্র একটি রাজনৈতিক দল ছিল দেশে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ অন্য সব রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্ত করা হয়েছিল। একমাত্র দলটির নাম ছিল বাকশাল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, ওই দিনের রাজনৈতিক সামরিক বিদ্রোহের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। আড়াই মাস পর ৩ নভেম্বরের সামরিক বিদ্রোহের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত করে দেয়া হয়েছিল। অতঃপর দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, ক্রমান্বয়ে যখন রাজনীতির অঙ্গনে জড়িয়ে পড়ছিলেন তখন তিনি নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেন। জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন রাজনীতিবিহীন একটি দেশ চলতে পারে না। তাই জিয়াউর রহমান যখন সংবিধান পুনরায় চালু করেন, তখন তিনি নতুন করে অথবা পুনরায় ১৯৭৫-এর জানুয়ারির আগের মতো বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। জিয়াউর রহমানের হাতেই আওয়ামী লীগও নতুন করে নিজেদের হারানো জীবন ফিরে পায়। আমি ১৯৭৮ সালের কথা বলছি। ওই আমলের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নাজুক অবস্থাতেই এত বেশি কাহিল ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। এখন ২০১৫ সালে আরাম-আয়েশে বসে ৩৫ বছর আগের কর্তাব্যক্তিদের দোষ দেয়া সহজ।
জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর
জিয়াউর রহমান দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেই ১৯৭৮ সালের একসময়, তার দৃষ্টিতে দ সেনা অফিসার ওই আমলের মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তমকে চট্টগ্রামের জিওসি নিযুক্ত করেছিলেন। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম অত্যন্ত মেধাবী অফিসার ছিলেন, যথাসময়ে স্টাফ কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেন। ১৯৭০-৭১-এ তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নামী-দামি বা অভিজাত প্যারাসুট ব্রিগেডের (সংক্ষেপে প্যারা ব্রিগেড) ব্রিগেড মেজর বা বিএম ছিলেন। ১৯৭১-এর মাঝামাঝিতে তিনি সপরিবার পাকিস্তান থেকে পলায়ন করে, আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। তিনি একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের জিওসি ছিলেন প্রায় তিন বছর এবং সেই সময় অনেক কৌশলগত (বা স্ট্র্যাটেজিক) সিদ্ধান্ত তিনি পেয়েছেন, বা নিজে নিয়েছেন এবং সবই বাস্তবায়ন করেছেন। অন্ততপে সামরিক বাহিনীর কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি রেওয়াজ বা ধারা তিনি গড়ে তোলেন। আমি ১৯৭৮ সালের প্রথমার্ধে যখন সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে, তখনকার আমলের ফারুয়া ও রাজস্থলী থানার ভৌগোলিক এলাকায় দায়িত্ব পালনরত ছিলাম। তখন একদিন রাজস্থলী বাজার ক্যাম্পে, জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুর এসেছিলেন। আধাঘণ্টা সময় অবস্থান করেছিলেন। ৮-৯ বছর চাকরির ইবরাহিম, জেনারেল মঞ্জুরের জ্ঞানগর্ভ ধারণাগত আলোচনা এবং দিকনির্দেশনাগুলো আংশিকভাবে বুঝেছিলাম মাত্র। সেই সময় শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক যুদ্ধ তুমুলভাবে চলছে। শান্তিবাহিনীর প্রাধান্য বিস্তার করা এলাকা ছিল দণি ও মধ্যম পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থাৎ বর্তমান আমলের বান্দরবান জেলা এবং রাঙ্গামাটি জেলার দক্ষিণাংশ। সামরিক বাহিনীর সামরিক কর্মকাণ্ড এই এলাকাগুলোতেই জোরদার করা হচ্ছিল। শান্তিবাহিনী সর্বপ্রকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান করেই যাচ্ছিল। চাঁদাবাজি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। গুম, অপহরণ ও হত্যা প্রায়ই হতো। শ্রমিকদের মেরে ফেলা হতো। পাহাড়িরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলেন না, অভ্যাস করতে দেয়াও হচ্ছিল না। এইরূপ পরিস্থিতিতে কী নিয়মে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালু করা ও অব্যাহত রাখা যায় এবং সাথে সাথে সামরিক অপারেশনও পরিচালনা করা যায়, এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন ছিল। আগামী সপ্তাহে এ নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
লেখক: মেজর জেনারেল (অব চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
(১ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত)
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের অবস্থানের প্রেক্ষাপট // মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক //
সূচনা বক্তব্য
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যাটি প্রসঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তরুণসমাজ পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় অসচেতন। তাই বর্তমান প্রজন্মকে অবহিত ও সচেতন করার জন্য কষ্ট করে কলাম লিখছি। যদিও একটি বা দু’টি বা চার-পাঁচটি কলামে সব কথা কোনোমতেই বলা সম্ভব নয়, তথাপি চেষ্টা করছি। প্রথম দু’টি কলাম ব্যয় হয়েছে প্রেক্ষাপট বোঝাতে। তৃতীয় কলামে গিয়ে বলেছি বাঙালি ও ভূমি সমস্যা প্রসঙ্গে। আজকেও বাঙালি ও ভূমি নিয়ে বলব। এ প্রসঙ্গে পঞ্চম ও শেষ কলামে লিখব দুই বা তিন সপ্তাহ পর উপজাতি গোষ্ঠীকে আদিবাসী বলা বা না বলা প্রসঙ্গে।
জাতীয়ভাবে ব্যবস্থাপনার কাঠামো
১৯৮৭ সালের ১৭-১৮ ডিসেম্বর শান্তিবাহিনীর সাথে সরকারি প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়েছিল। তার পর ১৯৮৮-এর জানুয়ারিতে একবার হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে একবার হয়েছে, আবার জুন মাসে হয়েছে। মাঝখানে এপ্রিল-মে মাসের গল্প গত ১৮ মার্চের কলামে বলেছি। কলামগুলো নয়া দিগন্তের ওয়েবসাইটের আর্কাইভসে পাবেন অথবা আমার ওয়েবসাইটে পাবেন। ওয়েবসাইটের পরিচয় এই কলামের শেষে দেয়া আছে। শান্তিবাহিনীর প থেকে উপস্থাপিত দাবিনামার ভেতরে দাবিগুলো এত মারাত্মক ছিল যে আমরা সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করিনি। গ্রহণ না করলেও আমরা জানি শান্তিবাহিনী কী চাচ্ছিল।
সরকারপ্রধান জেনারেল এরশাদের বক্তব্য ছিল, কিছু না কিছু দেবো, শান্তি চাই। কতটুকু দিলে হবে, এটা একটা উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। ১৯৮৮ সালে আমি খাগড়াছড়ি ব্রিগেড কমান্ডার ছিলাম। রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হলেও রাজনৈতিকভাবে আলাপ-আলোচনা পরিচালনা করার জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক অবকাঠামো ছিল না। তাই সরকার একটি পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি করেছিল; এর প্রধান ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার। সদস্য ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক পরে রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির, চট্টগ্রামের জিওসি, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রামের বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার প্রমুখ। মাঠে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য এককভাবে পরিশ্রম ও সংগ্রাম করতে হয়েছিল আমাকে। আমার পৃষ্ঠপোষকতায়, আমার সহকর্মীরাও অকান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল- সশস্ত্র বিদ্রোহকে সমাপ্তির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপাতত নিয়ন্ত্রণে আনা। উদ্দেশ্য ছিল- রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে, গ্রহণযোগ্য মাত্রায় গণতান্ত্রিক চর্চার ব্যবস্থা করা ও প্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা।
সেনাবাহিনী ও শান্তিবাহিনীর টানাটানি
১৯৮৮ সালের এপ্রিল-মে মাসের ঘটনার আগে থেকেই আমি পুরো খাগড়াছড়ি জেলায় প্রচার করেছিলাম যে, শান্তিবাহিনী যদি সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় না বসে, এবং শান্তিবাহিনী যদি বাঙালি গ্রামের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সরকার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে। অপরপে শান্তিবাহিনীর কৌশল ছিল এই যে, বাঙালিদের ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি করলে, সরকার চাপে পড়বে এবং তখন সরকার আমাদের (শান্তিবাহিনীর) পাঁচ দফা দাবিনামা আলোচনা করবে ও মেনে নেবে। এটা ছিল অ্যাথলেটিকস বা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন মাঠে যেমন রশি টানাটানি বা ‘টাগ অব ওয়্যার’-এর মতো। আগে আলোচনা করেছি, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সৌজন্যে দেশবাসী খাগড়াছড়ি জেলার মর্মান্তিক ঘটনাগুলো জানতে পারছিল। অতএব সরকারের ওপরে মনস্তাত্ত্বিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই ৮ মে ১৯৮৮ তারিখে বঙ্গভবনে ব্রিফিংয়ের পর, সরকারের প থেকে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ওই সিদ্ধান্তগুলো সামরিক বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন এবং গণ্যমান্য নাগরিকগণের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছিল।
গুচ্ছগ্রাম স্থাপনের সিদ্ধান্ত
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল দু’টি। প্রথমটি হলো খাগড়াছড়িতে বেশি, রাঙ্গামাটিতে কম; কিন্তু উভয় পার্বত্য জেলায় সামরিক বাহিনীর সংখ্যা বা শক্তি এপ্রিল ১৯৮৮ সালে যা ছিল তার ওপর প্রায় ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। যার ফলে শান্তিবাহিনীর বিদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ড দমন করা সহজ হয়েছিল এবং বাঙালি ও পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল। ৮ মে ১৯৮৮ তারিখের ব্রিফিংয়ের পরের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল, যেসব সেটেলার বাঙালির বসতি তাদের কৃষিজমি থেকে দূরে এবং যারা শান্তিবাহিনী কর্তৃক সহজেই আক্রান্ত হয়, সেসব বাঙালিকে নিজ নিজ বসতি-স্থান বা গ্রাম থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে এক জায়গায় একত্রিত বা গুচ্ছ করতে হবে। একত্রিত করার জন্য যুগপৎ দু’টি ব্যবস্থা ছিল। প্রথম ব্যবস্থা হলো, কোনো একটি ক্ষুদ্র বাঙালি গ্রামকে কেন্দ্র বা নিউকিয়াস বানিয়ে দূরবর্তী অন্য গ্রামের বাঙালিদের সেই নিউক্লিয়াস গ্রামে এনে জড়ো করা। তাহলে ওই গ্রামটি আকারে বড় হবে। দ্বিতীয় ব্যবস্থা হলো, একদম শূন্যস্থানে তথা শূন্য দু-চারটি পাহাড় ও উপত্যকা বেছে নিয়ে সেখানে বাঙালিদের এনে একত্রিত করা বা গুচ্ছ করা। উভয় ব্যবস্থায় অনেক বাঙালি এক জায়গায় হলে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া সহজ হবে এবং ন্যূনতম কিছু না কিছু নাগরিক সুবিধা দেয়া যেতেও পারে। এরূপ গ্রামগুলোকে নাম দেয়া হলো গুচ্ছগ্রাম। গুচ্ছগ্রামের মানুষেরা যেহেতু তাদের কৃষিজমি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল, সেহেতু তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ন্যূনতম রেশন দেয়ার বন্দোবস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
গুচ্ছগ্রাম স্থাপনের উদ্দেশ্য
গুচ্ছগ্রামে আনার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শান্তিবাহিনী এবং নিরস্ত্র কৃষক বাঙালিদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা, যেন শান্তিবাহিনী বাঙালি মারতে না পারে। গুচ্ছগ্রামে আনার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে পরিচালনা করে সমস্ত বা সর্বপ্রকার জমির আকৃতি-আয়তন ইত্যাদি নির্ধারণ করা এবং অতঃপর এর মধ্য থেকে যেগুলো কৃষিযোগ্য জমি সেগুলো পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে প্রয়োজন অনুপাতে বণ্টন করা মালিকানাসহ পাহাড়িদেরকে অগ্রাধিকার দিয়ে। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে অগ্রাধিকার পাবে খাগড়াছড়ি জেলা। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং তার সরকার গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতি অনুমোদন করার সময় প্রাক্কলন করেছিলেন, আগামী তিন বছরের মধ্যে এই জরিপের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। অতএব, আনুমানিক সাড়ে তিন-চার বছরের মাথায় গুচ্ছগ্রাম ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের বেসামরিক কর্মকর্তারা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা অকান্ত পরিশ্রম করে এই গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। ওই আমলে শান্তিবাহিনী প্রচারণা করেছিল যে, বাঙালিদেরকে এক জায়গায় করা হয়েছে যেন বাঙালি তরুণদের সশস্ত্র প্রশিণ দেয়া সম্ভব হয় এবং সেই সশস্ত্র প্রশিতি তরুণেরা কিছু দিনের মধ্যেই পাহাড়িদের আক্রমণ করবে। আজ বোঝা সম্ভব, শান্তিবাহিনীর প্রচারণা কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভ্রান্ত ছিল। যা হোক, ১৯৮৮ সালের মে-জুনে নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে করতে অক্টোবর শেষ হয়ে যায়। ওই গুচ্ছগ্রামগুলো এখনো আছে। কারণ, শান্তিবাহিনী ওই আমলে জরিপকাজে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করেছিল। বস্তুত, সাত-আট বছর আগে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কাজেও শান্তিবাহিনী বাধার সৃষ্টি করেছিল। এখনো শান্তিবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কাজে বাধার সৃষ্টি করছে। আমার মূল্যায়ন নিম্নরূপ : হয় শান্তিবাহিনী ভুলপথে আছে, অথবা উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ভুলপথে আছেন অথবা বাঙালিরা ভুলপথে আছেন অথবা বাংলাদেশ সরকার ভুলপথে আছে অথবা সবাই কম-বেশি কিছু না কিছু ভুলপথে আছেন। ভুলগুলো আবিষ্কার করা প্রয়োজন। ভুলগুলো সংশোধন করা প্রয়োজন। ভুল নিয়ে দীর্ঘ দিন বসবাস করলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকিতে থাকবে।
গুচ্ছগ্রামগুলোর মূল্যায়ন
যেহেতু গুচ্ছগ্রামগুলো এখনো (২০১৫) আছে, সেহেতু সরকারকে এখনো সেখানে ভর্তুকি মূল্যে রেশন দিতে হয়। কিন্তু ১৯৮৮ সালে যে পরিবারগুলো গুচ্ছগ্রামে গিয়েছিল, সে পরিবারগুলো এখন বর্ধিত হয়ে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের পাঁচ বছরের শিশু এখন (২৭ বছর পর) ৩২ বছরের যুবক এবং ওই যুবকেরই পাঁচ বছরের শিশু আছে। গত ২৭ বছরে গুচ্ছগ্রামে কত লোক মারা গিয়েছে, যাদেরকে আশপাশে দাফন করা হয়েছে তার হিসাব তাৎণিক দিতে পারছি না। গুচ্ছগ্রামগুলোতে জীবনযাপনের মান অত্যন্ত দুর্বল। আজ থেকে ৩৫ বা ৪০ বছর আগে উপজাতীয় জনগণের যেরূপ দুরবস্থা দেখে তখনকার আমলের সরকার উপজাতীয় জনগণকে বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছিল, আজ বাঙালি জনগণ ওই রকম দুরবস্থায় আছে এবং ওই রকমই সুবিধা তাদের প্রয়োজন। গুচ্ছগ্রামে বাঙালি জনগণ স্বেচ্ছায় যায়নি। তারা সরকারি হুকুমে সরকারি বন্দোবস্তে সরকারের কাজে সুযোগ সৃষ্টি করতে বা সহযোগিতা করতে গুচ্ছগ্রামে গিয়েছিল। যদি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে গুচ্ছগ্রামে নেয়া না হতো, তাহলে বাঙালিরা শান্তিবাহিনীর আক্রমণে মরত আবার নিজেরাও নিকটস্থ উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে মারত। মরে এবং মেরে তারা নিজেদের অধিকার আদায় করে ওখানে থাকত। কারণ, তারা এমনিতেই দুস্থ ও ভূমিহীন ছিল। তারা ঠিকানাবিহীন ছিল। সরকারি উদ্যোগে তাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছিল একান্তভাবেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে। ওই আমলের বাংলাদেশ সরকার তার অনুকূলে ভোটার সংখ্যা বাড়াতে ওই দুস্থ ভূমিহীন বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে নেয়নি। সরকার নিয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে। আজ অন্তত বাংলাদেশের পতাকা প্রচুর জায়গায় ওড়ে। কিন্তু ১৯৭৯ বা ’৮৩ বা ’৮৭ সালেও চার ভাগের তিন ভাগ অঞ্চলে বাংলাদেশের পতাকা উড়ত না। যে মর্যাদারই হোক না কেন, বাঙালি জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ আছে; তা না হলে এখানে ব্যতিক্রম হতো।
ইউএনডিপির অদ্ভুত প্রস্তাব
যা বলছিলাম, ১৭ মার্চ ২০১৫ তারিখটি ছিল সরকারি ছুটির দিন; বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস। ওইদিন দিনের প্রথমার্ধে ঢাকা মহানগরীতে অবস্থিত ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম বা ইউএনডিপি অফিসের উদ্যোগে রাঙ্গামাটি শহরে অবস্থিত ইউএনডিপি অফিসে শহরের বাঙালি নেতাদের ডেকে এনে বসানো হয়। অতঃপর ঢাকার সাথে রাঙ্গামাটির টেলিকনফারেন্স হয়। ঢাকা থেকে ইউএনডিপির অফিসের কর্মকর্তারা বাঙালি নেতাদের যা বলেন তা অনেকটা এ রকম : ‘আপনারা বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক কষ্টে আছেন। আপনাদেরকে পাহাড়িরা কেউ গ্রহণ করছে না। আপনারা এখানে অযাচিত। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনারাও বাংলাদেশের সন্তান। আপনাদেরও শুভাকাক্সী আছে। বাংলাদেশের শুভাকাক্সী এবং আপনাদের শুভাকাক্সী হিসেবে আমরা আপনাদের নিরাপত্তা ও মঙ্গল নিয়ে চিন্তিত। সে জন্য আমরা আপনাদের একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। প্রস্তাবটি হলো আমরা আপনাদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করব, আপনাদের পুনর্বাসনের জন্য যা লাগে তাই করব, কিন্তু আপনারা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে অন্যত্র যাবেন কি না। আপনারা সবাই বিজ্ঞ লোক, তাই আপনারা চিন্তা করে দেখুন।’ ১৭ মার্চের ওই টেলিকনফারেন্সে উপস্থিত বাঙালিরা কড়া কড়া যুক্তি দিয়ে অত্যন্ত প্রতিবাদী ভাষায় ইউএনডিপির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমি আমার ফেসবুকে এ রকম লিখেছি : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার বিরোধী দল দমনে ব্যস্ত; ইউএনডিপি বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে ও জনগোষ্ঠীকে পুনর্বিন্যাস করায় ব্যস্ত, আফসোস!
বাঙালিবিরোধী সম্প্রদায়
বস্তুত ইউএনডিপি ন্যাংটাভাবে যে কথাটি বলে ফেলেছে, এটা অতি পুরনো কথা। চিটাগং হিলট্রাক্টস কমিশন নামক একটি সংস্থা আছে। এটা মূলত উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের দু-একটি দেশের কয়েকজন ব্যক্তির উদ্যোগে করা। এই কমিশনের সাথে নিবিড় সহযোগিতা করেন বাংলাদেশের কয়েকজন বাঙালি ও উপজাতীয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রলোক। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠী থাকুক, এটা এই সিএইচটি কমিশন চায় না, এবং তাদের অনুসারী বাংলাদেশের কিছু বামপন্থী ও ধর্মনিরপেপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও চান না। বাঙালি জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে না থাকলে পাশ্চাত্য বিশ্বের আগামী দিনের কিছু কিছু কাজ (এখন গোপনীয়) অতি সহজে ভবিষ্যতে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা না থাকলে বাংলাদেশ সরকারের কী হবে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো বা বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদেরা কদাচিত চিন্তা করেন বলে আমার মনে হয়। অতীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চিন্তা করত। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে চিন্তা করে কি না আমার জানা নেই; কারণ কোনো লণ নেই। সেনাবাহিনী চিন্তা করলেও বিপদ; কারণ তখন গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী, সেনাবাহিনী-বিরোধী কিছুসংখ্যক সম্মানিত বুদ্ধিজীবী হৈ হৈ রৈ রৈ করে ওঠেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেকোনো বিরোধ হলেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ বামপন্থী ও ধর্মনিরপেপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক মহল বাঙালিদের দোষ খুঁজে বেড়ান। সম্মানিত সাংবাদিক ম. হামিদের অভিজ্ঞতার কথা আমি ইতঃপূর্বে কলামে লিখেছি। বাঙালিরা যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে যায়, তার জন্য হেন অপচেষ্টা, হেন কু-চেষ্টা, হেন ষড়যন্ত্র বাকি নেই যেটা ধর্মনিরপেপন্থী ও বামপন্থী প্রশাসন করছে না। সম্মানিত পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন, ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসের চুক্তিগুলোতে এবং ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের চুক্তিটিতে বাঙালিদের সম্বন্ধে কী ছিল?
১৯৮৮ ও ’৯৭-এর চুক্তি এবং বাঙালি প্রসঙ্গ
১৯৮৮ সালে তিনটি জেলার জন্য তিনটি আলাদা চুক্তি হয়েছিল। চুক্তিগুলো, আইনগুলো এবং নির্বাচনের অন্যতম একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল কাঠামোগতভাবে পাহাড়ি ও বাঙালি সব জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক মঞ্চে একাত্ম করা। তার জন্য পার্বত্য জেলা পরিষদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাঙালিদের জনসংখ্যা আনুপাতিকভাবে যত ছিল, তার থেকে কম অনুপাতে জেলা পরিষদের বাঙালি সদস্য সংখ্যা করা হয়েছিল। প্রত্য ভোটে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শান্তিবাহিনী সুবিধাগুলো নিয়েছে, সুফল ভোগ করেছে; কিন্তু ১৯৮৮-৮৯ সালের শাসনব্যবস্থার সংস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে না নিলেও কিন্তু ১৯৯৭-এর পর থেকে মেনে নিয়েছে এবং সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছে। পুনরায় উল্লেখ্য, বাঙালিদের জনসংখ্যা বেশি ছিল, অনুপাতে অনেক বেশি প্রতিনিধি পেত; কিন্তু সরকারের অনুরোধে তারা প্রতিনিধি সংখ্যা কম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। উদ্দেশ্য- গিভ অ্যান্ড টেক; মানে কিছু দাও, কিছু নাও। বাঙালিরা কিছু স্বার্থ ত্যাগ করবে, পাহাড়িরা কিছু স্বার্থ ত্যাগ করবে, সবাই মিলে শান্তিতে বসবাসের চেষ্টা করবে। প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালের জুন মাসের ২৫ তারিখে। দেড় বছর পর এরশাদ সরকার পদত্যাগ করে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখে। পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৯৯২ জুন-জুলাই মাসে। তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্বাচনটি করায়নি। আমার মতে, না করিয়ে বিএনপি সরকার ভুল করেছিল। নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার শিকড় গভীরে যেত এবং শান্তিবাহিনীর প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমেই কমত। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিতে এ কথা স্পষ্ট করে লেখা নেই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিরা থাকতে পারবে না। আবার এ কথাও স্পষ্ট করে লেখা নেই যে, বাঙালিরা থাকতে পারবে। তৎকালীন সরকার শান্তিবাহিনীকে এবং বাঙালিদেরকে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়েছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুনের পর দু’টি বিএনপি সরকার এবং দু’টি আওয়ামী লীগ সরকার গত হয়েছে, কিন্তু কোনো সরকারই জেলা পরিষদের নির্বাচনটি করায়নি। করালে বাঙালিরা ওই প্রক্রিয়ায় শক্তিশালী হতো।
শুভঙ্করের ফাঁকির কথা
১৯৯৭ সালের চুক্তির আগে শান্তিবাহিনীর প থেকে শক্তিশালী দাবি ছিল যে, বাঙালিদের এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে এবং এটা চুক্তিতে লিখতে হবে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিবেচনা করল যে, এটা যদি চুক্তিতে লেখা হয় তাহলে সমগ্র দেশের প্রোপটে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য রাজনৈতিক বিপর্যয় হবে। অতএব একটা বিকল্প বন্দোবস্ত চুক্তি ও চুক্তি-পরবর্তী আইনের মাধ্যমে করা হয়েছিল। বন্দোবস্তটি হলো এ রকম- পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জন্য দুই প্রকারের ভোটার তালিকা থাকবে। এক প্রকার ভোটার তালিকায় পাহাড়ি ও বাঙালি সবাই থাকবেন এবং এই ভোটার তালিকা মোতাবেকই পার্লামেন্ট নির্বাচনে তারা ভোট দেবেন। দ্বিতীয় প্রকারের ভোটার তালিকা মোতাবেক সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন যথা ইউনিয়ন পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনে ভোট দিতে হবে। দ্বিতীয় তালিকায় পাহাড়িরা তো থাকবেন অবশ্যই, কিন্তু শুধু ওই বাঙালিরা থাকবেন, যেই বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়, সার্কেল-প্রধান তথা রাজা সার্টিফিকেট দিতে হবে যে, ওই বাঙালি স্থায়ী বাসিন্দা। সার্কেল-প্রধান সার্টিফিকেট দেয়ার আগে শর্ত পূরণ করতে হবে, ওই বাঙালি আইনানুগভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে জায়গাজমির মালিক। সম্মানিত পাঠক, এখানে শুভঙ্করের ফাঁকিটা কোথায়? মেহেরবানি করে আপনি ১৯৮৮ সালে ফেরত যান। হাজার হাজার বাঙালি পরিবার গুচ্ছগ্রামে এসেছে এবং তাদের জায়গাজমি থেকে অনেক দূরে আছে। দু-এক বছরের মধ্যেই পাহাড়িরা ওই জমিগুলো দখল করে ফেললেন। সারা বাংলাদেশ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত ছিল এবং এরশাদ সাহেবও পার্বত্য চট্টগ্রামে মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। জরিপকাজ শুরুই হয়নি, শেষ করা তো দূরের কথা। এ রকম করতে করতে ১৯৯৭ সাল এলো। মানে ৯-১০ বছর সময়। বাঙালিরা ইতস্তত বিপ্তি অসঙ্ঘবদ্ধ। শান্তিবাহিনী এবং ওই আমলের আওয়ামী লীগ সরকার মনে করল, যেহেতু হাজার হাজার বাঙালি পরিবার তাদের জায়গাজমির মালিকানার সপে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবেন না, সেহেতু তারা অর্থাৎ ওই বাঙালিরা স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট পাবেন না। যদি স্থায়ী বাসিন্দার সার্টিফিকেট না পান, তাহলে ওই বাঙালিরা স্থানীয় পর্যায়ের কোনো কিছুতে ভোট দিতে পারবেন না। অনেক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাহলে ওই বাঙালিরা অধৈর্য এবং ত্যক্তবিরক্ত হয়ে একসময় বলবেন, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে থাকব না, আমরা বাংলাদেশের অন্য কোথাও চলে যাই। তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হলো। আওয়ামী লীগ সরকারকে এই দায়িত্ব নিতে হলো না যে, তাদের সিদ্ধান্তেই বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে চলে গেল। অপরপক্ষে শান্তিবাহিনীকেও সন্তুষ্ট করা গেল, তোমরা শান্তিবাহিনী ধৈর্য ধরো, বাঙালিরা ক্রমে ক্রমে চলে যাবে। বাঙালিরা আসলে যাননি। তাই নতুন কৌশলে শান্তি বাহিনী ও ইউপিডিএফ আগাচ্ছে। ওই কৌশলের নাম আদিবাসী কৌশল। আগামী দু-তিন সপ্তাহ কলাম লেখা সম্ভব নাও হতে পারে; সেজন্য বিনয়ের সাথে অগ্রিম দুঃখ প্রকাশ করে রাখছি। তারপর যে কলাম বের হবে, সেই কলামে আদিবাসী সম্পর্কে ইনশাআল্লাহ লিখব।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
বিষয়: বিবিধ
১৫৮৬ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হায়রে লীগের দেশপ্রেম(?)
মন্তব্য করতে লগইন করুন