পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক এর কলামগুলো১
লিখেছেন লিখেছেন বাংলার সিংহ ০৬ মে, ২০১৫, ০৯:০৯:৫৪ সকাল
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বোঝাবুঝির অভাব // মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক //
দুই প্রকারের ‘গ্যাপ’
দু’টি ইংরেজি শব্দযুগল উপস্থাপন করছি। একটা হলো ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’; আরেকটি হলো ‘জেনারেশন গ্যাপ’। প্রথমে কমিউনিকেশন গ্যাপ সম্বন্ধে বলি। এটা বলতে বুঝায়, দু’জন ব্যক্তির মধ্যে বোঝাবুঝির অভাব। এর মানে এই নয় যে, যোগাযোগের অভাব। ফোন আছে, ফোনে আলাপ হচ্ছে অথবা সামনে দেখা হচ্ছে, হাত মেলানো হচ্ছে, কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু বক্তা যা বলতে চাচ্ছেন, অথবা যা বললেন, শ্রোতা সেটা না বুঝে অন্য কিছু বুঝলেন। অনেক সময় তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে অনেক বার্তা আদান-প্রদান হয়; সেই সময়ও কী বার্তা প্রদান করা হলো এবং প্রাপক কী বুঝলেন, তার মধ্যে অনেক পার্থক্য হয়ে যায়। দু’জন ব্যক্তির মধ্যে এ ধরনের পরিস্থিতি হতেই পারে। এইরূপ পরিস্থিতিতে তিও হয়ে যেতে পারে। এখন জেনারেশন গ্যাপ নিয়ে বলি। সাধারণত ত্রিশ-বত্রিশ বছরকে একটা জেনারেশন বা প্রজন্ম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। আমি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। যখন যুদ্ধ করি তখন বয়স ছিল সাড়ে একুশ থেকে সাড়ে বাইশ। সার্বিকভাবে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তারা এখন ষাট বছরের বেশি বয়স্ক। আমরা একটা প্রজন্ম। যাদের বয়স এখন পঁচিশ-ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ, তারা আরেকটা প্রজন্ম। আমার নাতিরা বা তাদের চেয়ে পাঁচ-সাত বছরের বড় যারা তারা আরেকটা প্রজন্ম। পোশাক-আশাকের ধরন, কথা বলার ধরন, শব্দচয়নের ধরন, খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস, বিয়েশাদিতে সামাজিকতার নিয়মকানুন ইত্যাদি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তারতম্য হয় কিছুটা। আবার এটাও সত্য যে, আমাদের প্রজন্মের কষ্ট ও ত্যাগ (১৯৬৬-১৯৭২) অথবা স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে আমাদের কষ্ট ও ত্যাগ (১৯৭২-১৯৯০) সাধারণভাবে বর্তমান প্রজন্ম মূল্যায়ন করে কূল পাবে না। তাই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ইতিহাস-জ্ঞান প্রচার করতে হয়, যেন গ্যাপ কম থাকে। দেশের মানুষের মানসিক চিন্তার প্রকৃতি ও ধারা বদলে যাচ্ছে। এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলতে গেলে শ্রোতার কাছে এটা রূপকথার মতো মনে হয়। অনুরূপ আরো বিষয় আছে যেগুলো আজ ২০১৫ সালে অনেকের কাছে খুবই আশ্চর্যজনক মনে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আজকের সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে কষ্ট করে চিন্তা করতে হবে, মেজর মোহসিন নামক একজন সাহসী অফিসার কেন ঘণ্টাছড়ি নামক জায়গায় অ্যাম্বুশে পড়ে অনেক সৈনিকসহ শহীদ হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, আজকে যিনি রাঙ্গামাটি জেলার বরকল উপজেলায় এসি ল্যান্ডের দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি কল্পনাই করতে পারবেন না হয়তো, পঁচিশ বছর আগে এখানে আসতে হলে সপ্তাহে মাত্র দুই দিন সুযোগ হতো এবং তা-ও অনেক পাহারার মধ্য দিয়ে।
গ্যাপ সম্বন্ধে আলোচনা কেন?
কমিউনিকেশন গ্যাপ এবং জেনারেশন গ্যাপÑ এ দুটো কথা ব্যাখ্যা করার কারণ হলো, আজকে ২০১৫ সালে যাদের বয়স ত্রিশ এবং তার কম অথবা সেনাবাহিনীতে কর্মরত যাদের চাকরি বাইশ বছরের কম, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সেখানে বিরাজমান সমস্যা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত না থাকার সম্ভাবনা আছে। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে, কিন্তু লজ্জায় যদি ধারণাটা প্রকাশ না করি, সেটাও ভুল হতে পারে। আমাদের জেনারেশন এবং যাদের কথা উল্লেখ করলাম এই তরুণদের জেনারেশনের মধ্যে একটা ‘ভালো গ্যাপ’ সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য আজ এই কলামে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আলোচনা করছি। সেখানে একটি সমস্যা বিদ্যমান ছিল, আছে এবং থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত (অফিসারসহ) সেনা-বিডিআর-পুলিশ সদস্য প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের প,ে সরকারের হুকুমে দায়িত্ব পালনকালে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার বাঙালি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বার্থে। পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার নিরীহ পাহাড়ি নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ দিয়েছেন দুই পরে যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শত শত পাহাড়ি তরুণ প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তথা বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে। আজকের ২০১৫ সালে আমার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি কৃত্রিম শান্তি বিরাজ করছে। এই কৃত্রিম শান্তিও যদি লঙ্ঘিত হয়ে যায়, তখন শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং আমাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা নতুন প্রোপটে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা ও সার্কেল
এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি জেলা। ১৯৮৪ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর ছিল রাঙ্গামাটি। ওই জেলার তিনটি মহকুমার মধ্যে সদর মহকুমার নাম ছিল রাঙ্গামাটি। আরেকটি মহকুমার নাম ছিল বান্দরবান। তৃতীয় মহকুমার নাম একসময়ে ছিল রামগড়, কিন্তু হেডকোয়ার্টার খাগড়াছড়ি। রামগড় নামক ুদ্র শহরটি অতি সীমান্তবর্তী (জিরো লাইন সংলগ্ন) শহর হওয়ায় মহকুমার সদর দফতর ছিল কিছু দূরে খাগড়াছড়ি শহরে। ১৯০১ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক জেলা ও প্রশাসনিক অঞ্চলকে তিনটি সার্কেলে ভাগ করা হয়েছিল। রাঙ্গামাটি-কেন্দ্রিক সার্কেলটির নাম চাকমা সার্কেল। কারণ, এখানে চাকমা উপজাতীয় মানুষের প্রাধান্য ছিল। বান্দরবানকেন্দ্রিক সার্কেলটির নাম ছিল বোমাং সার্কেল এবং এখানে মার্মা উপজাতীয় মানুষের প্রাধান্য ছিল। খাগড়াছড়িকেন্দ্রিক কোনো সার্কেল ছিল না। তৃতীয় সার্কেলটির নাম ছিল মং সার্কেল এবং এটি ছিল মানিকছড়িকেন্দ্রিক। মানিকছড়ি হচ্ছে বর্তমানে একটি উপজেলা বা থানার নাম; চট্টগ্রাম মহানগর থেকে হাটহাজারী ফটিকছড়ি হয়ে মানিকছড়ির ওপর দিয়ে খাগড়াছড়ি যেতে হয়। মানিকছড়ি থেকে ৪০ মাইল উত্তরে এবং রামগড় থেকে ১২ মাইল পূর্বে খাগড়াছড়ি শহর। ব্রিটিশ আমল থেকে সার্কেলের প্রধানগণকে বলা হতো ইংরেজি ভাষায় ‘চিফ’। বাংলা ভাষায় বলা হয় ‘রাজা’; কিন্তু ইংরেজিতে কিং নয়। বর্তমান তিন সার্কেলের তিনজন চিফ তথা তিনজন রাজার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং বিবিধ অঙ্গনে সক্রিয় হলেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশিস রায়।
জনসংহতি সমিতি ও শান্তিবাহিনী
পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনীতি ছিল একটি গৌণ বিষয়। প্রথাগত বা ট্র্যাডিশনাল নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য এবং সামাজিক একতা ছিল পাহাড়ি সমাজের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী তিন বছরে এই বৈশিষ্ট্যগুলো বড় রকমের ঝাঁকি খায়। ১৯৭০ সালে রাঙ্গামাটি শহরে একটা গোপন মিটিং হয়েছিল, যে মিটিংয়ের মাধ্যমে রাঙ্গামাটি কমিউনিস্ট পার্টি নামে একটি গোপন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটি রাজনৈতিক দল । ১৯৭৩ সালে এর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে একটি সশস্ত্র শাখা খোলা হয়েছিল; যার নাম ছিল ‘শান্তিবাহিনী’। এর সর্বাধিক পরিচিত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তিনি ১৯৭০ সালে তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব, ১৯৭২-এ তিনি গণপরিষদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার সময় তিনি তার যৌক্তিক আপত্তিগুলো তুলে ধরেছিলেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সেদিকে কর্ণপাত করেনি। হাতেগোনা যে দু’চারজন গণপরিষদ সদস্য ১৯৭২ সালের শেষাংশে নতুনভাবে লেখা বাংলাদেশের সংবিধানে স্বার করেননি, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। ১৯৭৩ সালে রাঙ্গামাটি শহরে একটি জনসভায় বঙ্গবন্ধু নিজে পাহাড়িদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তোরা সবাই বাঙালি।’ এটা ছিল টিমটিম করে জ্বলা আগুনে কেরোসিন ঢেলে দেয়ার মতো একটি ঘটনা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত সময়ে শান্তিবাহিনী ভারতের মাটিতে এবং দেশের মাটিতে প্রশিণ গ্রহণ করে নিজেদের সুসংগঠিত করে। ভারতীয় সাহায্যে গোলাবারুদ সরঞ্জাম সংরতি করে। ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরে শান্তিবাহিনী প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সরকারের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। এটাই হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর প থেকে বিদ্রোহ বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
একেকজনের মূল্যায়নের একেক রকম প্রোপট
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইন্সার্জেন্সি, অর্থাৎ শান্তিবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সশস্ত্র বিদ্রোহের ইতিহাস ও ঘটনাপরিক্রমা দীর্ঘ। একেকজন বুদ্ধিজীবী বা সমাজবিজ্ঞানী বা সামরিক বিশ্লেষক বা ইতিহাসবিদ এই বিদ্রোহের ইতিহাস ও ঘটনাপরিক্রমাকে একেক রকম দৃষ্টিতে রচনা ও মূল্যায়ন করবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। তবে রচনা ও মূল্যায়নে কিছু মৌলিক বিষয়ে পার্থক্য না থাকাই ভালো। মারাত্মক দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের েেত্র এই স্বাভাবিকতা থাকেনি। অর্থাৎ অস্বাভাবিক হয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী বা সমাজবিজ্ঞানী বা ইতিহাসবিদ, এমনকি রাজনৈতিক কারণে সামরিক বিশ্লেষকদের মধ্যেও মূল্যায়নের যে পার্থক্য, সেটা কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে দৃশ্যমানভাবেই পরস্পর বিপরীতমুখী। তাই আজ ২০১৫ সালে এ প্রসঙ্গে অতি সংক্ষেপে কিছু কথা তুলে ধরছি। যারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১৯৯৬ সালের পরে কমিশন পেয়েছেন, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে মতামত প্রদান ও মূল্যায়ন করবেন একভাবে। যারা ১৯৭০ দশকের শেষাংশে বা পুরো ১৯৮০-এর দশকব্যাপী বা ১৯৯০-এর দশকের প্রথম অংশে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি করেছেন, তারা মতামত প্রদান ও মূল্যায়ন করবেন অন্যভাবে। অনুরূপ মন্তব্য বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্যও প্রযোজ্য। বেসামরিক ত্রে থেকে দু-একটি উদাহরণ দিই। যিনি ১৯৮৮-৮৯ সালে খাগড়াছড়ি জেলায় জেলা প্রশাসনে অথবা কোনো উপজেলায় চাকরি করেছেন, তিনি এক রকম দেখেছেন ও উপলব্ধি করেছেন। অপর দিকে, যে বেসামরিক কর্মকর্তা ১৯৯৬-৯৭ সালে জেলা প্রশাসনে বা কোনো উপজেলায় চাকরি করেছেন, তিনি আরেক রকম উপলব্ধি করেছেন।
আমার সম্পৃক্ততা
ব্যক্তিগতভাবে আমি ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি থেকে একই বছরে জুন মাস পর্যন্ত সাড়ে ছয় মাস সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে কাপ্তাইয়ের সন্নিকটে তৎকালীন ফারুয়া ও রাজস্থলী থানার ভৌগোলিক এলাকায় কাপ্তাইয়ে অবস্থিত পদাতিক ব্রিগেডের অধীনে কাজ করেছি। এরপর ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সাড়ে পাঁচ মাস, আশ্চর্যজনক ঘটনাক্রমে পঁচিশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে ফারুয়া (নতুন নাম বিলাইছড়ি) থানার ভৌগোলিক এলাকায় কাজ করেছি। এরপর ১৯৮৭ সালের জুলাই থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তারপর ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৭ থেকে ২৭ জুন ১৯৮৯ পর্যন্ত দেড় বছর খাগড়াছড়িতে অবস্থিত পদাতিক ব্রিগেডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির প্রয়োজনে, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে রিজিওন কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করতাম। মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য কর্মযজ্ঞ প্রস্তুত রাখেন। আমি যে দুই বছর ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছি, তার আগেও যেমন পরেও তেমন, সম্মানিত জ্যেষ্ঠ সেনাকর্মকর্তারা ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। প্রত্যেকের আমলই ঘটনাবহুল ছিল, তারা সর্বোৎকৃষ্ট অবদান রেখেছেন তাদের সহকর্মীদের নিয়ে। কিন্তু আমার ওই খাগড়াছড়ির সময়টুকু ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
১৯৮৮-৮৯ সাল ব্যতিক্রমী সময়
পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেকবারই পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সঙ্ঘাত হয়েছে; এবং উভয়পরে মানুষের প্রচুর য়তি হয়েছে। শান্তিবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত নৃশংসতাও হয়েছে প্রচুর। সরকারি বাহিনীগুলো কর্তৃক পরিচালিত অপারেশনের কারণেও অনেক তি হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৮-৮৯ সালটি ব্যতিক্রম এ জন্য যে, য়তি যেমন প্রচুর হচ্ছিল, তেমনই শান্তি স্থাপনের জন্যও সর্বাঙ্গীণ প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। চারবার আমি নিজে শান্তিবাহিনীর সাথে সংলাপ করার জন্য গভীর জঙ্গলে নিরস্ত্র ও পাহারাবিহীন অবস্থায়, সিভিল পোশাকে গিয়েছি; এর মধ্যে তিনবার ছিলাম সরকারি প্রতিনিধিদলের প্রধান। এ জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায় একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হয়েও আমাকে গভীরভাবে জনসম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে হয়েছিল। বেসামরিক প্রশাসনের সাথে নিবিড় ও আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছিল। শান্তি স্থাপনের জন্য মানুষের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে অনেক ধরনের পদপে নিতে হয়েছিল। শান্তি স্থাপনের জন্য বিদ্রোহী শান্তি বাহিনীর মনেও যেন সংলাপের প্রতি আগ্রহ থাকে, তার জন্য অনেক পদপে নিতে হয়েছিল। দেড় বছরে আমি ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের ৪৯টি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলাম বিভিন্ন ময়দানে; ঘরের ভেতরে ঘরোয়া বৈঠকের কথা বলছি না। আমার জন্য জনসম্পৃক্ত রাজনীতির হাতেখড়ি ওখানেই। অবশ্যই উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, এই শান্তিপ্রক্রিয়ার প্রধান উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আমার তাৎণিক ওপরে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চট্টগ্রামে অবস্থিত ডিভিশনের জিওসি (বৃহত্তর ময়মনসিংহের নান্দাইলের সন্তান) মেজর জেনারেল আব্দুস সালামও নিবিড় ও উদারভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আমাদেরকে অনেক ব্যতিক্রমধর্মী পদপে নিতে হয়েছিল। প্রথমেই আমাকে আমার কনিষ্ঠ সহযোগী ও সহকর্মীদের বোঝাতে হয়েছে, আশ্বস্ত করতে হয়েছে, উদ্দীপ্ত করতে হয়েছে। কারণ এ ধরনের বড় ও জোরালো কাজ কোনো দিনও একজনের পে সম্ভব নয়। একটা টিম লাগে। টিম বিল্ডিং একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহর রহমতে আমরা ভালো টিম গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। তাই আমি ওই সহকর্মী ও সহযোগীদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখানে নাম লিপিবদ্ধ না করলেও, ছোট-বড় শতাধিক অফিসার যারা আমার সহকর্মী ছিলেন এবং প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক বিভিন্ন পদবির সৈনিক যারা সহকর্মী ছিলেন, তারাও আপ্রাণ আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করেছেন। অফিসার ও সৈনিক বলতে সেনাবাহিনী, বিডিআর, জেলা পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, আনসার এবং ভিডিপি- সব সংস্থার মানুষকেই বুঝাচ্ছি।
বিস্তারিত তথ্যভাণ্ডার
আমার বক্তব্যে কেউ-না-কেউ দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। তর্ক-বিতর্ক করার স্বাধীনতা বহাল রাখতেই হবে। এই ুদ্র কলামে সব কথা যেহেতু কোনো অবস্থাতেই উপস্থাপন করা সম্ভব নয়, সেহেতু অবশ্যই সম্মানিত পাঠক সমাজকে আহ্বান জানাব একটি পুস্তক সংগ্রহ করে পড়ার জন্য। পুস্তকটির নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিপ্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’। পুস্তকটির লেখক আমি নিজে। প্রকাশক মওলা ব্রাদার্স। ঠিকানা : ৩৯, বাংলা বাজার, ঢাকা। মওলা ব্রাদার্সের ফোন নম্বর : ৭১৭৫২২৭ অথবা ৭১১৯৪৬৩। তাদের ইমেইল : . বইটি ঢাকায় অনেক দোকানে পাওয়া যায়, আবার অনেক দোকানে পাওয়া যাবেও না। কারণ পুস্তকের বিষয়বস্তু কঠিন এবং ‘আনকমন’। তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের সন্নিকটে ‘বুক ওয়ার্ম’ নামের দোকানে অথবা বেইলি রোডে (অপর নাম নাটক সরণি) সাগর পাবলিশার্সে পুস্তকটি পাওয়া যাবেই। চট্টগ্রাম মহানগরে প্রেস কাব বিল্ডিংয়ে ‘বাতিঘর’ নামের দোকানে বইটি পাবেন। সম্মানিত পাঠক, আমি কি ব্যক্তিগত বইয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনো নৈতিক অপরাধ করছি? উত্তর হলো, না। কারণ এই পুস্তকের বিক্রয়লব্ধ কোনো রয়েলটি নিই না বা আমার কাছে আসে না এবং এ নিয়ে আগ্রহী নই। কিন্তু পুস্তকটির বিষয়বস্তু আমার মতে, জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ; সেজন্য বিস্তারিতভাবে জানালাম। আমার ওয়েবসাইট, এই কলামের নিচে দেয়া আছে; ওই ওয়েবসাইটেও বইটির সারমর্ম পাবেন। বিশেষ করে সব ধরনের গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর ও প্রশাসনের কর্মকর্তা যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে জড়িত, তাদের জন্য বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামকে বুঝতে হলে এর প্রোপট জানতেই হবে। অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি অনেক বই লিখেছেন; সেগুলোও অবশ্যই পড়তে পারেন। কারণ, পড়া উচিত। নয়া দিগন্ত পত্রিকা, কিছু বিশেষ শ্রেণীর পাঠকের কাছে, সরকারি প্রশাসনিক নির্দেশে, পৌঁছায় না। তাই পাঠক সম্প্রদায়ের মধ্যে যাদের কাছে এই নয়া দিগন্ত পত্রিকা পৌঁছায়, তাদের মাধ্যমেই এই সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান রাখছি।
শান্তিপ্রক্রিয়ার দুইটি প্রধান ধাপ
পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাবলির সূত্রপাত (১৯৭১-৭৬) হয়েছিল আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রোপটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র বিদ্রোহ দুধ কলা খেয়ে, ভিটামিন খেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছিল (১৯৭৭-৯০) আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রোপটে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অনেক রকম পদপে নেয়া হয়েছিল; যার মধ্যে দুইটি প্রধান পদেেপর উল্লেখ করছি। একগুচ্ছ পদপে হলো ১৯৮৮-৮৯ সালের; যথা একাধিক দফায় সংলাপ, তিন জেলার সামাজিক ও নাগরিক নেতাদের সাথে তিনটি আলাদা চুক্তি, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পার্লামেন্টে তিন জেলার জন্য তিনটি ও সার্বিকভাবে একটি, মোট চারটি আইন পাস; আরো পরে ২৫ জুন ১৯৮৯ তারিখে তিন জেলায় প্রত্য ভোটের মাধ্যমে জেলা পরিষদের নির্বাচন। অপর পদেেপর গুচ্ছ হলো, ১৯৯৬-৯৭ সালের যথা একাধিক দফায় সংলাপ এবং ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বার। ১৯৮৮-৮৯ সালের পরিশ্রমের ফসল ছিল ওই সময়ের চুক্তি ও আইনগুলো। এই পরিশ্রম ও ফসলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৯৬-৯৭ সালে নতুন করে চুক্তি করা হয়েছিল। এই চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সতেরো বছর ধরেই বিতর্ক অব্যাহত আছে।
ছাই চাপা আগুন
আমার সামরিক অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে নিবেদন করছি, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রোপট বদলেছে, আঞ্চলিক রাজনীতির প্রোপট বদলেছে, আঞ্চলিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের রূপ বদলেছে ইত্যাদি যেমন সত্য, এটাও সত্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইন্সার্জেন্সির আগুন কোনোমতেই সম্পূর্ণভাবে নিভে যায়নি। যে আগুন নেভেনি, সেটা ছাই দিয়ে চাপা রাখা যায়। কিন্তু সে আগুন যে আবার জ্বলবে না, তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। সাম্প্রতিককালের পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সংবাদগুলোর মূল্যায়ন করেই এই কথাগুলো বলছি। আগামী সপ্তাহেও এই কলামের মতোই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আরো একটু লিখব বলে আশা করি।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব ও
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
(১১ মার্চ ২০১৫ তারিখে নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত)
(১৮ মার্চ ২০১৫ নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত)
রাজনীতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পর্ক নিয়ে বোঝাবুঝি // মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক //
গত বুধবার ১১ মার্চ ২০১৫ তারিখে এই নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে বোঝাবুঝির অভাব’ শিরোনামে প্রকাশিত কলামের ধারাবাহিকতাতেই আজকের এই কলাম। তবে আজকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে লেখার আগে অল্প পরিসরে কিছু ভিন্ন কথা উপস্থাপন করছি। অতঃপর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আলোচনা। গত সপ্তাহের কলামটি পড়ে প্রচুর লোক ইন্টারনেটে, ফেসবুকে এবং এসএমএস-এর মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বহু লোক ফোন করেছেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বিশেষ ধন্যবাদ কারণ আজ প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় তিনি মতিঝিলের রাজপথে, গণমানুষের মহব্বতে এবং তাদের স্বার্থে অবস্থান করছেন। ওই ভৌগোলিক অবস্থান থেকেই তিনি কলাম পড়ে ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ১২ মার্চ ২০১৫ তারিখে। তার ওখানে (মতিঝিলের ফুটপাথ) রাজনৈতিক অতিথি হওয়ার জন্য দাওয়াতও দিয়েছেন। নয়া দিগন্ত পত্রিকার অফিস থেকেও বঙ্গবীরসহ আরো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির অভিনন্দনের কথা আমাকে জানানো হয়েছে। বিনয়ের সাথে অভিনন্দন গ্রহণ করছি। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা এবং সংগঠক কাদের সিদ্দিকীকে আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন, তার সাহসী কষ্টসহিষ্ণু অবস্থানের জন্য। তিনি সর্বদাই মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণের পক্ষে নয়া দিগন্ত, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও অন্যান্য পত্রিকায় তার লেখা কলামগুলো বস্তুনিষ্ঠ ও পাঠকপ্রিয়।
প্রসঙ্গ সাংবাদিক মুন্নি সাহা
মাসাধিক কাল আগে ১৩ ফেব্র“য়ারি ২০১৫ তারিখে বিখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজে রাত সাড়ে ৯টায় একটি টকশোতে উপস্থিত ছিলাম। উপস্থাপক ছিলেন সম্মানিত এবং সুপরিচিত সাংবাদিক মুন্নি সাহা। আলোচনার শেষ চতুর্থাংশে হঠাৎ করে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনি বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ওয়ান ম্যান ওয়ান পার্টি। তিনি আমাকে ও আমাদের পার্টিকে অযাচিতভাবে অপ্রাসঙ্গিকভাবে অপমান করেছিলেন। আমি প্রতিবাদ করেছি সাথে সাথে, একপর্যায়ে দাবি করেছি তিনি যেন ক্ষমা চান। সম্মানিত সাংবাদিক মুন্নি সাহা তার ভুলের জন্য জাতির সামনে তাৎক্ষণিক ক্ষমা চান। অনেক অনলাইন পত্রিকা এবং অনেক ব্যক্তি, এটিএন নিউজের ওই লাইভ টকশো থেকে ওইটুকু দৃশ্য (৫১ সেকেন্ড) উদ্ধৃত করে ফেসবুকে শেয়ার করেন। ওই ৫১ সেকেন্ডের ভিডিওটি আমার টাইমলাইনে আমিও শেয়ার করেছি এবং আরো অগণিত ব্যক্তি ও অনলাইন পত্রিকা নিজেরাই শেয়ার করেছে। শুধু আমার ফেসবুক পোস্ট থেকেই প্রায় দুই লাখ বার ভিউ করা হয়েছে, মানে মানুষ দেখেছেন। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও তার লেখা কলামে প্রতিবাদ জানিয়েছেন আলোচ্য ঘটনার।
ছোট রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়া
ওপরের অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। এই কথাটা বললাম এ জন্য যে, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা, আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আমাদের রাজনীতি ও মিডিয়ার মধ্যে সম্পর্ক এমন যে, ুদ্র রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড, পরিচিতি ইত্যাদি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা খুব মুশকিল। কল্যাণ পার্টি একটি নিবন্ধিত দল; নিবন্ধনের সব শর্ত মেনেই চলছে। ঢাকা মহানগরের নয়াপল্টন এলাকায় মসজিদ গলিতে একটি দালানের ষষ্ঠ তলায় চারশত বর্গফুটের অফিস আছে কল্যাণ পার্টির; একই ফোরে বাংলাদেশ ন্যাপেরও অফিস আছে। ঢাকা মহানগরের মহাখালী এলাকায় কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যানের আলাদা কার্যালয় আছে এক হাজার ৫০০ বর্গফুটের। কল্যাণ পার্টিতে যুব সংগঠন আছে, ছাত্র সংগঠন আছে, মহিলা সংগঠন আছে। নিয়মিত মিটিং ও কাউন্সিল হয়। কল্যাণ পার্টিতে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি ও রাজনৈতিক কর্মীর সমাহার কম নয়। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আলেম-ওলামা, ইঞ্জিনিয়ার তথা পেশাজীবীরা বিভিন্ন নিয়মে সম্পৃক্ত আছেন। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য মেকানিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুশতাক হোসেন ১৩ মার্চ ২০১৫ দিনের শেষে রাত্রি ১১:৪০ মিনিটে ইন্তেকাল করলেন ৬৮ বছর বয়সে। আমরা তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি। সাড়ে ছয় বছর আগে আমাদের বয়স যখন মাত্র বারো মাস তখন ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে আমাদের ৩৬ জন প্রার্থী ছিল। সাহসের সাথে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি এবং বিনয়ের সাথে পরাজয় স্বীকার করেছি। মরহুম কর্নেল মুশতাক লাকসাম থেকে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু ওইসব প্রার্থী বা অন্যান্য নেতাকর্মী বা জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা, দেশবাসীর সামনে পরিচিত হবেন কোন নিয়মে? তাদের নিজ নিজ এলাকার মানুষ চেনে, কিন্তু তারা জাতীয় ভিত্তিতে পরিচিত নন। তারা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে যায়, শান্তিপূর্ণ মিছিলে যায়, গঠনমূলক আলোচনা সভায় যায়, নিজ নিজ এলাকায় সময় দেয়। কিন্তু দেশবাসীর কাছে কথাগুলো বা ঘটনাগুলো উপস্থাপন করার সুযোগ ও মাধ্যম স্বাভাবিকভাবেই দু®প্রাপ্য ও খুবই কঠিন। কিছু দিন আগে সরকারের অনুমতি নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সভা করেছিল। আজ থেকে কয়েক দিন আগে টেলিভিশনের টকশোতে ওই পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনলাম, ‘সোহরাওয়ার্দীতে আমরা যতবড় মিটিং করেছি, বিএনপি বা আওয়ামী লীগ করলে টিভিগুলো কম্পিটিশন দিয়ে দেখাত; অথচ আমরা ছোট বলে কেউ পাঁচ সেকেন্ড দেখাল, কেউ দেখালই না, কোনো টিভি বলল আবার কোনো টিভি বললও না।’ প্রায় চার মাস আগে, ৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে কল্যাণ পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। প্রেস ক্লাবের বড় হলে ৬০০ থেকে ৭০০ লোকের মিটিং ছিল। স্টেজ ভরা বিভিন্ন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা ছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ। ২০টা টিভি সংবাদে দেখিয়েছে। মুন্নি সাহার টিভিও দেখিয়েছে। কিন্তু শুধু এক দিন বা পাঁচ-সাত দিন দেখলেই, জাতির সামনে সব নেতাকর্মীর পরিচিত হওয়া বা রিকগনিশন পাওয়া মুশকিল, এটাও সত্য। আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই। আমাদের যত সদস্য, ততধিক শুভাকাঙ্ক্ষী আছে। আমাদের বড় কষ্ট আর্থিক কষ্ট। মেধার অভাব বা পরিশ্রমের অভাব আমাদের কষ্ট নয়। আমরা সবার সহযোগিতা চাই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ও জনসংখ্যা
ওপরের অনুচ্ছেদের আলোচনার ধারাবাহিকতায় বলতে চাই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টিও বাংলাদেশের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে অতি সচেতন এবং সোচ্চার। সর্বস্তরের বিশেষত জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদেরা এই সমস্যা অনুধাবন করলে ভালো। এই প্রসঙ্গে অল্পকিছু লিখব আজকের কলামে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০০ ভাগের ১ ভাগের অর্ধেকের কিছু বেশি তথা শূন্য দশমিক পাঁচ পাঁচ। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের দশ ভাগের এক ভাগ হলেও বিরাজমান সমস্যাটি আমাদের দেশের অন্য দশটি সমস্যার মতো নয়; অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু আয়তন দেখলে হবে না, পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভূমি চাষের যোগ্য নয় বা আবাসযোগ্য নয়, এটাও মনে রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যা এক শতাংশের কম হলেও, তাদের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেন এই আলোচনাটাই অতি সংপ্তিভাবে গত কলামে এবং এই কলামে করছি। সম্ভবত আরো দুই-একটি কলাম লিখতে হবে।
সাংবাদিক ম. হামিদ এবং আগুন
আমরা আজ থেকে ২৬ বছর ১১ মাস পেছনে ফিরে যাই। রমজান মাস চলছিল। তারিখটি হলো ২৪ এপ্রিল ১৯৮৮; সময় হলো তারাবিহর নামাজের পর রাত ৯টা। তৎকালীন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সুপরিচিত সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব ম. হামিদ আমার অফিসে বসা ছিলেন। আমি খাগড়াছড়ির ব্রিগেড কমান্ডার। তিনি গিয়েছিলেন, ক্ষুদ্র একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বা প্রামাণ্য চিত্র বানাতে। ম. হামিদ গল্পচ্ছলে যা বলেছিলেন সেটা হুবহু উদ্ধৃত করতে পারছি না, কিন্তু অনেকটা এ রকম ছিল : ‘আপনারা আর্মির লোক সব দিকে ভয়ের কথা ছড়াইতে থাকেন। কয়েক দিন ধরে পড়ে আছি, আপনাদের সাথেই তো চলাফেরা করছি, কই কোনো মারধর, গোলাগুলি বা আগুন তো নেই।’ আমার উত্তর : ‘হামিদ ভাই, এইরূপ প্রার্থনা করবেন না, আল্লাহ যেন আপনার এ রকম কোনো প্রার্থনা কবুল না করেন। গোলাগুলি ও আগুন দেখার শখ ভালো না।’ সম্মানিত পাঠক, বিশ্বাস করতেও পারেন, না-ও করতে পারেন। বাংলা ভাষার দুইটি শব্দ যথা : কাকতালীয় বা ঘটনাক্রমের সাথে আপনারা পরিচিত। এ রকমই কাকতালীয় ঘটনা। আমার কথা শেষ হওয়ার দুই-চার মিনিটের মধ্যেই প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ কানে এসে গেল। জনাব ম. হামিদকে বললাম, আপনি জিতে গেছেন, আপনার প্রার্থনা কবুল হয়েছে, এখন আপনাকে নিয়ে গোলাগুলি এবং আগুনের স্থলে যাবো। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সঙ্গী-সাথী নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলাম। আমার অফিস থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে কুমিল্লা টিলা নামক বাঙালি গ্রামে আক্রমণ এবং আগুন দিয়েছে শান্তিবাহিনী। গ্রাম পুড়ে গেল, এক ডজন মানুষ আগুনে এবং গুলিতে মরে গেল, অনেক ডজন জখম হলো। পরের দিন এবং তার পরের দিন এবং অব্যাহতভাবে আমাদের চেষ্টা ছিল, যেন অন্যত্র বাঙালিরা পাহাড়িদের গ্রামে প্রতিশোধমূলকভাবে কোনো আক্রমণ না করে। ২৪ এপ্রিলের ঘটনার পর থেকে পরবর্তী ১০-১২ দিন, প্রায় প্রতিদিন শান্তিবাহিনী খাগড়াছড়ি জেলার কোনো-না-কোনো বাঙালি গ্রামে আক্রমণ করছিল এবং আগুন দিচ্ছিল। সাংবাদিক ম. হামিদ ভাইয়ের ক্যামেরার দ্বারা দারুণ উপকার পাওয়া গেল। তিনি অনেক সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করতে পারলেন এসব সহিংসতা প্রসঙ্গে। ২৫ এপ্রিল তারিখে তিনি ছবি এবং কিছু বক্তব্য খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম থেকে আকাশ পথে ঢাকা পাঠালেন। বাংলাদেশের মানুষ ২৫ তারিখ দিনের শেষে রাতের সংবাদে এই নৃশংসতা দেখল। পরবর্তী তিন চার দিন সন্ধ্যাতেই, এইরূপভাবে খাগড়াছড়ি থেকে সচিত্র সংবাদ, বিটিভিতে দেখানো হয়েছে। বাঙালি এবং উপজাতি অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির মৌখিক সাক্ষাৎকারসহ সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পারল যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম নামক একটা জায়গা আছে এবং সেখানে একটা সমস্যা আছে। এই সুবিধাটা পাওয়া গিয়েছে, ঘটনাক্রমে খাগড়াছড়িতে টেলিভিশন ক্যামেরা থাকায়, যখন লোমহর্ষক ঘটনাগুলো ঘটছিল। সে জন্য বলতে বাধ্য যে, উপলব্ধি হয়েছে ভালো কিন্তু বড় মূল্য দিয়ে উপলব্ধি অর্জন করতে হয়েছে।
সমস্যার ব্যাপ্তি অনুধাবন
তখনকার আমলে কেউ বলতেন, এটা মিলিটারি প্রবলেম বা আর্মির সমস্যা। কেউ বলতেন, এটা ভারত সৃষ্টি করেছে। কেউ বলতেন, রাজনীতিবিদেরা এটাতে কোনোমতেই জড়িত না। সেই ২৪ এপ্রিল বা তৎপরবর্তী ঘটনাগুলো মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্ঘাত নিরসনের প্রক্রিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, ইতিবাচকভাবে। বাংলাদেশের জনমানুষের মানসপটে শান্তিবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দাঁড়ায়। বাংলাদেশ সরকার সংলাপের মাধ্যমে বিরাজমান পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান চায়, অপরপে শান্তিবাহিনী আক্রমণের মাধ্যমে সমাধান চায়- এরূপ ধারণা মানুষ মিডিয়া থেকে পায়। ৫ মে ১৯৮৮ তারিখে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ খাগড়াছড়ি জেলায় ও জেলা সদরে গিয়েছিলেন। হেলিকপ্টার থেকে এবং মাটিতে সব দেখে ও শুনে আমাদের ওপর অনেক বিরক্ত ছিলেন। অনেক বকাঝকা করলেন। বললেন, এত মানুষ কেন মরছে আমাকে বুঝাও। বোঝার জন্য তিনি ২০ মিনিট সময় দিয়েছিলেন। আমি বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, ২০ মিনিটে বলা যাবে না! আমি দুই ঘণ্টা সময় চেয়েছিলাম, আমার আবেগঘন আবেদনে রাজি হয়ে তিনি এবং অন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা দুই ঘণ্টা ধরে আমার কথা শুনেছিলেন। শুনে তিনি বলেছিলেন, আমি এর অর্ধেক কথাও জানতাম না। না জানার কারণ, প্রেসিডেন্টের কাছে এত কথা কে বলবে? অথবা এত কথা শোনার সময় প্রেসিডেন্টের কি আছে? শুনলেন তো এমনভাবেই শুনলেন যে, প্রেসিডেন্ট আমাদের আদেশ দিলেন বঙ্গভবনে এসে এই কথাগুলো শুনাতে। ৮ মে ১৯৮৮ বিকেলে ইফতারের আগে দুই-তিন ঘণ্টা সময়। দুই মিনিট বললেন প্রেসিডেন্ট; পাঁচ মিনিট বললেন তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আতিক; পাঁচ মিনিট বললেন তৎকালীন চট্টগ্রামের জিওসি জেনারেল সালাম। এক ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট বললাম আমি কর্নেল ইবরাহিম বীর প্রতীক। আধা ঘণ্টার মতো সময় প্রশ্ন এবং উত্তরের জন্য নির্ধারিত ছিল। কাদের সামনে বললাম? সরকারের ক্যাবিনেটে যতজন মন্ত্রী ছিলেন তারা, যতজন সচিব ছিলেন তারা, ঢাকায় যতজন জেনারেল ছিলেন তারা, ঢাকায় জ্যেষ্ঠ ব্রিগেডিয়ার, পুলিশের আইজি এবং আরো চার-পাঁচজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ অফিসার প্রমুখ। প্রেসিডেন্ট এবং সেনাপ্রধান অভয় দিয়েছিলেন যে, তুমি স্পষ্টভাবে সব কথা বলবে, ভয় পাবে না। কারণ আমরা চাই সরকারের নীতিনির্ধারক মহল সমস্যাটি সম্পর্কে অবহিত হোক।
সমস্যার দায়িত্ব হস্তান্তর
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ছোটকালে ক্যাডেট কলেজে পড়ার আমল থেকেই উপস্থিত বক্তৃতা এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। আশির দশকের মাঝখানে তিন বছর বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মেধাবী মাঝারি চাকরিপর্যায়ের অফিসারদের অপরিহার্য প্রশিণ প্রতিষ্ঠান স্টাফ কলেজের প্রশিক ছিল। অর্থাৎ ইবরাহিমের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে এরূপভাবে কথা গুছিয়ে উপস্থাপনের উদাহরণ যথেষ্ট ছিল। ওই ৮ মে ১৯৮৮ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটিকে মিলিটারিদের প্লেট (বাসন বা থালা) থেকে বেসামরিকদের প্লেটে হস্তান্তর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদপে ছিল। এটা যে শুধু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সমস্যা নয়, এটা যে বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় সমস্যা (তথা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, নৃতাত্ত্বিক, জাতিগঠন, অর্থনৈতিক ইত্যাদি) এই কথাটা উপস্থাপন এবং এই কথাটার গ্রহণযোগ্যতা শক্তভাবে শুরু হয় ৮ মে ১৯৮৮ তারিখ থেকে। ৮ মে ১৯৮৮ তারিখের পরবর্তী এক মাসের মধ্যে, সরকারের পাঁচটি ভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাঁচজন সচিব খাগড়াছড়ি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং একটি করে রাত কাটিয়েছিলেন। ইংরেজিতে কথা আছে- সিইং ইজ বিলিভিং অর্থাৎ দেখলেই বিশ্বাস হয়। খাগড়াছড়িতে সফর করে, ছোট বড় মানুষের সাথে কথা বলে, সচিব মহোদয়রা পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজেদের ধারণা পোক্ত করতে পেরেছিলেন।
নতুন অভিজ্ঞতা
আমি ওপরের দুই-তিনটি অনুচ্ছেদে বোঝাতে চেয়েছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান সমস্যাটির স্বরূপ নির্ধারণের প্রক্রিয়ার শুরু কী প্রকারে হয়েছিল। তাহলে পাঠকদের মধ্যে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো-না-কোনো প্রকারে কোনো-না-কোনো সময়ে চাকরি করেছেন, তাদের মনে প্রশ্ন থাকবে, এত দিন এটা কী প্রকারের সমস্যা ছিল। বস্তুত ১৯৭৫-এর ডিসেম্বরে শান্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রমণের মাধ্যমে যেই বিদ্রোহ বা যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছিল তার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছিল বা তার প্রকৃতি উন্মোচিত হতে দু’চার বছর লেগে গিয়েছিল। পাঠক অনুগ্রহপূর্বক ১৯৭৬-৭৭-৭৮-এর বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীগুলোর আকার-আকৃতি ও সাংগঠনিক অবস্থানের কথা খেয়াল করুন। নতুন দেশ নতুন বাহিনী। তার মধ্যে ১৯৭৫-এর ঘটনাবলি। ওই আমলের সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে এইরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও এইরূপ পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। অর্থাৎ এক দিকে শান্তিবাহিনী তাদের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড বা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, অপর দিকে বাংলাদেশ সরকার সেটা মোকাবেলা করার কলাকৌশল বা প্রক্রিয়ামাত্র রপ্ত করা শুরু করেছে। ঘটনাক্রমে ১৯৭৬-৭৭-৭৮ সালে যিনি বাংলাদেশ সরকারের কর্ণধার ছিলেন, সেনাবাহিনীরও কর্ণধার ছিলেন তিনি। অতএব তিনি তার কনিষ্ঠ সহকর্মীদের মূল দায়িত্বটি দিয়েছিলেন কলাকৌশল ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করার। মেহেরবানি করে খেয়াল করুন যে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ থেকে মাত্র একটি রাজনৈতিক দল ছিল দেশে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ অন্য সব রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্ত করা হয়েছিল। একমাত্র দলটির নাম ছিল বাকশাল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর, ওই দিনের রাজনৈতিক সামরিক বিদ্রোহের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। আড়াই মাস পর ৩ নভেম্বরের সামরিক বিদ্রোহের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত করে দেয়া হয়েছিল। অতঃপর দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, ক্রমান্বয়ে যখন রাজনীতির অঙ্গনে জড়িয়ে পড়ছিলেন তখন তিনি নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেন। জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন রাজনীতিবিহীন একটি দেশ চলতে পারে না। তাই জিয়াউর রহমান যখন সংবিধান পুনরায় চালু করেন, তখন তিনি নতুন করে অথবা পুনরায় ১৯৭৫-এর জানুয়ারির আগের মতো বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। জিয়াউর রহমানের হাতেই আওয়ামী লীগও নতুন করে নিজেদের হারানো জীবন ফিরে পায়। আমি ১৯৭৮ সালের কথা বলছি। ওই আমলের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নাজুক অবস্থাতেই এত বেশি কাহিল ছিল যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। এখন ২০১৫ সালে আরাম-আয়েশে বসে ৩৫ বছর আগের কর্তাব্যক্তিদের দোষ দেয়া সহজ।
জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুর
জিয়াউর রহমান দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেই ১৯৭৮ সালের একসময়, তার দৃষ্টিতে দ সেনা অফিসার ওই আমলের মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তমকে চট্টগ্রামের জিওসি নিযুক্ত করেছিলেন। মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর বীর উত্তম অত্যন্ত মেধাবী অফিসার ছিলেন, যথাসময়ে স্টাফ কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করেন। ১৯৭০-৭১-এ তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নামী-দামি বা অভিজাত প্যারাসুট ব্রিগেডের (সংক্ষেপে প্যারা ব্রিগেড) ব্রিগেড মেজর বা বিএম ছিলেন। ১৯৭১-এর মাঝামাঝিতে তিনি সপরিবার পাকিস্তান থেকে পলায়ন করে, আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। তিনি একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের জিওসি ছিলেন প্রায় তিন বছর এবং সেই সময় অনেক কৌশলগত (বা স্ট্র্যাটেজিক) সিদ্ধান্ত তিনি পেয়েছেন, বা নিজে নিয়েছেন এবং সবই বাস্তবায়ন করেছেন। অন্ততপে সামরিক বাহিনীর কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি রেওয়াজ বা ধারা তিনি গড়ে তোলেন। আমি ১৯৭৮ সালের প্রথমার্ধে যখন সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক হিসেবে, তখনকার আমলের ফারুয়া ও রাজস্থলী থানার ভৌগোলিক এলাকায় দায়িত্ব পালনরত ছিলাম। তখন একদিন রাজস্থলী বাজার ক্যাম্পে, জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুর এসেছিলেন। আধাঘণ্টা সময় অবস্থান করেছিলেন। ৮-৯ বছর চাকরির ইবরাহিম, জেনারেল মঞ্জুরের জ্ঞানগর্ভ ধারণাগত আলোচনা এবং দিকনির্দেশনাগুলো আংশিকভাবে বুঝেছিলাম মাত্র। সেই সময় শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক যুদ্ধ তুমুলভাবে চলছে। শান্তিবাহিনীর প্রাধান্য বিস্তার করা এলাকা ছিল দণি ও মধ্যম পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থাৎ বর্তমান আমলের বান্দরবান জেলা এবং রাঙ্গামাটি জেলার দক্ষিণাংশ। সামরিক বাহিনীর সামরিক কর্মকাণ্ড এই এলাকাগুলোতেই জোরদার করা হচ্ছিল। শান্তিবাহিনী সর্বপ্রকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান করেই যাচ্ছিল। চাঁদাবাজি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। গুম, অপহরণ ও হত্যা প্রায়ই হতো। শ্রমিকদের মেরে ফেলা হতো। পাহাড়িরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলেন না, অভ্যাস করতে দেয়াও হচ্ছিল না। এইরূপ পরিস্থিতিতে কী নিয়মে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালু করা ও অব্যাহত রাখা যায় এবং সাথে সাথে সামরিক অপারেশনও পরিচালনা করা যায়, এটা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রশ্ন ছিল। আগামী সপ্তাহে এ নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
লেখক: মেজর জেনারেল (অব চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
বিষয়: বিবিধ
১৭২৭ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আশা করি আগামী পর্বগুলোতে তা বুঝা যাবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন