দেবী...(একটি রাজনৈতিক রম্য গল্প)

লিখেছেন লিখেছেন সব্যসাচীর কলম ১১ মে, ২০১৩, ০৯:০৫:০৯ রাত



রাগে গজগজ করতে করতে ড্রইং রুমে পায়চারি করছেন আজগর সাহেব।

‘একমাত্র ছেলে বলে সব পাগলামি মানতে হবে নাকি…. মান সম্মান নিয়ে টানাটানি আমি কিন্তু সহ্য করব না… এরকম সিদ্ধান্তই যদি ওর হয়ে থাকে তাহলে এত আয়োজন করে এই শেষ মুহুর্তে এসে এসব বলার মানে কি। তোমার ছেলের পাগলামি বন্ধ করে ঘর থেকে বের হতে বল’- সোফায় বসতে বসতে রাগত স্বরে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বললেন আজগর সাহেব।

‘তুমি শুধু শুধু এত রাগ করছ কেন। নিজের ছেলেকে চেননা… ওকি কোনদিন আমাদের কষ্ট দেওয়ার মতো কোন কাজ করেছে… ওর কোন মানসিক সমস্যা হয়েছে কিনা একবারও ভাবছ না। ওদের মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝিও তো হতে পারে’- কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন মিসেস আজগর।

তাইতো এই বিষয়টাতো একবারও মাথায় আসেনি….. মনে মনে ভাবলেন আজগর সাহেব। ‘আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এদিকটা সামলাও। দেখ ওকে ঘর থেকে বের করতে পার কিনা। আমি একটু জামশেদের বাসায় যাচ্ছি… ওর সামনেই বা কি করে যাই… কি যে এক অবস্থায় পড়লাম’- বলে দীর্ঘদিনের বন্ধু জামশেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন আজগর সাহেব।

রাজিবটা সত্যিই এরকম না। গতকাল রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্তও সব ঠিক। বাপ-ছেলে একসাথে আজ সকালে পত্রিকা পড়েছে, তারপরই সব ওলট পালট। আজগর সাহেবের একমাত্র ছেলে রাজিব। ঢাকা মেডিকেলে শেষ বর্ষের ছাত্র সে। স্বভাবে প্রাণোচ্ছল রাজীব হাসি ঠাট্টা আর আমোদ প্রমোদেই মেতে থাকে সারাক্ষণ। বাবা মায়ের সাথে অসম্ভব রকমের খোলামেলা আর বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাজীবের। এতটাই খোলামেলা যে সেই ইন্টার পড়ার সময় রাজীবের মা রাজীবের সাথে ওর বিয়ে নিয়ে ঠাট্টা করত। রাজীব তখন বলত- ‘দ্যাখো মা, বিয়ের ব্যাপারে আমার মতামতই প্রাধান্য পাবে। কোন একটা অসাধারণ মেয়েকে আমি জীবনসঙ্গী করতে চাই’।

জামশেদ সাহেবের পুরো বাড়িটাকেই যেন বিষণ্নতা গ্রাস করেছে। ড্রইং রুমে বিষণ্ন মনে বসে আছেন জামশেদ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী। আজগরের জন্যই অপেক্ষা করছেন তাঁরা। বেডরুমের জানালার গ্রিল ধরে দুর আকাশের দিকে দৃষ্টি ছড়িয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে শীলা। জামশেদ সাহেবের একমাত্র মেযে শীলা ঢাকা মেডিকেলেরই দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। দু:খ বা কষ্টকে ছাপিয়ে রাজীবকে ঘিরে এক ধরণের আশংকা ঘিরে ধরেছে শীলাকে।

জামশেদ আর আজগরের বন্ধুত্বের সুত্র ধরেই এই দুই পরিবারের যোগাযোগ। রাজীব আর শীলার পরিচয়ের সুত্রও একই। শীলার ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর এই পরিচয়ই একটু ঘনিষ্টতায় রূপ নেয়। তবে পারিবারিক পরিচয় বা বাবা মায়ের কোন চাপের কারণে যে রাজীব শীলাকে পছন্দ করে বিষয়টা মোটেও সেরকম নয়। শীলার মধ্যে অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য পেয়েছে রাজীব। মেয়েটার আচরণ এবং কথায় কোন ভণিতা বা ছলচাতুরি নেই বরং সরল স্বীকারোক্তি এবং সহজ প্রকাশের এক অসাধারণ ছন্দ আছে। শীলার চাহুনিটা রাজীবের খুব পছন্দ। পুকুরের টলটলায়মান স্বচ্ছ পানিতে ঢিল ফেললে যেমন ঢেউ খেলে যায়, শীলার চাহুনিতে ওরকম একটা ঢেউ আছে।

রাজীব-শীলার পারস্পারিক পছন্দ আর সম্পর্কের সুত্র ধরেই এই দুই পরিবারে তাদের বিয়ের কথা পাকা। আগামী শুক্রবার (১৭/০৫/২০১৩) ওদের বিয়ে। আজ (১১/০৫/২০১৩) দুপুরে দুই পরিবার একসাথে বিয়ের বাজার করতে যাওয়ার কথা ছিল। গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত দুই পরিবার একসাথেই ছিল, তখনও রাজীব-শীলা বেশ অন্তরঙ্গভাবেই আলাপ করেছে। আজ সকালে আজগর সাহেব ছেলে রাজীবকে নিয়ে একসাথেই নাস্তা করছিলেন। রাজীব খুব মনযোগ দিয়ে পেপার পড়ছিল।

হঠাৎ নাস্তা ছেড়ে পেপারটা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় রাজীব- ‘বাবা, বিয়ের বিষয়টা আপাতত স্থগিত করো। আমি শীলাকে বিয়ে নাও করতে পারি….. একটু পরে তোমাদের জানাব… আর শীলাকেও ব্যাপারটা আমি ফোনে জানাব’। বলেই সোজা নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

কলিং বেলের শব্দ পেয়ে নিজেই উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন মিসেস জামশেদ। বিষণ্ন ও চিন্তাগ্রস্থ আজগর সোজা গিয়ে ড্রইং রুমে বসলেন। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।

‘জামশেদ, ভাবছি ডাক্তার শরীফকে একবার ডাকব কিনা’- নিরবতা ভাঙ্গলেন আজগর।

‘ডাক্তার শরীফ? সে তো মানসিক ডাক্তার’- বললেন জামশেদ।

‘দ্যাখো, রাজীবকে তো তুমি চেন। ও তো এমন না.. আমি ঠিক কিছু বুঝতে পারছি না। একটা কাউন্সেলিং হলে কি ভালো হতো না?’

‘হুম……হ্যাঁ, তা হতে পারে’

নিজের পাঠ্য বইয়ের হিউম্যান সারভাইভাল সংক্রান্ত সব চ্যাপ্টারগুলি তন্ন তন্ন করে দেখে যাচ্ছে রাজীব। যদিও জানা বিষয় তারপরও চরম আবেগের মুহুর্তে মানুষের ইন্দ্রীয়গুলো স্বাভাবিক কাজ করেনা। হ্যাঁ সব তো ঠিকই আছে। এই তো এখানেই লেখা আছে ‘খাবার ও পানি ছাড়া বেঁচে থাকাটা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণ অবস্থায় বিশ্রামরত মানবদেহ গড়ে ১০০ ওয়াট তাপমাত্রা তৈরি করে। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে তাপমাত্রা তৈরি করা কমে যায়। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যবান লোকের পক্ষে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ ক্যাথেরিন কলিন্সের মতে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেহও নিজেদের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়। দেহ নিজেই যত সম্ভব কম ক্যালরি ক্ষয় করে। দেহ যখন খাবার গ্রহণ বন্ধ করে দেয়, তখন বেঁচে থাকার কাজ শুরু হয় সঞ্চিত চিনির ওপর। এটাও শেষ হয়ে গেলে প্রোটিন ভেঙে শক্তি সংগ্রহ করতে থাকে। তবে এতে দেহের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণভাবে মানবদেহ পানি ছাড়া দুই থেকে তিন দিন বেঁচে থাকতে পারে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে কোনো ধরনের খাবার ছাড়া ৪০ দিন পর্যন্ত বাঁচা সম্ভব’।

হ্যাঁ সবই তো ঠিক আছে, রাজীব মনে মনে আওরাতে থাকে, কিন্তু প্রশ্ন তো ভিন্ন জায়গায়। সামান্য খাবারে সারভাইভাল ফাইটের পর শরীরে এর লক্ষণ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে বাধ্য। এতদিন অন্ধকার প্রকোষ্টে থেকে আলোতে আসার পর, লাশের বিকট গন্ধের মধ্যে এতদিন নির্ঘুম রাত কাটানোর পর স্বাভাবিক দৃষ্টি মেলতে পারাও সম্ভব না।

কিন্তু ছবি তো বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। এতদিনের সারভাইভাল ফাইট মেয়েটার চেহারার লাবণ্যতাকে এতটুকু ম্লান করতে পারেনি। ভ্যাঁপসা গরম ও ঘাম মেয়েটার পোশাকের উজ্জ্বলতাকে এতটুকু ম্লান করেনি। হাতের নখগুলো এতদিনেও বড় হয়নি।এতদিনের নির্ঘুম রাত মেয়েটার চোখ দুটোকে এতটুকু ক্লান্ত করেনি। কী ঝকঝকে দাঁত আর কী পরিস্কার পোশাকে চেহারার সমস্ত লাবণ্যতাকে ধারণ করে ধ্বংসস্তুপের গহীন ধেকে বেরিয়ে এল মেয়েটি। এ যেন নবী ইব্রাহিমকে পুড়িয়ে মারার আগুন সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় ফুলবাগানে পরিণত হওয়ার মতো। এ তো সাক্ষাত দেবী। ধরার বুকে এই তো সেই অসাধারণ মেয়ে। রাজীব চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

রাজীবের ঘরের সামনে বসে চিন্তিত আজগর, মিসেস আজগর, জামশেদ আর ডাক্তার শরীফ।

হঠাৎ খুলে গেল রাজীবের ঘরের দরজা। পেপারটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়।

‘আমি শীলাকে বিয়ে করব না বাবা’- বলল রাজীব।

‘তবে কাকে বিয়ে করবি’- প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বললেন আজগর।

‘যদি পার….. একে’ বলেই পেপারের ছবিটা এগিয়ে দিল যেখানে ছবির উপরে লাল অক্ষরে লেখা ‘ধ্বংসস্তুপে বিস্ময়কন্যার ১৭ দিন’…….

বিষয়: রাজনীতি

৩২৫৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File