পথিক, তুমি পথ হারাচ্ছ!
লিখেছেন লিখেছেন আল মাসুদ ০৪ মার্চ, ২০১৩, ০৮:৪৪:৫৯ রাত
শাহবাগ আন্দোলন শুরুর পর ঘটে গেছে অনেক কিছু। রাজীব নিহত হলেন, শান্ত মারা গেলেন, প্রজন্ম চত্বরে চারটা মহাসমাবেশ হলো, রায়েরবাজার ও মিরপুরে হলো আরো দুটো মহাসমাবেশ। আর শাহবাগে রাতজাগার ঘটনা অনেকের কাছে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা হয়ে সামনে এসেছে। আমরা জানি, এ সবই মূলত একটা দাবিকে কেন্দ্র করে- কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দণ্ড।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি সর্বজনীন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষুব্ধ তারুণ্য পথে নেমে এলে তাকে স্বাগত জানায় প্রায় সব দল-মতের মানুষ। আর এখানেই ছিল এই আন্দোলন সফল হওয়ার কিংবা এগিয়ে যাওয়ার পথে আশাজাগানিয়া ও আস্থার জায়গা। একটা অসংগঠিত আন্দোলনে দু-একজনের ডাকে মানুষ শাহবাগে ছুটে এসেছে, ব্যাপারটা তা নয়। বরং ওই সর্বজনীনতার কারণেই শাহবাগ আন্দোলন ‘গণজাগরণে'র রূপ পেয়েছে। আর আছে আমাদের রাজনৈতিক দৈন্য, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতির প্রতি মানুষের, বিশেষ করে, তরুণ প্রজন্মের বীতশ্রদ্ধতা। দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের দলগুলোর হানাহানির রাজনীতি আর পারস্পরিক বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ দেখে দেখে হতাশ তারুণ্য নতুন পথ খুঁজছিল তাদের ক্ষোভ প্রশমনের, খুঁজছিল নতুন আলোর দিশা। তারা সেই আলোই দেখছিল শাহবাগ জাগরণে।
ফলে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম এই জাগরণকে নিয়েছে নতুন মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে, তারা এখান থেকে আস্বাদন করতে চেয়েছে তাদের না-দেখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ফলে শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবার উপস্থিতি ঘটেছে এই প্রজন্ম চত্বরে। এমন অনেকে এখানে এসেছে, যারা কখনো কোনো মিছিল-শোভাযাত্রায় রাস্তায় নামেনি। আবার আমরা দেখেছি, মুহূর্তের ডাকে কীভাবে প্রজন্ম চত্বর তারুণ্যের জোয়ারে ভেসেছে।
এমন সব ইতিবাচক অভিজ্ঞতা আমাদের পুলকিত করেছে; দেশের তারুণ্য আর ভবিষ্যত্ নেতৃত্ব নিয়ে আমাদের আবার আশাবাদী করেছে।
কিন্তু এই আন্দোলন যে অবস্থান ও মর্যাদা নিয়ে শুরু হয়েছিল, ২২ দিন পর আজ সেই জায়গায় আছে কি না, তা পর্যালোচনার সময় এসেছে। পর্যালোচনার সময় এসেছে, আমরা সঠিক পথে আছি, নাকি এই আন্দোলনের প্রধান বৈশষ্ট্যি যে সর্বজনীনতা, তা ক্ষুণ্ন হয়েছে বা হচ্ছে। আরো ভেবে দেখতে হবে, আমাদের আবেগীয় কোনো কাজে, কথায় বা স্লোগানে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে কি না, কারও উপস্থিতি বিতর্ক তৈরিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে কি না।
এই প্রশ্নগুলো আমার ব্যক্তিগত মানসসঞ্জাত নয়, ইতিমধ্যে পাওয়া কয়েকটি অভিজ্ঞতা থেকে এগুলো তৈরি হয়েছে। আমি মনে করছি, বিষয়গুলো শাহবাগ আন্দোলনের সঞ্চালকদের জানিয়ে দেয়া দরকার।
একজন, যিনি প্রায় প্রতিদিন শাহবাগে ঘুরে গেছেন, তার আশঙ্কা, শাহবাগের তারুণ্য এখন আর মূল লক্ষ্যে স্থির নেই। একজন বলেছেন, তারা শাহবাগের তারুণ্যের ভিড়ে এমন কিছু মুখ সামনে দেখছেন, যাদের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সামনের কাতারে দাঁড়ানোর বাতিক আছে, এবং যারা মনে করেন, তারা ছাড়া অনুষ্ঠান-আন্দোলন অপূর্ণ থেকে যায়; এই মানুষগুলো আমাদের কলুষিত রাজনীতিরও পরোক্ষ অংশ। শাহবাগ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও সরব কিছু কর্মী, যারা কবি-লেখক প্রগতিবাদী বলে পরিচিত, তারা ‘নতুন প্রজন্ম ব্লগার ফোরাম' ব্যানারে দাবি জানাচ্ছেন, ‘এই গণ-আন্দোলনকে আওয়ামীকরণ করা চলবে না'। শাহবাগ আন্দোলনের সংবাদ কাভার করেন এমন অনেক সাংবাদিক বলেছেন, প্রজন্ম চত্বরের অনেক সক্রিয় কর্মী এখন আর শাহবাগে আসেন না।
তাহলে কি পথিক, তুমি পথ হারাচ্ছ? নাকি ইতিমধ্যে হারিয়েছ? না, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, শাহবাগ আন্দোলন পথ হারায়নি, তা হয়তো একটু হোঁচট খেয়েছে; ভুল পদক্ষেপে পা পিছলেছে। আবার সঠিক পদবিক্ষণে তার গতি ফিরে পাবে।
তবু, আমরা উপরে উল্লিখিত আশঙ্কাগুলোর সঙ্গে নিজেদের পর্যালোচনাটা একটু মিলিয়ে দেখি। শাহবাগ আন্দোলনের সর্বজনীনতা হলো যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি। এবং এই দাবিতেই শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম তিন দিন মুখর ছিল প্রজন্ম চত্বর। স্লোগান ও বক্তব্যে একটি দাবিই শাহবাগ কাঁপিয়েছে- ‘আর কোনো দাবি নাই, রাজাকারের ফাসি চাই'। টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজ আর পত্রিকার খবরে প্রচারিত শাহবাগে আসা মানুষের মুখে এই একটি দাবিই উচ্চারিত হতে দেখেছি। প্রকৃত অর্থে, শাহবাগ আন্দোলনের জনসম্পৃক্তি কেন্দ্রীভূত ছিল এই একটি দাবিতে। কিন্তু ৮ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশের পর এই দাবি যেন হঠাৎ গৌণ হয়ে গেছে। রায়েরবাজারের মহাসমাবেশের পর তা আরও সরে গেছে। সেখানে প্রধান দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু নতুন বিষয়, যেগুলো শাহবাগ আন্দোলনের সূচনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। আন্দোলন পরিচালনাকারী কিছু ব্যক্তি ও ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ ছাড়া সাধারণ্যে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এই দাবিগুলো। বরং এই দাবিগুলো তুলে আমরা কিছু প্রথা-প্রতিষ্ঠানকে আমাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছি, আমাদের সর্বজনীনতা নষ্ট করেছি। এরই বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখলাম ২২ ফেব্রুয়ারি দেশজুড়ে ইসলামী সমমনা দলগুলোর সহিংস আন্দোলনে।
আমি এর আগে এক নিবন্ধে লিখেছিলাম, আমরা যেন আবেগের কাছে হেরে না যাই, কুচক্রীর ফাঁদে যেন পা না দিই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমরা ইতিমধ্যে সে ফাঁদে পা দিয়েছি। আর এতে শাহবাগ আন্দোলনের একরকম রাজনৈতিকীকরণ ঘটে গেছে, খোয়াতে বসেছে এর সর্বজনীন চরিত্র। আমার আরো ধারণা, শাহবাগ আন্দোলনের প্রবক্তারা বিষয়টি ধরতে পারেননি, বা পারলেও ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আর যদি তারা এটা বুঝেশুনেই করে থাকেন, তাহলে বলতে হবে, আমরা সাধারণ মানুষের ভুল হয়ে গেছে। আর এই ভুলগুলোই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে উপরে উল্লিখিত কয়েকজনের আশঙ্কা প্রকাশের ভেতর।
শাহবাগ জাগরণের সূচনার যে সূত্র- যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি- তার সঙ্গে পরে যেসব দাবি যোগ হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে কিছু পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া, ‘আমার দেশ' পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার করা, ইসলামী ব্যাংক বর্জন করা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি। যদিও কিছু বিষয়ে শাহবাগ আন্দোলনের কর্মীরা আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের জায়গাটা ইতিমধ্যে যথষ্টে নড়বড়ে হয়ে গেছে।
তবে এ বিশ্বাসের জায়গায় পুনর্বাসনের জন্য ইতিমধ্যে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের স্লোগানে, বক্তৃতায়, ব্লগে, ফেসবুকে এখন অনেকটা সংযত ভাব দেখা যাচ্ছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। শাহবাগ আন্দোলনের জন্য যেমন, তেমনি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্যও এটা প্রয়োজন। আমরা আমাদের আবেগের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা নিয়ে আমরা আন্দোলন করছি। এই ট্রাইব্যুনালের আইনে নানা বিধিনিষেধ আছে। জানি না, আমরা ইতিমধ্যে এর কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছি কি না। তবে আমরা বলছি, এটা জনতার দাবি, জনতার অধিকার। তেমনি বিচার কার্যক্রমের কোনো ফাঁকফোকর নিয়ে বলার অধিকার কারো থাকতে পারে, এটাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাহলে আমরা কেন যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে কিছু পত্রিকাকে মিলিয়ে ফেললাম? আদালত যদি তার নীতিনৈতিকতা মেনে বিচার পরিচালনা করেন, তাহলে পত্রিকার কী সাধ্য বিচার বানচাল করে! আর আদালতের কাজে যদি কোনো ব্যত্যয় ঘটে, আর তা পত্রিকায় আসে, তার দায়ও আদালতের, পত্রিকার নয়। এসব যদি আমরা না মানি, তাহলে যুদ্ধাপরাধীরা এখন সরকারে কবজায় আছে, বিচারের দরকার কী, ফাঁসির দড়িতে লটকে দিলেই হয়।
কিন্তু তা সম্ভব নয়। বরং সরকার যাতে যুদ্ধাপরাধের বিচারে সঠিক ও দক্ষ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে আন্দোলনের দাবি পূরণে সহায়তা করে, সেদিকে আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত। সরকার যাতে যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে আঁতাত করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। সরকার ও অন্য কোনো দল যাতে শাহবাগ আন্দোলনকে তার রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজর থাকা উচিত। কারণ, সরকার অসীম ক্ষমতার অধিকারী; বড় রাজনৈতিক দলও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা ধারণ করে। তবে এখানে সরকারই মুখ্য; ভালো চাইলে সরকারই পারবে, মন্দ চাইলেও সরকারই পারবে। আমার ব্যক্তিগত মত, যুদ্ধাপরাধের যা সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে, তাতে আদালত ও সরকার প্রভাবিত না হলে যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায্য শাস্তি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের আদালত, বিশেষ করে, উচ্চ আদালতের ওপর মানুষের আস্থা এখনো বজায় আছে।
কাজেই আবেগের বশবর্তী হয়ে আমাদের এমন কিছু করা বা বলা ঠিক হবে না, যা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যায়। যা থেকে সরকার, বিরোধী দল কিংবা অন্য কোনো গোষ্ঠী ফায়দা লুটে নতুন প্রজন্মের জন্য হতাশার কারণ ঘটায়।
বিষয়: বিবিধ
১৩২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন