আমার মাঃ আমার আদর্শ
লিখেছেন লিখেছেন আল মাসুদ ০৩ মার্চ, ২০১৩, ১১:০৮:৩৫ রাত
পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর উচ্চারণ এবং অন্যতম একটি তৃপ্তিদায়ক শব্দ ‘মা’। ‘মা’ শিশুর সার্বজনীন ভাষা। একটি শিশু প্রথম যে শব্দটি উচ্চারণ করতে শেখে তা হলো ‘মা’। ‘মা’ উচ্চারণের সাথে সাথে হৃদয়ে যে আবেগ ও অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তাতে অনাবিল সুখের প্রশান্তি নেমে আসে। ‘মা’ ডাকের মধ্য দিয়ে সন্তান খুঁজে পায় তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল আর জননী তার দুঃখ কষ্ট ভূলে পায় চরম আনন্দ। পরিবারের প্রতি দৃষ্টি রাখতে যেয়ে, প্রতিদিন নিজের আরাম নষ্ট করে, নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, সন্তানদের পৃথিবীতে চলার যোগ্য তৈরী করে দেন যিনি, তিনি ‘মা’। আমাদের জীবনের গভীর সংকটকালে প্রথম স্মরণ করি পরম মমতাময়ী মাকে। সকলের ‘মা’ তার কাছে পুজনীয় এবং আরাধ্য।
সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসা সহজাত গুণ। এই ভালোবাসার কারণেই সৃষ্টির ধারা প্রবাহমান। ‘মা’ হচ্ছেন মমতা-নিরাপত্তা-অস্তিত্ব, নিশ্চয়তা ও আশ্রয়স্থল। মা সন্তানের পরিচালক, অভিভাবক, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, পথনির্দেশক ও বড় বন্ধু। সন্তানের প্রতি মায়ের এই তীব্র মমতার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান বলে, মায়ের দুধে এক প্রকার রাসায়নিক যৌগিক পদার্থ আছে-যা সন্তানের দেহে প্রবেশ করলে ‘মা’ ও সন্তানের মধ্যে প্রীতি ও সৌহার্দের নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি হয়। মায়ের দেহে “নিউট্রোপেট্রিক রাসায়নিক” পদার্থ থাকায় মায়ের মনের মাঝে সন্তানের জন্য মমতা জন্ম নেয়। তবে মায়ের ভালোবাসা বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
ইসলাম মাকেই দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান এবং মর্যাদা। ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।’ মহান আল্লাহ পাক মায়েদের অন্তরে সন্তানের প্রতি সৃষ্টি করেছেন এক পরম মমত্ববোধ। সন্তান গর্ভে ধারণ করা হতে অপরিসীম কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগের পর প্রসব। অতঃপর সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাক তাকে ভুলিয়ে দেয় দীর্ঘ দিবস-রজনীর যাতনা। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, ‘মাতৃত্বেই সকল মায়া-মমতা ও ভালবাসার শুরু এবং শেষ।’ মা-কে ভালোবাসার জন্য কোন আলাদা দিনের প্রয়োজন হয় না। সবসময় ‘মা’ সন্তানের পুজনীয় ও আরাধ্য হওয়া উচিত। তবু পশ্চিমা বিশ্বে বৃদ্ধাশ্রম যে হারে বেড়ে চলছে তাতে মায়ের প্রতি ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও মূল্যটুকু উপলব্ধি করার জন্য সন্তানদের আলাদা উপলক্ষ্যের প্রয়োজন হয়। তবে এই একদিন মায়ের প্রতি ভালবাসা দেখিয়ে মায়ের ঋণ শোধ করা সম্ভব না। যে ‘মা’ আমাদের কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেছে তার প্রতি একদিন ভালবাসা কি যথেষ্ট বরং তামাশা মাত্র। তারপরেও “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল”। আর বর্তমানে বিশ্ব ‘মা’ দিবস পালন মায়ের প্রতি ভালবাসা প্রকাশের উপলক্ষ।
কথিত আছে, ব্রিটেনেই প্রথম ‘মা’ দিবস পালন শুরু হয়। তবে ‘মা’ দিবস উদযাপনের উদ্ভাবক মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্টস। সতের শতক থেকে প্রতিবছর মে মাসের চতুর্থ রোববারকে “মাদারিং সানডে” হিসাবে পালন করা হতো ব্রিটেনে। এরপর আমেরিকার পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে প্রথম ‘মা’ দিবস পালন করা হয় ১৮৫৮ সালের জুনের ২ তারিখ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন সর্বপ্রথম মা দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেসে মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে 'মা' দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে এই দিন আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে মা দিবস।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য বিশেষ দিনগুলোর চেয়ে এ দিনটিতে সবচেয়ে বেশি ফোন কল হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ভিআইপি কমিউনিকেশন এর জরিপে বলা হয়েছে, এ দিনটিতে নববর্ষের চেয়ে ৮ শতাংশ, ভালোবাসা দিবসের চেয়ে ১১ শতাংশ এবং হ্যালোয়েনের চেয়ে ৬২ শতাংশ বেশি ফোন কল হয়। দক্ষিণ আফ্রিকানরা মা দিবসে ফোন করে সবচেয়ে বেশি। তাদের ফোন কলের হার ৯১ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঘানার অধিবাসীরা। বিশ্বে মাত্র দুটি দেশ মিসর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় মা দিবসে ফোন কলের সংখ্যা কম।
যাইহোক প্রসঙ্গে চলে আসি, আমার মা কামরুন্নেছাকে নিয়ে আমার এ লেখাটি। যে ছেলেটি আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠের ছাত্র তার সবটুকু অবদান আমার পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া মা’র। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর সন্তান অনেক বড় হবে, মানুষের মত মানুষ হবে। তাইতো আমার বংশের সর্বোচ্চ পড়ুয়া আমার আব্বাকে (এইস এস সি) ছাঁড়িয়ে আজ আমি ঢাবিতে। আমার ইউনিয়নটি বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ, সুন্দরবনের গা ঘেঁসে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা। যে ইউনিয়নটি গত ২৫ মে ২০০৯ সালে ভয়াবহ আইলায় সবচেয়ে বিধ্বস্থ। একে বলা হয় সভ্যতা থেকে আলাদা একটি জনপদ। ৪৫ হাজার মানুষের বসতি এ ইউনিয়নটি যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে আনেক পিছিয়ে। ভরা জোয়ারে মনে হয় সাগরের মধ্যে ভাসমান এক টুকরা সোলা। আমার ইউনিয়নের আমিই দ্বিতীয় যে ঢাবিতে চান্স পেয়েছে। বর্তমানে প্রতিবছর ১-২ জন করে আসা শুরু করেছে।
আমার আব্বা আমাদের গ্রামে একটি প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। এজন্য তার ব্যস্ততার কারণে মা সবসময় আমাদের আগলে রাখতেন। যে ইউনিয়নের মানুষেরা সন্ধ্যার পরপরই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত আমার ‘মা’ তখন আমার বড় বোন ফাতিমা ও আমাকে নিয়ে রাত ১০-১১ পর্যন্ত পড়াত। ল্যাম্পের (গ্রামের ভাষায় টেমি) মিটিমিটি আলোতে ঢুলুঢুলু চোখে মায়ের সাথে আমরা পড়তাম। ‘মা’ আমাদের পড়াতেন এবং নিজে ও পড়তেন। বর্তমানে আমি কোন সাহিত্য বা উপন্যাস কিনলে গভীর রাত জেগে ‘মা’ পড়েন। আমার একটি খাতা আছে যেখানে মায়ের ছাত্র জীবনে মুখস্থ করা ৫০-৬০ টি কবিতা তার কাছ থেকে শুনে আমি সংগ্রহ করেছি।
আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা সাধারণত লেখা-পড়া করত না বলে অনর্থক সময় নষ্ট করত। খেলা-ধুলা ও আড্ডাতে মগ্ন থাকত। এজন্য সারাদিন মা আমাদের চোখে চোখে রাখত তাদের সাথে মিশতে দিত না। আজ বুঝি কেন ‘মা’ আমাদের মিশতে দিত না। তাদের সাথে মিশলে হয়তো আজ এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। কেননা তাদের অধিকাংশ প্রাইমারী লেভেল ছাড়াতে পারিনি। কড়া নির্দেশ ছিল মাগরিবের পরপরই বই-খাতা নিয়ে বসতে হবে। আশপাশের মানুষেরা অশিক্ষিত হওয়ায় অশ্লীল ভাষা ছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু আমরা মায়ের মুখে কোনদিন অশ্লীল কথা শুনিনি আর আমরা ও কোনদিন কাউকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়নি। তবে আমাদের দুই ভাই-বোনের মধ্যে মাঝে মাঝে যে মল্লযুদ্ধ হত সেখানে বান্দর ও কুকুর শব্দদ্বয়ের কদাচিত অপপ্রয়োগ চলত। আমার ছোট ভাই মামুন [এবার এস এস সি ফলপ্রার্থী] আবশ্যই আমাদের মত পরিবেশ পায়নি। সে ছোট থেকে অন্যদের সাথে মিশতে শুরু করেছে,তবে সে ও কোনদিন কাউকে গালি দেয়নি বা অনর্থক কারো সাথে ঝগড়াতে জড়ায়নি। কেননা এ ব্যাপারে মায়ের কঠিন অবস্থান ছিল।
আব্বা স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকায় আমাদের খোঁজ খবর ঠিকমত নিতে পারত না। নিজের জমির ধান বিক্রি করে আব্বা স্কুলের কাজে লাগাত যার প্রভাব যে আমাদের উপর পড়িনি তা নয়। এজন্য মায়ের ডিম বিক্রি করা বা অন্যন্যা আনুষঙ্গিক টাকা দিয়ে আমাদের খাতা-কলম, পরীক্ষার ফিস ও জামা-কাপড়ের চাহিদা মিটাতো। অন্যদের সাথে মিথ্যা বলার ব্যাপারে মা ছিল খুব কড়া। কঠিন বাস্তবতা হলেও সব সময় আমাদেরকে সত্য কথা বলার জন্য বলত। কারো জিনিস না বলে নেওয়া যাবেনা এবং এটা যে গোনাহর কাজ তা সর্বপ্রথম মায়ের কাছ থেকে শেখা। অল্পতে সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারে মা সবসময় উপদেশ দিত। যে কারণে ক্লাস ফাইভ থেকে সেভেন পর্যন্ত একটি পাঞ্জাবী গায়ে দেওয়া কোন দিন মনোঃকষ্টের কারণ হয়নি। কেননা আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা যে সময় তাদের পিতা-মাতাদের দৈনিক ১০০ টাকা করে আয় করে দিত আমি তো সে সময় পিতা-মাতার টাকার উপর নির্ভরশীল ছিলাম। সংসারের কষ্টটা আব্বার চেয়ে মায়ে বেশি উপলব্ধি করেছে,কেননা আব্বা বেশি সময় বাইরে থাকত। আর এজন্য মা কোনদিন আমাদের বাইরে কাজ করতে পাঠাইনি। আমার মাকে আমাদের জন্য অন্য মায়েদের মত তাদের সন্তানদের ঝগড়া মিটাতে যাওয়া লাগিনি। মাদ্রাসা জীবনে যে সময় বোডিং থাকতাম তখন হারিকেনে পড়ার জন্য কেরোসিন কেনার টাকা মায়ে জোগান দিত।
"মা" কে অনুভব সেদিনই করেছিলাম যেদিন এই আমি প্রথম "মা"কে ছেড়ে খুলনাতে পড়তে যাই। যখন বোডিংয়ের খাওয়া খেতাম আর কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করতে যেতাম তখন মায়ের কথাটা বেশি মনে পড়ত। তাই খুলনাতে না পড়ে আবার বাড়িতে ফিরে যাই এবং আগের মাদ্রাসাতে ভর্তি হই। পরবর্তীতে ঢাকাতে আসার পরে মামার কাছে থাকায় মায়ের অনুপস্থিতি অতটা অনুভব করতাম না।
আজ যখন চিন্তা করি আমি কোথায় ছিলাম? কোথায় আছি? আবার কোথায় যাব? তখন আমার মায়ের কথাটা বেশি মনে পড়ে। কেননা যে অজ-পাড়া-গায়ে আমার জন্ম, যে এলাকাটা একেবারে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন বলা যায়, যেখানকার মানুষ অনেকে জানেনা সুইচে টিপ দিলে আলো আসে। অনেকে চার চাকার গাড়ি দেখিনি, পিচের রাস্তা সাদা না কালো? তা অনেকে জানে না। সেই এলাকা থেকে এই ‘আমার’ উঠে আসা। আর এর পিছনে যে ব্যক্তিটির সবচেয়ে বেশি অবদান সে আমার ‘মা’। আর এজন্য আমার মা, আমার আদর্শ।
বিষয়: Contest_mother
১৫১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন