'দৃষ্টিপাত' দৃষ্টির উপর
লিখেছেন লিখেছেন সংশপ্তক ১৫ জুলাই, ২০১৩, ০৬:১৩:২৯ সন্ধ্যা
যোগাযোগমন্ত্রীর বিলবোর্ড তত্ত্ব বেশ কিছুদিন মানুষজনের বিনোদনের খোরাক যুগিয়েছিল। বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ক’জন চালক ক’টা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সেটা জানা না থাকলেও এটা ঠিক যে, ঐ বিলবোর্ডগুলোর ‘কন্টেন্ট’ অশ্লীলতাকে আমাদের চোখে সয়ে দেওয়ার পেছনে ক্যাটালিস্ট হিসেবে ভূমিকা রাখছে আর মনকে প্রলুব্ধ করছে তাতে জড়িত হতে। বিলবোর্ডে তো তাও প্রাণহীন কন্টেন্ট, রাস্তাঘাটে বের হলেই অনেক বোনের আধুনিক গেটআপ, ছেলেদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ চলাফেরা যে কারো চোখ তো টানবেই, মাথাও ঘুরিয়ে দেবে। বিনোদন জগতের আপডেটের জন্য কিংবা লেটেস্ট ফ্যাশনটার জন্য পত্রিকায় বরাদ্দ পাতাটুকু অথবা নিদেনপক্ষে খেলার পাতায় টেনিসতারকাদের জন্য বরাদ্দ কলামটুকু চোখ-চিন্তা সবগুলোকেই সক্রিয় করবে, নো ডাউট। এইগুলো রাখা হয় ঐ পারপাসেই। টিভি চ্যানেলগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য। এমনকি মিডিয়াফায়ার থেকে নির্দোষ ডাউনলোড দিতে গিয়েও অনেকসময় চলে আসে স্যাম্পল ছবিসহ অমুক-তমুকের আমন্ত্রণ, কোথায়-কখন-কিভাবে কল, ব্লা ব্লা...। রাস্তা-ভার্সিটি-অফিস-রেস্টুরেন্ট-গাড়িঘোড়া-পত্রিকা-টিভি-বিলবোর্ড-নেট- মোটকথা, এমন একটি জায়গাও পাওয়া যাবে না যেখানে এই একই অবস্থা না। মানে, সবসময় আমাদের চোখের নাগালেই প্রলুব্ধকর ব্যাপারগুলো আসছে-যাচ্ছে, যাতে চোখ মেললেই দেখতে পাই। আমরা প্রলুব্ধ হতে থাকি দেখে দেখেই। এখন আমাদের এসব চমৎকার চোখ-সওয়া হয়ে গেছে, মানে আমাদের নৈতিকতাবোধ তেমন একটা আক্রান্ত হয় না এতে, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা উপভোগ(!?) করি, আস্তে আস্তে নিজেরাও পা বাড়াই সেইদিকে- না বাড়ালেও এগুলো নিতান্তই এখন স্বাভাবিক ব্যাপার আমাদের কাছে। আবার সমাজের নৈতিক অধঃপতনের পরিণামখবরগুলো যখন পত্রিকার পাতায় আমাদের চোখে পড়ে বা নিকট মানুষদের মধ্যে মাঝেমধ্যে শুনি, তখন কিঞ্চিৎ হলেও ঘৃণা-আফসোসের একটা মিশ্র অনুভূতিও অনেকের মধ্যে জাগে! ব্যাপারটা অদ্ভুত না? কখনো কি ভেবে দেখেছি, আমাদের দায়-দায়িত্ব এতে কতটুকু? আমাদেরই বা কি করণীয় ছিল? আমরা নিজেরাই কি সঠিক কাজটা করছি?
একটা ব্যাপার আমরা জানি কিনা যে, কুরআনে পর্দার নির্দেশের সূচনা পুরুষদের দিয়ে শুরু হয়েছে? নির্দেশের শুরু হয়েছে “হে নবী! মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে; ...”১ এটা দিয়ে। আচ্ছা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কেন ‘লজ্জাস্থানের হেফাজত’-এর আগে দৃষ্টি সংযত করার নির্দেশ উল্লেখ করলেন? এটা কি এজন্যই না যে- দেখার ফলেই আমরা প্রলুব্ধ হই? এজন্যই না যে- বারবার দেখেই আমাদের চোখ-সওয়া এবং মন-সওয়া হয়ে যায়, আমরা এগুলোকে স্বাভাবিক ও সামান্য ব্যাপার বলে একসময় মনে করতে থাকি, তারপর নিজেই একসময় নিষিদ্ধ কাজে জড়িত হয়ে পড়ি?? শুরুটা আসলে দেখা থেকে মানে এই দৃষ্টিপাত থেকেই শুরু হয়। মানুষ তার সমস্ত ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই ব্যভিচারের সাথে জড়িত হতে পারে। কিভাবে!? এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন। চোখের ব্যভিচার ‘দেখা’, কণ্ঠের ব্যভিচার ‘প্ররোচনা দেওয়া’, হাত দেওয়া ও অবৈধ উদ্দেশ্য নিয়ে চলা হাত ও পায়ের ব্যভিচার। ব্যভিচারের এ যাবতীয় ভূমিকা যখন পালিত হয়, তখন লজ্জাস্থানগুলো তাকে পূর্ণতা দেয় অথবা তা থেকে বিরত থাকে!২ তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কথা উদ্ধৃত করেছেন, “দৃষ্টি হচ্ছে ইবলীসের বিষাক্ত তীরগুলোর মধ্য থেকে একটি তীর।”৩
এই কিছুদিন আগে এক ভাইয়ের কাছ থেকে একটা বিরল জেনেটিক রোগের নাম জেনেছিলাম, এখন ভুলে গেছি। শ্বাস-প্রশ্বাসের যে ন্যাচারাল অটোমেটিক সিস্টেম, এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সেটা নষ্ট হয়ে যায়, তাকে বেঁচে থাকার জন্য মনে করে করে শ্বাস নিতে হয়! তো এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বাঁচে না, কেন? কারণ, ঘুমের মধ্যে কিভাবে সে শ্বাস নেওয়ার কথা মনে করবে!? সুবহানআল্লাহ!!
আমরা কি উপলব্ধি করি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কত বিরাট দান, কত বিরাট নি’আমাত এই চোখ, কান, নাক, হাত-পা, আমার সম্পূর্ণ শরীরের প্রতিটি পার্ট, প্রতিটি সিস্টেম?? প্রত্যেকটি নি’আমাত সম্পর্কেই আমাদের জিজ্ঞাসা করা হবে- সেই নি’আমাত কিভাবে কাজে লাগিয়েছি, কিভাবে সেটার কৃতজ্ঞতা ‘আদায়’ করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। “নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও অন্তর সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”৪
আমরা তাহলে কি করব? দেখাতে চায়, আমার কি দোষ- বলে মিচকেমি করব? সৌন্দর্য গোপন করার জিনিস নয় (কু)যুক্তি দেখিয়ে যেতে থাকব? মনের চোরাকুঠুরীতে লুকায়িত পশুটার লালসাকে গোপনে ‘স্যাটিসফাই’ করাটাকেই প্রাধান্য দেব? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সতর্ক করে দিচ্ছেন, আমরা যেন ভুলে না যাই! কি?? “...সেদিনের কথা, যেদিন তাদের নিজেদের কণ্ঠ এবং তাদের নিজেদের হাত-পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে!”৫
যেটা আমাদের করা ‘অবশ্য কর্তব্য’(ফরয), তা হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ স্ট্রিক্টলি মেনে চলা। যার যার নিজের ক্ষেত্রে হাইয়েস্ট যতটুকু সম্ভব তা মেনে চলা এবং আরো ডেভেলপমেন্টের চেষ্টা করা। পারসোনালি এবং কালেক্টিভলি, দ্যাট মীন্স, কাছের পরিচিতজনদের ও অন্য আর যাদের সম্ভব মোটিভেট করা। বেশি কিছু না, জাস্ট নিজের চোখকে বাঁচিয়ে চলা এমন জিনিস দেখা থেকে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও তাঁর রাসূল নিষেধ করেছেন, সেটা বাস্তবেই হোক আর পত্রিকার পাতায় হোক আর ভার্চুয়ালিই হোক। হঠাৎ যদি চোখ পড়ে যায় তাহলে কি করব-এ প্রশ্নের উত্তরও বলে দিয়েছেন রাসূল(সা), “তুমি তোমার দৃষ্টিকে কালবিলম্ব না করে ফিরিয়ে নেবে।”৬ আরো সতর্ক করেছেন, “... প্রথম দৃষ্টিপাত (অনিচ্ছাকৃত) তো ক্ষমাপ্রাপ্ত, কিন্তু দ্বিতীয় দৃষ্টিপাতের (ইচ্ছাকৃত) ক্ষমা নেই।”৭ এই ছোট্ট প্র্যাক্টিসটা থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হোক তাহলে!
প্র্যাক্টিসের জন্য এই রামাদানের চাইতে ভালো আর কোন উপলক্ষ্য পাওয়া যাবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রামাদানে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেন, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেন, শয়তান ও দুষ্ট জ্বিনদের বেঁধে রাখেন৮ এবং দু’আ কবুল করেন৯। আর কি চাই?? আল্লাহ তো আমাদের রোগের সূত্র ধরিয়েই দিয়েছেন, সেটার প্রতিষেধকও বলে দিয়েছেন সাথে সাথে। একটু কুরআনের পাতা উল্টালেই আমরা নিজেরাই সেটা দেখতে পাব।
একবার সিদ্ধান্ত নিলেই যে আর কোন ভুল হবে না, ব্যাপারটা এমন না। বরং একটু কঠিনই আছে। একারণেই প্র্যাক্টিস। একারণেই রামাদান মাস এত ইফেক্টিভ। কারণ, সাওমের প্রতিদান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার নিজের কাছ থেকে পেতে হলে, যেমনটি তিনি বলেছেন, অবশ্যই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে সাওমের শর্তগুলো যথাযথভাবে আমরা পালন করছি। সারাটাদিন আমাদের চোখ নিষিদ্ধ জিনিসের দর্শনসুখ উপভোগ করার পর কিভাবে আমরা আশা করতে পারি আমাদের সাওম কবুল হবে? ছোট্ট এই সংকল্পটুকু স্মরণে রাখতে হবে আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। ভুল হতেই পারে, কিন্তু জরুরি হল তৎক্ষণাৎ আন্তরিক অনুতাপ ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দিকে ‘ফিরে’ আসা, বারবারই ফিরে আসা। ইনশাআল্লাহ, ভুল থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের বের হয়ে আসার তাওফীক দেবেন। আর এক মাসের এই প্র্যাকটিসটা যথাযথভাবে যদি করতে পারি, ইনশাআল্লাহ, পরবর্তী এগার মাসও সেটা কন্টিনিউ করা খুবই সম্ভব। কিভাবে??
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, “দৃষ্টি হচ্ছে ইবলীসের বিষাক্ত তীরগুলোর মধ্য থেকে একটি তীর, যে ব্যক্তি আমাকে ভয় করে তা ত্যাগ করবে আমি তার বদলে তাকে এমন ঈমান দান করবো যার মিষ্টতা সে নিজের হৃদয়ে অনুভব করবে।”১০
আল্লাহু আ’লাম।
---------------------------------
১ সূরা নূরঃ ৩০।
২ বুখারী,আবু দাউদ।
৩ তাবারানী।
৪ সূরা বনী-ইসরাঈলঃ ৩৬।
৫ সূরা নূরঃ ২৪।
৬ মুসলিম।
৭ আবু দাউদ।
৮ বুখারী, মুসলিম।
৯ আহমাদ।
১০ তাবারানী।
বিষয়: বিবিধ
১২৮২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন