হেফাজত বনাম সরকার: কি হচ্ছে কি হবে?

লিখেছেন লিখেছেন ইকবাল হোসাইন নাবিল ০৬ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:৫৫:২৫ রাত

হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি নিয়ে আজ দেশ প্রায় দুইভাগে বিভক্ত। একপক্ষ পক্ষে। আরেকপক্ষ বিপক্ষে। প্রথম পক্ষ তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ সমর্থন দিচ্ছে, কেউ সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি অংশগ্রহণ করছে। কেউ না যেতে পারলেও ঘরে থেকে দোয়া করছে তাদের সফলতা চেয়ে। অবশ্য যারা সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি অংশগ্রহণ করছে তাদের মধ্যে কিছু লোক আছে যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। এরা সহিংসতা সৃষ্টি করে তার দ্বোষ হেফাজতের ঘাড়ে চাপাতে চায়। এবিষয়ে পরে আসছি। আর দ্বিতীয় পক্ষ স্বয়ং সরকার। যা তাতের ‍দ্বিমুখী নীতি ও আজকের কার্যকলাপের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে। হেফাজতের কর্মসূচিকে ব্যর্থ ও বানচাল করতে যা যা করা দরকার সরকার তার সবই করেছে; করছে এবং করবে। আজ ঢাকাগামী বাস, লঞ্চ ও ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। ঘাদানিকসহ কিছু নামসর্স্ব সংগঠন দ্বারা হরতাল ডাকিয়ে হেফাজতকে প্রতিহত করার প্রয়াস সরকারের আরেকটি রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের চরম প্রকাশ। আবার গণজাগরণ মঞ্চ ঢাকার চার প্রবেশদ্বারে অবরোধ বসিয়েছে। আর পুলিশের পাশাপাশি সেমিপুলিশ আওয়ামী লীগতো মাঠে আছেই। ওদিকে হেফাজতও যেকোন উপায়ে তাদের লংমার্চ সফল করতে বদ্ধ পরিকর। চট্রগ্রামসহ যেসব এলাকা থেকে তাদের নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসতে পারেনি তারা সেখানেই অবস্থান নিয়েছে। সব মিলিয়ে এটা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, লংমার্চ কর্মসূচি পালন করা হেফাজতে ইসলামের জন্য যেমন সহজ হচ্ছে না তেমনি তাদের দমিয়ে রাখাও সরকারের পক্ষে সহজ হচ্ছে না। এখানে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো আগামীকাল সারাদেশে ব্যাপক সংঘর্ষ হতে পারে এবং ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে। কারণ উভয় পক্ষই অনড় অবস্থানে আছে।

আমি আলোচ্য প্রবন্ধে এই অবস্থার জন্য কি কি বিষয় দায়ী বা কারা দায়ী সে বিষয়টি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে খোঁজার চেষ্টা করবো। প্রথমেই যে বিষয়টি সামনে আসে সেটি হলো- হেফাজতে ইসলাম ও সরকারের মধ্যে বোঝাপড়ার মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি। সরকার মনে করছে হেফাজতে ইসলামের সাথে জামাত কিংবা বিএনপির সাথে একটা আঁতাত হয়েছে। এবিষয়ে কিছু বলার আগে আসুন হেফাজতে ইসলামকে একটু জেনে নিই। এসংগঠনটি একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। হাটহাজারী মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী সাহেব সংগঠনটির আমীর। বাংলাদেশের কওমী মাদরাসা ও কওমী আলেম ওলামাগণ এ সংগঠন করে থাকেন। হেফাজত দেশের কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থনও করে না আবার কোন দলের বিরোধিতাও করে না। দেশে ইসলামবিরোধী কোন কাজ হলে তারা শান্তিপূর্ণভাবে তার প্রতিবাদ করে মাত্র। কওমী মাদরাসা কেন্দ্রিক এদলটি জামাতে ইসলামীকে ইসলামী দল বলেই মনে করে না। বরং তাদের যত প্রোগ্রাম হয় সেখানে তারা জাময়াতে ইসলামী যে মওদুদী মতবাদে বিশ্বাসী তার কড়া সমালোচনা করে থাকে। আর সরকার কিনা ভাবছে জামাতের সাতে তাদের আঁতাতরে কথা। অবান্তর আর অযৈাক্তিক ছাড়া কি বলা যায়? অবশ্য এটা মনে করার পেছনে সরকার যে বিষয়টি ভাবছে তা হলো- কিছুদিন আগে দেশের সমস্ত মসজিদ থেকে হেফাজতের ব্যানারে পরিচালিত মিছিল কর্মসূচিতে যে ভাঙচুর ও সহিংসতা চালানো হয়েছিল, সেটির কথা। অথচ তাদের মধ্যে ঢুকে ভাঙচুর করেছিল জামাত-শিবিরের কর্মীরা এটি সবার কাছেই দিনের মত পরিষ্কার। আর সরকার এটিকেই আঁতাত ভাবছে। বিগত দিনের সকল কর্মকান্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হেফাজতে ইসলামের গায়ে কোন রকম সহিংসতার দাগ নেই। বর্তমান কর্মসূচিতে ভাবার মত একটা বিষয় আমি খেয়াল করেছ। আহমদ শফী সাহেব বলেছেন, যেখানে বাধা আসবে আমরা সেখানে বসে ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির করবো। তিনি তো বলতে পারতেন যেখানে বাধা আসবে সেখানে পাল্টা জবাব দেয়া হবে। তিনি এটা না বলে তার আন্তরিক স্বচ্ছতা ও অসহিংস রুপেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। আশা করি শেষ পর্যন্ত এটাই যেন হয়।

বাংলাদেশের হলুদ মিডিয়া গুলোও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য অনেকাংশে দায়ি। তারা তিলকে তাল বানিয়ে হেফাজতকে জনসাধারণ ও সরকারের কাছে বিকৃতভাবে তুলে ধরেছে। ‘বিডিনউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’ নামক অনলাইন পত্রিকাটি বাংলার মহাণ ধর্মীয় নেতা আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী সাহেব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তথাকথিত ‘মুজাহিদ বাহিণী’ গঠন করে পাকিস্তানের সহযোগিতা করেছেন এমন কাল্পনিক, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল তখন দেশে সত্যিই একটা গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল যা দেখে জামাতের অন্তরাত্না কেঁপে উঠেছিল। ওই সময় ধর্ম অবমাননার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসা ছাড়া জামাতের ঝুড়িতে আর কোনো টোপ ছিল না। আর তাই তারা লেলিয়ে দিল সেটি আর গিলে ফেলল কওমী আলেম-ওলামারগণ। ব্লগ ও ফেসবুকে নাস্তিক-মুরতাদরা ইসলাম, কুরআন ও রাসূল সা. কে নিয়ে কটুক্তি করে অনেক আগ থেকেই। আমারব্লগ, সামহোয়্যারইন প্রভৃতি ব্লগে বছর দুয়েক আগ থেকেই ইসলাম ও কুরআন বিরোধী লেখালেখি চলছে। কেন হেফাজত ও আলেম-ওলামাগণ তখন মিছিল, লংমার্চ, হরতাল ইত্যাদি করলেন না? কারণও সোজা। তারা এত ব্লগ ও ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। তাই বিষয়টি তাদের অগোচরেই ছিল। মোক্ষম সময় ভেবে জামাতের ৮০% শেয়ারে পরিচালিত পত্রিকা দৈনিক আমারদেশ সেগুলো প্রকাশ করে সময়ের সর্বোচ্চ সুযোগ কাজে লাগালো। আলেম-ওলামাদের ক্ষেপিয়ে দিল। তারাও ভাবলেন কথাতো ঠিক। আমরা এতগুলো আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা থাকতে দেশে ইসলাম ও রাসূল সা.কে কটুক্তি করা হবে আর আমার ঘরে বসে থাকবো? দৈনিক আমারদেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান নিজেকে খুব বিশ্বাসী দাবি করেন। নিহত ব্লগার রাজীব ওরফে থাবা বাবা; শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃত্ব প্রদানকারী ইমরান এইচ সরকার, আরিফ জেবতিক, অমি রহমান পিয়ালসহ যাদের নাম এখন আসছে তারাও অনেকদিনে থেকেই ব্লগে ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করছে। কেন এত বিশ্বাসী মাহমুদুর রহমান সাহেব সেটা আগে প্রকাশ করেননি? এদিকে আর আগালাম না।

হেফাজতে ইসলামও তাদের কথাগুলো স্পষ্টভাবে সরকার ও জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। তারা মিডিয়াতে সংলাপের জন্য এমন ব্যক্তিদের পাঠিয়েছেন যারা কিনা ব্লগ কি, ব্লগার কি তাই-ই জানেন না। সমস্ত ব্লগারই যে নাস্তিক নয় এবিষয়টিও তারা পরিষ্কার করতে পারেননি। তারা জনগণকে বোঝাতে পারেননি যে, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে নয়। তারা শুধুমাত্র নাস্তিক ব্লগার; যারা রাসূল সা. এর বিরুদ্ধে কটুক্তি করেছে তাদের বিচার চান। তারা সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছিল। ২৯শে মার্চ ঢাকায় মুফতি রেজাউল করিমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসমাবেশ থেকেও বলা হয়েছিল যে, ৫ই এপ্রিলের মধ্যে নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেফতার করে বিচার শুরু করা না হলে তারা ৬ই এপ্রিলের লংমার্চকে পূর্ণ সমর্থন দিবে। সরকার তাদেরকেও বুঝতে চায়নি। গুটিকয়েক ব্লগারকে গ্রেফতার করে নাটক সাজিয়েছে। রাসূল সা.কে কটুক্তিকারী সকল নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেফতার করে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করলে আজ আলেম-ওলামা ও সরকারকে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াতে হতো না। এদিক থেকে সবচেয়ে বড় ভুল সরকারই করেছে বলে আমি মনে করি।

বর্তমান অবস্থায় যা দেখা যাচ্ছে তাতে হেফাজতের আন্দোলনের ফসল বিএনপি-জামাতের ঘরেই যাবে। কারণ হেফাজতের আন্দোলনের কারণে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হবে। সরকার যদি হেফাজতকে বাধা দেয় তাহলে তারাও হরতাল, অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি দেবে। তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যূটি চাপা পড়ে যাবে। নির্বাচন সামনে আসবে তথন আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে না। আবার জামাতকে নিষিদ্ধও করতে পারবে না। আর সে বিষয়টি মাথায় রেখেই সরকার হেফাজতকে দমিয়ে রাখতে চাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমিও চাই। তবে তা অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। সকল দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে কোন একটি দলকে পিছিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে নয়। বরং অপরাধের বিচার করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে।

হেফাজতে ইসলামের এই ঈমানী আন্দোলনকে আমি মনে প্রাণে সমর্থন জানাই। কিন্তু তারা কি শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্বচ্ছতা ধরে রাখতে পারবে? তাদের মধ্যে জামাত-শিবির ঢুকে কোন সহিংসতা চালিয়ে ফায়দা লুটার চেষ্টা যে করবে তা দিব্যি করে বলা যায়। হেফাজত কি পারবে তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে? সত্যিই কি তাদের আন্দোলন দেশের জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে নিয়ে আসবে? আশা করবো, সরকার ও হেফাজতে ইসলাম সময়ের উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিবে এবং দেশকে রক্তারক্তি, হানাহানি ও অস্থিশীলতার দিকে ঠেলে দিবে না।

বিষয়: রাজনীতি

১৪৩২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File