মরহুম জনাব ডঃ ইসরার আহমদ সাহেবের উর্দু ডি ভি ডি "বয়ানুল কোরাআন" এর সরল সংক্ষীপ্ত বাংলা অনুবাদ৷
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২৭ মার্চ, ২০১৩, ০৪:৪০:০৫ রাত
আত তাওবাহ; রুকু;-২ আয়াত;-৭-১৬
দ্বিতীয় রুকু শুরু করার আগে দুটি বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখার প্রয়োজন৷ এ রুকুটি নাজিল হয় অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের আগে৷ আর যেহেতু মুশরীক কোরাইশ পক্ষের গোত্র হোদায়বিয়ার সন্ধীর শর্ত লঙ্ঘন করে যার আভাস আমরা সুরা আনফালের ৫৮ নং আয়াতে পেয়েছি৷ এমত অবস্থায় কোরাইশ প্রধান আবু সুফিয়ান মদীনায় হাজির হয়ে চুক্তি বা সন্ধীটি পুনঃ নবায়নের জন্য বিশেষ ভাবে তদবীর করে চলেছে৷ কিছু কোমল হৃদয় সাহাবী ও এমন মোহাজীর ছিলেন, যিনি একাই হিজরত করেছেন, স্ত্রী পুত্রকন্যা গন আজও মক্কায়, আবু সুফয়ান এদের ও মোনাফেক দের দরজায় ধর্না দিয়ে চলেছে৷ অনেকেই মক্কা অভিযানে আপন জনের প্রান হানী বলেই মনে করতেন৷ তাদের দ্বারা ও হজরত আলি রাঃ দ্বারা সুপারিশে ব্যার্থ হয়ে অবশেষে নিজ কন্যা উম্মে হাবীবা রাঃ যিনি রসুল সঃ এর জওজায়ে মোহতারেমা বা পত্নি ছিলেন তার কাছে যায়৷ সুপারিশ তো দূরের কথা সেখানে অন্য এক দৃশ্যের অবতারণা হয়৷ কন্যার হুজরায় পিতার অবারিত দ্বার৷ ভিতরে গিয়ে বিছানো বিছানায় বসতে গেলে, কন্যা বললেন, আব্বা একটু অপেক্ষা করুন, বলে তিনি বিছানার উপরিভাগ গুটিয়েদিয়ে বাপকে বসতে বললেন। পিতার প্রশ্ন, ঐ বিছানাটা কি আমার উপযুক্ত ছিলনা, নাকি আমি ঐ বিছানার উপযুক্ত ছিলামনা? কন্যার উত্তর, ওটা নবীর বিছানা, আপনি মুশরীক নাপাক, আপনি ওতে বসার উপযুক্ত নন৷ রসুল সঃ ইতি মধ্যে জেনে গিয়ে ছিলেন যে, মুশরীকরা মুমিনদের বিরুদ্ধে আর অস্ত্র ধরার ক্ষমতা রাখেনা। আলোচ্য রুকুর আয়াতগুলি নাজিল হয় এমন অবস্থার প্রেক্ষা পটে৷
৭/كَيْفَ يَكُونُ لِلْمُشْرِكِينَ عَهْدٌ عِندَ اللّهِ وَعِندَ رَسُولِهِ إِلاَّ الَّذِينَ عَاهَدتُّمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ فَمَا اسْتَقَامُواْ لَكُمْ فَاسْتَقِيمُواْ لَهُمْ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ
অর্থাৎ;-কেমন করে আল্লাহ ও তার রসুলের চুক্তি মুশরীকদের সাথে বলবৎ থাকবে, যাদের সাথে মসজিদুল হারামের কাছে চুক্তি সম্পাদন করেছ৷ অতএব তারা যে পর্যন্ত তোমাদের সাথে সরল থাকে তোমরাও তাদের সাথে সরল ভাবে থাকবে৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভাল বাসেন৷
৮/كَيْفَ وَإِن يَظْهَرُوا عَلَيْكُمْ لاَ يَرْقُبُواْ فِيكُمْ إِلاًّ وَلاَ ذِمَّةً يُرْضُونَكُم بِأَفْوَاهِهِمْ وَتَأْبَى قُلُوبُهُمْ وَأَكْثَرُهُمْ فَاسِقُونَ
অর্থাৎ;-কেমন করে কার্যকর থাকবে, যদি তারা তোমাদের উপর প্রাধান্য লাভ করে, তবে তারা তোমাদের আত্মীয়তার মর্যাদাও দেবেনা এবং অঙ্গীকারেরওনা৷ তারা কেবল মৌখীক কথায় তোমাদের সন্তুষ্টই রাখে কিন্তু তাদের অন্তর তা স্বীকার করেনা৷ আসলে তাদের অধিকাংশই ফাসেক৷
৯/اشْتَرَوْاْ بِآيَاتِ اللّهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَصَدُّواْ عَن سَبِيلِهِ إِنَّهُمْ سَاء مَا كَانُواْ يَعْمَلُونَ
অর্থাৎ;-তারা আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে নিতান্ত নগন্য মূল্য গ্রহন করে এবং লোকদের তার পথ থেকে নিবৃত্ত করে৷ তারা যা করে তা অবশ্যই অতি নিকৃষ্ট৷
মক্কা বিজয় অভিযানে উৎসাহ দানে এক পর্যায়ে মুমিনদের মক্কায় অবস্থান কালে তাদের সাথে মুশরীকদের ব্যবহার, বাইতুল্লার পথে বাধা দিয়ে তারা নিজেদের নিকৃষ্টই প্রমান করেছে, এ কথা মনে করিয়ে দিলেন৷
১০/لاَ يَرْقُبُونَ فِي مُؤْمِنٍ إِلاًّ وَلاَ ذِمَّةً وَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْمُعْتَدُونَ
অর্থাৎ;-তারা মর্যাদা দেয়না মুসলীমদের ক্ষেত্রে আত্মীয়তার আর না অঙ্গীকারের৷ আর তারাই সীমা লঙ্ঘনকারী।
১১/فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ الصَّلاَةَ وَآتَوُاْ الزَّكَاةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّينِ وَنُفَصِّلُ الآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
অর্থাৎ;-তার পরও যদি তারা তওবা করে, নামাজ কায়েম করে, আর জাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই৷ আর আমি আয়াত সমুহ বর্ণনা করে থাকি জ্ঞানী লোকদের জন্য৷
১২/وَإِن نَّكَثُواْ أَيْمَانَهُم مِّن بَعْدِ عَهْدِهِمْ وَطَعَنُواْ فِي دِينِكُمْ فَقَاتِلُواْ أَئِمَّةَ الْكُفْرِ إِنَّهُمْ لاَ أَيْمَانَ لَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَنتَهُونَ
অর্থাৎ;-আর যদি তারা চুক্তির পর অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং তোমাদের দ্বীন সন্মন্ধে বিদ্রুপ করে, তবে তোমরা কাফেরদের ইমামের সাথে যুদ্ধ করবে। কেননা তাদের কোন অঙ্গীকারই বহাল নেই, যাতে তারা ফিরে আসবে।
“আইম্মাতুল কুফর” অর্থাৎ কাফেরদের ইমাম বা নেতা৷ তৎকালীন সময়ে মক্কা বা আস পাশের এলাকা গুলো কোন রাজা বা শাসকের অধীনে ছিলনা। মক্কা ছিল ব্যবসার কেন্দ্র৷ প্রতি বৎসর বহু লোক ক্বাবায় হজ্জ্বর মৌসুমে জমায়েত হত, তাদের পানির ব্যবস্থা থাকার সুযোগ ছাড়াও ক্বাবা ঘরের রক্ষণা বেক্ষণের সব দায়ীত্বই ছিল কোরাইশদের উপর৷ তাদেরই আইন কানুন সেখানে কার্য্যকরি হত৷ অতএব ওরাই ছিল ইমাম বা নেতা৷ এবং শির্কের সুত্রপাতও এদের দ্বারাই হত৷ তারাতো চুক্তি ভঙ্গ করেই বসে আছে। তাই প্রয়োজনে তাদের সাথেই আগে যুদ্ধ করতে হবে।
১৩/أَلاَ تُقَاتِلُونَ قَوْمًا نَّكَثُواْ أَيْمَانَهُمْ وَهَمُّواْ بِإِخْرَاجِ الرَّسُولِ وَهُم بَدَؤُوكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ أَتَخْشَوْنَهُمْ فَاللّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَوْهُ إِن كُنتُم مُّؤُمِنِينَ
অর্থাৎ;-তোমরাকি এমন লোকদের সাথে যুদ্ধ করবে না, যারা নিজেদের শপথ ভঙ্গ করেছে এবং রসুলকে বহিষ্কারের সংকল্প করেছে৷ আর এরাই প্রথম তোমাদের সাথে বিবাদের সূচনা করেছে৷ তোমরাকি তাদের ভয় কর? অথচ তোমাদের ভয়ের অধিকতর যোগ্য হলেন আল্লাহ, যদি তোমরা মুমিন হও৷
যারা নিজেদের মুমিন বলে দাবী করে, তাদের আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে এমন হওয়া উচিৎ নয়৷ বার তের বৎসর যারা তোমাদের নির্যাতন করেছে, তোমাদের ভাইদের শহীদ করেছে, তোমাদের মাতৃভূমী, আত্মীয় স্বজনের মায়া ত্যাগ করে ভীনদেশে হিজরত করতে বাধ্য করেছে, তারাই প্রথম বিবাদের সূচনা করেছে, নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, তারাই আজ তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে আরও বেশী অপরাধী হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে লড়তে আজ কেন তোমাদের মনে সংশয়, তবেকি তোমরা তাদের ভয় কর? এ আয়াতে আল্লাহ মুমিনদের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন৷
১৪/قَاتِلُوهُمْ يُعَذِّبْهُمُ اللّهُ بِأَيْدِيكُمْ وَيُخْزِهِمْ وَيَنصُرْكُمْ عَلَيْهِمْ وَيَشْفِ صُدُورَ قَوْمٍ مُّؤْمِنِينَ
অর্থাৎ;-যুদ্ধ কর ওদের সাথে৷ আল্লাহ তোমাদের দ্বারা তাদেরকে শাস্তি দেবেন, তাদের লাঞ্ছিত করবেন, এবং তাদের উপরে তোমাদের বিজয়ী করবেন৷ আর মুসলীমদের অন্তরকে শান্ত করবেন৷
তখনও কিছু নও মুসলীম মক্কায় মুশরীকদের লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করেও বাস করছিল৷ কারণ তারা ছিল বৃদ্ধ ও মহীলা৷ এ আয়াতে মুসলীমদের বিজয়ের আগাম সংবাদ দিলেন আর তার মাধ্যমে মুশরীকদের শাস্তি, লাঞ্ছনা গঞ্জনা দিয়ে ঐ লাঞ্ছিত মুসলীমদের অন্তরে শান্তি দিতে চান৷
১৫/وَيُذْهِبْ غَيْظَ قُلُوبِهِمْ وَيَتُوبُ اللّهُ عَلَى مَن يَشَاء وَاللّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
অর্থাৎ;-এবং তাদের অন্তরের ক্ষোভকে আল্লাহ দূর করে দেবেন, আর আল্লাহ যার প্রতি ইচ্ছা ক্ষমাশীল হবেন৷ আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
১৬/أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تُتْرَكُواْ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللّهُ الَّذِينَ جَاهَدُواْ مِنكُمْ وَلَمْ يَتَّخِذُواْ مِن دُونِ اللّهِ وَلاَ رَسُولِهِ وَلاَ الْمُؤْمِنِينَ وَلِيجَةً وَاللّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
অর্থাৎ;- তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদের এমনই ছেড়ে দেওয়া হবে, যতক্ষন না আল্লাহ জেনে নেবেন, তোমাদের কে জেহাদ করেছে, কে আল্লাহ ও তার রসুল ও মুসলীমদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধু রূপে গ্রহন করা থেকে বিরত থেকেছে৷ আর তোমরা যা কর সেবিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবগত৷
এটি তৃতীয় বার, এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনদের কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিলেন৷ ইমান এনেছি বললেই বেহেশ্ত হবেনা, ছাড় দেওয়াও হবেনা৷ সুরা বাক্বারার ২১৪ নং আয়াত, সুরা আলে ইমরাণের ১৪২ নং আয়াত আর এ সুরার ১৬ নং আয়াতে, প্রায় একই কথা বলেছেন, শুধু মুমিন হলেই হবেনা, তারজন্য পরীক্ষায় পাশও হতে হবে৷ কে কতটুকু ধৈর্য্য ধরতে পেরেছ, কে আল্লাহর জন্য জিহাদ করেছ, কোথাও বলেছেন, তোমরা তো এখনও তাদের মত বিপদে পড়নি, যারা অসহ্য হয়ে বলে ছিল, “মাতা নাসরুল্লাহ”, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? তিনটি আয়াতেরই অংকগুলির যোগফল ৭৷ রহস্য ভরা কোআনের এটিও একটি রহস্য৷
বিষয়: বিবিধ
১২৮৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন