ক্বোরবাণী

লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২৪ আগস্ট, ২০১৮, ০৯:৩২:৩৩ রাত

ক্বোরবাণী

মুসলীম উম্মার পিতা হজরত ইব্রাহীম আঃ। তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, আল্লাহ তাকে তার প্রীয় জিনিষ আল্লাহর নামে ক্বোরবাণী দিতে বলছেন। তিনি তাঁর পছন্দের উট দুম্বা প্রভৃতি এক এক করে ক্বোরবাণী দিয়ে চলেছেন, কিন্ত ইব্রাহীম আঃ এর সে ক্বোরবাণী আল্লাহর প্রীয়ের তালিকায় পড়ছে না। অবশেষে সাতাশী বৎসর বয়সে পাওয়া আজ ১৩ বৎসরের ইসমাঈলকে ক্বোরবাণী করার আদেশ হয়েছে। তথাস্তু, কিন্তু মন মানেনা। সাহস পেলেন যখন বালক ইসমাঈল আঃ বিষয়টি শুনে বললেন, ‘আব্বাজান, আপনাকে যা করতে বলা হয়েছে তা করে ফেলুন, আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন’। তিনি নিজের চোখ বেঁধে ধারালো ছুরি গলায় চালালেন, চোখের পর্দা সরিয়ে দেখলেন যে জবাই হয়েছে দুম্বা আর ইসমাঈল পাশে দাঁড়ানো।

ক্বোরবাণীর হুকুম এখান থেকে শুরু বলা হলেও সৃষ্টির আদীতে হজরত আদম আঃ এর দুই পুত্র ক্বোরবাণী দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। আজকের এ ক্বোরবাণীতে আল্লাহ চাইলেন তার আদেশের বাস্তবায়ন আর নবী প্রমান দিলেন তাঁর প্রকৃত মুসলীম হওয়ার। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের পশুর রক্ত বা গোশ্ত আমার কোনটাই কাম্য নয়, আমার কাম্য তোমাদের তাকওয়া’ আর মুসলীম হল ‘রাজি বা রেজায়ে রব’। মালিকের সন্তুষ্টিই গোলামের সন্তোষ। আর মালিক তখনই সন্তুষ্ট হবেন যখন তার দেওয়া আদেশ নিষেধ, দুঃখ জ্বরা, লাভ লোকসান, শান্তি সমস্তই দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করা হবে। ইব্রাহীম আঃ তাই করলেন।

বিশ্ব ব্যাপী মুসলীম উম্মার মাঝে আজও ঈদুল আজহার লগ্নে ক্বোরবাণী হয়ে থাকে তা আর সন্তান নয় পশু। যার মূল উদ্দেশ্য হল তাকওয়া অর্জন। এই তাকওয়া অর্জনের মাধ্যম হল নেকীর কাজ। সেই নেকীর কজগুলির পিছনে আল্লাহ ও তার রসুল কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। আল্লাহ কোরাআনের সুরা আলে ইমরাণের ৯২ নং আয়াতে বলেছেন,”লান তানালুল বির্রা হাত্তা তুনফিকু মিম্মা তুহিব্বুন”। ঘোষণাটি মূলতঃ অর্থ-সম্পদ আল্লাহর নির্দেশিত খাতে যা খরচ করা হয় তার জন্য। আয়াতের সাধারণ অর্থ হল, তোমরা কস্মিন কালেও নেকী পাবে না যতক্ষন না মহব্বতের জিনিষ খরচ করবে। আমার ধারণা ক্বোরবাণীর সাথেও অর্থ খরচ জড়িত,যদিও তা পশুর অবয়বে হয়ে থাকে। তাই মহব্বতের শর্ত এখানে থাকবে। আর রসুল সঃ বলেছেন, “মান সাল্লা ইয়ুরায়ী ফা-কাদ আশরাকা, অ মান সামা ইয়ুরায়ী ফা কাদ আশরাকা, অমান তাসাদ্দাকা ইয়ুরায়ী ফা কাদ আশরাকা”। যে লোক দেখানো নামাজ পড়লো সে শির্ক করেই ফেলেছে, যে লোক দেখানো রোজা রাখলো সে শির্ক রেই ফেলেছে, যে লোক দেখানো সদকা (দান-খয়রাত) করল সে শির্ক করেই ফেলেছে। অতএব মনে রাখতে হবে যে কোন ইবাদত বা নেকীর কাজে বিন্দুমাত্র অন্যকে দেখানোর নিয়ত থেকে থাকলে তা আর নেকীর কাজ থাকছে না বরং তার উল্টোটা গোনাহের কাজ হয়ে যাচ্ছে। আর যেখানে নেকীই নেই সেখানে তাকওয়া হবে কেমন করে?

আমার দেখা ক্বোরবাণী;-জীবনে ক্বোরবাণী করেছি মাত্র কয়েক বার কিন্তু দেখেছি অনেক, তারই কিছু অভিজ্ঞতা জানাতে চেষ্টা করব। যাযাবরি জীবনে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলার এক মুসলীম প্রধান গ্রামে। আমাদের পাড়ায় কমবেশী একশো ঘরের বাস। প্রতিবৎসর অন্ততঃ ১৮-২০টি গরু, যার প্রায় প্রতিটাই নিজের গোয়ালের। সারা পাড়ায় দুইটি স্পট কোরবাণীর জন্য নির্ধারিত ছিল। আর খাসী যে যার পছন্দের যায়গায় দিত। কোন কসাই আমদানী হত না, গ্রামের উৎসাহী জনেরাই সব করত। বড় গর্ত করে ওখানেই সব বর্জ পুঁতে দেওয়া হত। গরু জবাইয়ের আলাদা আলাদা করে গোশ্ত তৈরী হত। প্রতিটা তিন ভাগ করে দু ভাগ ক্বরবাণী দাতা বাড়ি নিত আর তৃতীয় ভাগ সবার এক যায়গায় মিশিয়ে গ্রামের সব গরীব মানুষের বাড়ি সমান ভাগে পৌঁছে দেওয়া হত। সেখানে বহিরাগত কোন ভিক্ষুকের আনাগোনা ছিলনা। আশপাশের প্রায় প্রতি গ্রামেই এ ব্যবস্থা ছিল। বাকী দুইভাগের থেকে প্রতিবেশী ও কাছে দূরের আত্মীয় পরিজনদের পাঠানো হত। কোন গরীবকেই ক্বোরবাণীর গোশ্তের জন্য কারও দরজায় হাত পাততে হত না, ঘরে বসেই তার প্রাপ্য বুঝে পেত। এটা তাদের হক বলেই তারা জানত। আর শিশু কিশোররাও এ ব্যবস্থায় অভ্যস্থ হয়ে উঠত। তিন ভাগের আগে কেউ কোন গোশ্ত বাড়ি নিত না। তবে যারা কাটাকাটি ও বিতরণের দায়িত্বে থাকত তাদের মজুরী ক্বোরবাণী দাতার নিজ অংশ থেকে দেওয়া হত। এ ভাবেই ক্বোরবাণীর তিন ভাগের বিষয়টা অন্তরে গেঁথে যায়। তা ছাড়া ওয়াজ মাহফিল, মশয়ালার কিতাবেও তার সমর্থন দেখেছি। আল্লাহর পথে খরচের প্রায় সবটাতেই অভাবীদের অংশ রয়েছে, ক্বরবাণীতেও থাকবেনা তা কেমন করে হয়।

ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হলাম যখন বাস্তুহারা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের খুলনার সেনহাটী গ্রামে এলাম। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে বাস করে। আচার আচরণেও ভিন্নতা। ফলে মতেও ভিন্নতা। প্রতিবেশী পাড়াতুত দাদা প্রতিবৎসরই গোয়ালের গরু ক্বোরবাণী দেন। জবাই হবার পরই কলিজা গুর্দা সহ কিছু গোশ্ত বিনিময়ের আশ্বাসে আগে রান্নার জন্য অন্দর মহলে চলে যায়। আর আমার প্রতিবাদ শুরু হয়। কয়েক বছরে আমার বাধায় কাজ হয়। এখানে যে যার মত ক্বোরবাণী করে। ভাগ তিনটি হয় তবে সঠিক বাস্তবায়ন হয় কিনা বলতে পারব না। তবে ক্রমে ক্রমে সঠিক হয়েছে বলেই ধারণা করি।

এর পর যখন নিজেরা ভাগে ক্বোরবাণী দেবার জন্য অন্যের সাথে হাটে গরু কিনতে হাটে গেলাম, সেখানেও বিরূপ অভিজ্ঞতা হল। গরুর দামের সাথে অনেকেই গোশ্তের পরিমান হিসেব করেন। নিয়ম পছন্দ হয়না। তাই ঠিক করলাম ভাগে আর নয়। সম্ভব হলে নিজেরা দুভাইয়ে দিই, নইলে নয়।

প্রবাসে থাকি। এখানে ক্বোরবাণীর ধরণ আরও আলাদা। গ্রোসারীর মালিক গন গরু খাসী দেখানো ও কেনার আগেই নির্দিষ্ট পরিমান টাকি জমা নেন। (শহরের ভিতর জ্যন্ত পশু যেমন বিক্রী হয়না তেমনই জবাইও করা যায়না। শহরের বাইরে দূরে ফার্মে গিয়ে কিনে জবাই করিয়ে বা করে আনা যায়।) ও ক্বোরবাণীর পরের দিন ওয়াদা মত গোশ্ত দিয়ে দেন। ক্বোরবাণী দাতা গরু বা খাসীর রংটিও দেখেন না। হয়ত তাদের ধারণা গোশ্ত তো কিনেই খেতাম, এখানে বোনাস হিসেবে নেকীটা পাওয়া গেল। আর একটি ধরণ হল- সমমনা সাতজন মিলে ফার্মে গিয়ে গরু পছন্দ করে, নিজেরা নিয়েত করে জবাই করে, ফার্মের লোকদ্বারা কেটে ছোট ছোট পিস করে বাড়ি আনেন। পুনরায় নিজেরা কেটে বেছে ভাগ করে বাড়ি নিয়ে যান।

শেষ অভিজ্ঞতাটি এমনই এক গ্রুপের সাহায্যকারি হিসেবে থেকে পেলাম। যথারীতি সাত জনের গোশ্ত আনা হল। ভাগের আগেই রান্নার জন্য নিতে চাইলে আমি আপত্তি করলাম। উত্তর হল, আমরা সাতজনই আছি, কাউকে ফাঁকি দিচ্ছিনা। বললাম, প্রত্যেকের ভাগওতো তিন ভাগ হবে, যার এক ভাগ গরীবদের, তাদের তো ঠকানো হল। উত্তর হল এখানে তেমন গরীব পাব কোথায়? তাছাড়া গরীবদের গোশ্ত দেওয়া মুস্তহাব, না দিলে দোষের কিছু নেই। সারা জীবনের লালিত সংষ্কারে ধাক্কা খেলাম। আমি আলেম, মুফতি নই তাই মুস্তাহাবেই থেমে গেলাম।

সমিকরণটি মিলিয়ে নেকীটুকু বার করার চেষ্টা করে দেখা যাক। হাট থেকে একদিন বা দুচারদিন আগে গরু কিনে আনা হল। কিছু যত্নও করা হল। আবার কেউ মিডিয়ার প্রচারের সর্বোচ্চ দামের পশুটাই কিনে আনলো বা গরুকিনে সুন্দর মালা পরিয়ে মহল্লা প্রদক্ষিন করালো, জবাই হল সঠিক ভাগ হলনা। বা গরীবরা কোন উপকার পেল না বা তাদের তাচ্ছিল্য করে কিছু দেওয়া হল। বা সাতজনে গরু পছন্দ করে ঈদুল আজহার দিনে দুরাকাত ইদুল আজহার নামাজ পড়ে গিয়ে জবাই করে সমান ভাগ করে প্রতিবেশী, আত্মীয়দের কিছু দিয়ে ফ্রীজজাত করা হল। দান খয়রাতের আগে আল্লাহর দেওয়া শর্তের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে, তিনি বলেছেন, ‘লান তানালুল বির্রা হাত্তা তুনফিকু মিম্মা তুহিব্বুন’-কস্মিন কালেও নেকী পাবে না যদি প্রীয় বস্তুটি না খরচ কর বা দাও। উপরোক্ত ধরণের ক্বোরবাণীর পশু গুলির উপর কার কতটা মুহব্বত জন্মেছিল জানিনা। এর পর আসি রসুল সঃ কথায়। তিনি বলেছেন, ‘মান তাসাদ্দাকা ইয়ুরায়ী ফা কাদ আশরাকা’। যিনি দেখাবার জন্য দান খয়রাত করলেল, তিনি শির্ক করেই ফেলেছেন।

কোন আলেম মুফতি বা অভিজ্ঞ বব্যক্তি সমীকরণটি মেলাতে পারলে মেহেরবাণী করে মিলিয়ে দেবেন। হয়ত কেউ বলবেন যে টাকার উপরতো মুহব্বত ছিলই পশুতে না থাক। আমি বলব যে ক্বোরবাণীটা টাকার নয় পশুর আর এটিও সদকার মধ্যেই পড়ে।

বিষয়: বিবিধ

৯৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File