%%% শৈশবের রমজান ও ঈদ %%%

লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২১ জুন, ২০১৬, ০৮:২৫:৪৪ রাত



ঠিক কবে থেকে প্রথম রোজা রাখা শুরু করেছি তা সঠিক করে বলতে পারব না। তবে এতটা অবশ্যই বলতে পারব যে তখনও রোজা রাখার উপযুক্ত কোন ভাবেই হয়ে উঠিনি, না বয়সে আর না শরীরে। ছোট বেলা থেকেই আমি ছিলাম খুবই রোগা পাতলা, যাকে বলে তাল পাতার সেপাই। তাই রোজা রাখার উৎসাহ দেখালেই শুনতে হত,’কোথায় দম আঁটকে পড়ে থাকবি খুঁজেও পাওয়া যাবেনা’। অনেকের মত আমিও দমে যাবার পাত্র নই। তাই চলত জিদ। অমুকে রোজা রাখে তমুকে রাখে আমিও রাখব। অনুমতি আসেনা। আবদার যা তার সবটাই মায়ের কাছে। কেননা আব্বা ছিল রুক্ষ্ম মেজাজের রাগি মানুষ। তার সাথে আমরা সবাই বেশ দুরত্ব রেখেই চলতাম। আব্বা কোনদিনও আমাদের বন্ধু ছিলনা। আর তা ছিল আমাদের জন্য সৎ পথে চলার সহায়ক। এমনই ভাবে জিদ ভিতরে জমা হতে থাকে। এমন অনেকদিন গেছে ভোরে আমাকে না ডেকে সবাই সেহরী খেয়ে রোজা রেখেছে আর আমি কিছু না খেয়েই রোজা রেখেছি। হাজার ভাংতে বললেও ভাঙ্গিনি। দিনটি সম্ভবতঃ তখন ছিল শীতের পরে তবে তেমন গরমের নয়। কাহিল হয়েছি, হাতপা অচল প্রায় তবুও রোজা ছাড়া যাবেনা। এ পরীক্ষায় পাশ করতেই হবে। পাশ করেছি। তখন থেকেই মাঝে সাজে দু একটা রোজা রাখার অনুমতি হয়েছে। বয়সটা তখন আসলেও ছিল অনেক কম।

সারা রোজার মাস মসজিদে ইফতার দেওয়া হত। গ্রামের সবাই সবাইকে চেনে। বহিরাগত মুসাফির তেমন কেউ থাকত না। আমার আব্বা কোনদিন মসজিদে ইফতার করতে যেত না। বলত সারাদিন রোজা রেখে অন্যের খাবারে ইফতার করব না। অগত্যা আমরা দু ভাই মসজিদে গিয়ে আব্বার ইফতার বাড়ি নিয়ে আসতাম। ইফতার এখনের মত এত সৌখিন ছিলনা বটে তবে তাই ছিল আমাদের জন্য তাবারক সম।

আমরা ছিলাম পাড়ার শেষ প্রান্তে। মসজিদের মাইক বিহীন আজান আমাদের বাড়ি পৌঁছত না। পাড়ায় মাত্র দুটি দেয়াল ঘড়ি ছিল। একটি মসজিদে আর অন্যটি আঃ রব ভাইয়ের দালানের ভিতর যা উঠানে দাঁড়ালে দেখা যেত। মেঘলা দিনে স্কুলে যাবার সময় দেখতে যেতাম। ইফতারের জন্য আজানের উপর নির্ভর করতে হত। আমরা ছোটরা অনেকে দল বেঁধে মসজিদের মিম্বর দেখা যায় এমন দুরত্বে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পজিশন থাকত যেন লম্বা দৌড়ের বাঁশির জন্যঅপেক্ষা। ইমাম চাচা মিম্বরে উঠে কানে হাত দিলেই আমাদের দৌড় শুরুহত বাড়ির দিকে। মুখে থাকত পাড়া মাতানো শব্দ,’ আজান হয়ে গেছে’। রীতিমত প্রতিযোগীতা চলত কে কার আগে যাবে। পড়ে হাত-পা ছড়ে গেলেও ভ্রুক্ষেপ নেই, আজানের খবর আগে পৌঁছতে হবে। রাতে খতম তারাবীতে যেতেই হবে। ছিলনা কোন ক্লান্তি ছিলনা কোন অবসাদ। বৎসরের এ মাসটা যেন সবার জন্যই ছিল মহা আনন্দের। চাষে যতটুকু ধানই হোক মা তা থেকে চিঁড়ে আর মুড়ির জন্য ধান আলাদা করে রেখে দিত রোজার মাসের জন্য। দক্ষীন পাড়ার এক গরীব চাচা সারা গ্রামে নায়াত গজল গেয়ে সেহরীর জন্য মানুষকে জাগিয়ে বেড়াত। ঈদের দিন বিকালে ঝোলা কাঁধে তার পারিশ্রমিকের জন্য বাড়ি বাড়ি হেঁটে বেড়াত। ধনী গরীব সবাই সধ্যমত তাকে বিনিময় দিত। এ সবের মাঝেই একদিন সারা রমজানের রোজা রাখার উপযুক্ত বিবেচিত হয়ে থাকব।

সামনে থাকত মহান ঈদুল ফিতর। এখনের মত তখন নতুন জামা জুতার এত প্রতিযোগীতা ছিল না। অবস্থাপন্ন লোকেরা তাদের ছেলে মেয়েদের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনতো। বাকীরা তোলা পানজাবী পায়জামা, ফ্রক কামিজ সালোার দিয়ে চালিয়ে নিত। কাউকে দুঃখ বা হা-হুতোস করতে দেখিনি। ঈদের নামাজের পর সারা পাড়ার চাচী খালা মামী ফুফু দাদী নানীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সালাম করে আসতেই হত। সালাম ছিল কিন্তু ছিলনা সালামী। আব্বার দেওয়া দু চার আনাই ছিল আমাদের কাছে সাত রাজার ধন। আমার নানার একমাত্র সন্তান আমার মা। নানা শহরে (চন্দন নগরে) থাকত। ঠিক চাঁদ রাতের বিকালে রিকসা ভরে তার প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাথে ঈদের যাবতীয় জিনিষ নিয়ে হাজির হত। তাতে তার স্টোভ ছোট ছোট রান্নার ঝকঝকে পরিষ্কার হাঁড়ি পাতিল গ্লাস, চায়ের সরঞ্জাম, ভিনেগার, কেচাপ,কণ্ডেন্সেড মিল্ক, বিস্কুট প্রভৃতি। সাথে সেমাই সুজি চিনি মায় গরম মশলা, পাউডার দুধ।পাকা রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ছিল বালী ভর্তী কাঁচা রাস্তা। রিক্সা ঠেলে বাড়ির কাছে নেওয়ার জন্য আমরা দু ভাই পাকা রাস্তায় গিয়ে বসে থাকতাম। সেই লট বহরের ভিতর কারও কারও জামা জুতাও থাকত।

এ সবের মাঝেই ক্রমে ক্রমে সারা মাসের রোজা রাখার অভ্যাস গড়ে ওঠে। এ সময়তো আমি হয়েগেছিলাম মাদ্রাসার তালেবে ইলম। তবে চুপি চুপি বলি প্রথম প্রথম প্রায়ই প্রথম রোজায় ভুলে এটা সেটা খেয়ে ফেলতাম। সারাদিন মৌসমের ফল যেমন খেজুর আম, জাম, আতা, বৈঁচি এসব যোগাড় করতাম ইফতারের পর খাবার জন্যে। আজ সবের মাঝেই এসেছে বাহুল্য কিন্তু আসেনা সে দিনের সেই নির্মল আনন্দ। আজ আমিও নানা। তবে আমার সেই পরহেজগার নানার মত হতে পারিনি।

বিষয়: বিবিধ

১২৯৯ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

372768
২১ জুন ২০১৬ রাত ০৮:৫৬
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার স্মৃতির পাতায় একটি অতিত যুগের কাহিনি জানলাম। অনেক ধন্যবাদ। কেন রমজান ও ঈদ আমাদের মধ্যে হয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক সেটাই ভাবি।
২১ জুন ২০১৬ রাত ০৯:১১
309500
শেখের পোলা লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মানুষ এখন চালাক হচ্ছে তাই ঠকছেও।
372772
২১ জুন ২০১৬ রাত ১০:০৪
দ্য স্লেভ লিখেছেন : অসাধারন অসাধারন। যদিও আপনার সময় অনেক আগের কিন্তু আমার ছোটবেলায়ও রোজার মাসে যেউৎসব আনন্দমুখর পরিবেশ পেয়েছি তা ভোলার নয়। নির্মল আনন্দ ছিলো ঈদে। নতুন জামা কাপুড় মানুস না পেলেও আনন্দে ঘাটাত দেখিনি। আর উপহার পেলে অনেক আনন্দ হত
২২ জুন ২০১৬ রাত ১২:৫৫
309522
শেখের পোলা লিখেছেন : আজ থেকে কম করে হলেও ৫৫ বছর আগের ঘঠনা। আমা অত চালাক ছিলামনা। লোভীতো নয়ই। যা পেতাম তাতেই ছিল ভরপুর আনন্দ। শবে বরাতে নানা শহর থেকে আমাদের উপযোগী বাজী পটাকা কিনে আনতো। পাড়ার ছেলে মেয়েরা মিলে ফোটাতাম। এখন আধুনিক জামানায় অনেক আধুনিক সরঞ্জাম আছে কিন্তু নেই সেদিনের মত নির্মল আনন্দ। ধন্যবাদ।
372778
২১ জুন ২০১৬ রাত ১০:৩৩
আবু জান্নাত লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আসলে আপনার ছোট বেলাতে আমি খুজে পাই অনেক রহস্যে ঘেরা অনুভুতি।

সময় পেলে আমাদের এলাকার বৃদ্ধদের পাশে বসেও অনেক অতীত শুনি। আমার তখন মনে হয়, ইস! সেই দিনগুলো যদি আমরা দেখতাম!

অনেক অনেক ধন্যবাদ

২২ জুন ২০১৬ রাত ১২:৫৮
309523
শেখের পোলা লিখেছেন : সে কাল আর একালের মাঝে অনেক পার্থক্য। দুটির মাঝে অনেক আফসোস। এখন অনেক কিছুই আছে অনেক উন্নতও হয়েছে। কিন্তু হারিয়েগেছে আগের সেই সরলতা। ধন্যবাদ চাচাজান।৷
372780
২১ জুন ২০১৬ রাত ১০:৪৪
আফরা লিখেছেন : নির্মল আলো নেই ,নির্মল বাতাস নেই, নেই নির্মল খাটি মানুষ তাহলে নির্মল আনন্দ থাকবে কি করে চাচাজান ।

খহুব ভাল লাগল আপনার ছোট বেলার ঈদ-রোজার কাহীনি । অনেক ধন্যবাদ চাচাজান ।
২২ জুন ২০১৬ রাত ১২:৫৯
309524
শেখের পোলা লিখেছেন : তোমার জন্যও রইল অনেক অনেক শুভ কামনা।।
372787
২১ জুন ২০১৬ রাত ১১:২৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়া।

এক টানে পড়ে ফেললাম। আপনার সেই ভীষণ আনন্দের আর মজার ছোটবেলার অসাধারণ রমযান আর ঈদের কাহিনী। অনেক কিছুই জানা হল। সেই মধুর দিনগুলোর কথা কি নানা হয়ে গেলেই ভোলা যায় নাকি সম্ভব?!

চমৎকার উপস্থাপনা মাশাআল্লাহ।
২২ জুন ২০১৬ রাত ০১:০৩
309525
শেখের পোলা লিখেছেন : অআলায়কুমুস সালাম অরহমাতুল্লাহে অবরকাতুহু। সাদামাঠা জীবনের ততোধিক সাদামাঠা কাহিনী আপনাদের ভাল লাগায় ধন্য হলাম। অবশ্য আপনি আমার সব লেখাতেই ভাল অনুভুতী রেখেযান।ধন্যবাদ।
373065
২৫ জুন ২০১৬ সকাল ১০:৪৩
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : সুন্দর স্মৃতিময় জৌলুসহীন কিন্তু তৃপ্তিময় ও আনন্দদায়ক শৈশব রামাদানের স্মৃতি রোমন্থনের জন্য জাযাকাল্লাহ খাইরান। আমাদের শৈশবের ঈদ রামাদান ও অনেক সাদামাটা কিন্তু বেশ আনন্দদায়ক ও উৎসবমুখর ছিল।
২৫ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪০
309755
শেখের পোলা লিখেছেন : : জৌলুশ বাড়ছে আর আনন্দ কমছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
373108
২৫ জুন ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪০
শেখের পোলা লিখেছেন : জৌলুশ বাড়ছে আর আনন্দ কমছে। ধন্যবাদ আপনাকে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File