&&&&&&/ জীবনেতিহাসের ছেঁড়া পাতা--৫/&&&&&&

লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২৮ মে, ২০১৬, ০৭:২৬:০৩ সকাল

১৯৬২ সালে ভারতের সাথে চীনের যুদ্ধ হয়। তাতে ভারতের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়, অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে পড়ে। খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। রেশন কার্ডের প্রচলন বেড়ে যায়। ঐ বয়সে এত কিছু বোঝার নয় তবে দেখেছি শহরের মনুষ রেশন কার্ড নির্ভর হয়ে পড়ে। গ্রামে এর কোন ছায়া পড়েনি বললেই চলে। গ্রাম থেকে বে সরকারী ভাবে চাল শহরে আসায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়৷ রেশনে যে চাল আটা দেওয়া হত তাতেই শহরবাসীকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ছুটিতে বাড়ি এসে দাদী বাড়ি (আমার আব্বার ভিটা, সেখানে তখন আমার দাদীরা বাস করত) বেড়াতে গিয়ে দেখেছি। আমার সম বয়সী চাচাতো ভাই আর আমি পাশের গ্রামের থেকে রাতের অন্ধকারে বাড়তি চাল কিনে আনতাম। এ অবস্থায় সরকার চাষের উপর মনযোগ দিতে বাধ্য হল। স্যালো টিউবওয়েল বসিয়ে অনাবাদী ও অলস জমীতে ইরিধান ফলাবার উদ্যোগ নিল। অনেকের কর্মসংস্থান ও খাদ্য ঘাটতি সহজেই মিটে গেল বটে তবে, ‘লাঙ্গল যার জমী তার’ ঘোষণায় বর্গাচাষীদের বিপদ দেখা দিল। যারা এতদিন জমীতে যেত না, তারা নিজেরা হাল গরু কিনে লোক রেখে চাষ নিজের তত্বাবধানে নিয়ে নিল। অন্যথায় জমী বর্গাচাষীর হয়ে যাবার ভয় ছিল। আমাদের চাষ বন্ধ হল তবে একমাত্র বড় ভাইয়ের ইনকামে আমাদের চলতে হত।

ছুটিতে বাড়ি এসেছি, বড় ভাইয়ের কয়েকজন বন্ধু ধরে বসল যে, তাদের কলকাতা ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। আগেই বলেছি শুধুমাত্র যাদের দোকান ছিল তারাই ব্যবসার খাতিরে কলকাতা যেত। অথচ বেশী দূরের পথ বা বিরাট খরচের ব্যাপারও ছিলনা। রাজী হলাম। ছুটি শেষ হবার একদিন আগেই তিনজনকে সাথে নিয়ে গেলাম। সারাদিনে যতখানি দেখানো যায় দেখিয়ে সন্ধ্যা বেলা হাওড়া শ্টেশনে ট্রেনে তুলে তাদের বিদায় দিলাম। সে দিনের একটা অভিজ্ঞতা আজও মনে আছে। কলকাতায় ট্রাম চলে। যারা কলকাতা গেছেন তাদের ট্রাম সম্পর্কে জানা আছে। আর যারা ইউরোপ আমেরিকা গেছেন বা থাকেন তাদের কথা আলাদা। কলকাতার ট্রাম স্টাণ্ডে থামেনা বললেই চলে। সামান্য স্লো হয়েই পুনরায় চলা শুরু করে। তারই মাঝে উঠা নামা করতে হয়, তবে খুব একটা অসুবিধা হয়না। সবাইকে বলে দিয়েছি যে সামনের স্ট্যাণ্ডে আমাদের নামতে হবে। সবাই দরজার কাছে রেডি। আমি সামনে। আমি নেমে পড়েছি কিন্তু তারা নামার সাহস করেনি। অগত্যা দৌড়ে গিয়ে আমাকে আবার চলন্ত ট্রামে উঠতে হয়েছিল। আর একটা বিষয় জানাতে হয়, তা হল ঐ ট্রামে দুটি বগি থাকে যার সামনেরটা ফার্ষ্ট ক্লাশ আর পিছনেরটা সেকেণ্ড ক্লাশ। ভাড়ায় মাত্র দু পয়সার তফাৎ। এখনের অবস্থা জানিনা, তবে শেষ ২০০৫ সালে গিয়ে দেখলাম যেমন ট্রাম লাইনের অবস্থা তেমনই গাড়ি গুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা। দেখলে মায়া হয়। শহরে লোক সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে। পুরাতন এলাকা গুলো আরও পুরাতন ও নোংরা হয়েছে।

রায়ট বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে মোটেও সুখকর নয় তা ছোটবেলায়ই জেনেছিলাম। তার জন্যই যে আমরা নিজের জন্মভূমীতেই উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছি তাও বুঝতাম। কিন্তু তা যে আবার ফিরে আসতে পারে এ খবর জানা ছিলনা।

১৯৬৪ সালের কোন একদিন মাসটা মনে নেই, তবে মনে হয় একটু আধটু শীত পড়ে থাকবে, মাগরিবের নামাজের পর গুলজার ভাই বলল যে, শহরের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না, হয়ত রায়ট বাধতে পারে, সামাদ, তুই বাড়ি চলে যা, আমি তোর ছুটির ব্যবস্থা করে দেব। রায়টের কথায় আঁতকে উঠলাম। রায়ট দেখিনি। শুনেছি হিন্দুরা মুসলমান পেলেই খুন করে। যার জন্য আমরা বাস্তুহারা হয়েছি, ৫০ সালে স্বজন হারা আমার চাঁপ দাড়ি ওয়ালা পরহেজগার শহুরে নানাকে সারা রাত বাবুদের বাগানে লুকিয়ে থাকতে হয়ে ছিল, সকাল বেলা দাড়ি চেঁছে ধূতী পরে শহর ছাড়তে হয়েছিল। আমি তাকে বললাম, ‘তুমি যাবে না’ উওর হল, তুই ছোট মানুষ, তুই যা, আমি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। এ সময় অনেকেই মাদ্রাসা ছাড়ল। আমিও খালি হাতে রাতে বাড়ি ফিরলাম।

পরদিন সকালে দেখি গুলজার ভাইও রাতে বাড়ি ফিরেছে। তার কাছে শুনলাম, আমি চলে আসার দুই আড়াই ঘণ্টা পরে হল্লা চিল্লার শব্দ শোনা গেলে সকলে মাদ্রাসা ছেড়ে কবরস্থানে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষন পরই মাদ্রাসায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। তাতে কেউ মারা পড়েছিল কিনা তা জানা যায়নি তবে, পরণে থাকা কাপড় ছাড়া আর কিছুই উদ্ধর হয়নি।

কয়েক মাস পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে খবর পেয়ে আমরা আবার কলকাতা গিয়ে অফিসে দেখা করলাম। সেক্রেটারী সাহেব জানালেন যে, তাঁতী বাগানে মসজিদ সংলগ্ন এক ফুরকানিয়া মক্তবে সাময়ীক ভাবে ক্লাশ চালু করা হয়েছে। সকালে বাচ্চাদের ক্লাশ শেষ হলে আমাদের ক্লাশ চলবে, আর মসজিদও ব্যবহার করা যাবে। এলাকাটি ছিল মুসলীম প্রধান। রায়ট যত মারাত্মকই হোক মুসলীম প্রধান এলাকায় তার ছোঁয়া লাগেনা, এখানেও লাগেনি। ২৫/৩০ জনকে নিয়ে মাদ্রাসা শুরু হল বটে কিন্তু আমার স্থায়িত্ব আর টিকল না। সে কথায় পরে আসব। পুরাণো মাদ্রাসায় ভয়ে ভয়ে একদিন গিয়ে দেখলাম, ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে। তারই মাঝে জানালা দরজা বিহীন মসজিদটি দগ্ধ রুগীর স্বাক্ষী হয়ে নির্জীব দাঁড়িয়ে আছে।

বিষয়: সাহিত্য

১১৪৭ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

370276
২৮ মে ২০১৬ সকাল ০৯:১৩
হতভাগা লিখেছেন : আপনি কি কলিকাতার বাঙ্গালী মুসলমান ?
২৮ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪৩
307317
শেখের পোলা লিখেছেন : হাঁ ভাই, আমার জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনায়। শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার অপরাধে পৈত্রীক ভিটে মাটি খুইয়ে জান বাঁচাতে ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম,তাই সেই মুসলমান হয়েও আপনরা যখন সেই ভারতের পায়ে আত্মসমর্পণ করেন তখনই আমাদের কষ্ট লাগে। ধন্যবাদ।
২৯ মে ২০১৬ বিকাল ০৪:৪৫
307379
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..


সে কষ্ট কী এনারা বুঝবেন??? চেতনাবটিকার ধকল কাটিয়ে উঠতে কয়পুরুষ যায় কে জানে!!
তবে কোন এক দাঙ্গার পরে এ জাতি যে আবার ঘুরে দাঁড়াবে তাতে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই!
370278
২৮ মে ২০১৬ সকাল ১০:০৩
গ্যাঞ্জাম খানের খোলা চিঠি লিখেছেন : আন্নে তো দেখছি পুরানা জল পান করা আদমী।
২৮ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪৬
307318
শেখের পোলা লিখেছেন : ঠিকই বলেছেন। শুধু তাই নয় গঙ্গা পদ্মা যমুনায় অনেক জল গড়িয়ে যেতেও দেখেছি৷ আজও দেখছি।ধন্যবাদ।
370285
২৮ মে ২০১৬ সকাল ১১:৩৭
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চলতে থাকুক। সাথে আছি।
আপনার মাদ্রাসাটির বর্তমান কি অবস্থা।
২৮ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪৭
307319
শেখের পোলা লিখেছেন : জানিনা। হয়ত আবার নতুন করে গড়ে উঠে থাকবে৷ সুযোগ হলে একবার গিয়ে দেখার ইচ্ছে আছে। ধন্যবাদ।
370290
২৮ মে ২০১৬ দুপুর ১২:১৩
নেহায়েৎ লিখেছেন : আপনার স্মৃতির পট উজার করে দিন ভাই। বেশ ভালই লাগছে ইতিহাস পড়তে। তাড়াতাড়ি শেষ করবেন না যেন প্লিজ।
২৮ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৫১
307320
শেখের পোলা লিখেছেন : প্রায় শেষ। কেননা সামনের অংশ আগেই 'না বলা কথা' হেডিং এ পোষ্ট করেছিলাম। বুড়া গরুর মত আমারও জাবর কাটতে মন্দ লাগেনা। ধন্যবাদ।
370351
২৮ মে ২০১৬ রাত ১০:১৯
আবু জান্নাত লিখেছেন : রায়ট কি এখনো হয়? রায়ট এর বিস্তারীত জানতে আগ্রহী।

আহ! এমন জালিম হিন্দুরা বাংলাদেশে কি মজেই দিন কাটাচ্ছে। নিজ দেশে মুসলমানরা এখনো নিষ্পেষিত।

আরো লিখুন, অনেক অনেক ধন্যবাদ

২৯ মে ২০১৬ সকাল ০৭:২০
307343
শেখের পোলা লিখেছেন : রায়টকে বাংলায় বলে সাম্পদায়িক দাঙ্গা। সোজা কথায় হিন্দু মুসলীমে কাটা কাটি। কিছুটা রাজ নীতিও তাতে জড়িয়ে থাকে। ভারতে আজও খুটিনাটি অজুহাতে হিন্দুরা মুসলীমদের কেটে আনন্দ করে। যেখানে মুসলীম প্রধান সেখানে তারা নীরব থাকে। চাকুরি ক্ষেত্রে মুসলীমরা বঞ্চিত হয়। ৫০ সালের রায়টে আমরা প্রাণে বাঁচলেও ভিটামাটি ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ৬৪ র রায়টে আমার বড় ভাই চাকরীচ্যুত হয়। আমরা ভারত ছাড়তে বাধ্য হই। বাংলাদেশে এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও হিন্দুরা মহাসুখে ছিল আছেও।
370370
২৯ মে ২০১৬ সকাল ০৬:৫৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অসুস্থ হয়ে ঘরে পরে আছি। এই সুযোগে অনেকগুলি মুভি দেখলাম। যার একটি নসিম হিজাযির "খাক আউর খুন" উপন্যাস অবলম্ববে নির্মিত মুভি। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ এর সময় পূর্ব পাঞ্জাব এর ঘটনাই এই মুভি ও উপন্যাস এর বিষয়। পশ্চিম বাংলা আর বিহারের কথা লিখার মত কোন সাহিত্যিক কেন এই দেশে জন্ম নেয়নি??
২৯ মে ২০১৬ সকাল ০৭:২৮
307344
শেখের পোলা লিখেছেন : বাংলা বিহারের অবস্থা লেখার মত লেখক বাংলাদেশে নাই। কারণ দালালদের জন্য তা পাবলিশ হবে না।। কিছুদিন আগে গুজরাটে রায়ট হয়ে গেল। গরুর গোস্ত রাখার মিথ্যা অপবাদে এক জনকে খুন করা হল, যদি কোন মুসলমান প্রোটেস্ট করত তবে হয়ত রায়ট হয়ে যেত। রাজনৈতিক ভাবে কিছুটা প্রোটেস্ট হয়েছিল বটে। ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা দান করুক।
370381
২৯ মে ২০১৬ সকাল ১১:২৫
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : চলতে থাকুক। ইতিহাস আর আপনার শৈশবের মিশেলে লেখা উপভোগ করছি বেশ।

এদেশ তো এখন ভারতের অঙ্গরাজ্যের চেয়েও বেশি কিছু।
৩১ মে ২০১৬ বিকাল ০৫:১১
307458
শেখের পোলা লিখেছেন : আপনার উপস্থিতি উৎসাহ বাড়িয়ে দিল। ধন্যবাদ আপনাকে আমার দৈন্যে ভরা সংগ্রামী শৈশব ভাল লাগার জন্য৷
370448
৩০ মে ২০১৬ রাত ০১:২০
ঘুম ভাঙাতে চাই লিখেছেন : বেশ কদিন পরেই ব্লগে। চাচাজান, আপনার লেখাগুলো পড়ছি সত্যিই হৃদয়ছোয়া।
কিন্তু এখন ভয় ভয় করছে কারণ গত কয়েকদিন ইয়াজুজ মাজুজ নিয়ে খুব ঘাটাঘাটি করছি। তারা আসলে কোথায় আছে? সেটা জানার কৌতুহল চেপে বসেছে। তারপর রাত হলেই খালি ভূমিকম্পের ভয় মাথায় কাজ করে আর ঘুমাতে পারিনা।
৩০ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪৬
307430
শেখের পোলা লিখেছেন : ভয়ের কোন কারণ নেই। মুসলীম আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায়না, আর দূর্ঘটনা যেটাই ঘটুক তা আল্লাহ অনুমোদিত জানবে। বান্দা তাতেই খুশী হবে এটাই আল্লাহ চান। ইয়াজুজ মাজুজ এখনও আছে বলে জানি। গবেষণা কর। পেয়ে যাবে।শুভেচ্ছা নিও।
370458
৩০ মে ২০১৬ রাত ০৩:৪৫
ধ্রুব নীল লিখেছেন : এখন পড়তে পারছিনা। পরে একসময় পড়ে অনুভূতি জানাবো ইনা শা আল্লাহ।
৩০ মে ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৪৬
307431
শেখের পোলা লিখেছেন : জাজাকাল্লাহ। তবে তাই হোক।
১০
370534
৩১ মে ২০১৬ দুপুর ০১:৫৯
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : তিনপর্ব একসাথে পড়লাম। ভালই লাগছে বেশ। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়।
৩১ মে ২০১৬ বিকাল ০৫:১৪
307459
শেখের পোলা লিখেছেন : আপনাকে প্রথমেই ধন্যবাদ। পরের পর্বেই শেষ হবে, কারণ বাকী গুলো আগেই 'না বলা কথা' হেডিং এ পোষ্ট আগেই করে ছিলাম। ভাল থাকেন।
৩১ মে ২০১৬ বিকাল ০৫:১৬
307460
শেখের পোলা লিখেছেন : প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ। পরের পর্বেই শেষ হবে। কারণ বাকী কথা 'না বলা কথা' হেডিং এ অনেক আগেই পোষ্ট করেছিলাম। ভাল থাকেন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File