()()() জীবনেতিহাসের ছেঁড়া পাতা--৪ ()()()
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ১৭ মে, ২০১৬, ০১:০৯:৪৭ রাত
১৯৬১ সালের রমজানের বন্ধের পর মাদ্রাসা আবার চালু হলে, হঠাৎ একদিন সকালে স্থানীয় মাদ্রাসার সেক্রেটারী জনাব হাজী আশরাফ আলী সাহেব আর হাজী শামসুল হুদা হুজুর আমাদের বাড়ি এলেন৷ আমার আব্বার কাছে বললেন, যে আমার আব্বার মত থাকলে তাঁরা আমাকে নিয়ে গিয়ে দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়ে আসবেন৷ আমাদের কোন খরচ লাগবে না৷ আব্বা বলল, যে অতটুকু ছেলে অত দূরের পথ, দুদিন লাগে যেতে৷ মা-বাপ ছেড়ে থাকতে পারবে না৷ কোন বিপদ হলে আমরা কেউই জানতে পারব না৷ তাদের দাবী টিকলো না, আমিও কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম বৈকি! এবার তাঁরা তাঁদের দাবীকে কমিয়ে এনে কলকাতায় ভর্তীর প্রস্তাব দিলেন৷ আমাদের গ্রাম থেকে কলকাতা মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ৷ আধ ঘণ্টা বাসে আর চুঁচুড়া শ্টেশন থেকে ট্রেনে এক ঘণ্টা৷ এখন দুরত্বের অজুহাত অচল হল৷ সামনে এল বোর্ডিং খরচ৷ উনারা বললেন, তা উনাারাই বুঝবেন৷ আমাদের কোন টাকাই লাগবে না৷ সম্ভাব্য দিন তারিখ ঠিক হল৷ কলকাতা যাবার আনন্দের কাছে সবাইকে ছেড়ে থাকার দুঃখ হার মানলো৷ মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ৷ অথচ গ্রামের ব্যবসায়ী দোকান মালিকরা ছাড়া প্রায় কেউই তখনও কলকাতা দেখেনি৷ সেই স্বপ্নের কলকাতায় পড়তে যাব, একি কম আনন্দের!
লুঙ্গী-গামছা, বিছানা-বালিশ, প্লেট- গ্লাস আর পথ ও হাত খরচের ৫/৭ টাকা সঙ্গে নিয়ে নির্দিষ্ট দিন সকালে মাদ্রাসায় গেলাম৷ উনারা দুইজন আমাকে নিয়ে কলকাতা রওয়ানা হলেন৷ আমার কোন গাড়ি ভাড়াতো লাগলোই না বরং দুপুরের খাওয়াটাও হল ফ্রী। হোটেলে খেয়ে আমরা ১৭২ নং পার্ক স্ট্রীটে মাদ্রাসার অফিসে সেক্রেটারী জনাব হাজী আনিসুল আম্বিয়া সাহেবের সাথে দেখা করলাম৷ তিনি পেশায় ছিলেন হোমিও ডাক্তার, বেশ রাশ ভারী গম্ভীর মানুষ। মাদ্রাসার অফিস ছি তার চেম্বারেই। রেজিষ্ট্রেশণের কাজ সেরে, পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপো থেকে পুবে প্রায় এক কিলো মিটার পথ, ডাইনে বিরাট পার্ক আর বামে লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজ যা শেরে বাংলা জনাব ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রীত্বের স্বাক্ষী, পিছনে ফেলে আমরা মাদ্রসায় পৌঁছলাম৷ জায়গাটা শহরের প্রায় প্রান্তে অবস্থিত৷ নাম গোবরা৷ পাঁচিল ঘেরা বিরাট একটি কবরস্থান, যার এ মাথা থেকে ও মাথা দেখা যায় না৷ অধিকাংশ কবরই পাকা৷ কোন কোনটা বেশ বড় দরজা জানালা বিশিষ্ট ঘরের ভিতর৷ এরিয়ার ভিতরে বেশ কয়েকটি পুকুর আছে৷ পায়ে হাটা পাকা পথ আর বড় বড় গাছপালায় ভরা৷ তারই পাশে রাস্তার অপর পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বিরাট মসজিদ, এলাকায় এক সময় মুসলীম আধিক্য ছিল তা মনে করিয়ে দেয়৷ পঞ্চাশের রায়টে অধিকাংশই স্থান ত্যাগ করে গেছে৷ অল্প দু চারটি পরিবার তখনও অবশিষ্ট ছিল৷ মসজিদের আঙ্গিনায় অনেক খানি ফাঁকা জায়গা৷ পুব ও উত্তরের পাঁচিল ঘেঁসে লম্বা টিনের ঘর যা বোর্ডিং ও কিচেনের জন্য৷ সব কয়টি ক্লাশ মসজিদেই হত৷ বোর্ডিং ম্যানেজার জনাব নুরুল হুদা সাহেব আমাদের জিনিষ পত্র রেখে আমার একটা ভর্তী পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন৷ আমার পাড়ার আঃ মজিদ চাচার ছেলে গুলজার আগেই এখানে ভর্তী হয়েছিল, তার পাশেই আমার থাকার যায়গা হল৷
সেক্রেটারি হাজী আশরাফ আলী সাহেব ও জনাব হাজী শামসুল হুদা সাহেব আমাকে রেখে বাড়ী ফিরে গেলেন৷ যাবার সময় কয়েকটি টাকা(কত মনে নাই) আমার হাতে দিয়ে বললেন যে, এ গুলি আমার নাস্তার খরচের জন্য৷ আরও কথা দিলেন যে, অফিসের কাজে তিনি যখনই কলকাতা আসবেন তখন আমার সাথে দেখা করবেন৷ আর আমি যখন যখন বাড়ী যাব যেন তাঁর সাথে দেখা করি৷ তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন৷
মাদ্রাসার বোর্ডিং থেকে দুপুরে ভাত ডাল তরকারী, আর রাতে ডাল রুটি দেওয়া হত৷ সকালে নাস্তা ছিল নিজ দায়িত্বে৷ সাধারণ নাস্তার জন্য এক জনের দু আনা বা ৮ পয়সাই ছিল যথেষ্ট৷ পাঁচ টাকায় সারা মাসের নাস্তা সহ তেল সাবানের খরচও চলে যেত৷ বছরখানিক পরে আমার বড় ভাই কলকাতার কাছে বেলুড়ের একটি কারখানায় কাজ পায়৷ বাড়ী থেকে স্টেশন সাইকেলে তার পর ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করত৷ মাঝে মাঝে বড় ভাই দেখা করতে এসেও ২/৫ টাকা দিয়ে যেত। দু/তিন মাস পর পর বাড়ীও যেতাম৷ মোট কথা কলকাতায় আমার জীবনটা ভালই ছিল৷ লেখা পড়ার ফাঁকে সমস্ত কলকাতা ঘুরে বেড়াতাম৷ ট্রামের শুরু থেকে শেষ মাথায় যেতে ভাড়া ছিল সাত নয়া পয়সা৷ শুক্রবারে বড় মসজীদে জুম্মা পড়তে যেতাম৷ কলকাতায় ওটাই ছিল সব চাইতে বড় আর সুন্দর মসজীদ৷ চার তলা বিশিষ্ট আর মেঝে ছিল মার্বেল পাথরে তৈরী৷ ঐ দিন যদি কোন বড় দলের বল খেলা থাকত, তা না দেখে হোষ্টেলে ফিরতাম না৷ টিকিট লাগত না। এখনের খবর জানিনা, তখনও ভাল খেলার টিকিটের জন্য আগের দিন থেকেই লাইন পড়তে দেখেছি৷ গড়ের মাঠে তিনটি ঘেরা স্টেডিয়াম ছিল যার প্রত্যেকটির এক গোল পোষ্টের দিকে ঘেরা ছিলনা, ছিল কাঁটা তারের বেড়া৷ বিনা টিকিটের লোকদের খেলা দেখার জন্যই এ ব্যবস্থা৷ মজার ব্যাপার, তিনটি মাঠেরই খোলা দিকটিতে ছিল ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ৷ যা ছিল মাটির নীচে আর ক্রমশঃ উঁচু৷ খোলা দিকটি ছিল তারই ঢালে৷ তাই যত পিছনে যাওয়া যায় ততই উঁচু, এ যেন দাঁড়ানোর গ্যালারী৷ সকলেই খেলা দেখতে পেত৷ আমরা এ সুযোগটিই নিতাম৷
বোর্ডিং এর খাবারের ব্যাপারে অনেকেরই জানা আছে। কোন হাই-ফাই খাবার ছিল না৷ পাতলা ডাল ভাত আর একটা সবজির ঘণ্ট৷ প্রায় প্রতি সপ্তায় একদিন গোশ্তের ব্যবস্থা হত, তাও ছিল সীমিত৷ তবে বাবুর্চি আঃ হালিম ভাইয়ের রান্না ছিল অপূর্ব। বিভিন্ন সবজি দিয়ে যে ঘণ্টটা রাঁধতো তার স্বাদ আজও মনে পড়ে৷ মাঝে মাঝে দানের খাসী আসত, সেদিন বেশ মজা হত৷ একটু তফাতেই ছিল বিহারী মুসলীমদের পাড়া৷ সেখানে প্রায়ই কোরআন খানি বা মিলাদের দাওয়াত হত। শবে বরাত আর মুহর্রমে অনেক দাওয়াত ফেরত যেত৷ যিনি দাওয়াত দিতেন তিনি কতজন যাবে তা বলেদিতেন। ভূরী ভোজের সাথে কিছু টাকাও আসত৷ হেফজখানা সহ কম বেশী সত্তরের মত ছাত্র বোর্ডিংএ ছিল আর ২/৫ জন ছিল স্থানীয়৷ শবে বরাতের মাসে কবরস্থানটি আলোয় আলোকিত হত। অজস্র মোমবাতি আর আগরবাতি পুড়তো। শবে বরাতের সারা রাত মাদ্রাসার অনেক ছাত্র বহিরাগত হুজুরদের সাথে কোরআন তেলাওয়াত ফেরী করত। আমিও তাদের সাথে থাকতাম। রমজানে মাদ্রাসা বন্ধ থাকত। যে যার বাড়ি চলে যেত৷ রমজানে আমাদের গ্রামের মসজীদে ১৫ তারাবীতে খতম হত। আমাদের কলকাতা মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র হাফেজ সুলতান কলকাতা থেকে এসে আমাদের গ্রামে থাকত আর খতম তারাবী পড়াত৷ বয়স আমার থেকে ২/৩ বছর বেশী ছিল। আমার আব্বা তাকে খুব পছন্দ করত৷ আমি কলকাতা যাবার পর তার বন্ধু হয়ে গেলাম৷ সে ছিল অবাঙ্গালী, তবে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে পারত।
একবার রমজানের ছুটিতে বাড়ি এসে স্থানীয় মাদ্রাসায় দেখা করতে গেলাম। সেক্রেটারী সাহেব তাঁর গ্রামের মসজিদে খতম তারাবী বাদে বাকী দিন তারাবী পড়াবার অফার দিলেন। রাজী হলাম, কিছু আমদানী হবার আশায় খুশীও হলাম। হা হতস্যি! মসজিদ কমিটি আমাকে দেখে বাতিল ঘোষণা করল। কারণ তখনও আমার গোঁফ-দাড়ী তো দূরের কথা তার রেখাও দেখা যায়নি৷ হতাশ হলাম।
দুই বছরের মধ্যে সারা কলকাতা চষে বেড়ালাম, অবশ্যই ছুটির দিনে। কলকাতা যেতে আমাদের তৎকালীন বিখ্যাত হাওড়া ব্রীজের উপর দিয়েই যেতে হত, তাই আলাদা করে দেখার প্রয়োজন ছিল না। তবে, গড়ের মাঠ, মনুমেন্ট, ইডেন গার্ডেন, লাট ভবন, ডাল হৌসী স্কয়ার, যাদু ঘর, চিড়িয়া খানা, হাওড়া বোটানিক্যাল গার্ডেন, বালীগঞ্জ লেক, এটা ছিল একটা পার্ক, লেকের একটা সাঁকোর উপর থেকে একমুঠো মুড়ি ফেললে নীচে বড় বড় অসংখ্য রুই মাছের মেলা বসত। এছাড়া শ্যাম বাজার, নারকেল ডাঙ্গা, খিদির পুর, হক সাহেবের বাজার, বড় বাজার, চীনা বাজার, মল্লিক বাজার, রাইটার্স বিল্ডিং, টালা ট্যাঙ্ক, এয়ার পোর্ট, সীঁদরে পটি মসজিদ (বড়মসজিদ) নাখোদা মসজিদ, টিপু সুলতান মসজিদ, বিড়লা মিউজিয়াম, গুরু সদয় রোডে যা ছিল আমাদের হাঁটা পথের মধ্যেই, একটি চার তলা বাড়ির পুরোটাই ছিল মিউজিয়াম। বলতে হয় এটা একটি বিজ্ঞান বিষয়ক মিউজিয়াম। আজও আছে কিনা জানি না। এখানে আমরা প্রায়ই যেতাম। যেখানে দেখেছি বিজ্ঞানের ভবিষ্যত আবিষ্কার। ট্যাপের নীচে হাত দিলেই পানি পড়া, দরজার সামনে গেলেই দরজা খুলে যাওয়া, শব্দের দ্বারা বাতি জ্বালানো, স্টীল আলমারিতে হাত ছোঁয়ালে ঘণ্টা বাজা, নিজের ভয়েস রেকর্ড করে শোনা, কয়লা খনিতে কি ভাবে কয়লা তোলা হয়, লোহা গলিয়ে কেমন করে যন্ত্রপাতী তৈরী হয়, আর সব চাইতে যা আমাদের জন্য আকর্ষনীয় ছিল তা হল টি ভি স্টুডিও৷ বাক্স আকারে টিভি দেখেছি বাংলাদেশে স্বাধীনের পরে, যা এই মিউজিয়ামে দেখেছি ১২/১৩ বছর বয়সে ১৯৬২/৬৩ সালে বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন দেওয়ালে সাঁটা স্ক্রীনে। তিন তলায় একটি কাঁচ ঘেরা রুমে হাই পাওয়ারের বাতির নীচে একটি ক্যামেরার সামনে একটা চেয়ার পাতা ছিল, যাতে বসে কবিতা, বক্তৃতা, গান গাইলে বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন দেওয়ালে লাগানো স্ক্রীনে সরাসরি দেখা ও শোনা যেত। আমার গুলজার ভাইয়ের গলা ভাল ছিল, খুব সুন্দর হামদ না’ত গাইত। তাকে নিয়ে গিয়ে আমরা ঐ টিভিতে গান গাইয়ে শুনতাম। ওখানে কোন প্রবেশ মূল্য লাগত না, তবে টিভি স্টুডিওর জন্য অফিস থেকে পারমিশন নিতে হত, তাও ছিল ফ্রী।
বিষয়: সাহিত্য
১৫২৮ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্মৃতিচারণ পড়ে খুবি ভালো লাগলো। এই ঘটনাগুলো আপনারা বর্ণনা না করলে এই জেনারশন কোনোদিনই অতীত চিনতে সক্ষম হবে না!
জাযাকাল্লাহু খাইর। আল্লাহ আপনাকে ঈমানের সাথে ,সুস্থ এবং নিরাপদ রাখুন । আমীন।
জীবন কাহিনী গুলো পড়তে বরাবর ই ভালো লাগে,
মনে হয় নিজে ই যেন সেই দিন গুলোতে হারিয়ে যাচ্ছি,
আচ্ছা ,
"! শবে বরাতের মাসে কবরস্থানটি আলোয় আলোকিত হত। অজস্র মোমবাতি আর আগরবাতি পুড়তো "
এই বিষয় গুলো কতটা ধর্ম সম্মত??
আপনাকে ধন্যবাদ।
জীবন কাহিনী গুলো পড়তে বরাবর ই ভালো লাগে,
মনে হয় নিজে ই যেন সেই দিন গুলোতে হারিয়ে যাচ্ছি, চলুক সাথে আছি ইনশা আল্লাহ্
জীবনের ছেঁড়া পাতাগুলো এতো সযত্নে রেখে দিয়েছেন যা সত্যিই অভিভূত করে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে লিখাগুলো ভাবনার ও শিক্ষার খোরাক যোগাবে আলহামদুলিল্লাহ্।
আরো লিখতে থাকুন, পড়বো ইন শা আল্লাহ।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন