{}{} জীবনেতিহাসের ছেঁড়া পাতা--৩ {}{}
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ০৩ মে, ২০১৬, ০১:৩২:০৬ রাত
তোলা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে একদিন সকালে একাই মাদ্রাসায় গিয়ে হাজির হলাম৷ অনেকেই ভাববেন যে, তোলা পায়জামা পাঞ্জাবী আবার কেমন! তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই তখনও ঈদ, কোরবাণীতে পোশাকের এত বাহুল্য ছিল না৷ গ্রামের মধ্যও নিম্নবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়েদের এক বা দুইসেট জামা কাপড় ধুয়ে ইস্ত্রি করে বাক্সে বা আলমারিতে তুলে রাখা হত৷ যা কুটুম বাড়ি যেতে বা ঈদ বকরাঈদ আর কোন অনুষ্ঠানেই ব্যবহার হত৷ যাদের ঘরে ইস্ত্রি ছিলনা তারা ভাজ করে বালিশের নীচে রেখে কাজটা সেরে নিত৷ পাড়ার যারা আগেই মাদ্রাসায় ভর্তী হয়েছিল তারা হুজুরকে আমার ভর্তী হবার কথা জানালো৷ মাওলানা হাজী শামসুল হুদা সাহেব আমার ইন্টারভিউ নিয়ে একটা স্লিপ হাতে দিয়ে অফিসে পাঠালেন৷ মাদ্রাসার সেক্রেটারি জনাব হাজী আশরাফ আলী সাহেব অফিসে ছিলেন৷ উনি স্লিপ দেখে আরবী উর্দু কায়দা সহ ক্লাশ ফোরের একসেট বই দিয়ে নিয়ম কানুন, বই বিনা দামে দেওয়া হল, পড়াশেষ হলে ফেরত দিতে হবে, তবে হারিয়ে বা ছিঁড়ে গেলে কিনে দিতে হবে৷ আমি থ্রী পাশ করেছি তাই ফোরে দেওয়া হল৷
কয়েকদিন ক্লাশ করার পর শামসুলহুদা হুজুর আমাকে সব বই সহ অফিসে যেতে বললেন৷ কেন তা বললেন না৷ ভয়ে ভয়ে গেলাম৷ ভয় এ জন্য যে হয়ত অজান্তে কোন অন্যায় হয়ে গেছে, তাই ফ্রী বই আমাকে দেওয়া হবে না৷ সামনে আমার জন্য একটা বড় বিষ্ময় অপেক্ষা করছিল৷ ভয় আনন্দে বদল হতে দেরী লাগল না৷ যখন ক্লাশ ফোরের বই এর বদলে এক সেট ফাইভের বই সাথে ফার্সী কায়দা দিয়ে ক্লাশ ফাইবে পাঠানো হল তখন আমার আনন্দ দেখে কে!
এই ধরণের মাদ্রাসা গুলোকে খারেজী নেসাবের বলা হত, যাকে এখন কওমী বলা হয়৷ মাদ্রাসার ক্লাশ বছরের গণ্ডিতে বাঁধা থাকলেও আরবী উর্দু ফারসী কিতাবগুলি শেষ হলেই পরেরটা দেওয়া হত৷ যেদিন আমার আরবী কায়দা শেষ হল; আমপারা পাব এই আশায় ছিলাম৷ কিন্তু হুজুর জানতে চাইলেন আমার বাড়িতে কোরআন শরীফ আছে কিনা৷ আছে শুনে বললেন, ‘এক দৌড়ে গিয়ে তা নিয়ে এস’৷ খুশীতে বোধ হয় দৌড়ে নয় উড়েই গিয়েছিলাম৷
মা কে সু খবরটা দিয়ে কোরআন শরিফ খানা নিয়ে আবারও দৌড়৷ সেটি এতই পুরানো ছিল যে, যাগায় যাগায় সাদা হয়ে গেছে, পড়া যায়না৷ লাইব্রেরী থেকে এক খানা নুতন কোরআন বরাদ্য পেলাম৷ উর্দু ফারসী সাহিত্যের সাথে একে একে মাজদার ফৌজ, মিজান মুনশাইব, মন্তেক, শরহে মিয়াতে আমিল, শরহে বোকায়া, কাফিয়া, কুদুরী, সাথে আরও ছিল ইসলামের ইতিাস ভুগোল অংক বাংলা সাহিত্য, ও কিছু ইংরাজী তিন বছরে শেষ করে ফেললাম৷ শুরুতে ভাষার মাধ্যমটি ছিল উর্দু, পরে যোগ হল ফারসী, তারও পরে আরবী৷ বোঝার মাধ্যম আগাগোড়াই ছিল উর্দু৷ পনের বছরের শিক্ষা জীবনে কোন ক্লাশে তো নয়ই এমন কি কোন সাবজেক্টেও কোনদিন ফেল করিনি৷ আমার সহপাঠি আলাউদ্দীন, বন্ধু ছিল কিন্তু ক্লাশে আমার প্রতিদ্বন্ধীও ছিল৷ মাঝে সাজে সেও ফার্স্ট হয়ে যেত আর আমি সেকেণ্ড৷ সে বোর্ডিংএ থাকত, কারণ তার বাড়ি ছিল দূরে৷ মাদ্রাসায় যারা পড়েছেন তারা ওস্দাদের পা টেপা, কাপড় ধোওয়ার বিষয়টা জানবেন৷ আমি বাড়ি থাকতাম তাই আমার কাছে হুজুররা সেবা খুব কমই পেতেন৷ শেষ বছরের শেষ পরীক্ষাটায় আলাউদ্দীনের চাইতে সব সাবজেক্টে ভাল লেখার পরও রেজাল্টের আগে বিশ্বস্থ সূত্রে আমার সেকেণ্ড হবার খবর আসল৷ এটা আমার কল্পনার অতীত ছিল৷ কিন্তু রেজাল্টে মার্কশিট যখন হাতে এল দেখলাম, দুই নম্বর কম পেয়ে আমি সেকেণ্ডই হয়েছি৷ মনে মনে রাগ ছিলই, এখন তা প্রকাশ হল৷ হেড মওলানা সাহেবের সামনে মার্কশীট ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলে দিয়ে পিঠ বাঁচাবার ভয়ে কাঁপতে লাগলাম৷ কিন্তু সদর মুদার্রেস কিছুই না বলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন৷ এমনকি অফিসেও জানালেন না৷ এ মাদ্রাসা পাশের সাথে আমার লেখাপড়াও বন্ধ হল৷
লেখা পড়ায় কোনদিন শাস্তি না পেলেও বাঁদরামীতে শাস্তি পেয়েছি বৈকি৷ ক্লাশ থ্রীতে পড়ার সময় এক গরম কালে দুপুরে যখন গ্রামের রিক্সা ওয়ালারা পাকা রাস্তার পাশে খামারে গাছ তলায় রিক্সা রেখে বাড়ি যেত, একদিন টিফিনের ফাঁকে তিন বন্ধু মিলে একটা রিক্সা চালাবার চষ্টা করছিলাম৷ খবর পেয়ে রিক্সার মালিক এসে হেড স্যারের কাছে নালিশ করে, তাতে তিন জনেরই পঞ্চাশ বার কান ধরে উঠবস করতে হয়েছিল৷ তারও আগে একদিন গরুর গাড়িথেকে পড়ে ডান হাত কব্জির কাছে ভেঙ্গে যায়৷ মারের ভয়ে বাড়িতে বলিনি৷ কিন্তু রাতে যন্তনা চেপে রাখতে না পেরে ধরা খেলাম৷ সবাই ভাবল খিল সরে গেছে কবিরাজ দিয়ে খিল বসানো হল৷ কিন্তু হাত অচল হয়েই থাকল৷ ঠিক মনে নেই হয়ত তখনও স্কুলে ভর্তী হইনি৷ মাস পার হয়ে গেল৷ তখন কেউকেউ পরামর্শ দিল শহরের হাসপাতালে নিতে৷ চন্দন নগর হাসপাতাল অন্ততঃ দশ মাইল পথ৷ কি ভাবে কার সাথে যাব৷ পাড়ার পরউপকারী রহমত ভাই একদিন সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে গেল৷ মনে আছে পায়ে ঝিঁঝি লেগে এক পাটি জুতো কোথায় খুলে পড়ে গেছে জানতে পারিনি৷ ডাক্তার বাবুও প্রথমে খিল বসাবার চেষ্টা করলেন, হলনা দেখে X-RAY করালেন৷ X-RAY দেখে বললেন যে, বড় দেরী হয়ে গেছে৷ ভাঙ্গা যায়গায় মাংস গজিয়ে গেছে৷ আপাততঃ প্লাষ্টার করে দেবেন৷ দেড় মাস পরে খোলা হবে যদি না ঠিক হয় তবে অপারেশণ করে মাংস ছাড়িয়ে আবার প্লষ্টার করতে হবে৷ আল্লার মেহেরবানীতে তা আর করতে হয়নি৷
পড়াশোনা শেষ করে আমিও পুরোদমে চাষের কাজে সধ্যমত আব্বার সহযোগী হলাম৷ আমরা বর্গাচাষী, আমাদের হাল, গরু, গাড়ি সাথে ছাগলও ছিল৷ পড়া লেখার ফাঁকে তাদের খাবারে কাঁচা ঘাসের যোগান আমাদের নিজেদেরই দিতে হত৷ তাই খেলধূলা বা বিনোদন জিনিষটা আমাদের কাছে আসতে পারেনি৷ সম্ভবতঃ ১৯৬০ সালে মাষ্টার ভাই রেডিও কিনলেন৷ উঠানের দুই প্রান্তে লম্বা দুটি বাঁশের মাথায় এরিয়াল দিয়ে ঘরের ভিতর একটা কাঠের বাক্সর সাথে তার জোড়া, যা থেকে গান শোনা যায়, খবর নাটক শোনা যায়৷ প্রথম প্রথম অবাক হলেও পরে বুঝলাম কলকাতা থেকে বাতাসে গান ভেঁসে আসে, তারের মাধ্যমে এই বাক্সয় আসে আর আমরা শুনি৷ শুক্রবার রাত সাড়ে আট আর রবিবার দুপুর দেড়টায় নাটক শোনা নেশায় পরিনত হল৷ এ ছাড়াাও ছিল বাবু বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের রূপ ও রঙ্গের আসর৷
অনেকেই হয়ত কলেরগান শোনেন নি৷ তা ছিল আমাদের জন্য আর এক বিষ্ময়৷ একটা কাঠের বাক্সের উপরে একটা চাকা, হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে দম দিয়ে ঘোরানো হত৷ তার উপর থাবা গেড়ে বসা কুকুরের ছবি সহ ‘হিজ মাষ্টার ভয়েসের’ কালো রেকর্ড ঘুরত। রেকর্ডের উপর একটি স্টিলের পিনের ঘসা লেগে গান বার হত৷ আওয়াজটাকে জোরালো করতে বাক্সের সাথে একটা কলমী শাকের ফুলের মত বড় পিতলের চোং লাগানো থাকত৷ আমরা ছোটরা ভাবতাম নিশ্চয়ই বাক্সের মধ্যে ছোট ছোট কিছু মানুষ আছে, তারাই গান গায়৷ এমন বোকা কথায় এখনের ছেলে মেয়েরা হাঁসবে৷
বিষয়: সাহিত্য
১৯০৪ বার পঠিত, ৩৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমিও কলের গান দেখেছি।
বাল্যজীবনি পড়ে মুগ্ধ হলাম। জাযাকাল্লাহ
আপনার খোলামেলা বক্তব্যটা আমার খুবই ভাল লেগেছে, অনেকে আত্মসম্নান হানি হবে বলে এগুলো লুকিয়ে রাখেন। এতে অন্যজনের জানার হক, উপলব্ধির হক নষ্ট হয়।
আমার ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলেটিকে এই বন্ধে মিজান-মুনশায়িব খুব ভাল ভাবে শেষ করিয়েছি। আগামী সপ্তাহে পরবর্তী সিলেবাস শুরু করাব। দোয়া করবেন তার জন্য। আল্লাহ আপনাকে রহম করুন, ভাল থাকুন। আমীন।
http://www.bdeditor.net/blog/blogdetail/detail/2120/abdulmazed/67215
এটা পড়তে পারেন।
http://www.bdeditor.net/blog/blogdetail/detail/2120/abdulmazed/67215
কায়দা থেকে চিরপা, তারপর আমপারাঃ, তা থেকে কুরআন, ওহ তখন কি যে আনন্দ স্নায়ুবিক উত্তেজনা কাজ করছিল! এখন তো বাচ্চারা দল বেধেঁ ওসব পড়ে না. এমন আনন্দ কোথা পাবে.
আপনার সহপাঠী কি কেবল আলাউদ্দিন ছিল, সালাউদ্দিন ছিলনা!
পড়াশোনায় আমার যে কত উত্থান পতন হয়েছে, ভালো রেজাল্ট ভালো স্টুডেন্ট, এই জাতীয় গল্প করার সাহস কখনো হয়নি. গুড, শেখ ভাই মেধাবী স্টুডেন্ট ছিলেন.
তা শেখ ভাই জীবনের ছেড়া পাতা গুলো যেভাবে ছিটাচ্ছেন, তাতে আফরার চাচীর দাম্পত্য জীবন হুমকির মুখে পড়বেনা তো?
কেননা সুন্দর সংগ্রামী জীবনে অনেক ললনা কুপোকাত হয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে.
সত্য বলতে কি অনেক উদ্দীন বন্ধু ছিল কিন্তু সালহ উদ্দীন নামের কেউ ছিলনা। তবে ছদ্ব বেশে আপনি থেকে থাকলে অন্য কথা৷
আর হ্যাঁ সুন্দরী ললনারা সংগ্রামী জীবনে কুপকাত হয়, তবে সবাই না৷ আমার ছেঁড়া পাতার ১ম ২য় পর্ব পড়লে আমার সংগ্রামী মায়ের কথা পাবেন। আমার গরীব মা বাবা আমার জন্য গর্ব। আল্লাহ এখন অনেক সুখে রাখছে। দুঃখে ছিলাম বলেই সুখ কে উপলব্ধি করতে পারি। দোওয়া করি উপযুক্ত সঙ্গীনী হোক। ধন্যবাদ।
চাচাজান আমাগো পারার সোবাহন হুজুর খুব নারাজ হইছে আমনে নিজেরে ফুলিয়ে ফাপিয়ে বলতে গিয়ে আলেম সমাজ কে হেয় করেছেন --উনি ধিক্কার জানিয়েছেন এই বিষয়ে -- আলেমদের বৌ এরা পা টিপা কাজ করে এটা সোবাহান হুজুরও করান উনার বিবি কে দিয়ে কনো ছাত্র কে দিয়া না .। আপনি একটা ডাহা মিথ্যা কথা কইলেন এর জন্য হুজুর আপনাকে তওবা করতে বলেছে।
ধন্যবাদ চাচাজান ।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার এই ওস্তাদদের সেবা করার বিষয়টা হিন্দুদের কাছ থেকে এসেছে বলে আমার মনে হয়।
সত্যিই অনবদ্য একটি লিখা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনাদের সময় নেসাব কেমন ছিল জানি না, আমাদের সময় ৩য় শ্রেণী থেকে উর্দূ ও ৫ম শ্রেণী থেকে ফার্সি ও মাসদার ফায়ুজ শুরু হতো, এখনো তেমন।
৬ষ্ঠ বছর থেকে মিযান মুনশাইবের মাধ্যমে আরবীর সুচনা হতো, বর্তমানেও এমন, তবে বোকাবুলারী বাড়ানোর জন্য ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীতে প্রাথমিক ভাবে কিছু আরবী শব্দ মুখস্থ করানো হয়, যেমন "এসো আরবী শিখি" "বাকুরাতুল আদাব" "আরবী ভাষা শিক্ষা" ইত্যাদি।
৭ম শ্রেণীতে নাহবে মীর, মালা বুদ্দা মিনহু, শহরে মিয়াতায়ে আমেল, ৮ম শ্রেণীতে হিদায়াতুন্নাহু ও নূরুল ইজাহ, ৯ম শ্রণীতে কাফিয়া, কুদুরী, ১০ম শেণীতে শহরে জামী ও কানযুদদাকায়েক, ১১তম শেণীতে শহরে বেকায়া, নূরুল আনওয়ার পড়ানো হয়। দ্বাদশ শ্রেণীতে হিদায়াহ পড়ানো হয়।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন