<><><> জীবনেতিহাসের ছেঁড়া পাতা৷<><><>
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ০৩ এপ্রিল, ২০১৬, ০৭:৩০:২৪ সকাল
বাড়ি থেকে বেরুলেই চোখে পড়ে ফষলের মাঠ৷ সারা বছরে ফষল বলতে দুই তিনটি৷ বাড়ির কানাচের জমিগুলোতে পাটের চাষ হয়৷ পাট উঠেগেলে কিছুদিন বিরতি দিয়ে সবাই আলুর জন্য জমি তৈরী করে৷ আবার আলু উঠে গেলে পুণরায় জমির বিরতি৷ আমরা ঐ অঞ্চলে নবাগত৷ আমার আব্বার পৈত্রিক পেশা ছিল চাষ৷ তার সে বিষয়ে অভিঙ্গতা অনেক৷ তাই ঐ অলস সময়টায় কারো কারো জমিতে মরিচ, ভুট্টা, গম, কুমড়া প্রভৃতির চাষ করে৷ বাড়তি এ ফষলটুকু পেয়ে জমির মালিক বেশ খুশী৷ ফলে আমার আব্বার ঐ অঞ্চলে বেশ কদর৷ আর এভাবেই চলে আমাদের জীবিকা৷
আমার পৈত্রীক নিবাস ছিল হুগলী নদী বা গঙ্গানদীর পূবে জগদ্দল থানার কাঁকিনাড়া শিল্পাঞ্চলের কাঁটাডাঙ্গা এলাকায়৷ যার পুবের পাশে ছিল চাষবাস আর পশ্চিমপাশে সারি সারি জুটমিল৷ পাকা পাঁচিল ঘেরা আম কাঁঠালের এক চিলতে বাগান সহ একতলা বাড়ি৷ ৪৭ এ দেশ ভাগের সময় আমার আব্বাও পৈতিক ভিটা ছেড়ে অন্য পাড়ায় ছোট্ট একটা বাড়ি বানিয়ে আলাদা হয়ে যায়৷ আমার আব্বা খুব ছোট বয়সে পিতৃহারা হলে আমার দাদী পুনরায় বিয়ে করে আমার সৎ দাদাকে জমি জায়গা সব দেখাশোনা করতে নিজ বাড়িতেই রেখে দেয়৷ বলা বাহুল্য নতুন দাদাও চাষী ছিলেন৷ আমার জেদী আব্বা তার মায়ের এই দ্বিতীয় বিয়ে মেনে না নেওয়াই আজকের এ বিভাজন৷
যাই হোক, তার তিন বছর পর ১৯৫০ সালে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাধে৷ বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান আমি তখন কোলে৷ অঞ্চলটি ছিল হিন্দু প্রধান৷ তাই সেখানে মুসলমানদের জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদের মায়া ত্যাগ করে রাতের আঁধারে মুসলীম প্রধান গ্রামের দিকে পালাতে হয়৷ অঞ্চলটি শিল্পাঞ্চল বিধায় পূর্ব পাকিস্তান হতে বহু রিফিউজীর আগমন ঘটে৷ সাথে প্রভাবশালী স্থানীয় হিন্দুরা মুসলীমদের ফাঁকা বাড়ি দখলে নেয়৷ আমরা হয়ে পড়ি উদ্বাস্তু৷
কয়েক মাস পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়, কিন্তু আমাদের বাড়িঘর জমিজমা সব শত্রুসম্পত্তিরূপে অন্যের মালিকানায় চলে যায়৷ আমার একমাত্র সৎচাচা দাদা দাদীসহ এক গ্রামেই রয়ে যায় আর আমার আব্বার দূর সম্পর্কের এক ফুফু গঙ্গাপারের হুগলী জেলার পোলবা থানার কাশ্বাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে আমাদের আনিয়ে নেয়৷ আব্বার ফুপাতো ভাই, আঃ আজিজ চাচা নিজের বাড়িতে প্রায় দু বছর রেখে গ্রামের শেষ প্রান্তে নিজের এক টুকরো জমি বাড়ি বানিয়ে বাস করার জন্য দিয়ে দেয়৷ সেখানেই আমার আব্বা মা বড় দুই ভাইবোন নিজেদের শ্রমদিয়ে মাটির প্রাচির ঘেরা মাটির দেওয়াল খড়ের ছাউনি দেয়া এক রুমের একটা ছোট বাড়ি বানিয়ে নেয়৷ গ্রামের জনগণ প্রয়োজনীয় বাঁশ কাঠ দিয়ে সাহায্য করে৷ আমার জ্ঞান হওয়ার পরে এটাকেই আমাদের বাড়ি বলে জেনেছি৷ এখানে প্রথমদিকে আব্বার দিনমজুরী, অল্প-সল্প বর্গাচাষ আর মায়ের অন্যের ধান সিদ্ধ শুকনা করে ঢেঁকিতে ছেঁটে চাল বানিয়ে দেওয়ার মজুরীই ছিল আমাদের জীবিকা৷ বলে রাখা ভাল তখনও ধান ভানা চালকল আবিষ্কৃত হয়নি৷ এই বাড়ির কথা দিয়েই শুরু করেছিলাম৷
বাংলা ১৩৬৩ সাল মোতাবেক ইংরাজী ১৯৫৭ বা ৫৮ সাল মাসটা সম্ভবতঃ ভাদ্র হবে৷ একদিন রাতে অনেক লোকের চেঁচামেচি শোনা গেল, কোদাল আনো, শাবল আনো, বড়ো বাঁধ ভেঙ্গেছে৷ বড় ভাইয়ের বয়স তখন দশ/এগারো হবে৷ আব্বার সাথে সেও কোদাল হাতে দৌড়ল৷ এ সব বোঝার বয়স হয়ত তখনও আমার হয়নি, বুঝলাম পরে যখন আমাদের শোবার ঘরে হাঁটু সমান পানি হয়ে গেল৷ আর মাছেরা নিরাপদে ঘরে ঘোরাফেরা করতে লাগল৷ উঠানে পানি আসার সাথেই আমরা জিনিষপত্র আর হাঁস মুরগী সহ সহৃদয় মাস্টার ভাইয়ের বাড়িতে বাড়তি ঘরে আশ্রয় নিলাম৷
আগেই বলেছি আমাদের বাড়িটা ছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে মাঠের সাথে, মাঠের সমতলেই ছিল আমাদের বাড়িটি৷ যার উত্তর ও পশ্চিম উভয় পাশেই ছিল জলা বা বিল৷ পশ্চিমে প্রায় দু-মাইল দূরে ছিল একটি ছোট নদী৷ শুকনাদিনে কোমর সমান পানি না থাকলেও বর্ষার দিনে তা হত ভয়াবহ৷ তাই তার উভয় পাশে অন্ততঃ বিশ হাত উঁচু চওড়া পাড় ছিল, যার উপর যাতায়াতের মেটে রাস্তা ছিল৷ কোথাওবা ছিল আদিবাসীদের বাস৷ মাঠে পানি নিষ্কাশনের জন্য স্লুইস গেট ছিল৷ কেউ না তা অসময়ে খুলে দেয় বা ইঁদুরের গর্ত বেয়ে পানি লিককরা বন্ধ করতে গ্রামের লোকেরা পাহারায় থাকত৷ সে বছর পানি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে দু কুল ছাপিয়ে পানি অবৈধ প্রবেশ করে, যার ফলে বাঁধও ধ্বসে যায়৷ গ্রামবাসীর কোদাল শাবলকোন কাজেই আসেনি৷ শেষরক্ষা হয়নি, ফলে সমস্ত বিলের ধান ডুবে সাগরের রূপ ধরে৷ সরকারী পাকা রাস্তার উপর হাঁটু সমান পানিতে জাল ফেলে মানুষ মাছধরা শুরুকরে৷
আমাদের মাটির তৈরী বাড়িটা পানির সাথে তিনদিন লড়াই করে খাড়া থাকলেও চতুর্থদিন পানির কাছে আত্মসমর্পণ করে৷ মাটিতে মিশে যায়৷ কঠিন হৃদয় আমার আব্বার চোখে সেদিন পানি দেখেছিলাম, তবে জীবনে এমন বহু পরীক্ষায় পড়তে দেখেছি কিন্তু কোনদিন ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি৷
সপ্তাহ খানেক পরে বন্যার পানি নেমে গেল৷ ভিটা আস্তে আস্তে শুকিয়ে গেলে আবারও অক্লান্ত পরিশ্রমে পুনরায় ছোট ছোট দুটো ঘর তৈরী হল৷ ঘরগুলোর পোতা বেশী উঁচু নয়, আর পাঁচিলও হলনা৷ মাত্র ৩ বছর পর আবারও বন্যা এল৷ তবে তত ভয়াবহ নয়৷ উঠানে পানি, ঘরের ভিতরেও পানি ঢুঁকলো আবারও ঘর ছেড়ে অন্যের আশ্রয়ে যেতে হল৷ এবার আর ঘর পড়ে গেলনা৷ কয়েক বছর পরে আমরা বেশ উঁচু ও সুন্দর করে আরও একখানা ঘর তৈরী করলাম৷ মনে হল জীবনে কিছুটা বোধ হয় স্বস্তি এল৷
বিষয়: বিবিধ
১৩৬৬ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনাদের বাড়ি এখন কোথায় আর কারা থাকেন সেখানে .... খুব জানতে ইচ্ছে করছে !
আপনার বর্ণনার ছবিগুলো আমার অতিচেনা, কখনো মুছে যাবার নয়!
কষ্ট ও দুর্গতির হাজারো রকমারী অভিজ্ঞতাই হয়তো মানুষকে কৃতজ্ঞ ও জনহিতৈষী থাকতে প্রেরণা যোগায়!
চাচাজান এত কষ্ট করে আপনাদের জীবন ধারণ! সত্যিই অনেক অসহায় অবস্থায় দিন কাটিয়েছেন, বর্তমানে যারা নদী ভাঙ্গা মানুষ তারাই হয়তো আপনাদের দুঃখগুলো খুবই উপলদ্ধি করতে পারবে।
আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সেই দিনগুলোর পরিবর্তন করেছেন, আলহামদু লিল্লাহ। আজ হয়তো মনে আসলেও তেমন কষ্ট হয় না।
আখিরাতেও মুমিনগণ দুনিয়ার কষ্টের কথা একটুও উপলদ্ধি করতে পারবে না। সুখ দেখে সব দুঃখ ভুলে যাবে।
আপনার অতীত জেনে সত্যিই অনেক কষ্ট পেয়েছি। জাযাকাল্লাহ খাইর
আপনার না বলা কথা আর শৈশব নিয়ে লিখা পড়ার পর থেকেই এমন বিস্তারিত জানার ইচ্ছা ছিল। বই আশা করি। কারন আপনার জিবন এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক দলিল হতে পারে।
আপনার উপদেশ মনে থাকবে৷ আপনাকে ধন্যবাদ৷
আমার নানার পৈতৃক বাড়ি হুগলীর মল্লিক কাসীমের হাটের পাশে৷ ৪৭ এ তাও হিন্দুরা দখল করে নয়৷ রায়টে নানী ও বড়খালা মারা গেলে একা নানা চন্দন নগর আর কলকাতা করে শেষে আমাদের বাড়ি এসেই মারা যান৷ আপনার নানা নানী ও মায়ের জন্য সালাম৷ আপনাকে শুভেচ্ছা৷
জীবনের চলার পথ বড়ই বন্ধুর, মসৃন মোটেও নয়৷ আর আমিতো সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মায়নি তাই জন্ম থেকেই প্রতিকূলতার মধ্যেই বেড়ে উঠেছি৷ কখনও অধৈর্য হইনি৷ মোকাবেলা করেছি৷ আল্লাহ সব বিপদ দূর করেছেন৷ এতার ইচ্ছায় দুনিয়ার দায়িত্ব যথা সম্ভব সমাধা করেছি৷ আশাকরি আখেরাতেও আল্লাহ পার করবেন৷ ধন্যবাদ আপনাকে৷
আমার জীবনটা প্রায় আপনার মতোই হত দরিদ্রতার ভিতর কিন্তু বর্তমানে তেমন না হলেও ২৫টি বছর মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে ঘুরছি স্বস্তির মতো তেমন পরিস্তিতি হয়নি
তারপরও আলহামদুল্লিাহ ভাল
আপনাকে ধন্যবাদ
ব্লগার রহিমকে নিয়ে লিখলাম, এমন জানলে আপনার ইতিহাসই সবার আগে লিখতাম।
কত সংগ্রামী জীবন আপনার!
লেখাটি যখন পড়ছি, কেমন জানি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আপনার অনেক অনেক দোয়া একেবারে দিল থেকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন