%%% সেই দিনটি আজও মনে পড়ে৷ %%%
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২০ মার্চ, ২০১৬, ০১:১০:৩০ রাত
মানুষের জীবন, তা স্বল্প কালের হোক বা দীর্ঘ কালের, প্রকৃতি তার চিরাচরিত নিয়মে কিছু ঘটনা কিংবা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে যায়৷ যার কিছু মানুষের স্মৃতীর পাতায় অম্লান হয়ে থাকে৷ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কারণে মানুষ তাকে রো-মন্থন করে কিংবা তার মনে আচমকাই দোলা দিয়ে আনন্দ অথবা বেদনার কথা মনে করিয়ে যায়৷ কম বেশী সবার জীবনেই এমনটি হয়ে থাকে৷ জ্ঞানীগুণী, কবি-সাহিত্যিকরা মনের মাধুরী মিশিয়ে তা বর্ণনা করে তাকে শ্রুতি মধুর অথবা ভয়ঙ্কর করে তোলেন৷
আমার জীবনেও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে বৈকি! যার মধ্যে কিছু সুখ-স্মৃতি আর কিছু-বেদনা জড়িতও আছে৷ কিন্তু সমস্যা হল তা পেন্সিলে লেখা খাতার পাতার মত ঝাপসা হয়ে গেছে৷ অলস মস্তৃষ্কে তাদেরই একটা ছোট ঘটনা উঁকি ঝুঁকি মারছে৷ তাকেই আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করব৷
তারিখটা মনে নেই৷ আশ্বিন মাসের শেষের দিকে ১৯৮৮ ইং, সালের কোন এক দিন৷ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল৷ মাঝে সাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও পড়ছে৷ রেডিওতে ঘণ ঘণ নিম্নচাপ ও বিপদ সংকেত জানানো হচ্ছে৷ ঘূর্ণীঝড় হতে পারে৷ আমার বাড়ি সমুদ্রের কাছে নয়৷ আর খুলনার দক্ষীনে সাগরকে বলতে হয় সুন্দবন ঘিরে রেখেছে, যেন উঁচু প্রাচীর৷ যার জন্য সমুদ্র হতে সৃষ্ট সাইক্লোনের তেজ সুন্দবনেই শেষ হয়ে যায়৷ উপকূল ছাড়া বড় একটা উত্তরে আসেনা৷ কিন্ত সে বারেরটি পটুয়াখালির দিক দিয়ে উঠে খুলনা হয়ে সুন্দরবন তছনছ করে নেমে গিয়ে ছিল৷
সন্ধ্যার পরই ঝড় ক্রমশঃ বেগবান হতে থাকল৷ আমার বাড়ি শহরের কাছে হলেও তা গ্রামে৷ বিদ্যুৎ, এলাকায় কোন রকম থাকলেও ঝড়ের আগেই তা পালিয়ে যায়৷ আজও তার অন্যথা হয়নি৷ আমাদের বাড়ী মোট পাঁচটা ঘর৷ সব গুলোই মাটির দেওয়াল৷ তিনটা ছাউনি গোল পাতার, যা ঝড়ের সময় উড়িয়ে নেয়ার সম্ভাবনা প্রচুর৷ বাকী দুটির কাঠামো বাঁশের ও ছাউনি টালির৷ তিন ভাইএর সংসার৷ সাথে আব্বা মা৷ সকাল সকাল রাতের খাওয়া সেরে মোটামুটি সবাই সাবধানে যার যার ঘরে ছেলে মেয়ে নিয়ে অবস্থান নিয়েছি৷ তিন ভাইয়ের আট জন ছেলে মেয়ে, দশ বছরের উপরে কেউই নয়৷ বাড়ির ভিতরে এক পাশে আব্বার ছোট্ট একটা দোকান আছে বেশ মজবুত৷ আব্বা রাতে সেখানেই থাকে৷ তার ভিতর থেকে বাইরে কি হচ্ছে তা বোঝা যায় না৷ ইতিমধ্যে ঝড়ের তিব্রতা বেশ বেড়েছে৷ মাঝে মাঝে জোরে দমকাও হচ্ছে৷ রাত নয়টার দিকে মনে হল ঘর আর বাঁচানো যাবেনা৷ চারিদিক দিয়ে ঘরের ভিতর পানির ঝাপটা এসে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে৷ সিদ্ধান্ত নিলাম, এখানে থাকা আর সমীচিন নয়৷ ছোট ভাইকে ডাকদিয়ে বললাম সবাইকে নিয়ে পাশের বাড়ির দালানে চলে যেতে৷ যার দুরত্ব মাত্র ৩০/৩৫ হাত৷ বাইরে কোন রকমে বার হয়ে দেখি উঠান বারান্দা গাছ আর ঝরা পাতায় ভরা৷ ছোট ভাই কাঁথা মুড়িদিয়ে ২/৩ জনকে সাথে নিয়ে বার হল৷ কিন্তু অন্ধকারে আর ভাঙ্গা গাছপালার জন্য পা ফেলার যায়গা নেই৷ আমার হুকুম কেউ পিছনে ফিরবে না৷ যে ভাবেই হোকও ও বাড়ি পৌঁছতে হবে৷
সবাইকে নিরাপদ যায়গায় পার করে আমি, আমার মা আর বড় ভাই আমার ঘরে আদ ভেজা হয়ে তক্তপোষের এক কোনায় বসে দোওয়া দরুদ পড়তে লাগলাম৷ কিছুক্ষন পরই আমরা দেখলাম আমার ঘরের টালির চাল ভেঙ্গে আম গাছের ডাল পালা ভিতরে ঢুঁকে এল৷ ঘরের পিছনে একটা মাঝারী আম গাছ ছিল বুঝলাম ইনি তিনিই৷ যাই হোক এখন আমরা পুরাই ভিজে গেলাম৷ ঘরের ভিতর আর কিছুই শুকনা ছিল না যা ব্যবহার করতে পারি৷
আঃ সালাম নামে একজন আনসার কমাণ্ডার পাড়ায় বাস করত, ঐ দূর্যোগের মধ্যেও প্রতিবেশীর খবর নিয়ে চলেছে৷ ডাক দিল, ‘মেজো ভাই, সবাই ঠিক আছেতো’৷ পরে জেনেছিলাম, অনেককেই সে আশ পাশের দালানে পৌঁছতে সাহায্য করেছে৷ আমার ছোট মেয়েটা তখনও ফিডার খায়৷ খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি শুরু করেছে৷ ও বাড়ি দুধ আছে কিন্তু তা গরম করার কোন সুযোগ নেই৷ অগত্যা দুধের বাটি হারিকেনের মাথায় দিয়ে গরম করে তাকে শান্ত করা হয়েছে৷
সারাটা রাত বিপদের সমুহ সম্ভাবনা নিয়ে সবাই নির্ঘুম বসা৷ ভোরের দিকে ঝড়-বৃষ্টি থামল৷ আলো ফুটলে বাইরে বার হয়ে দেখলাম, উঠানের দক্ষিন পাশের বড় আমড়া গাছটা বিদ্ধস্ত হয়ে সটান শুয়ে আছে৷ পশ্চিম পাশের সীমানার চারটি নারকেল গাছের ডাব, নারকেল, ও পাতা নাই বললেই চলে৷ তারি মাঝে এক লাইনে বিশটি সুপারী গাছে আঠারোটি এলো মেলো দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে৷ পিছনের জামরুল গাছটা হাত দশেক উপর থেকে ভেঙ্গে উপুড় হয়ে পড়ে আছে৷ দু একটা কলা গাছ দাঁড়িয়ে আছে তবে পাতগুলো খেজুর গাছের পাতার মত চেরল চেরল হয়ে গেছে৷ বাকী গুলো লণ্ড ভণ্ড হয়ে গেছে৷ পিছনের আম কাঁঠাল বাতাবী লেবুর গাছ প্রায় সব গুলি পড়ে গেছে৷ ঘরের ভিতরে পড়ার কথা আগেই বলেছি৷ নারকেল গাছগুলি রাস্তার পাশে তাই অল্প কয়েকটা ডাব নারকেল বাদে সব গায়েব হয়েছে৷ সব চাইতে মজার ব্যাপার হল, বিদ্যুৎ লাইন হতে বাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাত সার্ভিস তার যার বাড়ির বাইরের ২০ হাতের মত কে যেন কেটে নিয়ে গেছে৷
পরের ২/৩ দিন লেগেছিল গাছ পালা কেটে বাড়ি পরিষ্কার করতে আর ঘরের চাল মেরামত করতে৷ খুলনা দক্ষিনাঞ্চলে সেবার বহু লোকের প্রাণহানী হয়েছিল আর সাগরের লোনা পানিতে ফষলও নষ্ট হয়েছিল৷ চিংড়ীর ঘের প্রায় সব তলিয়ে গিয়েছিল৷
বিষয়: বিবিধ
১০৭৮ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার স্মৃতি চারণ আমাকেও আজ সিডরের কাছে নিয়ে গেল।
সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ |
১৯৯১ আরো বেশী ভয়াবহ ছিল শুনেছি। তখন আমি দেশের বাহিরে ছিলাম। অনেক দিন টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন