**** মাইকেল এইচ হার্ট এর চোখে বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সঃ৷**** (৫৭০-৬৩২ খ্রিঃ)

লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ১০ মার্চ, ২০১৬, ১০:০০:৫২ রাত

যে মহামানবের সৃষ্টি না হলে এ ভূ-পৃষ্ঠে কোন কিছুই সৃষ্টি হত না, যার পদচারণায় পৃথিবী ধন্য হয়েছে; আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা, অন্তরের পবিত্রতা, আত্মার মহত্ত্ব, ধৈর্য, ক্ষমা, সততা, নম্রতা, বদান্যতা, মিতাচার, আানতদারী, সুরুচিপূর্ণ মনোভাব, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা ও কঠোর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল যার চরিত্রের ভূষণ; যিনি ছিলেন একাধারে ইয়াতীম হিসেবে সবার স্নেহের পাত্র, স্বামী হিসেবে প্রেমময়, পিতা হিসেবে স্নেহের আধার, সঙ্গী হিসেবে বিশ্বস্ত, যিনি ছিলেন সফল ব্যবসায়ী, দূরদর্শী সংষ্কারক, ন্যায় বিচারক, মহত রাজনীতিবীদ এবং সফল রাষ্ট্রনায়ক; তিনি হলেন সর্বকালের সর্বযুগের এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)৷ তিনি এমন এক সময় পৃথিবীর বুকে আবির্ভূত হয়েছিলেন যখন আরবের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংষ্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্ময় অবস্থা অধঃপতনের চরম সীমায় নেমে গিয়েছিল৷

৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগষ্ট মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার প্রত্যুষে আরবের মক্কা নগরীতে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে মাতা আমেনার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তিনি৷ জন্মের ৫ মাস পূর্বে পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন৷ আরবের তৎকালীন অভিজাত পরিবারের প্রথানুযায়ী তাঁর লালন-পালন ও রক্ষাবেক্ষনের দায়িত্ব অর্পিত হয় বণী সাদ গোত্রের বিবি হালিমার উপর৷ এ সময় বিবি হালিমার আর এক পুত্র সন্তান ছিল, যার দুধপানের মুদ্দত তখনো শেষ হয়নি৷ বিবি হালিমা বর্ণনা করেন; “শিশু মোহাম্মদ কেবল মাত্র আমার ডান স্তনের দুধ পান করত৷ আমি তাকে বাম স্তনের দুধ দান করতে চাইলেও, তিনি কখনো বাম স্তন হতে দুধ পান করতেন না৷ আমার বাম স্তনের দুধ তিনি তাঁর অপর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন৷ দুধ পানের শেষ দিবস পর্যন্ত তাঁর এ নিয়ম বিদ্যমান ছিল৷” ইনসাফ ও সাম্যের মহান আদর্শ তিনি শিশুকালেই দেখিয়েছেন৷ মাত্র ৫ বছর তিনি ধাত্রীমা হালিমার তত্বাবধানে ছিলেন৷ এরপর ফিরে আসেন মা আমেনার গৃহে৷ ৬ বছছর বয়সে তিনি মাতা আমিনার সাথে পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা যান এবং মদীনা হতে প্রত্যাবর্তনকালে আবহাওয়া নামক স্থানে মাতা আমেনা ইন্তেকাল করেন৷ এর পর ইয়াতীম মোহাম্মদ (সঃ)এর লালন-পালনের দায়িত্ব অর্পিত হয় ক্রমান্বয়ে দাদা আব্দুল মোত্তালিব ও চাচা আবু তালিবের উপর৷ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ যে মহামানব আবির্ভূত হয়েছেন সারা জাহানের রহমত হিসেবে; তিনি হলেন আজন্ম ইয়াতীম এবং দুঃখ বেদনার মধ্যদিয়েই তিনি গড়ে ওঠেন সত্যবাদী, পরোপকারী এবং আমানতদারী হিসেবে৷ তাঁর চরিত্র, আমানতদারী ও সত্যবাদীতার জন্যে আরবের কাফেররা তাকে ‘আল-আমিন’ অর্থাৎ ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল৷ তৎকালীন আরবে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, হত্যা, যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার৷ ‘হরবে ফুজ্জার’ এর নৃশংসতা বিভিষিকা ও তাণ্ডবলীলা দেখে বালক মোহাম্মদ(সঃ) দারুনভাবে ব্যথিত হন এবং ৫৮৪ খ্রীষ্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সে চাচা হযরত যুবায়ের (রাঃ)ও কয়েকজন যুবককে সাথে নিয়ে অসহায় ও দূর্গত মানুষের সাহায্যার্থে এবং বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠার দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে গড়ে তোলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি সমাজ সেবামূলক সংগঠন৷ বালক মোহাম্মদ (সঃ) ভবিষ্যত জীবনে যে শান্তি স্থাপনের অগ্রদূত হবেন এখানেই তার প্রমান মেলে৷

যুবক মোহাম্মদ (সঃ) এর সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তা, চেতনা, কর্মদক্ষতা ও ন্যায় পরায়নতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন আরবের ধনাঢ্য ও বিধবা মহীলা বিবি খাদিজা বিনতে খুলাইদ বিবাহের প্রস্তাব দেন৷ এ সময় বিবি খাদিজার বয়স ছিল ৪০ বছর এবং হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর বয়স ছিল ২৫ বছর৷ তিনি চাচা আবু তালিবের সম্মতিক্রমে বিবি খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করেন৷ বিবাহের পর বিবি খাদিজা তাঁ ধন-সম্পদ হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর হাতে তুলে দেন৷ কিন্তু তৎকালীন আরবের কাফের, মুশরিক, ইহুদী, নাসারা ও অন্যান্ন ধর্ম মতালম্বীদের অন্যায়, জুলুম, অবিচার, মিথ্যা ও পাপাচার দেখে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর হৃদয় দুঃখ বেদনায় ভরে যেত এবং পৃথিবীতে কি ভাবে ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে চিন্তায় তিনি প্রায়ই মক্কার অনতিদূরে ‘হেরা’ নামক গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন৷ বিবি খাদিজা স্বামীর মহৎ প্রতিভাও মহান ব্যক্তিত্ব উপলব্ধি করতে পেরে হযরত মোহাম্মদ (সঃ)কে নিশ্চিত মনে অবসর সময় ‘হেরা’ পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকার পূর্ণ সুযোগ দিয়েছিলেন৷ ক্রমান্বয়ে তাঁর বয়স যখন ৪০ বছর পূর্ণ হয় তখন তিনি নবুয়ত লাভ করেন এবং তাঁর উপর সর্ব প্রথম নাজিল হয় পবিত্র কোরআনের সুরা আলাকের প্রথম কয়েকটি আয়াত৷ এর পর সুদীর্ঘ ২৩ বছরে বিভিন্ন ঘটনা ও প্রয়োজন অনুসারে তাঁ র উপর পূর্ণ ৩০ পারা কোরআন শরীফ নাজিল হয়৷

নবুয়ত প্রাপ্তির পর প্রথম প্রায় ৩ বছর তিনি গোপনে স্বীয় পরিবার ও আত্মীয়ের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন৷ সর্ব প্রথম ইসলাম কবুল করেন বিবি খাদিজা (রাঃ)৷ এরপর যখন তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং ঘোষণা করেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ তখন মক্কার কুরাইশ কাফেররা তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করে৷ এতদিন বিশ্বনবী (সাঃ) কুরাইশদের নিকট ছিলেন ‘আল আমিন’ হিসেবে পরিচিত; কিন্তু এ ঘোষণা দেয়ার পর তিনি হলেন কুরাইশ কাফেরদের ভাষায় একজন যাদুকর ও পাগল৷ যেহেতু কোরআন আরবী ভাষায় নাজিল হয়েছে এং আরববাসীদের ভাষাও ছিল আরবী, তাই তারা হযরত মোহাম্মদ (সঃ)এর বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিল৷ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, মোহাম্মদ (সঃ) যা প্রচার করছেন তা কোন সাধারণ কথা নয়৷ যদি এটা মেনে নেয়া হয় তাহলে তাদের ক্ষমতার মসনদ টিকে থাকবে না৷ তাই তারা হযরত মোহাম্মদ (সঃ) কে ভয়, ভীতি, হুমকী; এমনকি ধন-দৌলত ও আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী যুবতী নারীদের দেবার লোভ দোতে শুরু করে৷ মোহাম্মদ (সঃ) কাফিরদের শত ষড়যন্ত্র ও ভয়-ভীতির মধ্যেও ঘোষণা করলেন, “আমার ডান হাতে যদি সূর্য আর বাম হাতে চাঁদও দেয়া হয়, তবু আমি সত্য প্রচার হতে বিরত থাকব না৷” কাফিরদের কোন লোভ লালসা বিশ্বনবী (সঃ) কে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত রাখতে পারেনি৷ মক্কায় যারা পৌত্তলিকতা তথা মূর্তী পূঁজা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল কুরাইশরা তাদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে৷ কিন্তু ইসলামের শ্বাসত বাণী যারা একবার গ্রহণ করেছে তাঁদেরকে শত নির্যাতন করেও ইসলাম থেকে পৌত্তলিকতায় ফিরিয়ে নিতে পারেনি৷ ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ (সঃ) এর জীবন সঙ্গিনী বিবি খাদিজা (রাঃ) এবং পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করেন৷ জীবনের এ সংকটময় মুহূর্তে তাঁদেরকে হারিয়ে বিশ্বনবী (সঃ) শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়েন৷ বিবি খাদিজা ছিলেন বিশ্বনবীর দুঃসময়ের স্ত্রী, উপদেষ্ঠা এবং বিপদ আপদে সান্ত্বনা স্বরূপ৷ চাচা আবু তালেব ছিলেন শৈশবের অবলম্বন, যৌবনের অভিভাবক এবং পরবর্তী নবুয়ত জীবনের একনিষ্ঠ সমর্থক৷ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি স্বীয় পালিত পুত্র হযরত যায়েদ বিন হারেসকে সংগে নিয়ে তায়েফ গমন করলে সেখানেও তিনি তায়েফবাসী কর্তৃক নির্যাতিত হন৷ তায়েফবাীা প্রস্তরাঘাতে বিশ্বনবীকে জর্জরিত করে ফেলে৷

অবশেষে ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ২ জুলাই (নুয়তের ত্রয়োদশ বছর) ইতিমধ্যে মদীনায় ইসলামী আন্দোলনের একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল৷ মদীনাবাসীগন মুহাম্মদ (সঃ) এর কা্যপদ্ধতিতে এক বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়৷ এতদিন মক্কায় ইসলাম ছিল কেবলমাত্র একটি ধর্মের নাম; কিন্তু মদীনায় এসে তিনি দৃঢ় ভিত্তির উপর ইসলমী রাষ্ট্র গঠনে আত্মনিয়োগ করেন৷ এতদুদ্দেশ্যে তিনি সেখানে চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলে দেন৷ সে সময় মদীনায় পৌত্তলিক ও ইহুদীরা বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল৷ মুহম্মদ (সঃ) মনেপ্রাণে অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, যেখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের বাস সেখানে সকল সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগীা না পেলে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি দূর্বল হয়ে পড়বে৷ তাই তিনি সেখানে সকল সম্প্রদায়ের লোকদের নিয়ে একটি সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি আন্তর্জাতিক সনদপত্রও স্বাক্ষরিত হয়, যা ইসলামের ইতিহাসে, ‘মদীনা সনদ’ নামে পরিচিত৷ পৃথিবীর ইতিহাসে এটাই ছিল প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র বা সংবিধান৷ উক্ত সংবিধানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, জান,মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা ঘোষণা করা হয়৷ মুহাম্মদ (সঃ) হন ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সভাপতি৷ তিনি যে একজন দূরদর্শী ও সফল রাজনীতিবীদ এখানেই তার প্রমান পাওয়া যায়৷ মদীনা সনদ নাগরিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থাপিত হয় ঐক্য৷

বিশ্বনবী (সঃ) তলোয়ারের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেননি বরং উদারতার মাধ্যমেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ তাঁর ও নবদিক্ষিত মুসলমানগনের (সাহাবায়ে কেরাম) চালচলন, কথাবার্তা, সততা ও উদারতায় মুগ্ধ হয়ে যখন দলে দলে লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল তখন কুরাইশ নেতাদের মনে হিংসা ও শত্রুতার উদ্রেক হয়৷ অপরদিকে মদীনার কতিপয় বিশ্বাসঘাতক মুহম্মদের (সঃ)এর প্রাধান্য সহ্য করতে না পেরে গোপনভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের ষড়যন্ত্র করতে থাকে৷ কাফেরদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার জন্যেই মুহম্মদ (সঃ) তলোয়ার ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন৷ ফলে ঐতিহাসিক বদর, উহুদ ও খন্দক সহ অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়, এবং সকল যুদ্ধের প্রায় সবগুলোতেই মুসলমানগণ জয়লাভ করেন৷ বিশ্বনবী (সঃ) মোট ২৭টি যুদ্ধে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালণ করেছিলেন৷ ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ষষ্ঠ হিজরীতে ১৪০০ নিরস্ত্র সাহাবী সঙ্গে নিয়ে মুহম্মদ (সঃ) মাতৃভূমী দর্শণ ও পবিত্র হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কা রওয়ানা দেন৷ কিন্তু পথিমধ্যে কুরাইশ বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যা ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে পরিচিত৷

সন্ধির শর্তাবলীর মধ্যে এ কথাগুলো ও উল্লেখ ছিল যে-(১) মুসলমানগণ এ বছর ওমরা আদায় না করে ফিরে যাবে৷ (২) আগামী বছর হজ্জে আগমন করবে, তবে ৩ দিনের বেশী মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না, (৩) যদি কোন কাফির স্বীয় অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত মুসলমান হয়ে মদীনায় গমন করে তাহলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দিতে হবে৷ পক্ষান্তরে মদীনা হতে যদি কোন ব্যক্তি পলায়ণ পূর্বক মক্কায় চলে আসে তা হলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না, (৪) প্রথম থেকে যেসব মুসলমান মক্কায় বসবাস করছে তাদের কাউকে সথে করে মদীনায় নিয়ে যাওয়া যাবেনা৷ আর মুসলমানগনের মধ্যে যারা মক্কায় থাকতে চায় তাদেরকে বিরত রাখা যাবে না৷ (৫)আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলির এ স্বাধীনতা থাকবে যে, তারা উভয় পক্ষের (মুসলমান ও কাফির) মাঝে যাদের সাথে ইচ্ছে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে, (৬) সন্ধিচুক্তির মেয়াদের মধ্যে উভয় পক্ষ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে যাতায়াতের সম্পর্ক চালু রাখতে পারবে৷ এ ছাড়া কুরাইশ প্রতিনীধি সুহাইল বিন আমর সন্ধিপত্র থেকে ‘বিসমিল্লাহির রহমানের রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বাক্যদুটি কেটে দেবার জন্য দাবী করেছিল৷ কিন্তু সন্ধিপত্রের লেখক হযরত আলী (রাঃ) তা মেনে নিতে রাজি হলেন না৷ অবশেষে বিশ্বনবী(সঃ) সুহাইল বিন আমরের আপত্তির প্রেক্ষিতে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ এবং ‘মুহাম্মদুর রাসুলাল্ল্লাহ’ বাক্য দুটি নিজ হাতে কেটে দেন এবং এর পরিবর্তে সুহাইল বিন আমরের দাবী অনুযায়ী ‘বিসমিকা’ অপমানজনক হলেও তা মুহাম্মদ(সঃ) কে অনেক সুোগ সুবিধা ও সাফল্য এনে দিয়েছিল৷

এ সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা মুহাম্মদ (সঃ) এর রাজনৈতিক সত্তাকে একটি স্বধীন সত্তা হিসেবে স্বীকার করে নেয়৷ সন্ধির শর্তানুযায়ী অমুসলীমগণ মুসলমানদের সাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ পায়৷ ফলে অমুসলীমগণ ইসলামের মহৎ বাণী উপলব্ধি করতে থাকে এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে৷ এ সন্ধির পরই মুহাম্মদ (সঃ) বিভিন্ন রাজন্যবর্গের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং অনেকেই ইসলাম গগ্রহণ করেন৷ মুহাম্মদ (সঃ) যেখানে মাত্র ১৪০০ মুসলীম সৈন্য নিয়ে হুদায়বিয়াতে গিয়েছিলেন, সেখানে মাত্র ২ বছর অর্থাৎ অষ্টম হিজরীতে ১০,০০০ মুসলীম সৈন্য নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন৷ যে মক্কা থেকে বিশ্ব নবী (সঃ) নির্যাতিত অবস্থায় বিতাড়িত হয়েছিলেন, সেখানে আজ তিনি বিজয়ীর বেশে উপস্থিত হলেন এবং মক্কাবাসীদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন৷ মক্কা বিজয়ের দিন হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানকে গ্রেফতার করে মুহাম্মদ (সঃ) এর সম্মুখে উপস্থিত করেন৷ কিন্তু তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রুকে হাতে পেয়েও ক্ষমা করে দেন৷ ক্ষমর এ মহান অদর্শ পৃথিবীর ইতিহাসে আজও বিরল৷ মক্কায় আজ ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডিয়মান৷ সকল অন্যায়, অসত্য, শোষণ ও জুলুমের রাজত্ব চিরতরে বিলুপ্ত৷ ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক দশম হিজরীতে মুহাম্মদ (সঃ)লক্ষ্যাধিক মুসলীম সৈন্য নিয়ে বিদায় হজ্জ্ব সম্পাদন করেন এবং হজ্জ্ব শেষে আরাফাতের বিশাল ময়দানে প্রায় ১,১৪,০০০ সাহাবীর সম্মুখে জীবনের অন্তিম ভাষণ প্রদান করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ’ নামে পরিচিত৷ বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে বিশ্বনবী (সঃ) মানবাধিকার সম্পর্কিত যে সনদপত্র ঘোষণা করেন দুনিয়ার ইতিহাসে তা আজও অতুলনীয়৷ তিনি দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, (১)হে বন্ধুগণ, স্মরণ রেখ, আজিকার এ দিন, এ মাস এবং এ পবিত্র নগরী তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র, তমনি পবিত্র তোমাদের সকলের জীবন, তোমাদের ধন-সম্পদ, রক্ত এবং তোমাদের মান-মর্যাদা তোমাদের পরষ্পরের নিকট৷ কখনও অন্যের উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না৷ (২) নে রেখ, স্ত্রীদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার আছে, তোমাদের উপরও স্ত্রীদের তেমন অধিকার আছে৷ (৩) সাবধান, শ্রমিকের ঘাম শুকাবার পুর্বেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরশোধ করে দিবে৷ (৪) মনে রেখ, যে পেটভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্থ থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতে পারে না৷ (৫) চাকর চাকরাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর হইও না৷ তোমরা যা খাবে, তাদেরকে তাই খেতে দিবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকে তাই (সমমূল্যের) পরধান করতে দিবে৷ (৬) কোন অবস্থাতেই ইয়াতীমের সম্পদ আত্মস্যাত করবে না৷ এমনই ভাবে মানবাধিকার সম্পর্কিত বহু বাণী তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে পেশ করে যান৷ তিনি হলেন উত্তম চরিত্রের অধিকারী, মানবজাতির একমাত্র আদর্শ এবং বিশ্বজাহানের রহমত হিসেবে প্রেরিত৷

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর নবুয়তের ২৩ বছরের আন্দোলনে আরবের একটি অসভ্য ও বর্বর জাতিকে একটি সভ্য ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিলেন৷ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংষ্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমূল সংষ্কার সাধিত হয়৷ রাজনৈতিক ক্ষেত্র চিরাচরিত গোত্রীয় পার্থক্য তুলেদিয়ে তিনি ঘোষণা করেন ‘অনারবের উপর আরবের এবং আরবের উপর অনারবের, কৃষ্ণাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের এবং শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন পার্থক্য নেই৷ বরং তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি উত্তম যে অধিক মুত্তাকীন৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি সূদকে সম্পূর্ণ ভভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং জাকাত ভিত্তিক অর্থনৈতির মাধ্যমে এমন একটি অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক তাদের আর্থিক নিরাপত্তা লাভ করেছিল৷ সামজিক ক্ষেত্রে নারীর কোন মর্যাদা ও অধিকার ছিল না৷ বিশ্বনবী (সঃ) নারীজাতিকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং ঘোষণা করলেন ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশ্ত’৷ নারীজাতিকে শুধুমাত্র মাতৃত্বের মর্যাদাই দেননি, উত্তরাধিকার ক্ষেত্রেও তাদের অধিকারকে করেছেন সমন্নত ও সু প্রতিষ্ঠিত৷ ক্রীতদাস আযাদ করাকে তিনি উত্তম ইবাদত বলে ঘোষণা ককরেন৷ ধর্মীয় ক্ষেত্রে যেখানে মূর্তীপূজা, অগ্নিপূজা এবং বিভিন্ন বস্তুর পূজা আরববাসীদের জীবনকে কলুষিত করেছিল সেখানে তিনি আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেন৷ মুদ্দা কথা তিনি এমন একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে কোন হানিহানি, রাহাজানি, বিশৃঙ্খলা, শোষণ, জুলুম, অবিচার, ব্যভিচার, সূদ ঘুষ ইত্যাদী ছিল না৷

অবশেষে এ মহামানব ১২ রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরী মোতাবেক ৭ জুন ৬৩২ খ্রীঃ ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন৷ তিনি হলেন সর্বশেষ নবী ও রাসুল৷ পৃথিবীর বুকে কেয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবীর আবির্ভাব হবে না বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) গোটা মুসলীম জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছেন, ‘আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিষ রেখে গেলাম৷ যতদিন তোমরা এ দুটি জিনিষকে আঁকড়ে রাখবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ঠ হবে না৷ একটি হল আল্লাহর কিতাব অর্থাৎ কোরআন আর অপরটি হল আমার সুন্নাহ অর্থাৎ হাদিস৷’ বিশ্বনবী (সঃ) এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর বলেছেন “He was the mater mind not only of his own age but of all ages” অর্থাৎ মুহাম্মদ (সঃ) যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না, বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের, সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ মনীষী৷ শুধুমাত্র উইলিয়াম মূরই নন, পৃথিবীর বুকে যত মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান বাণী পৃথিবীর বুকে রেখে গেছেন৷ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্যে আল্লাহর রসুল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’৷ (সুরা-আহযাব, আয়াত ২১)

বর্তমান অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও দ্বন্দ মূখর আধুনিক বিশ্বে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আদর্শকে অনুসরণ করা হলে বিশ্বে শান্তি ও একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে সম্ভব৷


(মাইকেল এইচ হার্ট এর ‘দি হাণ্ড্রেড’ গ্রন্থ থেকে লেখাটি হুবহু তুলে দেওয়া হল৷ যে গ্রন্থে লেখক মানব সভ্যতার একশতজন মনীষীর সংক্ষীপ্ত জীবনী তুলে ধরেছেন ও তাঁদের মধ্যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এক নম্বরে স্থান দিয়েছেন৷)

বিষয়: বিবিধ

১৮৩৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

362129
১০ মার্চ ২০১৬ রাত ১০:৪২
আফরা লিখেছেন : উত্তম শেয়ার !! জাজাকাল্লাহ খায়ের চাচাজান ।
১১ মার্চ ২০১৬ রাত ১২:৩৯
300117
শেখের পোলা লিখেছেন : শুভেচ্ছা নিও আম্মাজান৷
362131
১০ মার্চ ২০১৬ রাত ১০:৪৭
গাজী সালাউদ্দিন লিখেছেন :
বর্তমান অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও দ্বন্দ মূখর আধুনিক বিশ্বে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর আদর্শকে অনুসরণ করা হলে বিশ্বে শান্তি ও একটি অপরাধমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে সম্ভব৷


সহমত
১১ মার্চ ২০১৬ রাত ১২:৪২
300118
শেখের পোলা লিখেছেন : গাজী ভাই, কথাটা আমার নয়,এটি অমুসলীম এক বিখ্যাত লেখকের কথা৷ অথচ আমরা মুসলীম হয়েও এমন কথায় আস্থা রাখতে পারিনা৷ এটা আমাদের লজ্জ্বা৷আপনাকে ধন্যবাদ৷
362144
১১ মার্চ ২০১৬ রাত ০৩:২৩
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam. Excellent sharing mashallah.
১১ মার্চ ২০১৬ রাত ০৩:৩২
300122
শেখের পোলা লিখেছেন : অ আলাইকুমুস সালাম৷ আপনাকে ধন্যবাদ৷
362174
১১ মার্চ ২০১৬ বিকাল ০৪:৫৪
বিবর্ন সন্ধা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম

(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)

আমরা নামে মুসলিম বলে ই
আমাদের আজ এই দুরদশা Broken Heart
১১ মার্চ ২০১৬ সন্ধ্যা ০৭:৩৮
300152
শেখের পোলা লিখেছেন : একজন অমুসলীম নবীকে যতটা চিনেছে আমরা মুসলীম হয়েও ততটা চিনিনা৷ আমরা হলাম গরু খাওয়া মুসলীম৷ এবার সেটাও বন্ধ হবে৷ ধন্যবাদ৷
362186
১১ মার্চ ২০১৬ রাত ০৮:১৬
মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম লিখেছেন : সীরাত চর্চা চলুক-শেয়ারিংএও, আগে পড়েছিলাম-আবার ও চোখ বুলিয়ে নিলাম।ধন্যবাদ।
১১ মার্চ ২০১৬ রাত ০৮:৪৫
300156
শেখের পোলা লিখেছেন : একজন অমুসলীমের চোখে বিশ্বনবী৷ একটু গর্বের বিষয় নয়কি? ধন্যবাদ৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File