"অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামত ও কুদরত অস্বীকার করবে?"
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ১৯ এপ্রিল, ২০১৫, ০৭:০১:১৬ সকাল
( উর্দু বয়ানুল কোরআনের বাংলা অনুবাদ)
(৫৫) সুরা আর রহমান (মক্কী) রুকু ৩টি ও আয়াত ৭৮টি
সপ্তম গ্রুপের ষষ্ঠ মক্কী সুরা এটি৷ পরের সুরা ‘ওয়াকেয়ার’ সাথে এর এমন মিল যেমন আয়নার ভিতর বার, সেই সূত্রে এরা পরষ্পর জোড়া৷ সুরা ‘রহমানে’ রয়েছে কোরআনের আজমত, মানুষের উপর কোরআনের দাবী, আল্লাহর নেয়ামতের প্রকাশ, জাহান্নাম ও পরে জান্নাতের কথা৷ আর সুরা ‘ওয়াকেয়ায়’ আছে দুই দল কামিয়াব মানুষের কথা৷ তারপর জাহান্নাম ও আল্লাহর আজমতের বয়ান ও কোরআনের হক আদায় না করার পরিনাম৷
যেহেতু ওহীর ধারক রূহ, আর তা দেওয়া হয়েছিল আদম আঃ কে৷ অপর দিকে জ্বীনদের ইমান, ইনকারের স্বাধীনতা মানুষের মত থাকলেও তাদের মাঝে ওহী, কিতাব, নবী রসুল আসেননি৷ কেননা তাদের রূহ দেওয়া হয়নি৷ মানুষের জন্য প্রেরীত ওহী, কিতাব, নবী, রসুল একাধারে তাদের জন্যও৷ যার প্রমান আমরা পেয়েছি, রসুল সঃ এর কোরআন পাঠ শুনে একদল জ্বীন যারা হজরত মুসা আঃ এর অনুসারী ছিল, নিজ কওমে গিয়ে তবলীগ শুরু করেছিল৷ এ জোড়া সুরায় ইনসানের সমান্তরালে জ্বীনদেরও আলাদা ভাবে দ্বিবচণ ব্যবহার করে শামিল করা হয়েছে৷ যদিও অন্যত্র ‘ইয়া আইয়ুহান্নাস’ বলা হলেও একই সাথে জ্বীনরাও সে আহবানে শামিল হয়ে যায়৷
এ সুরায় রয়েছে তিনটি রুকু ও আটাত্তরটি আয়াত৷ সুরা ‘শো-য়ারায়’ একই আয়াত আটবার ব্যবহার হয়েছে, সুরা ‘ক্বামার’ এ একই আয়াত চার বার ব্যবহার হয়েছে, আর এ সুরায় একই আয়াত একত্রিশ বার ব্যবহার হয়েছে৷
সুরা আর রহমান রুকু;-১ আয়াত;-১-২৫
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
১/الرَّحْمَنُ
অর্থ;-করুনাময়,
# এটি একটি আয়াত, কিন্তু বাক্য নয়৷ আল্লাহর নামগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাম ‘রহমান’৷ যিনি রহমত বা করুনার আধার, সে করুনা যেন তেন নয়, উত্তাল সমুদ্রের ন্যায়৷ যার রহমত তার সৃষ্ট জীবের জন্য একান্ত প্রয়োজন৷ মানুষের চুড়ান্ত গন্তব্য জান্নাত, কিন্তু আপন আমলের দ্বারায়ও কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না, যদি আল্লাহ করুনা না করেন৷ (আল হাদিশ) হজরত আয়েশা রাঃ রসুল সঃ এর কাছে জানতে চাইলেন, রসুলের ব্যাপারেও এটা প্রযোজ্য কিনা৷ উত্তরে রসুল সঃ জানালেন, হাঁ, তিনিও আল্লাহর রহমত ছাড়া জান্নাতে যেতে পারবেন না৷ পরের আয়াতে বাক্যটি পুরা হয়েছে.
২/عَلَّمَ الْقُرْآنَ
অর্থ;-‘কোরআন’ শিক্ষা দিয়েছেন৷
# করুনাময় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ‘কোরআন’ শিক্ষা দিয়েছেন৷ যে কোরআন সম্পর্কে হজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান, যাঁর নামটিও এ কাফিয়ায় (ছন্দে) পড়ে, ‘রহমান’ ‘কোরআন’ ‘ইনসান, ‘বয়ান’, একটি হাদিশ বর্ণনা করেছেন, ‘খাইরুকুম মান তায়াল্লামাল কুরআনা অ আল্লামা হু, তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি যিনি কোরআন শিক্ষা করেন ও শিক্ষা দেন৷
৩/خَلَقَ الْإِنسَانَ
অর্থ;-মানুষ সৃষ্টি করেছেন৷
# আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানুষই শ্রেষ্ঠ, যার মাঝে আল্লাহ নিজের রুহ সংযোজন করে দিয়েছেন ফলে আলমে ‘আরওয়াহ’ও আলমে ‘খালক’ এখানে এক হয়ে গেছে৷ আল্লাহ বলেন যে, মানুষকে তিনি নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন৷
৪/عَلَّمَهُ الْبَيَانَ
অর্থ;-তাকে কথন শিক্ষা দিয়েছেন৷
# চারটি আয়াতে চারটি শ্রেষ্ঠত্বের কথা এসেছে৷ চতুর্থটি, শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের শ্রেষ্ঠ গুন বয়ান বা কথন৷ সব সৃষ্টির মাঝেই কিছু গুন আছে৷ মানুষের গুন বা বৈশিষ্টের মত অনেক বৈশিষ্ট জীব জগতেও দেওয়া হয়েছে৷ কোন কোন ক্ষেত্রে পশুরা মানুষের চাইতে এগিয়ে রয়েছে, যেমন, শ্রবন শক্তিতে ঘোড়া, শোঁকার বা ঘ্রাণ শক্তিতে কুকুর, দৃষ্টি শক্তিতে পেঁচা সহ অনেকেই আছে যারা অন্ধকারে দেখতে পায়৷ কিন্তু বয়ানে মানুষ শ্রেষ্ঠ৷ মানুষ শোনে বা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করে, ব্রেণের প্রসেসিং সেন্টারে প্রসেসিং করে ফলাফল ঠিক করে ও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়৷ যা আর কোন সৃ্ষ্টি পারেনা৷
চারটি আয়াতে তিনটি বাক্য গঠণ হয়েছে৷ অংক শাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী চতুর্থটি বার করতে হবে৷ চতুর্থটি হল; শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কোরআন আয়ত্ব করে অন্যের কাছে বয়াণ করা৷
৫/الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ
অর্থ;-চন্দ্র ও সূর্য হিসাব মত আবর্তন করে৷
# সৌর জগতের একটি বিধিবদ্ধ নিয়ম রয়েছে, যে নিয়ম অনুযায়ী সকলেই চলে৷ চাঁদ সূর্যও সেই নিয়মেই চলে, যার ফলে হয় সকাল বিকাল, দিন রাত, সপ্তাহ, মাস, বৎসর৷
৬/وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ
অর্থ;-আর তৃণ লতা ও বৃক্ষাদি সেজদাহরত আছে৷
৭/وَالسَّمَاء رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيزَانَ
অর্থ;-তিনি আসমানকে সু উচ্চ করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন৷
৮/أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ
অর্থ;-যাতে তোমরা ভারসাম্যে তারতম্য না কর৷
# আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মাঝে এক অদৃশ্য ভারসাম্য সৃষ্টি করেছেন, যা প্রত্যেক এক নির্দিষ্ট আকর্ষণে যার অবস্থানে রয়েছে৷ কোন কারণে এ ভারসাম্যে তারতম্য হলে আকর্ষণ ছিন্ন হয়ে সব চুরমার হয়ে যাবে৷
৯/وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ
অর্থ;-তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম কর এবং ওজনে কম করোনা
১০/وَالْأَرْضَ وَضَعَهَا لِلْأَنَامِ
অর্থ;-তিনি সৃষ্টি জীবের জন্য পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন৷
১১/فِيهَا فَاكِهَةٌ وَالنَّخْلُ ذَاتُ الْأَكْمَامِ
অর্থ;-এতে আছে ফল মূল এবং খোসাযুক্ত খেজুরের গাছ৷
১২/وَالْحَبُّ ذُو الْعَصْفِ وَالرَّيْحَانُ
অর্থ;-এবং খোসা বিশিষ্ট শস্যদানা এবং সুগন্ধি ফুল৷
১৩/فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
অর্থ;-অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামত ও কুদরত অস্বীকার করবে৷
# উভয় বলতে এখানে জ্বীন এবং ইনসান বোঝানো হয়েছে৷৷
১৪/خَلَقَ الْإِنسَانَ مِن صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ
অর্থ;-তিনি মানুষকে পোড়া মাটির পাত্রের ন্যায় শুকনো মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন৷
১৫/وَخَلَقَ الْجَانَّ مِن مَّارِجٍ مِّن نَّارٍ
অর্থ;-এবং জ্বীনে সৃষ্টি করেছেন আগুনের শিখা থেকে৷৷
# আগুন দেখা যায় কিন্তু আগুনের শিখার পরে কিছু অংশ দেখা যায়না অথচ সেখানে তাপ থাকে, আগুনের সেই অংশ থেকেই জ্বীনের সৃষ্টি৷
১৬/فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
অর্থ;-অতএব, তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন অনুগ্রহ ও দক্ষতাকে অস্বীকার করবে!
১৭/رَبُّ الْمَشْرِقَيْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَيْنِ
অর্থ;-তিনি দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচলের মালিক৷
# পৃথিবীর এক প্রান্তে যখন সূর্য উদয় হয় অন্য প্রান্তে তখন অস্ত যায়৷ আবার অস্ত যাওয়া প্রান্তে যখন উদয় হয়, উদয় প্রান্তে তখন অস্ত যায়৷ এই অর্থে একই প্রান্ত দুই অবস্থার মালিক৷ আর তাতেই দুই উদয়াচল ও দুই অস্তাচল হয়৷ আবার বলা যায় পৃথিবীর প্রতিটি অংশেই দুই অবস্থার সৃষ্টি হয়৷
১৮/فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
অর্থ;-অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন কোন অনুগ্রহ ও দক্ষতাকে অস্বীকার করবে৷
১৯/مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِيَانِ
অর্থ;-তিনি পাশা পাশি দুই দরিয়াকে প্রবাহিত করেছেন৷
২০/بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لَّا يَبْغِيَانِ
অর্থ;-উভয়ের মাঝে রয়েছে এক পর্দা, যা তারা অতিক্রম করেনা৷
২১/فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
অর্থ;-অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন কোন অনুগ্রহ ও দক্ষতাকে অস্বীকার করবে৷
২২/يَخْرُجُ مِنْهُمَا اللُّؤْلُؤُ وَالْمَرْجَانُ
অর্থ;-উভয় দরিয়া থেকেই মোতি ও প্রবাল উৎপন্ন হয়৷
২৩/فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
অর্থ;-অতএব, তোরা ঊভয়ে তোমাদের রবের কোন কোন অনুগ্রহ ও দক্ষতাকে অস্বীকার করবে৷
২৪/وَلَهُ الْجَوَارِ الْمُنشَآتُ فِي الْبَحْرِ كَالْأَعْلَامِ
অর্থ;-দরিয়ায় বিচরণশীল পর্বত সদৃশ জাহাজ সমুহ তাঁরই আওতাধীন৷
২৫/فَبِأَيِّ آلَاء رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
অর্থ;-অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন কোন অনুগ্রহ ও দক্ষতা অস্বীকার করবে৷
বিষয়: বিবিধ
২০৫৮ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুরা আর-রাহমান এবং ওয়াকিয়াহ, এই দুইটি সুরা মধ্যে যে সম্পর্ক তা শুনেছিলাম ওস্তাদ নুমান আলী খানের একটি লেকচার থেকে। আপনার কাছথেকেও জানতে পারলাম। ধন্যবাদ আপনাকে ।
অসংখ্য অগনিত নিয়ামতে আমরা ডুবে আছি , আল্লাহ আমাদের শোকরগুজার বান্দাবান্দীর মধ্যে শামিল করুন!
আল্লাহুম্মা আইন্নি আলা যিকরিকা ,ওয়া শুকরিকা, ওয়া হুসনে ইবাদাতিক -হে আল্লাহ ! তোমার যিকির , তোমার শুকরিয়া জ্ঞাপন করার এবং তোমার ইবাদত সঠিক ও সুন্দর ভাবে সমাধা করার কাজে সহায়তা কর!
জাযাকাল্লাহু খাইর!
আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন দুনিয়া ও আখিরাতে । আমীন
মন্তব্য করতে লগইন করুন