"হে মুমিনগন, তোমরা তা কেন বল যা কর না"
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২২ মার্চ, ২০১৫, ১০:৫৬:৪৪ রাত
(মরহুম জনাব ইসরার আহমদ সাহেবের উর্বদূ বয়ানুল কোরআনের বাংলা অনুবাদ)
(৬১) সুরা আস সফ (মাদানী) রুকু ২টি আয়াত ১৪টি
ষষ্ঠ গ্রুপের মাদানী সুরা অংশের পঞ্চম ও মধ্যের মুসাব্বেহাত জোড়ার প্রথম সুরা, সুরা ‘আস সফ৷’ শুরু হয়েছা ‘সাব্বাহা’ দিয়ে, জোড়ার অপর সুরা ‘জুমআ’ শুরু হবে ‘ইসাব্বেহু’ দিয়ে৷ উভয়ে মিলিত হয়ে, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় সৃষ্টি তার স্রষ্টার অনবরত পবিত্রতা বা তাসবীহ পাঠের সংবাদ দিচ্ছে৷
সুরা ‘হাদীদের’ ২৫ আয়াতে খোলাখুলি ভাবে দ্বীনের চাহিদা, তাৎপর্য, নবী রসুল গণের আগমনের হেতু ও লৌহ পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা এবং তারই মাধ্যমে দ্বীনের প্রকৃত খাদেম চিহ্নিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে৷
আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ পাঠিয়েছেন, অন্যের ইচ্ছা, অধিকারকে দাবিয়ে রেখে নিজের ইচ্ছা, অধিকারকে অন্যের উপর চাপিয়ে আধিপত্ত বিস্তারের প্রবল ইচ্ছা যেমন দিয়েছেন, অপর দিকে তেমনই খলিফা হিসাবে আল্লাহ ইচ্ছা আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার মনোভাবও দিয়েছেন ও তাদের সাহায্য করার জন্য যুগে যুগে নবী রসুল, মিজান, কিতাব দিয়ে বহু নবী রসুলও পাঠিয়েছেন৷ সংগ্রাম চলেছে আদল ইনসাফ প্রতিষ্ঠার, স্বাধিনতার৷ কিন্তু আল্লাহর দল শয়তানের দলের উপর সার্বিক সাফল্য আনতে ব্যর্থই হয়েছে, কোন নবী পূঁজার ঘরে স্থান পেয়েছেন, কেউবা পূজনীয় হয়েছেন আল্লাহর পুত্র রূপে৷ ব্যাতিক্রম শুধু নবী মোহাম্মদ সঃ৷
সৃষ্টি হয়েছে, সামন্ত তন্ত্র, রাজতন্ত্র, জমিদার তন্ত্র নামের এক নায়ক তন্ত্র৷ শ্রমিক মজুরের রক্তে গড়ে উঠেছে জালিমের বালাখানা, বাইজী খানা, শরাবের আসর৷ সংগ্রাম থেমে থাকেনি৷ শাসক বদল হলেও শোষণ থামেনি, ইনসাফ কায়েম হয়নি৷ এক নায়ক তন্ত্র থেকে এসেছে এক দলীয়, সামজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, গনতন্ত্র৷
প্রত্যেক নবী রসুল আঃ কে আল্লাহ বশির, নজির, করে সঙ্গে দিয়েছিলেন কিতাব, মিজান ও মোজেজা৷ মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সঃ কে দিলেন, এত সবের সমাহার আলহুদা, আল কোরআন৷ উদ্দেশ্য একই, মিজান বা আদল ইনসাফ প্রতিষ্ঠা৷ একার পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়৷ একা মোকাবেলায় নামা আত্মহত্যার সমান৷ বারোটি বৎসর ব্যয় হল সমমনা অনুগত একটি জমাত গঠনে৷ অত্যাচার, উৎপীড়ণে জীবন বাজী ধরেও তারা প্রশিক্ষণে পাশ করলেন৷ জীবন দিয়েছেন, প্রতিবাদ প্রতিরোধ নিষেধ, অন্যথা হয়নি৷ অথচ সামান্য একটা বিড়ালও আত্মরক্ষায় মানুষের প্রতি থাবা বাড়ায়৷ একান্ত অনুগত এই মানুষেরাই আল্লাহ অনুমতি ক্রমে লোহার শক্তি হাতে নিয়ে (সুরা আল হাদীদ ২৫) পরের ১৩ বৎসরে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলেন আদল ও ইনসাফ কি৷
এ সুরায় দুইটি রুকু ও ১৪টি আয়াত আছে৷ প্রথম চারটি আয়াতে আছে তামহিদী কালাম বা বিষয় বস্তু৷ পরের চারটি ইহুদী নাসারাদের সংক্ষিপ্ত বয়ান৷ তৃতীয় চারটিতে আছে রসুল সঃ এর আগমনের উদ্দেশ্য ও বাকী দুটি আয়াতে পাওয়া যাবে যারা এ সুরার আহবানে ‘লাব্বায়েক’ বলবে বা ময়দানে হাজির হবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের পুরষ্কার৷ নবম আয়াতটির বিষয় বস্তুই এ সুরার মূল বিষয়৷
সুরা আস সফ রুকু;- ১ আয়াত;-১-৯
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
১/سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
অর্থ;-নভো মণ্ডলে যাকিছু আছে ও ভূমণ্ডলে যাকিছু আছে তা সবই আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে৷ তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাবান৷
২/يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ
অর্থ;-হে মুমিন গন তোমরা তা কেন বল যা করোনা?
# এটা মুমিনদের ঝাঁকি দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া যে তারা মুখে অনেক কিছুই করে ফেলে যা বাস্তবে তারা করেনা৷ তোমরা নিজেদের মুমিন বলে পরিচয় দাও কিন্ত তোমাদের কর্মে, তোমাদের চরিত্রে তার নমুনা নেই৷ তোমরা আল্লাহর বিধান বাদ দিয়ে বিধর্মীদের বানানো আইনে চলো, নিজেরা আইন বানিয়ে শুধু শির্ক নয়, খোদার কাজ হাতে নেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়ে, পারত পক্ষে খোদায়ী দাবী করছ!
৩/كَبُرَ مَقْتًا عِندَ اللَّهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ
অর্থ;-তোমরা যা করোনা তা বলা আল্লাহর কাছে অতিশয় অসন্তোষজনক৷
# বিশ্বাস করা, মুখে বলা আর বাস্তবে তা না করা আল্লাহর কাছে গর্হীত অপরাধ৷ পরের আয়াতে কারা তার প্রীয় তা বলা হয়েছে৷
৪/إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُم بُنيَانٌ مَّرْصُوصٌ
অর্থ;-নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভাল বাসেন, যারা তাঁর পথে যুদ্ধ করে সারিবদ্ধ ভাবে, যেন তারা সীসা ঢালা সুদৃঢ় প্রাচীর৷
# আসন্ন মৃত্যুকে পরওয়া নাকরে যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সীসা ঢালা নিশ্ছিদ্র প্রাচীরের ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাতীলের বিরুদ্ধে লড়াই করে, আল্লাহ তাদেরই পছন্দ করেন৷ দুঃখের বিষয় আমরা হজ্জ ওমরাহ, ইজ্তেমা, মাহফীল, জিকিরের জন্য একাত্ম তে পারি, বাতীলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নয়৷ এ সারিবদ্ধতাকে ইমাম সাহেবরা নামাজের কাতারে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন, যুদ্ধের ময়দানে নয়। কোন কোন জমাত একে পায়ে নামিয়ে নামাজে তা এত প্রারিত করেন যে অন্যের অসুবিধাই সৃষ্টি করে৷
৫/وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ لِمَ تُؤْذُونَنِي وَقَد تَّعْلَمُونَ أَنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
অর্থ;-মুসা (আঃ) যখন তাঁর সম্পদায়কে বললেন, হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা কেন আমাকে কষ্ট দাও, অথচ তোমরা জান যে আমি তোমাবের কাছে আল্লাহর নবী৷ অতঃপর তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে আরও বক্র করে দিলেন৷ আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শণ করেন না৷
# হজরত মুসা আঃ বণী ইস্রাঈলের জন্য নবী ছিলেন, তাই বক্রতা অবলম্বন করেও বণী ইস্রাঈল ধ্বংসের শাস্তি পায়নি৷ আর তিনি ফেরাউন সম্পদায়ের জন্য ছিলেন রসুল, তাই তারা বক্রতা অবলম্বন করে ধ্বংস হয়েছে৷ এ আয়াতে রসুল নবী অর্থে এসেছে৷ প্রায়ই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে অন্ধ, বধির করে দিয়েছেন, মোহর মেরে দিয়েছেন ইত্যাদী৷ এ আয়াতে তার কারণ ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন মানুষ নিজেই বক্রতায় লিপ্ত হয়, আল্লাহ তখনই তাকে আরও বক্র করে দেন৷
৬/وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءهُم بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُّبِينٌ
অর্থ;-আর যখন মরিয়ম তনয় ইশা বণী ইস্রাঈলকে বললেন, নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের কাছে প্রেরিত রসুল৷ আমার পূর্ববর্তী তওরাতের আমি সত্যায়নকারী এবং আমি একজন রসুলের সংবাদ দতা, যিনি আমার পরে আগমন করবেন৷ তাঁর নাম আহমদ৷ অতঃপর যখন তিনি স্পষ্ট প্রমানাদী নিয়ে উপস্থিত হলেন, তখন তারা বলল, এ তো এক প্রকাশ্য যাদু৷
# বেশ কয়েকটি শক্তিশালী মোজেজা নিয়ে, দোলনায় থেকে নবুয়তের ঘোষণা দিয়ে যিনি তাদের মাঝে এলেন, তাঁর পূর্বে নাজিল হওয়া আসমানী কিতাব, তাওরাতের সত্যতার সাক্ষ্য দিলেন, পর বর্তী নবী, শেষ নবীর আগমনি ও তাঁর নামও অগ্রীম ঘোষণা করলেন, বণী ইস্রাঈল সম্প্রদায় তাঁকেও যাদুকর আখ্যা দিল৷
৭/وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ وَهُوَ يُدْعَى إِلَى الْإِسْلَامِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِين
অর্থ;-যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহুত হয়েও আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে; তার চাইতে অধিক জালেম আর কে? আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শণ করেন না৷
৮/يُرِيدُونَ لِيُطْفِؤُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
অর্থ;-তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়, আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণ রূপে বিকশিত করবেন, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে৷
# এ আয়াতের বিষয়টি সুরা তওবায় ৩২ আয়াতে এসে গেছে৷ এটি বিশেষ করে ইহুদীর উদ্দেশ্যে৷ তারা আড়ালে থেকে ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তার নূর, হুদা, কোরআনকে প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বেন, কেউ পছন্দ করুক আর না করুক৷ সুরা ‘হাশরে’ বলা হয়েছে যে, তারা আড়ালে থেকে কিংবা সুরক্ষিত স্থানে থেকে যুদ্ধ করবে৷ রসুল সঃ বলেছেন যে, ‘আল মারহামাতুল উজমা’, সর্ব বৃহৎ যুদ্ধ যা কেয়ামতের আগে সংঘটিত হবে, তাতেই তারা সামনে আসবে আর তার পরই আল্লাহ আলো সর্বময় বিকশিত হবে৷
৯/هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
অর্থ;-তিনি তাঁর রসুলকে সত্য দ্বীন ও আলহুদা দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে তিনি ইসলামকে সকল ধর্মের উপর প্রকাশ ঘটান৷ যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে৷
# এ আয়াতটিই এ সুরার মূল বিষয়৷ অন্যান্ন নবী রসুল আঃ গনকেও বশির, নজির, রূপে কিতাব, মোজেজা দিয়ে পাঠানো হয়েছিল৷ তাঁরা কেউই প্রচলিত নেজাম, বদল করে মিজান বা ন্যায় দণ্ড স্থাপন করে ততখানি সাফল্য দেখাতে পারেনি যা হজরত মোহাম্মদ সঃ আলহুদা বা কোরআন হাতে করে দেখিয়েছেন৷ তাদের কারও স্থান হয়েছে পূঁজার ঘরে, আর কেউবা আল্লাহর পুত্র হিসেবে মর্যাদা পেয়ে চলেছেন৷
দুঃখের বিষয় যদি আল্লাহ রসুল সঃ কে ফলোআপের জন্য এখন পাঠান, তিনিকি চিনতে পারবেন তাঁর দিক্ষীত সেই রেখে যাওয়া উম্মত কে! তাঁর সেই হাতিয়ার, আলহুদা ঠিক আগের মতই আছে, কিন্তু তা মসজিদ, মাদ্রসা, হজ, ওমরা, ইজ্তেমা, মাহফীল, জিকির, তাবিজ কবজ,পানি পড়ার মাঝে আবদ্ধ হয়ে গেছে৷
বিষয়: বিবিধ
২২২২ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ চাচাজান ।
মুশরিকের বদলে মুসলিম লিখে ফেলেছেন...
জাজাকাল্লাহ খায়রান। আমরা এমন এক চিজ যে অন্যকে উপদেশ না দিয়ে থাকতে পারিনা।অথচ আমরা তা নিজেরা করিনা। এটা আমাদের রক্তগত সমস্যা। আল্লাহ হেফাজত করুক।
এই আয়াতের অর্থে মুশরিক শব্দের পরিবর্তে লিখেছেন 'মুসলিম'। সম্ভবত টাইপ মিসটেইক।
ফুৎকার দিয়ে নিভিয়ে দেয়ার শিক্ষাটা 'তারা আজো রপ্ত করে যাচ্ছে। অথচ তারা বুঝে না আল্লাহ্ যদি কোন কিছু দীপ্তিমান করে রাখতে চান, তাঁদের কি সাধ্য তা ঠেকানোর!
যথার্ত্থই বলেছেন।
আমাদের ওলামারা বুঝেও না বোঝার ভান করে৷ আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দিক৷
এই সেই সুরা- যার তাফসীরপাঠ আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ!
জাযাকআল্লাহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন