"নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের বাহিনী সমুহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়৷"

লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৭:৪৯:৩২ সকাল

(মরহুম ইসরার আহমাদ সাহেবের, উর্দূ বয়ানুল কোরআনের বাংলা অনুবাদ)

(৪৮) সুরা আল ফাতহ (মাদানী) রুকু ৪টি আয়াত ২৯টি

আগেই বলা হয়েছে, বিজয়ের শুভ সূচনার সংবাদ নিয়েই নাজিল হয় সুরা আল ফাতহ৷ পঞ্চম হিজরীতে আহযাবের যুদ্ধের পর রসুল সঃ ঘোষণা দেন যে, এর পর কোরাইশদের আর তোমাদের উপর চড়াও হবার দুঃসাহস হবেনা৷ ছয় সনে তিনি ওমরা করার ঘোষণা দেন৷ ওমরা করতে কাউকে বাধা দেবার নিয়ম ছিলনা৷ কিন্তু ১৪০০ মতান্তরে ১৮০০ সাহাবীর ওমরা কাফেলার কথা কোরাইশদের কানে পৌঁছলে, তারা বিপদের আশংকা করল৷ রসুল সঃ সাহাবী সহ এহরাম বেঁধে কাফেলা নিয়ে হোদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছে হজরত ওসমান রাঃ কে খোঁজ খবর নিতে মক্কা পাঠালেন৷ তাঁর ফিরতে দেরী দেখে, সকলে ধরেই নিলেন যে হজরত ওসমান শহীদ হয়েছেন৷ তখন কোরাইশদের মোকাবেলা করার জন্য সাহাবীদের বায়াত নিলেন, অর্থাৎ সকলে রসুলের হাতে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করলেন যে জীবন থাকতে কোরাইশদের কাছে বদলা না নিয়ে কেউ ফেরত যাবেন না৷ একে ‘বায়াতে রিজওয়ান’ বা ‘বায়াত আলাল মওত’ বলা হয়৷

এ খবর শোনার পর কোরাইরা ভীত হয়ে সন্ধীর প্রস্তাব দেয়৷ মুসলীমদের অধিকার ক্ষুন্ন হলেও রসুল সঃ তাতে রাজী হন৷ রসুলের জবানীতে হজরত আলী চুক্তিনামা লেখেন৷ ‘মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ বনাম কোরাইশদের মাঝে চুক্তি’৷ সোহাইল আপত্তি করে বলে যে, যদি আমি এ পত্রে সই করি তবেতো মোহাম্মদ কে (সঃ) রসুল বলে মেনে নেওয়া হয়. অথচ আমি তা মানিনা, এটা কাটতে হবে৷ রসুল সঃ মুচকি হেঁসে বললেন, তুমি না মানলেও আমি আল্লাহর রসুল৷ হজরত আলীকে কথটি কেটে, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মোহাম্মদ ও কোরাইশদের মাঝে চুক্তি’ লিখতে বললেন৷ জবাবে হজরত আলী বললেন যে জীবনে তিনি কোনদিন রসুলের অবাধ্য হন নি, কিন্তু আজ এ আদেশ তিনি রাখতে পারবেন না৷ রসুল সঃ শব্দগুলি কোথায় জেনে নিয়ে নিজেই কেটে দিলেন৷

শর্ত মোতাবেক, এ বৎসর ওমরা না করেই মুসলীমদের ফেরত যেতে হবে৷ বিনিময়ে সামনের বৎসর তিন দিন মুশরিকরা মক্কা ছেড়ে বাইরে যাবে আর মুলীমরা বিনা ঝঞ্ছাটে ওমরা করবে৷ মদীনা থেকে কোন মুসলীম মক্কায় ফেরত এলে তাকে আর ফেরত দেওয়া হবেনা, কিন্তু মক্কা ছেড়ে কেউ মদীনা গেলে তাকে ফেরত দিতে হবে৷ হজরত আবু জান্দাল, মক্কা ছেড়ে এ কাফেলার সাথে মদীনা যেতে এসেছিলেন, শর্ত অনুযায়ী রসুল সঃ বিপদ জেনেও তাঁকে সবর করার পরামর্শ দিয়ে পুনরায় মক্কায় ফেরত দিলেন৷

সন্ধীর প্রস্তাব তখনই আসে যখন প্রতিপক্ষকে প্রবলতর মনে হয়৷ মুমিনদের উৎসাহ উদ্দিনার খবরে কোরাইশগন বুঝে নিয়েছিল যে, মোহাম্মদের সঃ সাথে মোকাবেলার ক্ষমতা তাদের আর নাই৷ তাই তারা সন্ধীর প্রস্তাব পাঠায়৷ এদিকে মুমিনগন, যারা জীবনদিতে প্রস্তুত ছিলেন, অসম শর্তের সন্ধীতে তাঁরা মনক্ষুন্ন হলেন৷ হজরত ওমর রাঃ রসুল সঃ কে প্রশ্ন করেই বসলেন, আপনিকি আল্লাহর রসুল নন, রসুল সঃ উত্তর দিলেন, অবশ্যই, পাল্টা প্রশ্ন, তবে এমন অসম চুক্তি কেন মানতে হল৷ রসুল সঃ বললেন, আমি তাই করি যা আল্লাহ আদেশ করেন৷ আবেগ তাড়িত হয়ে এমন প্রশ্ন করে হজরত ওমর সারা জীবন অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন৷

রসুল সঃ প্রকাশ্যে সকলকে এহরাম ভেঙ্গে কোরবানী করার আদেশ দিলেন, এক বার দুইবার, তিন বার, কিন্তু আদেশ পালনের লক্ষন দেখা গেলনা৷ তখন রসুল সঃ শিবিরে ঢুকে হজরত উম্মে সালমা রাঃ কে ঘটনাটি বলায় তিনি পরামর্শ দিলেন যে আপনি নিজে আগে প্রকাশ্যে এহরাম ভেঙ্গে কোরবাণী করুন, তাহলে হয়ত সবাই করবে৷ তিনি তাই করলেন৷ অবস্থা স্বাভাবিক হল৷ সাহাবীরা সন্দেহের মধ্যে ছিলেন যে, রসুল সঃ তাদের ইমান ও বায়াতের পরীক্ষা নিচ্ছেন কিনা! অথবা হঠাৎ পিস্থিতির পরিবর্তনে আশংকাও তাদের মাঝে ছিল৷ মুসলীমদের সান্ত্বনা ও আশার আলো জাগাবার জন্যই এ ঘটনার পরেই এ সুরা নাজিল হয়, প্রথম আয়াতেই একে প্রকাশ্য বিজয় ঘোষণা দেওয়া হয়৷ এ সুরায় চারটি রুকু ও ঊনত্রীশটি আয়াত রয়েছে৷

সুরা আল ফাতহ রুকু;-১ আয়াত;-১-১০

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

১/إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا

অর্থ;-নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি৷



২/لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُّسْتَقِيمًا

অর্থ;-যেন আল্লাহ ক্ষমা করেদেন আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ত্রুটিবিচ্যুতি সমুহ এবং পূর্ণ করেদেন আপনার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ আর আপনাকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন৷

# ত্রুটি বিচ্যুতি ক্ষমা করার বিষয়ে সুরা মোহাম্মদের ১৯ আয়াতে আলোচনা হয়েছে৷ এ আয়াতে ভবিষ্যতের গুলিও মাফ করার কথা বলা হয়েছে৷ এ চুক্তিতে সন্তুষ্ট না হওয়ায় রসুলের আনুগত্যে সাহাবীদের কিছু শৈথিল্য হয়ে থাকলে তারও ক্ষমা ঘোষণা হল৷ নেয়ামত বা অনুগ্রহ পূর্ণ করার ঘোষণা আমরা সুরা মায়ীদায় পড়ে এসেছি, এখানে তা বাস্তবে পরিনত করার ও ঝঞ্ছাট বিহীন সরল পথে এগিয়ে যাবার জন্যই বিজয় দেওয়া হয়েছে৷

৩/وَيَنصُرَكَ اللَّهُ نَصْرًا عَزِيزًا

অর্থ;-এবং যাতে আপনাকে বলিষ্ঠ সাহায্য দান করেন৷

৪/هُوَ الَّذِي أَنزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَّعَ إِيمَانِهِمْ وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا

অর্থ;-যাতে তিনি মুমিনের অন্তরে প্রশান্তি নাজিল করেন, যাতে তাদের ইমানের সাথে আরও ইমান বেড়ে যায়৷ নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের বাহিনী সমুহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়৷

# মুমিনরা মানষীক ভাবে কোরাইদের সাথে জীবন বাজি রেখে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ছিলেন৷ সেই সাথে তাঁদের মনে সন্দেহ ছিল যে রসুল সঃ এহরাম ভঙ্গ ও কোরবাণীর আদেশের মাধ্যমে তাঁদের বায়াতের পরীক্ষা করছেন৷ এ আশংকাও ছিল যে অবস্থার পরিবর্তন হয়েও যেতে পারে৷ এ সুরা নাজিলে তাদের অন্তরে প্রশান্তি নেমে এল, ইমান আরও মজবুত হল৷

৫/لِيُدْخِلَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَيُكَفِّرَ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَكَانَ ذَلِكَ عِندَ اللَّهِ فَوْزًا عَظِيمًا

অর্থ;-ইমান এ জন্য বেড়ে যায়, যাতে তিনি মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করান, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত৷ সেখানে তারা চিরকাল বসবাস করবে এবং যাতে তিনি তাদের পাপ মোচন করেন৷ এটা আল্লাহর কাছে মহা সাফল্য৷

৬/وَيُعَذِّبَ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ الظَّانِّينَ بِاللَّهِ ظَنَّ السَّوْءِ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَهَنَّمَ وَسَاءتْ مَصِيرًا

অর্থ;-এং যাতে মোনাফেক পুরুষ ও মোনাফেক নারী, মুশরিক পুরুষ মুশরিক নারী, যারা আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারনা পোষণ করে তাদের শাস্তি দেন৷ তাদের উপর অমঙ্গলের আবর্তন অবশ্যম্ভাবী৷ আর আল্লাহর গজব তাদের উপরে এবং তিনি তাদেরকে লা’নত করেছেন ও তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছেন৷ কত নিকৃষ্ট তাদের প্রত্যাবর্তন স্থল৷

# সুরা আহযাবের শেষের আয়াতটর সাথে এ আয়াতের মিল রয়েছে৷ সুরা আহযাব পাঁচ হিজরী ও সুরা ফাতহ ছয় হিজরীতে নাজিল হয়৷

৭/وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا

অর্থ;-নভোমণ্ডল ও ভূ মণ্ডলের বাহিনী সমুহ আল্লাহরই, আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়৷

৮/إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا

অর্থ;-আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ক কারী রূপে৷

৯/لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا

অর্থ;-যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ইমান আন এবং রসুলকে সাহায্য কর ও সন্মান কর এবং সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর৷

১০/إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللَّهَ يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنكُثُ عَلَى نَفْسِهِ وَمَنْ أَوْفَى بِمَا عَاهَدَ عَلَيْهُ اللَّهَ فَسَيُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

অর্থ;-যারা আপনার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারাতো আল্লাহর কাছে আনুগত্যের স্বীকার করে৷ আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে, অতএব, যে শপথ ভঙ্গ করে, অতি অবশ্যই সে তার নিজের ক্ষতির জন্যই করে৷ আর যে আল্লাহর কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে, আল্লাহ সত্তরই তাকে মহা পুরষ্কার দান করবেন৷

# সুরা তওবার ১১১ আয়াতের সাথে এ আয়াতটির মিল রয়েছে৷ সেখানে বলা হয়েছে মুমিনদের জান মাল আল্লাহ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন৷ আর এখানে বলা হয়েছে যে যারা রসুলের হাতের উপর হাত রেখে বয়াত বা আনুগত্যের ওয়াদা করেছে, ধরে নিতে হবে তারা আল্লাহর সাথেই ওয়াদা করেছে, কেননা তাদের হাতের উপর অদৃশ্য ভাবে আল্লাহর হাত ছিল৷

(এ রাকুর বিষয়বস্তুর সাথে তৃতীয় রুকুর বিষয় বস্তুর মিল পাওয়া যাবে৷)

বিষয়: বিবিধ

১২২১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

295879
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ১০:২৯
ভিশু লিখেছেন : এই ঐতিহাসিক সন্ধিটি মুসলিম উম্মাহর জন্য যে কত বড় শিক্ষার - অথচ তা আজও বিজ্ঞ অমুসলিমদেরকে বিস্মিত করে।
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:২৩
239490
শেখের পোলা লিখেছেন : সময় থাকতে কেউই শিক্ষা নেয়না৷ আপনাকে ধন্যবাদ৷
295923
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:৩৪
এ কিউ এম ইব্রাহীম লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইরান। Rose
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:২৪
239491
শেখের পোলা লিখেছেন : আমিন৷ ধন্যবাদ৷ আবার আসবেন৷
295960
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৩১
আফরা লিখেছেন : মাত্র কয়েকদিন আগেই এই সুরার দারস শুনেছিলাম খুব ভাল লাগল ।

জাযাকাল্লাহু খইরান চাচাজান ।
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:২৫
239492
শেখের পোলা লিখেছেন : ভাল থাক মামনি৷ আমিন৷
296009
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
আনুগত্যের এই ওয়াদা আমরা কেন পুরন করতে পারছিনা!
২০ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:২৬
239494
শেখের পোলা লিখেছেন : আমাদের ইমানের জোর কম তাই৷ ধন্যবাদ৷
296162
২১ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ১১:৩৯
ফাতিমা মারিয়াম লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ Praying
296292
২১ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ১০:৫০
শেখের পোলা লিখেছেন : আমিন! সুম্মা আমিন৷

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File