"না বলা কথা" শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ১৩ অক্টোবর, ২০১৪, ০৮:৪৩:৩০ রাত
ছোট ভাইয়ের সাথে আমরা যৌথ ফ্যামিলী ছিলাম৷ যৌথ বড় ফ্যামিলী আমার পছন্দের৷ বড় ভাই মহেশ্বর পাশায় শশুরের পাড়ায় বাড়ী করে চলে গেছে৷ এখন মা আব্বা আর আমাদের দু ভাইয়ের ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার৷ সংসার চালাবার দায়িত্ব ছোট ভাইয়ের, মাস শেষে সাধ্য মত শেয়ার করি, আমার দায়ীত্ব শেষ৷ তবে প্রশাসনিক দায়ীত্বটা আমার৷ সেখানে আব্বা মা বড় ভাইয়ের কোনদিন অমত দেখিনি৷ ব্যস্ততা নিয়ে সুখেই দিন কাটে৷ এমনই একদিন পিপুল্স স্কুলের হেড স্যার, আমার চির হীতাকাঙ্খী কাজী স্যার ডেকে পাঠালেন৷ স্কুলে দেখা করতে গেলাম৷ বললেন, এখানে কলেজ খুলেছি, কাল থেকে ক্লাশে আসবে৷ অনুনয় করে বললাম স্যার, চাকরী বউ ছেলে মেয়ে সংসার নিয়ে এই বয়সে আর সম্ভব নয়৷ গম্ভীর উত্তর; ‘কালথেকে ক্লাশে হাজির চাই, এখন যেতে পার৷’ এ আদেশ অমান্য করার সাহস হয়িনি, খাতা কলম নিয়ে ক্লাশে হাজির হয়েছি৷ কিন্তু অল্প কয়েক মাস পর মিলের সাথে সব বন্ধ হল৷ কিছুদিন পর আবার কিছুদিনের জন্য চালু হয়েছিল৷ আমার আর যাওয়া হয়নি৷
এমন করেই সময় এগিয়ে চলে৷ পারভেজ মিল্লাত পেপারের খুলনা ব্যুরো প্রধান হয়ে কনসার্ন ছেড়ে নিজেই অফিস খুলেছে৷ বিপুল কাষ্টমের চাকরী নিয়ে মোংলায় জয়েন করেছে, আমাকেও কনসার্নের স্বায়ত্ব শাসিত অঙ্গ সংগঠন, হ্যাণ্ডি ক্রাফ্ট সেন্টারের সব দায়ীত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে৷ সেখানে ১০৩ জন মহীলা, যার বেশীর ভাগই অবাঙ্গালী, অস্থায়ী ক্যম্পবাসী৷ তাদের কাজের ট্রেনিং ,মূলধন দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে৷ এরা প্রায়ই সভ্রান্ত বংশীয়া, হিজাব ধারী ও পর্দানশীন৷ এরা কেউ ক্রূশ কাটায় সূতার কাজ, কেউ উলের কাজ, আর প্রায় সকলেই পাটের প্লেস ম্যাট, কোষ্টার, সাইড ব্যাগ বানায়৷ আর সেগুলি চাহিদা মোতাবেক, ঢাকায়, কোর দি জুট ওয়ার্কস, কারিকা, সিতুলী ও আড়ংএ পাঠায়৷ যার যার কাজের মজুরী ও বৎসর শেষে লাভের অংশ পায়৷ আর সেখান থেকেই একজন দারোয়ান, আমার বেতন, কোয়ালিটি কন্ট্রোলারের ভাতা ও বাড়ি ভাড়া চলে৷ বৎসর যায়, খরচ বাড়ে কিন্তু এখানে আমার বেতন বাড়েনা৷ বৎসর তিন পরে বিষয়টা মবিন ভাইকে জানালাম৷ উনি হেড অফিসের ইসলাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করে আমাকে পুনরায় WTC তে ফিরিয়ে নিলেন এই শর্তে যে অবসর সময়ে স্বেচ্ছাশ্রমে হ্যাণ্ডি ক্রাফ্টটিও আমাকে দেখাশোনা করতে হবে৷ তথাস্তু৷ আবার ফিরে গেলাম৷ বেতন ছয়শো থেকে এগারোশো হয়ে গেল৷
মবিন সাহেব প্রমোশন পেয়ে মহা পরিদর্শক হয়ে ঢাকায় চলে গেলেন৷ আসলাম ম্যানেজার হল, আমাকে তার সহকারী করে খাদ্য বিষয়ক দায়িত্ব দেওয়া হল৷
সি এস ডি গোডাউন থেকে মালামাল আনার অভিজ্ঞতা ব্যাটেলিয়নে থাকতেই হয়েছে৷ প্রতিমাসে মহীলাদের রিলিফের গম, একটি প্রাইমারী স্কুল ও WTCএর বাচ্চাদের খাবার তেল ও গম, তাকে মেশিনে ক্ষুদ বানানো, শাক সব্জীর যোগানঃ, প্রইমারী স্কুলে রান্না জাউ পাঠানো, মাস শেষে গম বিতরণ, এ সব তদারক করা সহ আরও অনেক কিছু এখন আমার বাড়তি দায়ীত্বে৷ সবার কাছে বাড়তি সন্মানও পেতে থাকলাম, তবে আসলাম সাহেব, সামাদ ভাইয়ের বদলে সামাদ মিয়া বলেই সন্মান দিতে লাগল৷
পারভেজ ছিল মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব, তারই প্রচেষ্টায় আমরা একটা সাহায্য সংস্থা, ‘সার্ভিস ফর এ্যানিমল এণ্ড বার্ড’স’ চালু করলাম৷ চাকরীর ক্ষেত্র আলাদা হলেও এখানে আমরা একত্র হই৷ বিভিন্ন অঞ্চলে গরু মহিশ, ছাগল, হাঁস মুরগীর টিকা ইঞ্জেকশন ক্যাম্পেইন করি, কাগজে ছবি সহ খবর ছাপা হয়৷ ভাল লাগে৷ এর পর খুলনার গল্লামারীতে একটা স্থায়ী ক্লিনিক চালু করা হয়েছে, যেখানে সপ্তায় একদিন এক ইরাণী পশু ডাক্তার সেবা দেন৷ অন্য দিন যুব উন্নয়নের ট্রেনিং প্রাপ্ত একজন দেখাশোনা করে৷ ইতি মধ্যে অনেক উৎসাহী বেকার যুবককে সাভার থেকে সরকারী খরচে, হাঁস মুরগী, গরু, ছাগল পালন ট্রেনিং দেওয়ানো হয়েছে৷ অবশ্য তারা আজ আর কেউ ও পেশায় নেই৷ কিছু দুঃস্থ মহীলাকে আমাদের দেয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও সরকারী ঔষধ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় হাঁস মুরগীর চিকিৎসা দিয়ে কিছু রোজগার করতে দেখেছি৷ দুইবার ট্রাক ভর্তী পশুখাদ্য নিয়ে নড়াইল ও মোল্লাহাটে বন্যাদূর্গতদের মাঝে S C M (স্টুডেন্ট ক্রীশ্চীয়ান মুভমেনেট)এর সাথে যৌথ উদ্যোগে বিতরণ করেছি৷ এ সব সমাজ সেবায় বেশ উৎসাহ পেতাম, মনে প্রশান্তি আসতো৷
সময় এগিয়ে চলে৷ এরই মধ্যে বিপুল বাবু আমেরিকে ট্যুর দিয়ে ফিরেছে৷ মি্ল্লাত কাগজ বন্ধ হয়েছে৷ পারভেজ সাহেব সপরিবারে ঢাকা চলে গেছে৷ ‘সার্ভিস ফর এ্যনিমল ণ্ড বার্ডসের’ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে৷
এন জি ও গুলোতে বসিং সিষ্টেম অচল, অন্ততঃ কনসার্নে যা দেখেছি৷ সবাই ভাই ভাই৷ আইরীশদের কোন না কোন মেয়ে প্রতিনিধি সব সময়ই থাকে৷ তারা নাম ধরে ডাকতে বলে কিন্তু আমরা তা পারিনা, সিস্টার বলে ডাকি৷ তারা বাঙ্গলাদেশীদের মতই পোষাক পরে৷ বাৎসরিক পিকনিকে অনেকে শাড়ি পরেও যায়৷ কোন ভেদাভেদ নেই৷
আসলামের ব্যবহার মবিন ভাইয়ের কাছে বলার পর তিনি তাকে সাবধান করে দেন৷ এতে আমার উপর তার চাপা আক্রোশ থেকে যায়৷ আর তাই নয় বৎসর সুনামের সাথে কাজ করার পর আমাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হতে হয়৷
আমার ছোট বোনাই গাছ কিনে লগ ও সাইজকাঠ বিক্রি করে, কিন্তু মূলধনের অভাবে পেরে ওঠেনা৷ সিদ্ধান্ত নিলাম তার সাথে ব্যবসা করার৷ আমার কনসার্নে পাওয়া টাকা আর বিপুল বাবুর কাছে ধার নিলাম ৫০ হাজার টাকা নিয়ে লেগে গেলাম৷ সাথে একটা ফার্নিচারের দোকান দিলাম, যেটায় আমি থাকতাম৷ বছর দুই পরে দেখলাম, খাতায় মাল আছে কিন্তু স’ মিলে মাল নাই৷ চালান শেষ৷ ফার্নিচারে যা ছিল তা বোনাইকে দিয়ে বাড়ি এলাম৷ ইতি মধ্যে বিপুল বাবু জার্মান গিয়ে রয়ে গেছে৷ আর আমি এখন পাড়ায় একজনের সাথে কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করি৷ অভিজ্ঞতা কম, তাই পোষায় না৷ মাঝে মাঝে দূরের হাট থেকে তরি তরকারী ট্রেনে করে এনে দৌলতপুর বাজারে পাইকারী দেই৷ শ্টেশন অনেক দূর তাই অ সুবিধা হয় যাতায়াতে৷ তা বাদ দিয়ে ভারত গিয়ে চাচাতো ভাইদের সাথে ফুটপাতে পিস কাপড়ের দোকান দিলাম৷ এ সময় বিপুল বাবু দেশে এসে আমাকে টেলিগ্রাম দিয়ে নিয়ে এল৷ পুনরায় টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে বলল৷ আমি রাজি হলামনা৷ এক সময় সে আমাকে বিদেশ যাওয়ার অফার দেয়, আমি ফিরিয়ে দিই, আর আজ আমি তাকে অনুরোধ করলাম বিদেশ পাঠাতে৷ আমার জার্মান যাবার ব্যবস্থা করলে, জিজ্ঞেস করলাম সে কি করবে৷ বলল কানাডায় যাবে৷ আমি বললাম, আমিও কানাডায় যাব৷ওরা দিল্লী বেড়াতে গিয়ে, কানাডার ভীসা যোগাড় করে ফেলেছে৷ আমরও সাথে যাবার কথা ছিল৷ কোন কারণে আমি সাথে দিল্লী যেতে না পারায় পিছিয়ে পড়লাম৷ হয়ত এটাই আল্লাহর ইচ্ছা ছিল৷ পরের মাসেই ওরা স্বামী স্ত্রী কানাডা চলে গেল৷ দেখা হয়নি তবে চিঠি দিয়ে জানিয়ে ছিল যত শিঘ্র পারি কাগজপত্র্র পাঠাব৷
এই সময়ের দুইটা বৎসর আমার সত্যিকারের দূর্দিন গেছে৷ ছোট ভাই হাল ছেড়ে দিয়েছে, বিদেশী ভূত ঘাড় থেকে নামাবার জন্যে মা বার বার তাগিদ দিচ্ছে৷ ভেঙ্গে পড়িনি, আল্লাহর উপর আস্থা রেখে মোকাবেলা করেছি৷ ভাগ্নার সাইকেল রিপিয়ারিং সপে সাইকেল মেরামতের কাজ করেছি৷ আমার মামাও এসময় কিছু সাহায্য করেছে, আমার শ্যালকরাও সহযোগীতা করেছে৷ দুই বৎসর পর আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এল, সঙ্গে ইনিসট্রাকশন৷
নতুন পাশপোর্ট বানানোই ছিল৷ তা নিয়ে ঢাকা কানাডিয়ান এমব্যাসিতে গেলাম৷ গেটের ও পাশ থেকে দারোয়ান ফরম দিচ্ছে, আমার পাশপোর্ট খান এগিয়ে দিলাম৷ উনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ পাশপোর্টে কানাডা ভীসা দেবেনা’৷ জিজ্ঞেস করলাম কোথাওকি ভুল আছে? উনি বললেন, ‘যে পাশপোর্টে দু একটা বড় বড় দেশের ভীসা থাকে, তাতেই কানাডা ভীসা দেয়’৷ আমি বললাম, কানাডাতো একটা বড় দেশ, তারা যদি আমার পাশপোর্টে প্রথম ভীসাটা দেয়, তাতে কি খুব ভুল হবে! লোকটি খুশী হয়ে হেঁসে দিলেন ও একটা ফরম দিলেন৷ বাইরে বসে ফিলাপ করে জমা দিলাম৷
ঘন্টা তিনেক পরে ইন্টারভিউ এর ডাক পড়ল৷ জানালার ও পাশে এক তাগড়া আফ্রিকান অফিসার আর এ পাশে বারান্দায় আমি৷ তিন চারটি প্রশ্ন করে ভিতরে চলে যান, ক মিনিট পরে আবার এসে প্রশ্ন করেন৷ প্রত্যেক বারই আমাকে অপেক্ষা করতে বলে যান৷ এ ভাবে প্রায় ঘন্টা খানিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করে শেষে বললেন, আমি আমার রিপোর্ট তোমার পাশপোর্টের সাথে ব্যাংকক পাঠাবো, ভীসা দেওয়া না দেওয়া তাদের ব্যাপার৷ এক সপ্তার ভিতর তোমার ঠিকানায় চিঠি যাবে৷ ভীসা হলে ডাকা হবে, না হলে পাশপোর্ট ফেরত যাবে৷৷
ধারণা ছিল অফিসারকে আমার উত্তরে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি৷ কিন্তু চিঠি যাবার কথায় বিপদে পড়লাম৷ আমি গ্রামে থাকি চিঠি যেতে দেরী হয়, তাই বিপুল বাবুর কথামত শহরের একটা ঠিকানা ব্যবহার করেছি, যেখান থেকে চিঠি উদ্ধার করা দূরহ৷ এখন উপায়? বিপুলকে ফোনে জানালাম, বলল, ঐ এলাকার পিয়ন সামাদ মিয়া, জিপিওতে গিয়ে তারসাথে দেখা করেন, উনি ব্যবস্থা করে দেবেন৷ উনাকে আমিও চিনতাম৷ গিয়ে সমস্যা জানালাম৷ জানলাম, ওনার প্রমোশণ হয়েছে, আর চিঠি বিলি করেন না৷ তবে ঐ এলাকার পিয়নকে দেখিয়ে দিলেন৷ সমস্যা বলতে, উনি জিপিও থেকে আমার চিঠি দিতে পারবেননা বললেন৷ অতঃপর চামিষ্টি খেয়ে রাজি হলেন৷ এক সপ্তাহ সকাল দশটায় ছয় মাইল সাইকেলিং করে তাকে সালাম জানানো আমার ডিউটি হল৷ সপ্তাহ পার হয়ে গেল, চিঠি এলনা৷ অগত্যা এ্যমব্যাসীতে ফোনকরে জানলাম ঐ দিনই রাতে ব্যাংককের মেইল আসবে, তাতে থাকলে পাঠানো হবে৷ বললাম পাঠাতে হবেনা আমি নিজেই সকালে অফিসে আসব৷ ঐ রাতেই ঢাকা রওয়ানা হলাম৷
সকালে অফিস খোলার পর অনেকের সাথে দুরু দুরু বুকে নাম ডাকার অপেক্ষা করতে থাকলাম৷ অনেকেই পাশপোর্ট নিয়ে ফিরে যাচ্ছে৷ তাতে ভীসা ছিল কিনা বলতে পারিনা৷ যখন প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল, কাছে গিয়ে জানালা দিয়ে টাইপ করা লিষ্ট খান বার বার পড়লাম, তাতে আমার নাম দেখা গেলনা৷ দুশচিন্তা ঘনিভুত হতে লাগল৷ অবশেষে নীচে হাতে লেখা কয়েকটি নামের ভিড়ে নিজেকে আবিষ্কার করলাম৷ আলাদা করে হাতে লেখা৷ সাহস পাইনা৷ সেই সিরিয়ালে যখন ডাক পড়ল, সামনে গেলাম, ওপাশ থেকে বলাহল পনেরশো চল্লিশ টাকা দেন৷ হালে পানি পেলাম৷ টাকটা রেডি ছিল দিলাম৷ রবার্ট বাবু ভিতরে গিয়ে ক্যাশ মেশিন থেকে একটা চিরকুট আর পাশপোর্ট খানি হাতে দিলেন৷ সরে এসে পাতা উল্টে কাঙ্খীত সেই ঝকঝকে সোনালী রংগের স্টিকারটি দেখে চোখে পানি এল, আল্লার শুকরিয়া আর বিপুলের জন্য শুভকামনা করে হন হন করে পা চালালাম, পাছে না ডেকে বলে ভুল হয়েছে৷
ঐ দিনই খুলনা চলে গেলাম৷ ফ্যাক্সে বিপুলকে জানালাম ও জানতে চাইলাম, ভীসা পেয়েছি এখন টিকিট কিভাবে হবে৷ তখন কানডায় ফোন করতে মিনিটে একশো টাকা লাগত আর এক মিনিটের ফ্যাক্সেও একশো টাকা লগত৷ দুইজন পরিচিতের কাছে পঁচিশ হাজার করে টাকা নিয়ে ঢাকায় (এজেস্সীর নাম মনেনেই) বাবু ভাইয়ের কাছে বুকিং দেওয়া আছে, টিকিট আনতে বলেদিল৷ নির্দেশ মত গিয়ে ব্রিটীশ এয়ারের টিকিট আনলাম৷ ছোট একটা লাগেজ কাপড় চোপড় নিয়ে, যে কথা কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, যে প্লেনকে শুধু মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতেই দেখেছি, ১৯৯৪ সালের ১৪ই জানুয়ারী, পরিচিত পরিবেশ, আমার বাড়ি, গ্রাম, বউ, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয় স্বজন, দেশ ছেড়ে, অন্নের সংস্থানে, সেই মহান আল্লহর নামে ও সংশ্লিষ্ট সহযোগীদের কুশল কামনা করে অজানার উদ্দেশ্যে সেই প্লেনের পেটে প্রবেশ করলাম৷
প্লেনের দেওয়া খাবারের মধ্যে যেগুলো চিনতাম শুধু তাই খেলাম৷ হিথরো নামার পর এগারো ঘন্টা অপেক্ষা৷ কানাডায় বিপুল বাবুকে কালেক্ট কল দিলাম, আমি ফোন করব আর বিল দেবে যে ফোন রিসিভ করবে৷ এ সব কৌশল তারই শেখানো৷ ভিতরে দোকান আছে কিছু কিনে খাবার পরামর্শ দিল, কিন্তু কোনটার কি নাম, কি বলে চাইব, কেমন করে দাম দেবো, তাই এসব ঝামেলায় আর গেলামনা৷ পরের ফ্লাইটে উঠলাম৷ খাওয়া দাওয়া আগের নিয়মে৷ গন্তব্য মন্টিয়ল৷ রিফিউজি হতে হবে, মন্ট্রিয়লে জিজ্ঞাসাবাদ কম, তাই এ ব্যবস্থা৷ ওখান থেকে টরোন্টর ট্রেন বিকাল পাঁচটায় ছেড়ে যাবে, সেটা ধরাই লক্ষ্য৷ যথা সময়ে মন্ট্রিয়ল নামলাম৷ বাসে চড়ে শ্টেসনে যেতে হবে৷ বাইরে বাস দাঁড়ানো৷ লাগেজা হাতে নিয়ে বাইরে গেলাম৷ পরিচয় হল মাইনাস সাতাশ ডিগ্রি, ঝড়ো হাওয়া সহ তুষার পাতের সঙ্গে৷ সাধারণ শার্ট প্যান্ট কোট শরীরে আছে বলে মনে হলনা৷ এক লাফে ফেরত এলাম৷ বলা হল সময় মত ডেকে নেওয়া হবে৷ বাসে উঠে ড্রাইভারকে শ্টেসনে নামিয়ে দেবার কথা বললাম, তিনি ঠিক মতই নামালেন৷ কি্তু কোনদিকে শ্টেসন খুঁজে পেলামনা৷ রাস্তায় লোকজন নাই৷ দু একজন যাওবা পেলাম, কেউ আমার কথা বোঝেনা৷ বেশ কিছুপরে একজন বুঝলেন ও একটা দরজা খুলে লিফ্টে পুরে বোতাম টিপৈ বললেন, যেখানে থামবে ওটাই শ্টেসন৷ যায়গামত এলাম. কিন্তু ট্রেন ছেড়ে গেছে৷ আবার কালেক্ট কল৷ রাত বারোটায় বাস আছে তাই বাস স্ট্যাণ্ডে যাবার নির্দেশ৷ টিকিট মাষ্টারের কাছে হেল্প চাইলাম৷ তিনি একজনকে বলেদিলেন৷ তিনি আমার লাগেজটি নিজে একটা ট্যাক্সিত দিয়ে তাকে বলে দিলেন৷বাস স্ট্যাণ্ডে এলাম৷ ছয় ঘন্টার অপেক্ষা, ক্লান্ত শরীর, চারিদিকে বাস আসা যাওয়ায় বার বার দরজা খোলে আর সব ঠাণ্ডা তীর বেগে এসে আমাকেই লাগে৷
যথা সময়ে বাস ছাড়লো, আর আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম৷ ঘুম ভাংতে সামনে প্রায়ই টরোন্ট লেখা সাইন পড়তে লাগল৷ ভাবলাম প্রায় এসেগেছি৷ এক জায়গায় অনেক বড় বড় বিল্ডিং, বাস দাঁড়ালো, হুড় হুড় করে লোক নামতে লাগল, আমিও নেমে গেলাম৷ কিছু লোক নিয়ে বাস ছেড়ে গেল৷ তখনও সূর্য ওঠার দেরী আছে, তবে চারিদিক ফর্সা হয়ে গেছে৷ যারা নেমে ছিল অল্প সময়ের মধ্যে সব উধাও হয়ে গেল৷ আমি প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে একা হয়ে গেলাম৷ দুজন আমাকে নিতে আসবে, তাদের না দেখে আন্দাজ ঘনিভুত হল যে আসলেই ভুল যায়গায় নেমে পড়েছি৷ অগত্যা আবার কালেক্ট কল৷ জায়গার নাম চাইল৷ কোথাও কোন সাইন বোর্ড নাই বা জায়গার নাম লেখা দেখলাম না৷ কিছু দূরে দুইটা ছেলেকে রোলার স্কেড বোর্ড চালিয়ে যেতে দেখে ডাক দিয়ে, তাদের কাছে আমার অবস্থান জানার জন্য একজনের হাতে ফোন ধরিয়ে দিলাম৷ তারা জানালো জায়গাটি স্কার বরো টাউন সেন্টার৷ ধন্যবাদ দিয়ে তাদের বিদায় দিলাম৷ আমাকে ট্যাক্সি নিয়ে ঠিকানা জানাতে বলাহল৷ ট্যাক্সি ড্রাইভাব ঠিক মত নিয়ে পৌঁছে দিলেন৷ নেমে সাইন বোর্ড দেখলাম; ‘বম্বে গ্রোসারী, ব্লোর স্ট্রীট ওয়েস্ট, টরোন্ট৷’
সেদিন থেকেই আমি কানাডা প্রবাসী৷ ২০০৬ সালে ফ্যামেলী নিয়ে এসেছি৷ তিন ছেলেমেয়ের দেশেই বিয়ে দিয়েছি৷ দুটি নাতি নাতনীও আছে৷ সবাই এ শহরেই থাকে৷ আল্লাহর ইচ্ছায় বেশ ভাল আছি৷ বয়স হেলেও কাগুজে মার প্যাঁচে অবসরে যেতে পারছিনা৷ হাঁটা চলাও সিমীত হয়ে গেছে৷ সবার দোওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে শেষ করছি৷ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য৷
বিষয়: বিবিধ
১৫৯৩ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শেষ করে দিলেন!
তাহলে আরেক সিরজ শুরু হোক -
ইতিহাস তো আপনাদেরই লিখতে হবে নতুন প্রজন্মের জন্য-
সরকারে যারা যা্য তারা তো ইতিহাসকে পাতিহাঁস বা রাঝাঁস বানিয়ে জবাই করে পিকনিক করে - ৪৩বছর ধরে তাই চলছে
অপেক্ষায় রইলাম-
আল্লাহতায়ালা আপনার কলমে ও মগজে বরকত দিন
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
ইতিহাস নয় এটা বৈচিত্রময় জীবন কাহিনী৷ আর চোখে দেখা ঘটনা যার সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে শুধু তাই বলেছি৷
দেশে থাকলে হয়তো ২/৩ বছর কামলা দিলে দেশেই হয়তো ১/২ লাখ টাকা বেতন পেতে পারি, আর কোনমতে ক্রিমিনালী মানে রাজনীতি-ব্যবসার লাইন পাইলে হয়ত কলাগাছও হয়ে যেতে পারি!
কি করা উচিৎ বলে মনে করেন, আমার জন্য? গোলামী করতেই ইচ্ছা করে না আমার, গোলামীর কথা মনে হইলেই কান্দন আসে!
তারপরেও, কানাডায় যাওয়ার প্রসেস, কি কি কাজ করা লাগতে পারে নতুনদের, কি ধরনের অসুবিধা হয় নতুনদের, ইনকাম এর কি পরিমাণ খরচ জীবন-যাপনের ব্যায়ে চলে যায়, ইত্যাদী নিয়ে আপনার থেকে জানার আগ্রহবোধ করছি; আশা করছি একটা সুন্দর পোষ্ট পাবো।
হুম আপু, ৪ বছর আগেই ১০ হাজার কম ১ লাখ পেতাম ৪ মাসের জব-এক্সপেরিয়েন্সে! কারণ আমরা চোরের ফাইলোদ্দার, কেমনে ক্ষতি করতে হয়ঃ তাতে আমরা সিদ্ধহস্ত!
এখনও অনেকেই বলে শুধু গোলামীটা মেনে নেন, কোথাও কোন অভাব নাই-তো! কোন কষ্ট ছাড়াই যদি ইচ্ছামতো মৃত্যুবরণ করা যেতো, তবে ৪ বছর আগেই মরে যেতাম!
মন্তব্য করতে লগইন করুন