শৈশব;- স্মৃতীর অতলে পাওয়া৷
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:৫৭:৫৩ রাত
ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে, ‘মর্নিং শোজ দি ডে’ সকাল বেলাই নাকি বলে দেয় দিনটি কেমন হবে৷ মানুষের শৈশবও তো তার সকাল, সেই শৈশব দেখে তার ব্যাপারে কতখানি আন্দাজ করা যায় তা আমার যেমন জানা নেই তেমনই আমার শৈশবে আমাকে নিয়ে কে কি আন্দাজ করেছিল তাও জানা নেই৷ তবে কূ সংষ্কার বলে মানলেও আমি যে, অপয়া হয়ে জন্মেছিলাম তা বলতে পারি৷
আমার জন্ম ১৯৫০ খ্রী্টাব্দে৷ মা বলতেন ভাদ্র মাসের কোন এক তারিখে৷ আমার শৈশবে পিতৃহারা জেদী আব্বা, বিয়ের পর বেশীদিন আমার নতুন দাদার সংসারে থাকেননি৷ অন্য পাড়ায় আমার বড় দুই ভাই বোন ও মাকে নিয়ে আলাদা বাড়ী করে, পৈতূক ভিটা, চাষ বাস ছেড়ে চলে আসেন৷ আমাদের বাড়িটা ছিল পশ্চিম বঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার জগদ্দল থানার কাঁকিনাড়া শহরের শহরতলী কাঁটাডাঙ্গা এলাকায়৷ একপাশে শহর, ও বাজার আর গঙ্গানদীর পাড়ে সারিসারি মিল কারখানা আর অন্য পাশে চাষ বাস ওয়ালা গ্রাম৷ আমার দাদার বাড়ি, বাগান, মাঠে চাষের জমি ও বাড়িতে হাল গরুও ছিল৷ নতুন বাড়িতে এসে আাব্বা হয়েছিলেন মিল শ্রমিক৷
আমার বড় ভাইয়ের জন্ম হয়, ৪৭ এর দেশ ভাগের পর উদ্ভুত দূর্ভিক্ষের পর, আর আমার জন্মের পর, যখন আমি কেবল বসা শিখেছি তখন শুরু হয় সাম্রদায়িক দাঙ্গা, মুসলীমরা ভারত ছাড়৷ আমার আব্বা মা ভারত না ছেড়ে পরণের কাপড় আর তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ছেড়ে দূরে মুসলীম প্রধান গ্রামে গিয়ে উঠেছিলেন৷ পৈতৃক সম্পত্তি কিংবা নিজের সেই ছোট্ট বাড়িটি আর ফিরে পাননি৷ শুধু তাই নয়, আব্বার একদার খেলার সাথী, সহপাঠী বন্ধুও সহকর্মী পথে আটকে, ‘গনি শেখ এখন কোথায় যাবি’ বলেও দয়া পরবশ হয়ে ছেড়ে দিয়ে ছিল৷ এ সব মায়ের কাছে শুনেছি৷৷
যেহেতু আমি তখন শিশু তাই বলতে হয়, এখানেই শুরু আমার শৈশবের৷ অন্যের দয়ায় কারো বারান্দায়, কারো দহলিজে বেশ কয়মাস কাটে আমার শৈশবের৷ দাঙ্গাবাজরা শান্ত হলে, আব্বার দূর সম্পর্কের এক ফুফু আমাদের গঙ্গা পার করে হুগলী জেলার এক মুসলীম প্রধান গ্রামে নিজের বাড়ি নিয়ে যান৷ এ সব ঘটনা আমার মনে পড়েনা, পড়ার কথাও নয়৷ তবে আমার সেই দাদীর বড় উঠানে মাদুর বিছিয়ে মিলাদের অনুষ্ঠানের পরের দিন আমাদর দু ভাইয়ে খৎনার কথা মনে পড়ে৷ দাদীর কথাও মনে পড়েনা তবে তারই দেওয়া গ্রামের শেষ প্রান্তে একচিলতে জমীর উপরে আমার আব্বা-মার মিলিত শ্রমে নির্মিত একটা ছোট বাড়ীর কথা আজও ভুলতে পারিনি৷ মাটির ঘর খড়ের ছাউনি কি্ন্তু চারিদিকে মাটিরই প্রাচীর৷ অবশ্য আমার ঐ দাদীর বাড়িটিও ছিল গ্রামের শেষে৷ আমাদের মাঝে ছিল একটি মাঝারি লম্বা পুকুর৷ আমার শৈশব বর্ণনায় এ সবের গুরুত্ব খুব বেশী না থাকলেও এ গুলোর প্রয়োজন আছে বলেই মনে করি তাই পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির কাছে মাফ চাই৷৷
আমার আব্বা প্রাইমারীর গণ্ডী পেরুলেও আর সামনে যেতে পারেননি, তবে শিক্ষার প্রতি তার আগ্রহ ছিল আর তাই নিজে সুযোগ না পেলেও, তের বছরের ছোট এক মাত্র সত ভাইটিকে এন্ট্রান্স (মেট্রিক) পাশ করিয়ে ছিলেন৷ নিজের সন্তানদের শিক্ষার জন্য তার নিয়ম ছিল, বাড়িতে নিজে পড়িয়ে প্রথম শ্রেনী পাশের উপযুক্ত করে পুনরায় প্রথম শ্রেনীতে ভর্তী করা৷ স্কুলের পাঠ্যবই গুলো তখনও পুস্তক ব্যবসায়ী ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের বাড়তি আয়ের মাধ্যম হয়ে পারেনি৷ তাই, আমার বড় বোনের শেষ করা বই, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণ পরিচয় ১ম ভাগ ও ২য় ভাগ আর ধারাপাত বইখানা আমার বড় ভাই শেষ করে৷ পরে তা আমার হয়৷ তারও অনেক পরে আমার ছোটভাই ও ছোটবোন পায়৷ ধারাপাত তখন একটা কঠিন সাবজেক্ট ছিল৷ সারাদিন চাষের কাজ বা দিনমজুরী করার পর সন্ধ্যা বেলা আব্বা ছড়ি নিয়ে পড়াতে বসতেন৷ অবশ্য সে ছড়িটি আমাদের তিন ভাইবোনের জন্য খুব একটা ব্যবহার করতে হতনা৷ ছোট দুই জনের জন্য কদাচিত ব্যবহার হত৷ বাড়তি ছিল তার লাল চোখ৷ যা দেখে পরবর্তীতে আমাদের ছেলে মেয়েরাও ভয় পেত৷ এক কথায় তিনি কড়া শাসক ছিলেন, আমাদের বন্ধু ছিলেন না৷ আর এটাই আমাদের কখনও কারও কাছে অপ্রীয় হতে দেয়নি৷
আমার বড় ভাই আমার চেয়ে তিন বছরের বড়৷ তার যখন হাতে খড়ি তখন আমার বয়স কত আন্দাজ করুন৷ বড়ভাই যখন পড়ত; ‘অ এ অজগর আসছে চলে, আ এ আনারসটি খাবে বলে৷ ই তে ইঁদূর ছানা ভয়ে মরে, ঈ তে ঈগল পাখি পাছে ধরে৷’ এ ছড়া শুনে শুনে চন্দ্র বিন্দু(ঁ) পর্যন্ত আমার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল৷ পাড়ার মুজিদ চাচা পাশের গাঁয়ের মসজিদে ইমামতি করতেন আর সকালে মসজিদ চত্তরে মক্তবে ছোটদের আরবী পড়াতেন৷ আমার বিদ্যার বহর তার কানে গেলে, তিনি একদিন আমাকে তার ছাত্র ছাত্রীদের শোনাবার জন্য সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ কি শুনিয়েছিলাম আমার মনে নেই, তবে পাশের এক বাড়িতে আমার ডাক পড়েছিল, সেখানে একটি পোষা শালিকের আপ্যায়ন, ‘কুটুম এসেছে, বসতে দাও,’ বলাটি আজও মনে আছে৷ শালিকের মুখে কথা শুনে অবাকই হয়ে ছিলাম৷
যথা সময়ে আব্বার পারিবারিক কোচিং সেন্টারে আমার পড়া লেখা শুরু হয়৷ যথারীতি ১ম ভাগ আর ২য় ভাগ সাথে ধারাপাতের শতকিয়া, কড়াকিয়া, বুড়িকিয়া, গণ্ডাকিয়া, ও প্রথম নামতা শেষ করে আমাকে স্কুলে প্রথম শ্রেনীতে পাঠানো হয়৷ যথা নিয়মে ক্লাশ করে ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পরেও নুতন বছরেও সেই আগের জায়গায় গিয়ে বসতাম৷ সহপাঠিরা বলতে লাগল, তুইতো পাশ করেছিস, আমাদের সাথে ক্লাশ টুতে বসবি চল৷ যেহেতু রেজিস্টারে আমার নাম উঠানো হয়নি, তাই আমার পাশ,ফেল ঘোষণা হয়নি৷ এ খবর আব্বাকে জানালে ক্লাশটুতে গিয়ে খাতায় নাম ওঠে৷
বিরাট লম্বা একটা মাটির দেয়াল, টালীর ছাউনি ঘরে, মাঝে দুইটি কাঠের পার্টিশান দিয়ে, ১ম, ২য় আর ৩য় শ্রেণীর ক্লাশ চলত৷ ৪র্থ শ্রেণীটি ছিল আলাদা অফিস ও পোস্ট অফিসের সাথে, পাকা দেয়াল আর টিনের ছাউনি৷ ভারতে আজও প্রাইমারী স্কুল ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত৷ ইংরাজীর শুরু হয় হাইস্কুলে৷
প্রথম শ্রেণীতে কি হইছিলাম জানিনা তবে, বড় ভাই আর আমি শিক্ষা জীবনের কোন পরীক্ষায় ২য় হইনি, আর এ মিছিলে ছোটভাই যোগ হয় ৫ম শ্রেণী থেকে৷ পড়ার জন্য জীবনেও কোন স্যারের কাছে মার খাইনি৷ বানান, নামতা না পরার কারণে বোকা ছাত্রদের কান মলে হাত ব্যাথা করেছি অনেক৷ নিজেও কান ধরে পঞ্চাশ বার উঠবস করিছি৷ সে ঘটনা বলি; আমাদের স্কুলটি ছিল পাকা রাস্তার পাশে৷ গরম কালের দুপুর, টিফিনের ছুটি৷ ক্লান্ত রিক্সা ওয়ালারা পাশের খামারে গাছের ছায়ায় রিক্সা রেখে বাড়ি গেছে৷ আমি তখন ক্লশ থ্রীর ছাত্র৷ কয় বন্ধু পরামর্শ করে একটা রিক্সা নিয়ে চালাবার চেষ্টা করছি, রিক্সার মালিক খবর পেয়ে এসে হেডস্যারের কাছে নালিশ দিয়েছে, আর যায় কোথায়৷ অফিসে তলব, অপরাধ স্বীকার করায় শাস্তি কম, ভবিষ্যতে না করার ওয়াদার পর রেহাই৷
প্রাসঙ্গীক কারণে বড় ভাইয়ের বিষয়ে আর একটু বলতে হয়৷ ঐ স্কুলে আমার বড় ভাই যখন ক্লাশ ফোর পাশ করে শিক্ষা শেষ করল, তখন একদিন হেডস্যার, (মজিবুর রহমান সাহেব) আমার আব্বার কাছে, আমাদের বাড়ি এসে বললেন যে, গনি ভাই তোমার ছেলেটা আমাদের স্কুলের গর্ব ছিল৷ সেতো হাজী মহসীন ফাণ্ডের বৃত্তি পেত৷ ওকে আমাদের কাছে ছেড়ে দাও৷ তোমার কোন খরচ লাগবে না, আমরা সব ব্যবস্থা করব৷ ওকে হাইস্কুলে ভর্তী করে দেব৷
হাইস্কুল ছিল আমাদের গ্রাম থেকে মাইল চারেক দূরে৷ অবস্থাপন্নরা বাসে যাতায়াত করত৷ সমর্থবানরা সাইকেলে৷ আমার আব্বার কোনটাই ছিলনা৷ স্যার সব দায়ীত্ব নিলেও আমার আব্বা তাকে ছেড়েদিতে পারেনি, কারণ সে এখন একটু বড় হয়েছে, প্রান্তিক চাষী আমার আব্বার চাষের কাজে তাকে প্রয়োজন৷ এ ঢোল বাজানোর উদ্দেশ্য এই য়ে, আমরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাইনি, পাঠককে এটাই মনে করিয়ে দেওয়া৷
আমি যখন ক্লাশ থ্রীতে পড়ি, একদিন এক বন্ধুর সাথে গরুর গাড়ির দুই মাথায় দুজন বসে দোল খেতে গিয়ে আমি পড়ে গিয়ে ডান হাতে ব্যাথা পেলাম৷ আব্বার মারের ভয়ে তা কারও কাছে প্রকাশ করলাম না, কিন্তু হাত অনেক ফুলে উঠলো আর অচল হয়ে গেল৷ সবাই ভাবলো কব্জির খিল সরে গেছে৷ ওঝা দিয়ে বসানোর চেষ্টা হল, চূন হলুদ. মালিশ ফেল হল৷ এমন ভাবে মাস পার হয়ে গেল৷ তখন হাস পাতালে যাবার সিদ্ধান্ত হল৷ হাস পাতাল বাড়িথেকে অন্ততঃ আট মাইল দূরে৷ কেমন করে যাওয়া হবে, সাথে খরচের ব্যাপারও আছে৷ পাড়ার রহমত ভাই, অশিক্ষিত কিন্তু চালাক চতুর৷ উনি তার সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে গেলেন৷ পথে পায়ে ঝিঁঝিঁ লেগে একপাটি জুতা কোথায় পড়ে গিয়েছিল জানিনা৷
ডাক্তার বাবু আমার ছোট হাতখানা টেবিলের উপর রেখে নিজের দুই হাতে শরীরের বল দিয়ে খিল বসাবার চেষ্টা করলেন৷ যখন আমি হাত উপুড় করে টেবিলের উপর রেখে হাতের কব্জির ইঞ্চি দুয়েক উপরে আর একটা ভাঁজ দিয়ে দেখালাম, তখন তিনি নিশ্চত হলেন যে হাতের দুটি হাড়ই ভেঙ্গে গেছে৷ x-ray করিয়ে বললেন, ভাঙ্গা জায়গায় মাংস গজিয়ে গেছে, আমি প্লাষ্টার করে দিচ্ছি, তিনমাস পরে খুলে দেখব যদি জোড়া না লেগে থাকে তবে অপারেশন করে মংস ছাড়িয়ে আবার প্লাষ্টার করতে হবে৷ ঐ প্লাষ্টারেই কাজ হয়েছিল, পুনরায় আর কিছু করতে হয়নি৷
ইতি মধ্যে গ্রামের প্রান্তে একটা বড় পুকেরের চওড়া পাড় যা কবরস্থান রূপে ব্যবহার হয়, তারই একপাড়ে একটা মাদ্রাসা চালু হয়ে গেছে৷ আশে পাশের গ্রমগুলিতে মওলানা সাহেবদের সাথে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্টেজে উঠে মাইকের সামনে কেরাত, গজল, নাত গেয়ে বেড়ায়, তা দেখে আমিও বয়না ধরলাম আমিও মাদ্রাসায় যাব৷ মঞ্জুর হল৷ ক্লাশ থ্রী পাশকরে একদিন মাদ্রাসায় গিয়ে হাজির হলাম৷ মাদ্রাসায় বই পুস্তক কেনা লাগেনা৷ মাদ্রসার সীল মারা বই যত্ন সহকারে পড়ে পরীক্ষার পর জমা দিতে হয়৷ ছিঁড়ে বা হারিয়ে গেলে কিনে দিতে হবে৷
মওলানা হাজী শামসুল হুদা সাহেব নাম রেজিষ্ট্র করে, ক্লাস ফোরে উঠেছি শুনে, লাইব্রেরীতে ক্লাশ ফোরের বই পুস্তক আনতে সেক্রেটারী হাজী আশাফ আলী সাহেবের কাছে পাঠালেন৷ এ দুজনের একজন ছিলেন অনেক দূর গ্রামের আর আশরাফ সাহেব ছিলেন পাশের গ্রামের৷
বাংলা, অংক, ভূগোল, ইসলামের ইতিহাস সাথে আরবী কায়েদা, উর্দূ ও ফার্সী কায়েদা নিয়ে ক্লাশ সুরু হল৷ আমার স্বল্প শিক্ষা জীবনে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে এ দুজনের কথা কোন দিনও ভোলার নয়৷ প্রাইমারী স্কুলেও দুজন বিশেষ শুভাকাঙ্খী পেয়েছি, যার একজন আমার পাড়ার৷আব্দুর রহমান মণ্ডল৷ আব্বাকে মামা বলতেন আর আমরা তাকে ভাই বলতাম৷ অন্যজনের নাম মনেনাই৷ কড়া মেজাজী হিন্দু ভদ্রলোক৷ এদের স্নেহও ভোলার নয়৷
মাদ্রাসাটা ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মিনিট দশের পথ৷ মাঝে কয়েক বিঘা ধান জমি৷ আল পথে যাতায়াত, তাই বর্ষা কালে পাকা রাস্তা ঘুরে যেতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগে যেত৷ বই খাতা বগলে লম্বা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গী পরে খড়ম পায়ে খট খট শব্দে রহমান ভাইয়ের দালানের পিছন দিয়ে হেঁটে যেতাম তখন রহমান মাষ্টার ভাই ভাবীকে ডেকে বলতেন, ঐ দেখ ক্ষুদে মৌলুবী চলেছে৷
ক্লাশ চলে, বেশ ভালই লাগে৷ সপ্তাহ খানেক পরে একদিন শামসুল হুদা হুজুর বললেন, তোমার বইগুলো নিয়ে লাইব্রেরীতে যাও, ফেরত দিতে হবে৷ হয়ত অজান্তে কোন অপরাধ করে ফেলেছি তাই হয়ত আমাকে বই দেওয়া হবেনা ভেবে গেলাম৷ সেক্রটারী হুজুর আরবী, উর্দূ আর ফারসী ছাড়া সব বই জমা নিয়ে অন্য আর এক সেট দিয়ে বললেন, ক্লাশ ফাইভে গিয়ে বস৷ তখন কোথায় আমার ভয়? আমার আনন্দ দেখে কে!
মাদ্রাসার শিক্ষা পদ্ধতিটা ছিল খারেজি৷ যাকে কওমী বলা হয়৷ বাংলা, অংক, ভূগোল, ইতিহাস ছাড়া অন্যগুলো শেষ করতে পারলেই পরের খানা শুরু হত৷ আরবী কায়দা শেষ হলে সাধারণতঃ আম পারা দেওয়া হয়৷ আমাকে আমপারা নাদিয়ে সরাসরি কোরআন দেওয়া হয়েছিল৷ তিন বৎসরে গুলিস্তাঁ, তাইসীরুল মন্তেক, কাফিয়া, কুদূরীর সমাপ্তীর সাথে ঐ মাদ্রাসা শেষ করলাম৷ ষান্মাসীক পরিক্ষায় দু- একবার সেকেণ্ড হলেও বাৎসরীক পরীক্ষার রিপোর্টে উত্তীর্ণের স্থানে আউয়াল লেখা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম৷ একবার রেজাল্ট বার হবার আগেই খবর পেলাম যে, আলাউদ্দীন কে, যে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ও প্রতিদন্দ্বী ছিল, তাকে প্রথম করা হবে৷ সে বোর্ডিংএ থাকত, হেড মৌলানার একনিষ্ঠ সেবকও ছিল৷ যথা সময়ে দেখলাম ঘটনা সত্য৷ রিপোর্ট হাতে পেয়েই তা ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলেদিলাম৷ অবস্থা দর্শণে হেড মৌলানা, আবু তাহের সাহেবের চোখ বিপদের আভাস দিল৷ ভাবলাম বেত মাটিতে পড়বেনা৷ কিন্তু না কিছুই বললেন না৷ এমনকি অফিসে নালিশও করেননি৷
যেহেতু আমরা ছিলাম দারিদ্র সীমার একে বারে নীচে তাই, দ্বীন মজুর, বর্গাচাষী আব্বার আপ্রাণ সহযোগীতা সবাই করতে বাধ্য হয়েছি৷ হালের গরু ছাড়াও আমাদের আরও গরু ছাগল ছিল, তাদের যত্ন, খোরাক যোগাড় করতে বাকী সময় ব্যয় করতে হত৷ তার ফলে খেলা ধূলার সময় আমাদের ছিলনা৷ তবে লাটিম, ডাংগুলি, ঘুড়ি উড়ানো ছাড়া আর কিছুই জানতাম না৷ গ্রীষ্মের দুপুরে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছুটা সময় বার হত৷ ঐ সময় ধান ক্ষেতও ফাঁকা পড়েথাকে৷ বল খেলা যায়৷ সমবয়সীরা রবারের বল কেনার সিদ্ধান্ত হল৷ দাম অনেক, সামর্থ কম, তাই বেশী সদস্য নিতে হল৷ সমস্যা হল, এত লোক একসাথে খেলা যায়না৷ ঝগড়া মারামারি৷ শেষে বল কেটে টুকরা করে সবাইকে ভাগ করে দেওয়া হল
ঐ মাদ্রাসা পাশের সাথে আমারও শিক্ষার ইতি৷ কিন্তু না, একদিন সেক্রেটারী, হাজী আশরাফ সাহেব আর শামসুল হুদা হুজুর আমাদের বাড়ি এলেন, আমার সব দায়ীত্ব নিয়ে আমাকে দওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তী করে দেবার আগ্রহ জানালেন৷ আব্বা বললেন, দেওবন্দ দু দিনের পথ৷ অতটুকু ছেলে পাঠাতে সাহস হয়না৷ কেবল এগারো পেরিয়েছি, আমারও ভয় হতে লাগল৷ হুজুররা বললেন, তা হলে কলকাতায় দিয়ে আসি৷ আমাদের গ্রাম থেকে বাস আর ট্রেন মিলিয়ে দেড় ঘন্টার পথ৷ আব্বা তাতে রাজি হলেন৷
দিন দুই পরে আমার বিছানা বাক্স সহ তাঁরা আমাকে নিয়ে কলকাতার মাদ্রাসা জামেউল উলুমের সেক্রেটারী ডাঃ হাজী আনিুল আম্বিয়া সাহেবের কাছে নিয়ে ভর্তী করে দিলেন৷ বোর্ডিংয়ে থাকা খাওয়া ৪৫ টাকা আমার জন্য ফ্রী, তবে আর সবার মত নাস্তার খরচ আমার নিজের৷ এক আনা বা ছয় পয়সার বেশী নাস্তায় লাগতোনা (১৬ আনা বা ৬৪ পয়সায় এক টাকা হত৷)৷ সেক্রেটারী সাহেব হাত খরচের জন্য সেদিনই কিছু টাকা দিয়ে এসেছিলেন (কত তা মনে নেই)৷ তিনি যখনই কলকাতায় আসতেন, আমার সাথে দেখা করে ৫/১০ টাকা দিয়ে আসতেন৷ ইতি মধ্যে আমার বড় ভাই কলকাতার কাছেই একটা ফ্যা্টরীতে চাকরী পেয়েছে৷ প্রতিদিন বাড়ী থেকে যাতায়াত করে৷ মাঝে মাঝে বড় ভাইও দেখা করতে আসতো, টাকাও দিত৷
পাড়ার সেই ওস্তাদজীর ছেলে, গুলজার রহমান, আমার থেকে বেশ বড়, অনেক আগেই ঐ মাদ্রাসায় ভর্তী হয়েছিল৷ তার সাথে থাকা, বেড়ানো, বাড়ি আসা যাওয়া, বেশ ভালই ছিলাম৷ দেখতে দেখতে দু বছর পার হয়েছে৷ হেদায়া, তাফসীরে জালালাইন মোতায়ালা করি৷
১৯৬৪ সাল, মাস তারিখ মনে নেই৷ একদিন সন্ধ্যাবেলা গুলজার ভাই বলল, সামাদ, শহরের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছেনা, ‘রায়ট’ হতে পারে৷ তুই বাড়ি চলে যা৷ রায়টের আগেই আমার জন্ম৷ তার ভয়বহতা শুনেছি, পরিনামও জানি৷ তা আবার কোনদিন ফিরে আসতে পারে, তার ধারণা ছিলনা৷ জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যাবে না? বলল, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব, তুই ছোট মানুষ, তুই চলে যা৷ বোরডিং ম্যানেজারকে জানিয়ে, খালি হাতে, গাড়ি ভাড়া সম্বল করে বাড়ি রওয়ানা হলাম ও অনায়াসেই বাড়ি পৌঁছে গেলাম৷
মাদ্রাসাটা ছিল পার্কসার্কাস এরিয়ার একেবারে পূর্বপ্রান্তে৷ অল্প কিছু মুসলীম, বাকী সবই হিন্দুর বাস৷ বেশ বড়সড় তিন গম্বুজ ওয়ালা মসজিদ, সামনে মাঠ৷ মাঠের একপাশে বোর্ডিং অন্য পাশে ক্লাশ রুম৷ এ গুলো ইঁটের দেওয়ালের উপর টিনের ছাউনি৷ দক্ষীন পাশে, রামমোহন বেরা লেন পার হলেই বিরাট গোবরা কবরস্থান৷ চারিদিকে পাঁচিল ঘেরা৷ ভিতরে অনেক পাকা রাস্তা৷ বেশ কয়েকটি পুকুরও আছে, যাতে আমরা মাঝে মাঝে গোসল করতাম৷ প্রায় সব কবরই পাকা ও পাঁচিল ঘেরা, যার জন্য বেশিদূর দৃষ্টি চলেনা৷ শবে বরাতের রাতে এখানে আগর বাতি, মোম বাতি, আলোক সজ্জার উৎসব হত, সঙ্গে দোওয়া দরুদ, কোরআন খানির পাইকারী ও খুজরা বেচা কেনা৷
পরের দিন সকালে উঠে দেখি গুলজার ভাইও এসে গেছে৷ অবস্থা জানালো, সবাই সতর্কই ছিলাম৷ পাড়ায় হৈ-হল্লা শুনে আমরা অনেকেই কবরস্থানে পালিয়ে বাঁচি৷ দূর থেকে আগুন জ্বলতে দেখেছি৷ বাকী আর কিছুই জানিনা৷ রেল লাইন ধরে হেঁটে শিয়ালদাহ, সেখান থেকে হাওড়া, তরপর বাড়ি৷ পথে কোন বিপদ হয়নি৷ কারণ তারও তখনও দাড়ি গজায়নি৷৷
এখানেই ইতি হল আমার মাদ্রাসা শিক্ষার৷ সাথে শৈশব ও কৈশোরের যবনিকা পাত৷ কজন বেঁচেছিল বা বাকীদের খবর জানা জায়নি, তবে কয়েক মাস পরে গিয়ে দেখেছি মসজিদের দেওয়াল খাড়া আছে, ধোঁয়ায় দেয়াল কালো হয়েছে, টিন শেডার চিহ্ন নাই, শুধু পাকা মেঝেটা তার অস্তিত্য জানান দিচ্ছে৷
শুনেছি অবশিষ্ট যারা পুনরায় এসেছিল তাদের নিয়ে তাঁতী বাগানের এক মক্তবে ক্লাশ শুরু হয়েছিল৷ গুলজার ভাই তার কোর্স শেষ করে মসজিদের ইমাম হয়েছিলেন৷ জেহেন ভাল ছিল৷ ভাল বক্তাও হয়েছিলেন৷ দেখা বা শোনার সৌভাগ্য হয়নি, কারণ আমরা ততদিনে কপালে রিফিউজী সীল মেরে, আমাদের ভাগের পূর্ব পাকিস্তানে মুসলীম হিসেবে নির্ভয়ে বাসের জন্য দ্বিতীয় দফা রিফিউজী হয়ে গেছি৷
আব্দুস সামাদ/শেখের পোলা৷ টরোন্ট;-১২/৯/’১৪
(এ লেখা যদি কারও বিন্দুমাত্র ভাল লেগে থাকে তবে ভিশু ভাইয়ের জন্য দোওয়া করবেন৷ কারণ তার উৎসাহেই এর অবতারণা৷ ধন্যবাদ জানাই ব্লগ কর্তৃপক্ষকে৷)
(শৈশব প্রতিযোগীতা) বাবাকে হঠাতে পারলাম না, দুঃখীত)
বিষয়: বিবিধ
১৬১১ বার পঠিত, ৩২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভুলগুলি ঠিক করে দিন
"হাত অনেক ভুলে উঠলো" ফুলে হবে।
"১৬ আনা বা ৬৪ পয়সায় এক টাকা হত৷"
৯৬ পয়সায় এক টাকা হবে।
"মসজিদের লেওয়াল খাড়া আছে" দেওয়াল।
ধন্যবাদ
আপনার এই স্মৃতিময় শৈশব আরো বিস্তারিত ভাবে জানবার আশা রাখছি।
অনেক ধন্যবাদ এই শিক্ষনিয় পোষ্টটির জন্য।
কিয়া তাজ্জব কি বাত !!!
হাসপাতাল বানান লিখেছেন= হাস পাতাল। হাস মানে প্রানী,আর পাতাল মানে মাটির নীচে
পুরোটা পড়লাম। ব্যপক ভয়াবহ শৈশব। আল্লাহ আপনাকে পৃথিবী এবং আখিরাতে কল্যান দান করুন। যাদেরকে আল্লাহ সফল করেছেন,তাদের কাতারে রাখুক
আমার দেশের ব্যাঙ্কে কোন এ্যকাউন্ট নেই, এখানে আছে বেতন ওঠানোর জন্য,দেশে বিশ হাজার টাকা ইনকামের একটা বাড়ি যা অচল অবস্থার জীবিকার আশায় করেছি৷ আর কোন সম্পদ নেই, এর পরও আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিই, তিনি আমাকে অনেক সফলতা দিয়েছেন, আমাকে সুখী মানুষদের দলে রেখেছেন৷ধন্যবাদ৷
কানাডায় কি এখন স্থায়ীভাবে বসবাস?
মন্তব্য করতে লগইন করুন