"তোমরা আল্লাহর জন্য জিহাদ করো, যে ভাবে জিহাদ করা উচিৎ৷ তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন৷"
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৮:৩২:৫০ রাত
(উর্দূ বয়ানুল কোরআনের বাংলা অনুবাদ)
সুরা আল হাজ্জ রুকু;-১০ আয়াত;-৭৩-৭৮(শেষ)
সুরা হাজ্জের ছয় আয়াত বিশিষ্ট এ শেষ রুকুটি পবিত্র কোরআনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এজন্য যে, এ ছয়টি আয়াতের প্রথম চারটিতে তৌহীদ বা আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব ও একত্ববাদের বাণীকে বিশ্ব মানব সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য উম্মতে মোহাম্মদীকে রসুলে বাশার, হজরত মোহাম্মদ সঃ ও রসুলে মালায়েক হজরত জিব্রাঈল আঃ এর সাথে লিংক বা যোগ করে দেওয়া হয়েছে৷ যাতে রহমাতুল্লিল আলামিনের আরাধ্য কাজ ও বিশ্ব মানব, তা সে যে মতবাদেরই হোক, যে অঞ্চলেরই হোক, ধণী গরীব, কালো সাদা যাই হোক, তার জন্য প্রেরীত হেদায়েতের বাণী, পবিত্র কোরআন পৌঁছে যায়৷
প্রথম চারটি আয়াতে ইমান, আমল বা কর্মের ব্যাপারে বলা হয়েছে৷
৭৩/يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَن يَخْلُقُوا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ وَإِن يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لَّا يَسْتَنقِذُوهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ
অর্থ;-হে মানব সম্প্রদায়, একটি উপমা বর্ণনা করা হল, অতএব, তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোনো; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটা মাছি সৃষ্টি করতে পারবে না, যদেও তারা সকলে একত্রীত হয়৷ আর মাছি যদি তাদের কাছথেকে কিছু ছিনিয়ে নেয় তবে তারা তা তার কাছথেকে উদ্ধার করতে পারবে না৷ পূজারী ও দেবতা কত অক্ষম!
# এ আয়াতে, ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সমগ্র মনুষ্য জাতিকে সম্বোধন করে একটি উপমা বর্ণনা করা হয়েছে৷ এটি নিছক উপমা নয়, এটি নিজের বিশ্বাস ও অন্তরে উঁকি দেবার উপাদানও বটে, যেমন হজরত ইব্রাহীম আঃ বড় মূর্তী টাকে অক্ষত রেখে ছোট গুলোকে ভেঙ্গে মূর্তী পূজায় বিশ্বাসীদের অন্তর সামান্য ক্ষণের জন্য হলেও নাড়া দিয়ে ছিলেন৷
প্রত্যেক মানুষ একটি আদর্শের লক্ষ্যে দৌড়ঝাঁপ করে থাকে৷ যার চিন্তধারা মহত তার আদর্শও মহত৷ যে সে মহত্বের সন্ধান পায়না সেই নিকৃষ্ট আদর্শে ডুবে থাকে৷ ক্বাবায় রক্ষিত ৩৬০ টি মূর্তীই শুধু নয় আজ ৩৩ কোটি দেবতা মিলেও একটি মাছি তৈরী করতে সক্ষম নয়, এমনকি তার সামনে রাখা খাদ্য খাবার নিয়ে গেলেও তা ফেরত উদ্ধার করার ক্ষমতা তারা রাখে না৷ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে; যেমন দেবতা তেমনই তাদের পূজারী৷ অথচ, মানুষ সৃষ্টির সেরা, তার সৃষ্টি কর্তাও সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী৷ তাই ‘মতলুব’ বা আরাধ্য জড় পদার্থ নয়, অর্থসম্পদ নয়, চাকুরী নয়, দেশের মাটি নয়, একমাত্র আল্লাহ৷ যদিও জীবন জীবিকার জন্য এ সবের প্রয়োজন রয়েছে৷
৭৪/مَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
অর্থ;-তারা আল্লাহর যথাযোগ্য মর্যাদা বোঝেনি৷ নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিধর, মহা পরাক্রমশীল৷
৭৫/اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ
অর্থ;-আল্লাহ ফেরেশ্তা ও মানুষের মধ্য হতে রসুল মনোনীত করেন৷ আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা৷
৭৬/يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الأمُورُ
অর্থ;-তিনি জানেন যা তাদের সামনে আছে এবং যা পশ্চাতে আছে এবং সব কিছু আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে৷
# আল্লাহ তায়ালা ফেরেশ্তাদের মধ্য থেকে হজরত জিব্রাঈল আঃ কে রসুল ও মানুষের মধ্য থেকে হজরত মোহাম্মদ সঃ কে রসুল মনোনীত করলেন৷ দুই রসুলের মাঝে একটি যোগসূত্র তৈরী করে, বিশ্ববাসীর হেদায়েত পবিত্র কোরআন নাজিল করলেন৷
এ তিনটি আয়াতে তৌহীদ বা ইমান, রেসালাত ও আখেরাতের কথা বলা হল৷
যারা এ আহবানে সাড়া দিলনা তাদের কাছে নামজ, রোজা, হজ্জ, আমলে সালেহের কোন দাওয়াত হলনা৷ আর যারা এ আহবানে হাজির হল; তাদের পরবর্তী করনীয় পরের দু আয়াতে আসছে৷ আর তাই, ‘ইয়া আইয়োহান্নাস’ নয় ‘ইয়া আইয়োহাল্লাজিনা আমানু’ বলা হয়েছে৷
৭৭/يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ;-হে মুমিন গন, তোমরা রুকু করো, সেজদাহ করো, তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত করো, সৎকাজ সম্পাদন করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার৷
# সম্বোধনের ভাষা বদলে এখন মুমিনদের প্রতি চলে এসেছে৷ তোমরা যারা ডাকে আল্লাহর ‘লাব্বয়েক’ বলেছ, তারা পরবর্তী করণীয় শোন; তোমরা সৃষ্টি কর্তার প্রতি নত হও, আরও নত হও (সেজদাহ কর), তার ইবাদত করো, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধটিও ইবাদতের মধ্যেই এসে যায়,কিন্তু তার পরও সৎকাজ সম্পাদন করতে হুকুম দেওয়া হয়েছে৷ এ সৎকাজ বলতে ‘খেদমতে খালক’ বা সৃষ্টির সেবা করার আদেশ হল৷ যার মুখ্যটি হল মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানো৷ আর এরই মাঝে রয়েছে সফলতা৷ তাই শুধুই ইবাদত, দান খয়রাত, মাদ্রাসা এতিমখানা, আমলে সালেহের মাঝেই সফলতা সীমাবদ্ধ নয়, মানুষকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর প্রচেষ্টাও এর শামিল৷ এবং এর চাইতেও গুরুত্ব পূর্ণ দায়িত্ব আসছে পরের আয়াতে৷
(ইমাম শাফী রঃ এ আয়াতটিকেও সেজদার আয়াত বলেছেন, পাঠক ও শ্রোতাকে সেজদাহ করতে অনুরোধ করা হল)
৭৮/وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِّلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمينَ مِن قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاء عَلَى النَّاسِ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ فَنِعْمَ الْمَوْلَى وَنِعْمَ النَّصِيرُ
অর্থ;-তোমরা আল্লাহর জন্য জিহাদ করো, যে ভাবে জিহাদ করা উচিৎ৷ তিনি তোমাদেরকে মনোনীত করেছেন৷ তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন সংকীর্নতা রাখেননি৷ তোমাদের পিতা ইব্রাহীমের মিল্লাত, তিনিই তোমাদের নাম মুসলীম রেখেছেন এবং এ কোরআনেও৷ যাতে রসুল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা এবং তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানব মণ্ডলীর জন্য৷ সুতরাং নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহর সাথে দৃঢ় ভাবে সেঁটে যাও৷ তিনিই তোমাদের মালিক৷ তিনি কতই না উত্তম মালিক, কতই না উত্তম সাহায্যকারী৷
# উপরের হুকুম গুলোর পরই বিশেষ ভাবে এসেছে; যখন যেখানে যেভাবে যতটুকু প্রয়োজন জিহাদ করতে হবে৷ তাই কোন আমল অপেক্ষা জিহাদকে কম গুরুত্ব দেওয়ার অবকাশ নেই৷ তারও পরে আসছে নামাজ, জাকাত ও আল্লাহতে আত্মসমর্পণ করে অটল থাকার হুকুম৷ কেননা উম্মতে মোহাম্মদী সঃ কে আল্লাহ এ কাজের জন্য মনোনীত করেছেন৷আর মুসলীম বা আত্মসমর্পণকারী নামটি যা কোরআনেও আছে তা তাদের পূর্ব পুরুষ হজরত ইব্রাহীম আঃ ই রেখে ছিলেন৷
কেয়ামতে উম্মতে মোহাম্মদী সঃ কে দেখিয়ে রসুল মোহাম্মদ সঃ বলবেন; হে আল্লাহ, আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব আমি এদের কাছে যথাযত পৌঁছে দিয়ে ছিলাম৷ আর উম্মতে মোহাম্মদী সঃ দেরও দাঁড়িয়ে অন্যদেরকে দেখিয়ে বলতে হবে; হে আল্লাহ, আমিও তা যথাযথ ভাবে এদেরকে পৌঁছে দিয়েছিলাম৷
সুরা নিসা’র ১৪৩ নং আয়াতেও বলা হয়েছে; ‘এমনই ভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি, যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানব মণ্ডলীর জন্যে আর যাতে রসুল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্যে’৷রসুল লিংকে ছিলেন হজরত জিব্রাঈলের সঙ্গে, আর উম্মতে মোহাম্মদীর লিংক হল রসুল সঃ এর সঙ্গে৷
লক্ষ্যনীয় যে, উপরের চার আয়াতে সাধারণের জন্য এসেছে মাত্র একটি হুকুম বা ‘ফেল এ আমরে’র শব্দ, ‘মনোযোগ দিয়ে শোন’৷ আর নীচের দুটি আয়াতের মধ্যে এসেছে একাধিক হুকুম বা ‘ফেল এ আমর’, রুকু, সেজদাহ, ইবাদত, সৎ কাজ, জিহাদ, নামাজ, জাকাত ও আল্লাহর সাথে লেগে থাকা৷ আল্লাহর হুকুমকেই আমরা ফরজ রূপে জানি৷ অতএব, এর প্রত্যেকটিই ফরজ৷ কারও গুরুত্ব কারারও চেয়ে কম নয় বা কোনটি এড়িয়ে যাবার অবকাশ নেই৷
আসুন, আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এ কথা বলার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি৷ আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন৷
বিষয়: বিবিধ
১৩৩০ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার দোওয়া কবুল করুক৷ আমিন৷
মন্তব্য করতে লগইন করুন