"নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট হতে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন৷"

লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ১৩ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:১৩:৩৯ রাত

(ধারাবাহিক অনুবাদ, পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আত তাওবাহ রুকু;-১৪ আয়াত;-১১১-১১৮

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি আয়াত নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে এ রুকুটি৷ বেচা কেনা সাধারণতঃ দু ভাবে হয়, নগদ ও বাকী৷ নগদ বেচা কেনায় সাধারণতঃ কোন চুক্তি হয়না, কিন্তু বাকী বেচা কেনায় চুক্তির প্রয়োজন হয়৷ প্রথম আয়াতটিতে আল্লাহর সাথে মুমিন বান্দাদের বাকী বেচা কেনার একটা চুক্তির কথা বলা হয়েছে, এবং সে চুক্তিটি হয়েছে রসুল সঃ এর মাধ্যমে৷ মানুষের জীবন সহ দুনিয়ার যাবতীয় বস্তুরই প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা৷ মানুষকে কিছু জিনিষ স্বাধীন ভাবে ব্যবহার করার জন্য সাময়িক ব্যবহারিক মালিকানা দিয়েছেন৷ সেই ব্যবহারিক মালিকানাধীন জিনিষেরই বেচা কেনার চুক্তি৷

১১১/ إِنَّ اللّهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالإِنجِيلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللّهِ فَاسْتَبْشِرُواْ بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

অর্থাৎ;-নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট হতে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন, বিনিময়ে অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত৷ তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, অতঃপর হত্যা করে ও নিহত হয়৷ তওরাত, ইঞ্জীল ও কোরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে৷ আর আল্লহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দ কর তোমাদের সে সওদার জন্য যা তোমরা তার সাথে করেছ৷ আর তাই হল বিরাট সাফল্য৷



# মুমিনদের ইমান আনার সাথেই আল্লাহর সাথে এ অলিখিত চুক্তি হয়ে যায়৷ যার লিখিত প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তার তিনটি আসমানী কিতাবে দিয়েছেন৷ মুমিনরা তাদের জান ও মাল আল্লাহর পথে খরচ করবে, আর তার বিনিময়ে আল্লাহ তাদেরকে পরকালে জান্নাত দেবেন৷ আল্লাহর পথে বলতে, তার দ্বীন প্রতিষ্ঠায়৷ এতে করে তারা হত্যাও করবেন ও শহীদও হবেন৷ যেমন বদরে সত্তর জনকে হত্যা করলেন আবার ওহোদে সত্তর জন শহীদ হলেন৷ নগদের উপরেই মানুষের আস্থা বেশী, এ বাকীর সওদায় যাতে সন্দেহ না থাকে তার জন্য তিনটি কিতাবেই গ্যারান্টী দেওয়া হয়েছে৷ আর এ সওদার মধ্যেই মুমিনদের জন্য রয়েছে বিরাট সাফল্য৷

এ আয়াতে একই ধাতুর (মাসদার)দুটি শব্দ ব্যবহার হয়েছে, একটি ‘বাইয়েকুম’ যার অর্থ বেচা কেনা আর অপরটি ‘বা-ইয়া’তুম’ যার অর্থ চুক্তি করা, যা ‘বিহী’ শব্দ দিয়ে রসুলের সাথে করার কথা বলা হয়েছে৷ ‘বায়েত’ শব্দটি এখান থেকেই এসেছে, যা রসুল সঃ এর হাতের উপর হাত রেখে মুমিনগন করে ছিলেন বা ইমান এনে ছিলেন৷ অন্যত্র বলা হয়েছে, তার উপর আরও একটি অদৃশ্য হাত আছে যা আল্লাহর৷

১১২/ التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدونَ الآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللّهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ

অর্থাৎ;-তারা তওবাকারী, ইবাদতকারী, প্রশংসাকারী, সংসারত্যাগী, রুকু আদায়কারী, সেজদাহ আদায়কারী, সৎ কাজের আদেশ দানকারী, মন্দ কাজে বাধা প্রদানকারী ওআল্লাহর (বিধানের)সীমা রেখার হেফাজতকারী৷



# উক্ত বায়েতের মাধ্যমে মুমিনদের গুনাবলী গুলো এ আয়াতে বলা হয়েছে, যার ছয়টি ব্যাক্তি কেন্দ্রীক আর তিনটি সামাজিক৷ সংসার ত্যাগী বলতে, বৈরাগ্যকে বোঝানো হয়েছে, যা আগে ছিল, মানুষ সংসার ফেলে আল্লাহর নামে বেরিয়ে পড়ত৷ এটি পরে বন্ধ হয়ে যায়, তারই ধারাবাহিকতায় দূর দূরান্তে ইসলামের প্রচার বা তবলীগ আজও আছে৷

সামাজিকে আছে, সৎ কাজের নির্দেশ, মন্দ কাজে বাধা প্রদান ও আল্লাহর বিধি বিধানের সীমানা রক্ষার্থে, সীমানা রক্ষী হওয়া৷ এবং তা মুখের কথায়, সামর্থে অথবা দলীয় ভাবে শক্তি প্রয়োগ করে সীমানা অতিক্রম করতে না দেওয়া৷

আর এগুলোই চুক্তির শর্ত৷ বাস্তবায়িত হলেই রয়েছে সেই প্রতিশ্রুত জান্নাত, মুমিনের স্বার্থকতা৷

১১৩/ مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَن يَسْتَغْفِرُواْ لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُواْ أُوْلِي قُرْبَى مِن بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ

অর্থাৎ;-নবী ও মুমিনদের পক্ষে উচিৎ নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে মুরশীকদের জন্য, যদিও তারা নিকট আত্মীয়ও হয়, যখন তাদের কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তারা জাহান্নামী৷

# নিশ্চিত জাহান্নমীর জন্য, যদি সে নিকট আত্মীয়ও হয় তবুও তার জন্য মাগফেরাত চাওয়া কে অবৈধ করা হল৷ মুমিনদের জন্য তো বটেই এমনকি নবী সঃ এর জন্যও তা নিষিদ্ধ হল৷ পরের আয়াতে আসছে তার উদাহরণ৷

১১৪/ وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلاَّ عَن مَّوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لأوَّاهٌ حَلِيمٌ

অর্থাৎ;-আর ইব্রাহীমের স্বীয় পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা ছিল শুধু একটি ওয়াদার কারণে, যা তিনি পিতার সাথে করে ছিলেন৷ তার পর যখন তার কাছে এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন৷ নিশ্চয় ইব্রাহীম ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয় ও সহনশীল৷

#এ ঘটনা সুরা মরিয়মে পাওয়া যাবে৷ যখন ইব্রাহীম আঃ কে তাঁর আপন পিতা পৌত্তলিকতা ত্যাগ করার অপরাধে তাঁকে বহিষ্কার করলেন, তখন তিনি বলে ছিলেন, “সালাম আপনার প্রতি, আমি আপনার জন্য আমার রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব, নিশ্চয় তিনি আমার প্রতি অতিশয় মেহের বান”(৪৭)৷ এ ওয়াদার কারণেই তিনি পিতার মাগফেরাতের জন্য আল্লাহর কাছে দোওয়া করে ছিলেন, কিন্ত যখন কাফের অবস্থায়ই পিতার মৃত্যু হওয়ার সংবাদ শুনলেন, তখন তিনি তাঁর ওয়াদা ফেরত নিলেন৷

ভবিষ্যতে যাতে কেউ এটি দলীল হিসেবে পেশ করতে না পারে, আল্লাহ এ আয়াতে সে পথ বন্ধ করলেন৷

১১৫/ وَمَا كَانَ اللّهُ لِيُضِلَّ قَوْمًا بَعْدَ إِذْ هَدَاهُمْ حَتَّى يُبَيِّنَ لَهُم مَّا يَتَّقُونَ إِنَّ اللّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

অর্থাৎ;-আর আল্লাহ এমন নন যে তিনি কোন কওমকে হেদায়েত করার পর গোমরাহ (পথ ভ্রষ্ঠ) করে দেবেন, যে পর্যন্ত না তাদের কে সু-স্পষ্ট ভাবে বলেদেন সে সব বিষয় যা থেকে তাদের বেঁচে থাকতে হবে৷ নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে স-বিশেষ ওয়াকিফহাল৷

# আল্লাহ তায়ালা তার স্পষ্ট পথ নির্দেশনা বা বিধান নাজিল না করা পর্যন্ত, তার বরখেলাফ কে আমলে নেন না৷ এতে করে তিনি হজরত ইব্রাহীম আঃ এর মুশরীক পিতার জন্য মাগফেরাত চাওয়া বা অন্য যে কেউ তা করেছেন তাকে অবৈধ বা গোনাহের কাজ বলে গন্য করবেন না৷ হয়তবা তিনি কবুলও করে থাকবেন৷

১১৬/ إِنَّ اللّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ يُحْيِـي وَيُمِيتُ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ اللّهِ مِن وَلِيٍّ وَلاَ نَصِيرٍ

অর্থাৎ;-নিশ্চয় আসমান ও জমিনের সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই৷ তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান৷ তোমাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া কোন বন্ধু নেই, কোন সাহায্যকারীও নেই৷



১১৭/ لَقَد تَّابَ الله عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ مِن بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِّنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ إِنَّهُ بِهِمْ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ

অর্থাৎ;-আল্লাহ কৃপা দৃষ্টি দান করলেন নবীর প্রতি এবং মোহাজির ও আনসারদের প্রতি,যারা তাঁর অনুসরণ করেছিল অতি কঠীন সময়, যখন তাদের এক দলের অন্তর বিচলিত হওয়ার উপক্রম করে ছিল৷ তার পর আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করলেন৷ নিশ্চয় আল্লাহ তাদের প্রতি পরম মমতাময়, পরম দয়ালু৷

# আমরা জানি তাবুক অভিযান ছিল একটি ভীষণ কঠীন সময়ে, প্রচণ্ড গরম, দীর্ঘ মরু পথ৷ খেজুরের ফষল ঘরে না তুললে দূর্ভীক্ষ অবশ্যম্ভাবী৷ এ সময় যারাই আল্লাহর এ অভিযানে নবী সঃ এর সঙ্গী হয়েছিলেন তাদের সবার প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন৷ ওহোদের যুদ্ধে যেমন বনু হারশা ও বনু সালমা গোত্রের লোকদের মাঝে দূর্বলতা দেখা দিয়েছিল, এখানেও কিছু লোকের হৃদয়ে তা দেখা দেয়, আল্লাহ তাদের তওবাও কবুল করেন৷

১১৮/ وَعَلَى الثَّلاَثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُواْ حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّواْ أَن لاَّ مَلْجَأَ مِنَ اللّهِ إِلاَّ إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُواْ إِنَّ اللّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

অর্থাৎ;-আর ঐ তিন ব্যাক্তির প্রতিও তিনি কৃপা দৃষ্টি দান করলেন, যাদের ব্যাপার মুলতুবী রাখা হয়েছিল৷ এমনকি যখন জমীন প্রশস্থ হওয়া সত্বেও তাদের উপরে সংকুচিত হয়ে গেল এবং তাদের জীবনও তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়ল৷ আর তারা বুঝতে পারল যে, আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া ছাড়া কোন আশ্রয় পাওয়ার উপায় নেই৷ তখন তিনি তাদের প্রতি কৃপা দৃষ্টি দান করলেন, যাতে তারা তওবা করে৷ নিশ্চয় আল্লাহই পরম তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু৷



# ১০৬ নং আয়াতে যাদের কেইস মুতুবী করা হয়েছিল, এ আয়াতে তাদের তওবা কবুলের ঘোষণা এল৷ তারা সামাজিক বয়কটে এতই অথিষ্ঠ ও সংকীর্ণতার মাঝে পড়ে গিয়ে ছিলেন যে, তারা অবশেষে বুঝে ছিলেন আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া ছাড়া বিকল্প পথ নেই৷ যেমন কোন মা যখন তার বাচ্চাটিকে শাসন করতে মার ধর করতে থাকে তখন বাচ্চাটি সেই মাকেই জড়িয়ে ধরতেই চায়, সেও জানে এমন নির্ভরযোগ্য আশ্রয় আর নেই৷

বিষয়: বিবিধ

৩১০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File