শির্কের ভিন্ন রূপ৷

লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ০৪ আগস্ট, ২০১৩, ০৭:৩৮:০১ সকাল



শির্কের ভিন্ন রূপ৷

(মূল বক্তব্য মরহুম ডাঃ ইসরার আহমদ৷ ভবানুবাদ আব্দুস সামাদ)

সুরা কাহাফের ৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “পৃথিবীতে যা কিছু আছে আমি তা পৃথিবীর জন্য শোভা করে দিয়েছি৷” আবার একই সুরার ৪৬ নং আয়াতে আল্লহ বলেন, “ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা আর সৎ কর্মের ফল স্থায়ী, তা তোমার প্রতিপালকের কাছে পুরষ্কার পাওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠ ও বাসনা পুরণের জন্য ভালো”৷

সুরা শোয়ারার ৮৮, ৮৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান সন্ততি কোন কাজে আসবে না, সেদিন উপকৃত হবে সে-ই যে আল্লাহর কাছে বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে উপস্থিত হবে”৷ অন্যত্র আল্লাহ আরও বলেছেন, “তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য কে ভাল কাজ করে”৷

মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াকে মনোরম করে সাজাবার জন্য নানান ঐশ্বর্য, চাকচিক্য ও লোভনীয় দ্রব্য সামগ্রী ব্যবহার করেছেন৷ এবং তা অন্তঃকরণ দিয়ে গ্রহণ করার কূফলও বর্ণনা করেছেন৷ এ যেন সেই প্রদীপ জ্বেলে পতঙ্গ কে পরীক্ষা করা সে আত্মহুতি দেয় না সংযত থাকে!

আমরা জানি শির্ক এক বড় অপরাধ, বড় গোনাহ৷ অন্য সব গোনাহ মাফ হলেও শির্কের গোনাহ আল্লাহ মাফ করেন না৷ আমরা জানি মূর্তী পূঁজা বা কাউকে আল্লাহর অংশীদার মনে করা বা তার সমকক্ষ মনে করাই শির্ক৷ কিন্তু আমরা জানিনা এই শির্ক যুগে যুগে তার বেশ বদল করে ভিন্ন রূপে আমাদের মাঝে হাজির হয়৷ তাই শির্ক কে সঠিক ভাবে চিহ্নিত না করতে পারলে আমরা আমাদের অজান্তে শিরক করেই যাব৷

বর্তমানে আমাদের মাঝে দুটি বেশ বড় ধরণের শির্ক গেড়ে বসেছে এবং আমরা আমাদের অজান্তে তা করেই চলেছি৷ সে দুটি সম্পর্কে আমি এখানে কিছু আলোচনা করতে চাই৷

একটি হল গনতন্ত্র;-গণতন্ত্র কাকে বলে বতে আমরা জানি, আমাদের মাঝের কিছু জ্ঞানী লোক আমদের দ্বারায় নির্বাচিত হয়ে বিশাল জনগোষ্ঠিকে পরিচালনার জন্য কিছু নিয়ম নীতি, আইন কানুন তৈরী করবেন ও তার দ্বারায় দেশের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে৷

মুসলীম হিসেবে আমরা জানি ও মানি, “ইনিল হুকমু ইল্লা বিল্লাহে” আল্লাহর দুনিয়ায় নিয়ম নীতি, আইন কানুন বানাবার অধিকার একমাত্র আল্লাহর৷ মানুষকে আল্লাহ দুনিয়ায় তার প্রতিনীধি করে পাঠিয়েছেন৷ প্রতিনীধি তারাই যারা মালিকের ইচ্ছাকেই প্রতিফলিত করে৷ গণতন্ত্রে যা হয় তা অবশ্যই আল্লাহর বিরোধী ও কিছু মানুষকে হাকিম হিসেবে তারই আসনে বসানো৷ এবং এটা অবশ্যই শির্ক৷ হোকনা তা সারা দুনিয়ায় সমাদৃত৷

অপরটি হল সম্পদ;-সুরা ‘তাকাসুরে আল্লাহ বলেন, “তোমাদেরকে প্রাচুর্যের লালসা ভুলিয়ে রাখে৷ যে পর্যন্তনা তোমরা কবরে উপনিত হও”৷

সুরা কাহাফের ৫ম আয়াতে আল্লাহ তায়ালা উদাহরণ স্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন৷ দুইজন লোক, ধরে নিলাম তারা দুই বন্ধু৷ একজন বিত্তশালী৷ তার উপযুক্ত সন্তানও আছে৷

এক সময় সন্তান জনবল হিসেবে পরিগনিত হত৷ অতএব ঐ ব্যক্তি ধনশালী ও বলশালীও৷ অপর বন্ধু দরীদ্র৷ ধনে জনে প্রথম জনের চাইতে অনেক কম৷ ধনশালী লোকটিকে আল্লাহ দুইটি আঙ্গুরের বাগান দিয়ে ছিলেন, যার চারিধারে খেজুরের গাছ বেড়া হয়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগ হতে বাগান দুটিকে রক্ষা করত৷ দুটি বাগনের মাঝে ছিল একটি খাল বা ঝর্ণা যা বাগান দুটিকে রস যোগাতো৷ বাগান দুটি যথারীতি ফল দিয়ে যেত৷

একদিন ধনশালী বন্ধু দরীদ্র বন্ধুকে গর্বের সাথে বলল; ধন সম্পদ ও জনবলে আমি তোমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী৷ কথপোকথনে তারা সেই বাগানে ঢুকলো৷ বাগানের শ্রী দেখে বন্ধুকে বলল; ‘আমি মনে করিনা যে আমার এ বাগান কোনদিন ধ্বংস হবে৷ বহু মেধা, উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে একে আমি গড়ে তুলেছি৷ আর আমি এও মনে করিনা যে কোনদিন কেয়ামত হবে৷ আর যদি সত্যই কেয়ামত হয়ও, আর আমাকে যদি আমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতেই হয় তবে অবশ্যই সেখানে আমি এর চাইতে আরও বেশী পাব৷ কারণ আল্লাহ আমার উপর সন্তুষ্ট বলেইনা আমাকে এত দিয়েছেন৷’ খেয়াল করুন, ধনী লোকটি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা না বললেও কোন দেবদেবী বা কারও অনুগ্রহ উল্লেখ করেনি৷ কেয়ামতকে অস্বীকার করলেও আল্লাহকে রব বলে স্বীকার করে তার কাছে ফিরে যাবার কথা সন্দেহের সাথে হলেও স্বীকার করেছে৷

দরীদ্র বন্ধু মনে দুঃখ পেলেও উত্তরে বলল; ‘তুমিকি তাকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন তার পর শুক্র থেকে তার পর মানুষের অবয়বে? আমার প্রতিপালক আল্লাহ, আমি কাউকে আমার প্রতিপালকের শরিক করিনা৷ তুমি যখন ধনে জনে আমাকে কম দেখলে তখন তোমার বাগানে ঢুঁকে তুমি কেন বললেনা ‘আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে’ (মা শা আল্লাহ), আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন শক্তি নেই৷ হয়ত আমার রব আমাকে তোমার বাগানের চেয়ে আরও ভাল কিছু দেবেন ও তোমার বাগানে আকাশ থেকে আগুন ঝরাবেন, যার ফলে তা গাছপালা শূন্য মাটি হয়ে যাবে বা ওর পানি মাটির নীচে হারিয়ে যাবে আর তুমি কখনও তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না’৷

এখানে রসুল সঃ এর একটি হাদিশের উল্লেখ করা যায়, তিনি বলেছেন; সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের চোখে হত দরীদ্র, অনুপযুক্ত৷ কোন মজলিসে তাদের অভ্যার্থনা জানানো হয়না, তাদের কোন সুপারিশ গ্রহনযোগ্যতা পায়না, আত্মিয়তা করতে চাইলে তা যোগ্যতার অভাবে প্রাত্যাখ্যাত হয়৷ কিন্তু আল্লাহর কাছে ঐ মানুষ গুলো এতই প্রীয় যে যদি তারা ভুল বশতঃও কোন ওয়াদা করে বসে তবে আল্লাহ তার ওয়াদা বাস্তবায়নে তৎপর হন৷ এখানে দরীদ্র বন্ধুর আক্ষেপে তেমনই কিছু হয়ে থাকবে৷ এ আয়াতে আরও একটি বিষয় জানা গেল, তা ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরের নিচে নেমে যাওয়া,যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা দেখতে পাই৷ এটিও আল্লাহর শাস্তি৷

অবশেষে বাগান দুটি মাচা সমেত ধ্বসে পড়ল, সেখানে সে যে মেহনত বা পুঁজি লগ্নি করেছিল তা বিফল হল৷ সে অসহায় হয়ে হাত কচলাতে কচলাতে আক্ষেপ করে বলল; ‘হায়! আমি যদি কাউকে আমার রবের সাথে শরিক না করতাম’৷ কোথাও শরিকের কোন শব্দ (আমাদের জানা মতে) ব্যবহার না করেও সে শরিক করেছে বলে মেনে নিল৷ বাস্তবিকই সে তার অর্থকরী আঙ্গুরের বাগানের উপর এতই আস্থাশীল হয়েছিল যা আল্লাহ সাথে শরিক করার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল৷

আমরা প্রতি নিয়ত এমন শির্ক আমাদের অজান্তে করে চলেছি৷ এখানে বাগানের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে বলেই এ অবস্থা বাগানেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা দেশের মাটি, ডলার, দিনার ও হতে পারে৷

সুরা কাহাফ এ আল্লাহর প্রতি সৌজন্যতা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কিছু শব্দ আমাদের শিক্ষা দিয়ে থাকে৷ যার একটি ‘মা শা আল্লাহ’৷ আপনি আপনার পক্ষে কোন মনোরম বা সন্তোষ জনক কিছু দেখলে বলার শিক্ষা দেয়৷ আপনি ক্ষুধার্থ বা তৃষ্ণার্থ, খাবার খেলেন বা ঠাণ্ডা পানি পান করে ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটালেন, যদিও পারতপক্ষে খাদ্য বা পানিয় আপনার চাহিদা মেটালো কিন্ত বলতে হবে ‘আলহামদু লিল্লাহ’৷ খাদ্যের গুন ক্ষুধা নিবারণ, পানির গুন তৃষ্ণা নিবারণ, কিন্তু প্রতিটি দ্রব্যের গুনাগুন প্রকাশ পেতে আল্লাহর সাহায্য প্রয়োজন৷ অন্যথায় তার গুন বা ধর্ম কার্যকরী সম্ভব নয়৷ আমরা জানি পানির উপরি ভাগ সমতলে অবস্থান করে৷ পানিতে আঘাত করলে সাময়িক তা সরে গিয়ে পরক্ষনেই আগের মত সমতল হয়ে যায়৷ আল্লাহ বললেন; ‘হে মুসা(আঃ) তোমার লাঠি দিয়ে পানিতে আঘাত কর’৷ আঘাতে পানি দুপাশে সরে গিয়ে পাথরের প্রাচীর সম দাঁড়িয়ে গেল৷ এখানে পানির ধর্ম অচল হল৷ আগুনের ধর্ম দহন৷ হজরত ইব্রাহীম আঃ কে আগুনে নিক্ষেপ করা হল কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আগুন তাকে দহন করল না৷ আগুনের ধর্মও কারযকরী হল না৷ আর এ কারণেই বলতে হয় ‘আলহামদু লিল্লাহ’৷

বিধর্মী মুশরিকরা বিভিন্ন সময় নবী সঃ কে উদ্ভট প্রশ্ন করে যাচাই করত, যেমন; রুহ কি, জুলকারনাইন কে ছিল৷ হজরত জিব্রাঈল আঃ এ সবের উত্তর ওহীর মাধ্যমে নবী সঃ কে প্রতি নিয়ত পৌঁছেদিতেন৷ রসুল সঃ এতে এতই অভ্যস্থ হয়ে ছিলেন যে, যখন তারা প্রশ্ন করল, ‘আসহাবে কাহাফ’ কারা৷ রসুল সঃ বললেন; ঠিক আছে আগামী কাল বলে দেব৷ পরের দিন জিব্রাঈল আঃ আর এলেন না৷ এমন করে তিন দিন পার হল৷ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল না৷ মুশরিকরা তালি বাজাতে লাগল যে মোহাম্মদের (সঃ) কেরামতি শেষ৷ কল্পনা করুন রসুল সঃ এর মানষীক অবস্থা কেমন হয়েছিল৷ এমন সময়ে জিব্রাঈল আঃ উত্তর নিয়ে এলেন সাথে এও নসিহত করলেন, যে আগামীতে কোন কাজ করতে চাইলে যেন অবশ্যই ‘ইন শা আল্লাহ’ বলেন৷

বিষয়: বিবিধ

১৩৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File