আল মাহমুদের বাসায় একদিন
লিখেছেন লিখেছেন ইকুইকবাল ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:৪৬:২০ রাত
ঢাকায় কোন এক সাহিত্য সম্মেলনে কবি আবিদ আজমকে সাহিত্য পদক দেয়ার জন্য কবি আল মাহমুদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন। সেই প্রথম দেখা কবির সাথে। অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। এরপর নিয়মিত কবির লেখা পড়ছি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায়। তার আগে খড়ের গম্বুজ পড়ে মূলত কবির প্রতি অনুরক্ত হই। অনেকদিন অতিবাহিত হলেও কবির সাথে দেখা করার কোন উপলক্ষ, সময়, সুযোগ খুঁজে পাচ্ছিলাম না ।
বিক্রমপুরের সাহিত্যিকদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‘মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর লেখক ফোরাম’। ফোরামের পক্ষ থেকে বিক্রমপুরের প্রায় সব সাহিত্যিকদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করা হয়। ফোরামের কোরামে সিদ্ধান্ত হয় জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্যিকদের সাথেও সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয়। সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কবি আল মাহমুদের বাসায় যাওয়া। আবিদ আজম কবি আল মাহমুদের সাথে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে আমাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার ইচ্ছা পোষণ করেন। আবিদ আজম বর্তমান তরুণ কবিদের মাঝে অন্যমত। ওর হাত ধরেই সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করি। লেখালেখির সুবাদেই ওর সাথে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। আবিদের অনেক বই বের হয়েছে। অনেক পুরস্কার, পদকের কথা নাই বা বললাম। প্রথম আলো, ইত্তেফাক, আলোকিত বাংলাদেশসহ অনেক পত্রিকাতেই আবিদ কাজ করেছিল। সম্প্রতি রেডিও টুডেতে কাজ করছে বলে আমাকে জানায়।
ফোরামের পক্ষ থেকে সবাইকে জানানো হয় কবি আল মাহমুদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার বিষয়টি। অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্তেও আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেনি। অবশেষে সভাপতি হিসেবে আমি ও সাধারণ সম্পাদক রমজান মাহমুদ কবির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে রওয়ানা দেই। রমজান মাহমুদ মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে ও আমি সিরাজদিখান থেকে গুলিস্তান এসে একত্রিত হই। আমরা একটি রিক্সায় উঠে আবিদের সাথে যোগাযোগ করি। আবিদ আমাদের যেখানে যেতে বলে সেখানে গিয়ে ওর সাথে সোজা কবির বাসায় হাজির হই। কবিকে আমরা অসুস্থ পেলাম। কষ্ট এবং আনন্দ দুটোই লক্ষ করার মত। অযতœ-অবহেলার দরুন কবির করুণ অবস্থায় আমাদের ব্যথিত করে। এই ভেবে আনন্দিত হই যে কবির সাথে আমাদের লেখক ফোরামের সৌজন্য সাক্ষাৎ। ওফ্! ভুলেই গেছি কবি সম্পর্কে কিছু বলতে। তাহলে পাঠকবৃন্দ শুনুন।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে যোগদান করেন এবং পরিচালকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি সময়ে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকায় আল মাহমুদ বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশের একজন অন্যতম শ্রষ্টাও। অপরদিকে তিনি আবহমান বাংলা ও বাঙালি ঐতিহ্যেরে শ্রেষ্ঠ রূপকার। তার সৃষ্টির পরিধি এতো বিশাল ও ব্যাপক যে, তাকে একজন যুগ¯্রষ্টা হিসেবে হিহ্নিত করলেও অতিরঞ্জিত হয় না। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে তার সমতুল্য আর কেউ নেই। বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্যে আল মাহমুদ কখনো কখনো এক ও অবিভাজ্য সত্তা। বাংলা কবিতা যাদের হাত ধরে আধুনিকতায় পৌঁছেছে, আল মাহমুদ তাদেরও অন্যতম। স্বাধীনতার পর তিনি ‘দৈনিক গণকন্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। পৃথিবীর বড় বড় মানুষদের নিয়ে বিতর্ক হয়েছে বড় রকমের। তার বেলায়ও তাই হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য, ভালোবাসা ও সমানভাবে প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। তিনি সর্বাধিক আলোচিত। সমালোচিতও। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী নন তিনি কিন্তু বৈচিত্র্য আছে তার পোড় খাওয়া জীবনে। বর্তমানে তিনি অন্য এক আল মাহমুদ। শারীরিক বার্ধক্যে উপনীত মাহমুদের মনে এখন শিশু সারল্য। মানসিক তারুণ্য ও দৃঢ়তার কাঁধে ভর করে শ্রুতিলেখক দিয়ে এখনও লিখছেন সব রকমের লেখা। তার কবিতায় লোকজ শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগ যেমন লক্ষণীয় তেমনি কবিতায় রয়েছে ঐতিহ্যপ্রীতি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৬ সালে প্রকাশ পায় ‘কালের কলস’ ও ‘সোনালী কাবিন’। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি। কথাসাহিত্য: ‘পানকৌড়ির রক্ত’। ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ তাঁর শিশুতোষ কবিতার বই। তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। লিখেছেন ‘উপমহাদেশ’ ও ‘কাবিলের বোন’ এর মতো উপন্যাস। তার লেখা কিশোর কবিতার বই বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। আট খন্ডে রচনাসমগ্র ছাড়া প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে বেশ কিছু পুরস্কার ও স্বর্ণপদক পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, নাসিরুদ্দিন স্বর্ণপদক ইত্যাদি।
কবির সম্পর্কে লেখে শেষ করা যাবে না। আমরা কবির সাথে এবার বেশি কথা বলতে পারলাম না। কবি আমাদের ফোরামের জন্য একটি শুভেচ্ছা বাণী দিলেন। এদিকে আমাদের জন্য গেস্ট রুমে খাবার দিয়ে চলে গেল কাজের বুয়া। খিচুড়ি অবশ্য আমার খুব প্রিয় তা কাউকেই বোঝতে দিলাম না। আবিদ বলল তোমরা অনেক দূর থেকে এসেছ কিছু খেয়ে নাও। আমি বললাম না তোমাকে ছাড়া আমরা খাব না। তুমিও আমাদের সাথে বস। তিনজন এক সাথে খেতে বসে কাজের কথা সেরে নিলাম। খাওয়া-দাওয়া শেষে কবির সাথে ছবি তুলে নিলাম। বিদায় নেওয়ার সময় হাস্যোজ্জল চেহারা মলিন হয়ে যায়। জানিনা আবার কবে দেখা হবে এমন মহান মানুষের সাথে।
লেখক:-আশরাফ ইকবাল, সভাপতি, মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর লেখক ফোরাম
বিষয়: সাহিত্য
১৩১০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
(খানা ছাড়া নাম পরিবর্তন মেনে নেওয়া হবেনা)
মন্তব্য করতে লগইন করুন