আগের মত চোখে পরে না বাবুই পাখি ও বাসা

লিখেছেন লিখেছেন ইকুইকবাল ২৪ জুন, ২০১৪, ১০:০৮:০২ রাত



আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নিপুণ বাসা তৈরীর দক্ষ কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা এখন আর আগের মত চোখে পরে না। পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজার, নতুন বনায়নে বাসযোগ্য পরিবেশ ও খাদ্যের অভাব, নির্বিচারে তালগাছ কাটায়, অসাধু শিকারীর ফাঁদ সহ বহুবিধ কারণে কালের আবর্তে সময়ের পরিধিতে প্রকৃতির স্থপতি, বয়ন শিল্পী এবং সামাজিক বন্ধনের প্রতিচ্ছবি বাবুই পাখি ও দৃষ্টিনন্দন বাসা ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগেও গ্রামগঞ্জে ব্যাপকভাবে বাবুই পাখি ও তার বাসা চোখে পড়ত। কিচিরমিচির শব্দ আর তাদের শৈল্পিক বাসা মানুষকে পুলকিত করত। অপূর্ব শিল্প শৈলীতে প্রকৃতির অপার বিস্ময় তাদের সেই ঝুলন্ত বাসাও আজ নদীর পাড়ে, পুকুর পাড়ে, বিলের ধারে ও বাড়ির তালগাছে এখন আর সচারাচর চোখে পরে না। আগের মতো বাবুই পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয় না গ্রাম বাংলার জনপদ।

নিরীহ, শান্ত প্রকৃতির এই বাবুই পাখি উচু এবং নিরিবিলি পরিবেশে বাসা তৈরি করে। গ্রামগঞ্জের তাল, সুপারি, নারিকেল, খেজুর গাছ বা আখক্ষেতে বাসা তৈরি করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে এরা। এই পাখি বাসা তৈরীর কাজে ব্যবহার করে থাকে খড়ের ফালি, ধানের পাতা, তালের কচি পাতা, ঝাউ ও কাশবনের লতা। চমৎকার আকৃতির এই বাসা বিশেষ করে তাল গাছের ডালে এমনভাবে সাঁটানো থাকে যাতে কোনো ঝড়-তুফানে সহসাই ছিড়ে না পড়ে। এদের বাসা শুধু শৈল্পিক নিদর্শনই নয়, মানুষের মনে চিন্তার খোরাক জোগায় এবং স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করে। এটি দেখতে যেমন আকর্ষণী তেমই মজবুত। ঠোঁট দিয়ে বাবুই পাখি আস্তনর ছড়ায়। পেট দিয়ে ঘঁষে তা আবার মসৃণ করে। বাসা বানাতে শুরুতেই দুটি নিম্নমুখী গর্ত করে থাকে। পরে তা একদিকে বন্ধ করে ডিম পাড়ার জায়গা করে। অন্যদিকে লম্বা করে প্রবেশ ও প্রস্থান পথ তৈরি করে। ব্যালেন্স করার জন্য বাসার ভিতরে কাদার প্রলেপ দেয়। যা বড়ই যুক্তি সংগত। বাসার ভিতরে ঠিক মাঝখানে একটি আড়া তৈরি করে বাবুই পাখি। যে আড়াতে পাশা পাশি দুটি পাখি বসে প্রেম আলাপসহ নানা রকম গল্প করে। এ আড়াতেই তারা নিদ্রা যায়। কি অপূর্ব বিজ্ঞান সম্মত চেতনাবোধ। ছোট হলেও বুদ্ধিতে সব পাখিকে হার মানায় এ পাখি।

এরা এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যায় সঙ্গী খুঁজতে। এমনকি এক গাছের বাবুই অন্য গাছে গিয়ে পছন্দের সঙ্গীকে খোঁজে। সঙ্গী পছন্দ হলে সাথী বানানোর জন্য কত কিছুই না করে। পুরুষ বাবুই নিজের প্রতি আকর্ষণ করার জন্য ডোবার গোসল সেরে ফুর্তিতে নেচে নেচে উড়ে বেড়ায় এক ডাল থেকে অন্য ডালে। এরপর উচুঁ গাছের ডালে বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। অর্ধেক কাজ হলে কাঙ্খিত স্ত্রী বাবুইকে ডেকে সেই বাসা দেখায়। বাসা পছন্দ হলেই কেবল পুরো কাজ শেষ করে। তা না হলে অর্ধেক কাজ করেই নতুন করে আরেকটি বাসা তৈরির কাজ শুরু করে। অর্ধেক বাসা বাঁধতে সময় লাগে ৪-৫ দিন। কাঙ্খিত স্ত্রী বাবুইর পাখির পছন্দ হলে বাকিটা শেষ করতে সময় লাগে ৪ দিন। পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ৬ টি পর্যন্ত বাসা বুনতে পারে। তাছাড়া এরা ঘর করতে পারে ৬ টির সঙ্গে। স্ত্রী বাবুইদের এতে কোন বাধা নেই। প্রজনন প্রক্রিয়ায় স্ত্রী বাবুই ডিমে তা দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা ফোটে। আর বাচ্চা বাসা ছেড়ে প্রথম উড়ে যায় জন্মের তিন সপ্তাহের মধ্যে। ধান ঘরে ওঠার মৌসুম হলো বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। দুধ ধান সংগ্রহ করে এনে স্ত্রী বাবুই বাচ্চাদের খাওয়ায়। এরা তালগাছেই বাসা বাঁধে বেশি। সঙ্গত কারণেই বাবুই পাখি তালগাছ ছেড়ে ভিন্ন গাছে নীড় বেঁধেছে। এই দক্ষ স্থপতি বাবুই পাখির নীড় ভেঙে দিচ্ছে একশ্রেণীর মানুষ।

এক সময় সিরাজদিখান উপজেলার অনেক গ্রামে দেখা যেতো শতশত বাবুই পাখির বাসা। এই এলাকার গাঁও গ্রাম ঘুরেও এখন আর দৃষ্টি নন্দন বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসা আগের মতো দেখা যায় না। তবে সিরাজদিখান উপজেলার কমলাপুর গ্রামের মাওলানা আব্দুল খালেক সাহেবের বাড়িতে ১টি ও একই উপজেলার চর বয়রাগাদী এলাকার হাজি চাঁন মিয়ার বাড়িয়ে ২টি গাছে বাবুই পাখির বাসা দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহ করে শহরে ধনীদের নিকট বিক্রি করছে। ধনীদের ড্রইং রুমে এখন শোভা পাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য দৃষ্টি নন্দন বাবুই পাখির বাসা। রাতের আধারে পাখি শিকারীদের জালে বাবুই পাখি আটক হয়ে বিক্রি হচ্ছে শহরের পাখি শিকারিদের দোকানে।

উপজেলার ঘাসভোগ গ্রামের সোহেলা আক্তার সানজিদা একান্ত আলাপচারিতায় বলেন, সারাবিশ্বে বাবুই পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১১৭টি। তবে বাংলাদেশে তিন প্রজাতির বাবুই পাখির বাস। তিনি আরও বলেন, বাবুই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রাতের বেলায় ঘর আলোকিত করার জন্য এরা জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে বাসায় রাখে এবং সকাল হলে আবার তাদের ছেড়ে দেয়। ধান, চাল, গম ও পোকা-মাকড় প্রভূতি তাদের প্রধান খাবার।

মুন্সিগঞ্জ জেলার আইএফসি বাংলাদেশ নদী ও পরিবেশ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাহমুদ হাসান মুকুট বলেন, যে হারে অট্টালিকা নির্মাণ হচ্ছে এতে করে ব্যাঙ্গবিদ্রুপকারী চড়–ই পাখির জয়জয়কার গান। আর হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পের বড়াইকারী সেই বাবুই পাখি। সমাজে গুণীজনদের যথাযথ সম্মান প্রদানে কৃপণতা ছেড়ে দিয়ে সমাজের অবকাঠামো মজবুত করতে হবে। নিপুণ কারিগর বাবুই পাখি ও তার বাসা টিকিয়ে রাখতে হলে বৃক্ষনিধনকারীদের হাত থেকে উক্ত গাছ রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির সোন্দর্য বৃদ্ধিতে বাবুই পাখির বাসা তৈরির পরিবেশ সহজ করে দিতে হবে।

উপজেলার পরিবেশ কর্মী মুরাদ হোসেন জিলানী জানান, বাবুই পাখি হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো শিকার করা। নির্বিচারে এ পাখির আবাস্থল ধংস করা। যার ফলেই আজ এই পাখি আর চোখে পড়ে না আগের মতো। তবে বিলুপ্তি ঠেকাতে প্রথমতো দরকার হলো জন-সচেতনতা আর সরকারিভাবে প্রজনণের মাধ্যমে বাবুই পাখির বিলুপ্তি ঠেকানো সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। সরকার এ পাখি অবাদ বিচরণের ব্যবস্থা করতে পারলে আগের মতোই গ্রাম-বাংলায় শোনা যাবে এ পাখির কলতান।

ক্যাপশন: মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার কমলাপুর গ্রামের মাওলানা আব্দুল খালেক সাহেবের বাড়ি থেকে সম্প্রতি তোলা ছবি।

বিষয়: বিবিধ

২৭৭৯ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

238490
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১০:২০
আওণ রাহ'বার লিখেছেন : বাবুই পাখিরে দেখলে বাবুই আর চড়াইয়ের কবিতাটি মনে পরে যায়।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া সুন্দর পোষ্টটির জন্য।
Good Luck Good Luck Good Luck Happy
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১০:২৬
184955
ইকুইকবাল লিখেছেন : তুমি কেন কর শিল্পের বড়াই!
238494
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১০:৩৪
আওণ রাহ'বার লিখেছেন : অসাধারন শিল্প বাবুইয়ের।
আপনার বাসা থেকে নেয়া ছবিটাও অনেক সুন্দর।
জাজাকাল্লাহ ।
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১১:৩৮
184990
ইকুইকবাল লিখেছেন : জিনিয়াস!!!!!
238504
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১০:৫০
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : বাবুই পাখি নিয়ে একটা কবিতা পড়েছিলাম। তখন পড়েছিলাম না বুঝে। এখন মনে হয় অর্থটা কত সুন্দর! খুব ভালো লাগলো। অজানা অনেক কিছু জানলাম। ধন্যবাদ আপনাকে Good Luck Good Luck
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১১:৪২
184994
ইকুইকবাল লিখেছেন : সবাই ছড়াটি দেয় আমি আমার লেখায় দেইনি। এটি অন্যরকম একটি অনুভূতি। সবাই মনে করতে চাইবে কি যেন কবিতাটি্
238517
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১১:০৫
সুমাইয়া হাবীবা লিখেছেন : সত্যি! আমারও অনেক ভালো লাগে। অঅমিও প্রায়ই ভাবি বলি। ইসস..আগের মত গাছও নাই পাখীও নাই! Sad Sad Sad
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১১:৩৭
184989
ইকুইকবাল লিখেছেন : ঠিক বলেছেন হাবিবা
238531
২৪ জুন ২০১৪ রাত ১১:৪৫
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : যেভাবে সবখানে বিল্ডিং উঠছে বাবুই এর থেকে এখন চড়ুই এর বাসা করার সুযোগ বেশি।
ছবিগুলির জন্য ধন্যবাদ।
২৫ জুন ২০১৪ রাত ১২:১৫
185002
ইকুইকবাল লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ
238566
২৫ জুন ২০১৪ রাত ০২:২৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো লাগলো লিখাটি
২৮ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৪০
203090
ইকুইকবাল লিখেছেন : লেখাটি ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম
238614
২৫ জুন ২০১৪ সকাল ০৯:৫১
শফিক সোহাগ লিখেছেন : গ্রামে গেলে আজো খুঁজি বাবুই পাখির বাসা। Day Dreaming Day Dreaming
২৮ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৪১
203091
ইকুইকবাল লিখেছেন : তালগাছের তুলনায় তেমন বাবুই পাখি দেখা যায় না বললে একদম ভুল হবেনা

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File