বিবর্ণ সেই অতীত

লিখেছেন লিখেছেন ইকুইকবাল ৩০ এপ্রিল, ২০১৪, ০৪:৫৮:৫৮ বিকাল

গভীর মনযোগ দিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়তেছি। ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি মনযোগী না হলেও ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলামনা। প্রত্যেক ক্লাশেই প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থান আমার দখলেই থাকত। ২০০৬ সালের ১৫ মে সন্ধায় পড়ার টেবিলে বসে হঠাৎ দরজার দিক থেকে আসা হাসির আওয়াজ শুনতে পেলাম। পেছনে ফিরে দেখি সানজিদা। এবার সাথে ওর বড় বোন সারমিনও এসেছে। কি আর করা! ওদের সাথে গল্প জুড়িয়ে দিলাম। আমি আবার এসবের পাল্লায় পড়লে লেখাপড়া গোল্লায় যাক তার চিন্তার ধার ধারেও ছিলামনা কোন কালেই। প্রথম সাক্ষাতেই সানজিদার সাথে আমার বেশ ভাব জমে উঠে। আমরা ঠিক করলাম আগামীকাল দুজনে অপরূপ সাজে সজ্জিত বিলে শাপলা তুলতে যাব। ওকে নিয়ে দিনভর শাপলা তোলার ইচ্ছায় কোসা নৌকা নিয়ে দুজনেই বাড়ির পাশের বিলে রওয়ানা দিলাম। আশেপাশে নানা রঙ্গের শাপলার সমাহার। অনেক শাপলা নিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরলাম। তারপর এত এত শাপলা দিয়ে কি করা হল কিছুই জানতে পারলামনা। তবে গল্পে গল্পে সানজিদার কাছ থেকে জানতে পারলাম ওগুলো দিয়ে নাকি খুব সুন্দর করে মালা তৈরি করছে। পরের দিন বিকেলে ওর সাথে অন্যরকম মজা করা হল। আমি তখন ওকে মেজিক দেখানোর ইচ্ছায় আমার পায়ের পাতা আমগাছের ডালে বাজিয়ে ঝুলছি ঠিক বাদুরের মত। হঠাৎ পা ফসকে পড়ে যাওয়ায় আমার হাটুর নিচের অংশের অনেক খানি জায়গা ছুলে গর্ত হয়ে যায়। এতে সানজিদা ভীষণ বিচলীত হয়ে যায়। মজার ব্যপার হল বিষয়টি ও বেমালুম ভুলেই যায় যা আজও আমার মনে আছে সাথে সেই চিহ্নও। দিনের পর দিন আমাদের বন্ধুত্ব ও ভালবাসার তীব্রতা বাড়ছিল।

অনেকদিন পর..

এবার অনেকদিন থাকবে ভাবে বুঝলাম। সানজিদা আসাতে ওর সাথে বেশ ভালই ভাব জমছিল। একদিন ওকে নিয়ে আমাদের বাড়ির অদূরের ব্রিজে প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য দেখতে গেলাম। পানকরি মাছ ধরার দৃশ্য, মাছরাঙ্গার শিকারের অপেক্ষায় অধির আগ্রহ নিয়ে বসে থাকার দৃশ্য, বউ-ঝিদের কলসি কাখে পানি নেওয়ার দৃশ্য, ছোট ছেলে-মেয়েদের সাঁতার কাটার দৃশ্য, রাজহাস আর খল্লা মাছের খেলা দেখতাম জম্পেস বসে। তখন ওর সাথে ফটোসেশনও করা হয়। নদীর পাড় দিয়ে ঘুরে ঘুরে আমরা মহান সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলে বাড়ি ফিরে আসলাম। ও আমাদের এলাকার প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলি- ‘আমাদের এলাকার চারদিকে মাছরাঙ্গা, টুনটুনি, ঘুঘু, ডাহুক, বাবুই, শালিক, দোয়েল, পাপিয়া প্রভৃতি পাখির কলকাকলি, নদীর কুল কুল ধ্বনি, পাতার মার্মর শব্দ, শ্যামল শস্যের ভঙ্গিময় হেলাদোলায় মন ভরিয়ে তুলে। বিল-ঝিলের কাকচক্ষু জলে ঢ্যাপ, শাপলা-কমল-কলমির ফুটন্ত মুখগুলো ভরে আছে ¯িœগ্ধ লাবণ্যে। যেদিকে তাকাই, দেখি আলোকিত আকাশ, পাই সুরভিত বাতাস।

গ্রীষ্মের আকাশে গনগনে সূর্য-রোদ্রতপ্ত দিন। কৃষকেরা প্রত্যাশার দৃষ্টি-কখন বৃষ্টি নামবে, মাটির তপ্ত বুক জুড়াবে। বর্ষায় গায়ে গা ঘেঁষে হাঁটুজলে দাড়িয়ে থাকে ধান-পাটের বাড়ন্ত শিশুরা। এখানে মেয়েরা রঙ্গিন বেত দিয়ে বোনে শীতলপাটি। কলসি-কাঁখে নদী থেকে পানি আনে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে আঁচলে ছেঁকে ছোট ছোট মাছ ধরে। ইছামতি, পোড়াগঙ্গা, ধলেশ্বরী, পদ্মা, মেঘনা নদীর বাঁকে বাঁকে জেলেদের গ্রাম। নৌকা আর জাল নিয়ে সারাদিন তারা নদীর বুকে ভেসে বেড়ায় আর মাছ ধরে। পদ্মা-মেঘনায় ধরা পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে রুপালি ইলিশ। সুনিবিড় ছায়াঘেরা আমাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে শরতে-হেমন্তে নদীর বুকের চরে গজায় কাশ ও শরবন। শীতকালে জমে উঠে পিঠাপুলির উৎসব। মাঠে মাঠে রাখালেরা গরু চরায়। এ অঞ্চলের উর্বর মাটিতে ফলে নানা রকমের গোল আলু, গম, আখ প্রভৃতি। মৃৎশিল্পীরা মালসা, রসের ঠিলি, দইয়ের তেলাইন, খাঁসা, মাটির ব্যাংক প্রভৃতি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকে। কামার সম্প্রদায় দা, বটি, টেডি, খুন্তি, ছেনি, হাসুয়া, ফুলকুচি ইত্যাদি তৈরি করে। তাছাড়া এই অঞ্চলে কিছুটা মানসম্পন্ন সুতার শিল্প, মুদ্রণ শিল্প, কুটির শিল্প, বেকারী শিল্পও গড়ে উঠেছে। বিক্রমপুরের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য পাতক্ষীরসহ মিষ্টি, দই, ছানা, রসমালাই ও আমৃত্তি বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকে এই অঞ্চলের ঘোষ পরিবারেরা। সাধু, ফকির, মস্তান, সাধক শ্রেণীর ব্যক্তিরা ভাদ্র মাসের বৃহস্পতিবার রাতে ঢোল বাজনার আওয়াজের তালে তালে ভেলা ভাসানোর উৎসবে মেতে উঠে। এছাড়া রথ উৎসব, খোদাই সিন্নি উৎসব, ঈদ মেলা, বিভিন্ন পূজার মেলা, বৈশাখী মেলা, নৌকা বাইচ মেলা, মনষা মেলা, দশমী মেলা, কৃষি মেলা, বইমেলা, নবান্ন উৎস প্রভৃতিতেও আপামর জনতা আনন্দে মেতে উঠে। এই এলাকার মানুষ সময় পেলেই সাঁতার বাইচ, নৌকা বাইচ, অলডুবানি, ষাঁড়ের লড়াই, পলানটুক, কুমীর ডাঙ্গা, কুস্তি প্রভৃতি খেলায় মেতে উঠে। কিছু বিয়ের মধ্যে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য পালকির প্রচলনও প্রত্যক্ষ করা যায়। শীতকালে গভীর রাতে ওয়াজ মাহফিলের সাথে পাল্লা দিয়ে বয়াতী গানের আসরও বেশ জমে উঠে। কাজের অবসরে টেকের হাটে বসে লালন গানের আসর। শখের বশবর্তী হয়ে এই অঞ্চলের মানুষ পান চাষ করে। কর্মজীবনের ব্যস্ততার মাঝে সপ্তাহ শেষে পদ্মা নদীর চরে গড়ে উঠা মনোমুগ্ধকর পদ্মা রিসোর্ট দেয় প্রকৃতির স্বাধ। সব মিলে আমাদের বিক্রমপুর যেন এক মহান শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক অতুলনীয় ছবি। ’ একথা শুনে সানজিদা মুগ্ধ হয়ে গেল।

এর মাঝে ও আমার খোঁজ নিত কোথায় আছি। বেশিরভাগ সময় আমি যখন পড়তে বসতাম তখন আমার রোমে ওর হঠাৎ আগমন ঘটত। ও গল্প কবিতা পড়তে বেশ পছন্দ করত। আমি কিশোর কন্ঠ পড়তাম তাই ওকেও তাই পড়তে দিতাম। খুব মজা করেই পড়ত। যখনই আসত সাথে নতুন নতুন সংখ্যা ওর জন্য সর্বরাহ করতাম। ওর পরিচয় দিতে ভুলে গেছি ও হচ্ছে ঘাসভোগ গ্রামের আমার এক প্রিয় ভাগনী। প্রায়ই স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাগুলি জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় আমার মনে। ওর সাথে একটি পর্যায়ে অনেক গভীর বন্ধুত্ব হয়ে উঠে আমার। দুজনেই লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করি। ওর বাড়ি অনেক দূর। ইচ্ছা থাকলেও দেখা করার উপায় ছিলনা। শুধু ওর কথা ভাবতাম আর কবিতা লিখতাম। এক সময়ে ভাবলাম ওর সাথে আমার আর দেখা হবেনা। শুধু শুধু ওকে ভেবে কষ্ট পেয়ে লাভ নেই।

কয়েক বছর পর...

আমার চাচাত বোন আলেয়ার বিয়েতে আসছে দেখলাম। ওকে দেখেই মনে পড়ে যায় বিবর্ণ সেই অতীত। অতীতের অনেক স্মৃতি বার বার দোলা দিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির জনালায়। এবার সানজিদা অনেক বড় হয়েছে কিন্তু আমার সাথে দেখা করেনি ভাবলাম হয়ত আমাকে ভুলে গেছে। তারপরও কয়েক বছর কেটে গেল। এর ভিতরে আর ওকে দেখিনি। ওকে সব সময় মিস করছি ও আমাকে মিস করছে কিনা জানিনা। কোন এক বিকেলে পড়ার টেবিলে বসে ওর কথা মনে পড়ায় কাকতালিয়ভাবে হঠাৎ ওর মত কাউকে দেখতে পেয়ে গলা হাকিয়ে ডাকলাম। দেরি না করে আমার ডাক পেয়ে একদম কাছেও চলে আসল। আনন্দভরা বাড়িতে সুন-সান নিরবতা। কিছুক্ষণের গল্পের ফলশ্রুতিতে আমাদের আগের বন্ধুত্ব সম্পর্কে ফিরে এল।

দীর্ঘদিন পর ওকে কাছে পেয়ে আমার কেমন আনন্দ লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা একদম। এই অনুভূতির সাথে জড়িয়ে আছে ওর সাথে অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া ধূসরস্মৃতি। ওকে দিয়ে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা করিয়ে আমি রীতিমতো অনেক ছবি তুললাম। যা বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য সানজিদা ও আমি সেই পত্রিকা নিয়ে খুব মজা পেয়েছি। সানজিদা যে কদিন আমাদের বাড়িতে ছিল প্রতিদিন বিকেলে আমরা গল্প করতাম। একদিন দেখি ওর মনটি খুব খারাপ যখন আমি ওর ছবি যে পত্রিকায় বের হয়েছে তার কপি আনতে যাচ্ছি। পরে জানতে পারলাম আমি ওইদিন ওর সাথে গল্প করিনি বিধায় মনটি খারাপ ছিল। জানতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হল এই ভেবে যে আমিই শুধু ওকে ভালবাসিনা আমাকেও সে ভালবাসে।

বিষয়: বিবিধ

১৫৮৩ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

215459
৩০ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:১১
বাংলার দামাল সন্তান লিখেছেন : প্রথম সাক্ষাতেই সানজিদার সাথে আমার বেশ ভাব জমে উঠে। ঐ মিয়া বর্তমান সানজিদার কি খবর বিয়া শাদী করবেন কবে।
৩০ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২০
163738
ইকুইকবাল লিখেছেন : কোন বিয়ে করবনা। এটা আমার পাইনাল কতা
215460
৩০ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:১১
মু নূরনবী লিখেছেন : ...কাহিনী কি শ্যাষ?....

;Winking
৩০ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২০
163740
ইকুইকবাল লিখেছেন : আর আছে
215468
৩০ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:২২
মুজিব সেনা লিখেছেন : ইয়ে দিল কা মামলা,মুখকা নেহি। বুঝতে হবে ব্যাপার আছে।
৩০ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০৯:৩৩
163872
ইকুইকবাল লিখেছেন : হিন্দী বুঝিনা ভাইজান। ধন্যবাদ। অবশ্যই ব্যাপার আছে
215652
৩০ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১১:৫১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : কেইস টা কি ইকু ভাই....
২০ মে ২০১৪ রাত ১১:০২
171267
ইকুইকবাল লিখেছেন : সময়মত বলব
215776
০১ মে ২০১৪ সকাল ০৯:০২
সূর্যের পাশে হারিকেন লিখেছেন : জানতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হল এই ভেবে যে আমিই শুধু ওকে ভালবাসিনা আমাকেও সে ভালবাসে। Crying Crying Crying Crying
২০ মে ২০১৪ রাত ১১:০২
171266
ইকুইকবাল লিখেছেন : হুম।
216234
০১ মে ২০১৪ রাত ১০:১৮
আওণ রাহ'বার লিখেছেন : এস্তেখারা ছাড়া বিয়ে করলে পরে পস্তাতে হয়।
আর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক পছন্দ ভালো নয়।
Time Out Time Out Time Out
২০ মে ২০১৪ রাত ১১:০২
171264
ইকুইকবাল লিখেছেন : একদম সত্যি কথা বলেছ
২০ মে ২০১৪ রাত ১১:০২
171265
ইকুইকবাল লিখেছেন : একদম সত্যি কথা বলেছ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File