স্মৃতিময় পাথরঘাটা-গল্প
লিখেছেন লিখেছেন ইকুইকবাল ২৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:৫১:৪৭ দুপুর
আশ্চর্য ব্যাপার। তুমি তো অদ্ভুত মানুষ। এখনও খাওয়া-দাওয়া করনি। কয়টা বাজে? ঘড়ি দেখেছ? তুমি আসবেনা? এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলল আশরাফ। ফোনে তার কথা শেষ হতে না হতেই বিছানা থেকে তড়াক করে উঠে তাসনীম। না খেয়েই ঝটপট নিজের বানানো জামা পড়ে তাড়াতাড়ি সেজেগুজে বের হয়।
আকাশে মেঘ জমেছে। দিনের আলো হারিয়ে অন্ধকার হতে যাচ্ছে। যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। এখন কী করবে, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এখন কিভাবে যাবো? নাহ কথা দিয়েছি যেতেই হবে। তার সাথে দেখা করতেই হবে। পাথরঘাটা যাওয়ার ব্যাপারে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল তাসনীম।
এদিকে আশরাফ তার অপেক্ষায় বসে থাকে। সে কখন আসবে। কখন দেখা হবে। অপেক্ষার সময় যেনো শেষ হতে চায় না।
তাসনীম বাবা-মায়ের সর্ব কনিষ্ট সন্তান। প্রচন্ড ভালবাসায় বড় হয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো গোলাপ কাননে সদ্য গজানো ফুলের কলি। বেশ আকর্ষণীয়, অপূর্ব সুন্দরী, প্রখর মেধাবী। ব্যক্তিজীবনে কঠোর পরিশ্রমী। সে এবার দক্ষতার সহিত এইচ এস সি পরীক্ষা দিচ্ছে।
মাহবুব কবির আশরাফ। তাকে সবাই আশরাফ নামেই চিনে। তার বাবা এলাকার স্বনামধন্য ব্যক্তি। তিনি বহু আগেই ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন। তার ছেলে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করতেছে। প্রখর মেধাবী। যেমন ভদ্র তেমন সুদর্শন নয়। তার দক্ষতা, যুগ্যতা, সাহিত্যিক কর্মকান্ড ও মেধার কারণে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক অনুষ্ঠানে যেতে হয়। এভাবে কোন এক অনুষ্ঠানে তাসনীমের সাথে আশরাফের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কটা এমন, যেনো বিনিসুতার মালা। কেউ কাউকে ছাড়তে পারেনা। একজনকে ছাড়া অপরজনকে কল্পনাই করা যায় না। দু’জনের মাঝে বয়সের সামান্য পার্থক্য থাকলেও মনের মাঝে কোন পার্থক্য নেই।
তাসনীম পাথরঘাটায় এসে আশরাফকে উষ্ণ অভিবাদন জানাল। আশরাফ ওর হাতে একটি টকটকে লাল গোলাপ দিয়ে বলল, ‘আই লাভ ইউ’। তারপর দু’জনে চুপচাপ অনেকটা সময় একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলো। তাসনীম লজ্জা পেলো। ও আশরাফের গালটা ছুঁয়ে বলল, আমিও। সেকেন্ডের একটি স্পর্শ আশরাফের সূক্ষè অনুভূতিকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। আশরাফও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। দুরুদুরু বুকে আশরাফ ওর হাত ধরল। এই প্রথম কোনো নারীর হাত ধরল, পাশে বসল, গন্ধ শুঁকল, ছুঁয়ে দেখল আশরাফ।
এই পাথরঘাটা তাদেরকে স্বচ্ছ অতীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দূর্বার গতিতে। মনে পড়েছে এর আগে ২ বার এখানে আসার বিষয়টি। প্রথমবার তাসনীমের বোনের সাথে। ২য় বার ভালবাসার টানে দু’জনে চুপিসারে ঘুরা। প্রায়ই স্মৃতি বিজড়িত ঘটনাগুলি জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় তাদের মনে। তখনও বুঝতে পারেনি আশরাফ সামনে কতটা অমসৃণ পথ অপেক্ষা করছে।
ঈদের পর দু’জনের সাক্ষাৎ হওয়ায় একে অপরকে বখশিশ দিল। সাথে নীল খামের চিঠিও। দু’জনে মিলে ঘুরতে লাগল। নদীর পারে সাদা সাদা কাশফুল, সাড়ি সাড়ি পালতোলা নৌকা, জেলেদের মাছ ধরা, পানকড়ির মাছ শিকার, দক্ষিণের দিকটায় বসে থাকা মাছরাঙাটির টুইট টুইট শব্দ, নদীর উপর নীল আকাশে রঙবেরঙ্গের পাখি উড়া, নদীর উথাল-পাথাল ঢেউ, নদীর পাড় ঘেঁষে চলা শীপ-লঞ্চ-স্টীমার এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপলাবণ্য দেখে দু’জনই মুগ্ধ। ওপাড়ে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। ধানের শীর্ষে মৃদু দোলা দিয়ে যাচ্ছে স্বর্গীয় বাতাস। দেখে মনে হচ্ছে কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা বিমূর্ত ছবি। পাঁকা ধানের গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ। গ্রীষ্মের চিরচেনা রূপ অকৃপণভাবে বিলিয়ে দিয়েছে এ ধরায়। দু:খভরা যে কোন মানুষ যদি প্রকৃতির এ রূপে অবগাহন করতে পারে পরিপূর্ণভাবে তাহলে তার দু:খ কষ্ট উধাও হয়ে যাবে। বেশ ভালই কাটছিল জম্পেস আড্ডার মুহূর্তগুলো। তখনও আশরাফ বুঝতে পারেনি সামনে কতটা অমসৃণ পথ অপেক্ষা করছে।
একদিন স্বপ্নে দেখি তাসনীম আমাদের আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসছে। খুশিতে আমার শরীর কাঁপতে শুরু করল। সন্ধায় পেয়ারা গাছের নিচে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওর সাথে অনেক গল্প করলাম। রাতে আমার রুমে নিয়ে গেলাম। আমি ওকে বিশ্বাস করি তাসনীমও আমাকে প্রচন্ড মাত্রায় বিশ্বাস করে যার দরুণ খুব সহজেই আমার সাথে একাই চলে আসল নির্দিধায়। যেখানে আমি পড়াশুনা ও সাহিত্যচর্চা করি সেখানে। খাটের উপর বসে দু’জনে চুপচাপ একে অপরের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। কেমন যেনো এক ভাল লাগার মতো অন্ধ আবেগ। আমরা মুহূর্তে ভুলে গেলাম পৃথিবীর সব ক্লেদ ঘৃণা। ভালোবাসায় সিক্ত হলাম। কিন্তু জীবন যেনো কেমন। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। ৫ মিনিট পরে বেরিয়ে আসি বিড়াল পায়ে গলাগলি করে। তারপর তাসনীম আমার বুকে হাত রেখে কথা দিল আমাকে কোন দিন ভুলবেনা, কষ্ট দিবেনা ও জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিবে যত বাধাই আসুক। ও শোয়ার পর বাহির থেকে জানালা দিয়ে আমি আবারও গল্প জুড়ে দিলাম। এক পর্যায়ে কোনো কারণে তাসনীম কষ্ট পাওয়ায় আমি কান্না করে দিলাম শিশুর মত। কোন মেয়ের ভালবাসা অর্জনের জন্য জীবনে এই প্রথম কান্না। ও আমার চোখের জল আলতো হাতে খুব যতœ করে মুছে দিচ্ছে। কান্না দেখে আমাকে ক্ষমা করে দেয়ায় ও তাসনীমের নরম হাতের ছোঁয়ায় কান্না থেমে যায়। তখনই বোঝলাম ও আমাকে কতটা ভালবাসে। ওর গুণে মুগ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেই এমন মেয়েকে যে করেই হোক আমার জীবন সাথী করতেই হবে। দিনে কয়েকবার তাসনীম আমাকে ফোন দিত। সে কী মধুর আলাপ। প্রতি পরতে পরতে ভালোবাসার অপরূপ প্রকাশ। ফোনে আমাকে গান শুনাতো মাঝে মাঝে হাসত। সেদিন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। ও সোজাসাপ্টা জবাব দিল তোমাকে আমি আজ থেকে মুক্ত করলাম, ছেড়ে দিলাম। আমি বললাম ভোগে সুখ নয়, ত্যাগেই সুখ। পাওয়ার সুখের চেয়ে হারানো দু:খে; ভালবাসাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা যায়। সব অপ্রাপ্তি, অপূর্ণতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমি হতাশ নই, কারণ আগুনের দরিয়া সাঁতরে স্বপ্ন সম্ভাবনার শান্ত-শীতল দীঘিতে অবগাহন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। অস্থির হৃদয়টা কেঁদে ওঠে তাসনীমকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। কিন্তু চেষ্টার ফল ব্যর্থ ভেবে একাকিত্ব জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। এর পরও ওর সাথে আমার নিয়মিত দিনে ৫-৬ বার কথা হত মোবাইলে। আমি ওর পরীক্ষার খোঁজ নিতাম, সাজেশন দিতাম। তাসনীমের পরীক্ষার পর শেষ বারের মতো ওর সাথে দেখা করি। ওকে নিয়ে আমার রচিত একটি গল্প পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় উপহার হিসেবে দিয়ে বিদায় নেই। আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। অনেক মন খারাপ করে জনমের মত ওর ইচ্ছায় আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিটিকে বিদায় দিয়ে আসি। এদিকে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে পরিবারের কাঙ্খিত শিক্ষিত, সুদর্শন ও ধনী ছেলের সাথে। মহা ধুমধামে বিয়ের আয়োজন হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষটি বধূর সাজে অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে। ভাবতেই গা শির শির করে উঠল। তাসনীম ও ওর পরিবারের সুখের কথা চিন্তা করে ত্যাগ শিকার করলাম। যদি আমার ফেমেলীর কারো সাথে শেয়ার করতাম ওকে ভালবাসার কথা, তাহলে সবাই পরীর মত এমন মেয়েকে একদম হাতছাড়া করতনা। এক্ষেত্রে আমার সুখকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছি। সত্যি আমি তাসনীমের প্রেমে এতটা পাগল ছিলাম যে, তখন ও যা বলতো আমার কাছে মনে হতো এটাই পৃথিবীর অনেক বড় সত্য। ভালবাসা কী? আমি জানতাম না। আজ আমার মনে হচ্ছে ভালবাসা মানে দু’টি মনের মিলন। দু’টি দেহের একটি আত্মা! একই সাথে মিশে যাওয়া। আমি যে ওকে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারি না। সে কথা কি ও জানতো না। তবে কেনো চলে গেলো অন্যের কাছে এভাবে---
সেই ভালবাসা, সেসব স্মৃতি আমাকে শুধু তাড়া করে বেড়ায়। রবি ঠাকুরের ভাষায়, সখি ভালবাসা কারে কয়, সেকি শুধুই যাতনাময়। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কথায়, ভুলে যাবো বলে এত দূর আসা তবু ভুলে গেছি কিন্তু ভুলে থাকতে পারিনি। কারো ভাষায়, ভালবাসা ভালবাসে, শুধুই তাকে, ভালবেসে ভালবাসায় বেধে যে রাখে।
আচ্ছা তাসনীম কি সত্যিই জানতো না, ওকে ছাড়া আমার এ জীবন শূণ্য মরুভূমির মতো। ওর পাঠানো ইনবক্সে পুরনো এসএমএস। পড়ি। চোখে জল ধরে। ঠোঁট কাঁপে। ভালবাসার ফুলগুলো দাগ রেখে যায়। গল্প হয় অন্যের। রোমিও-জুলিয়েট, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রাধা-কৃষ্ণ, কিংবা মমতাজ-শাহজাহানের মতো। প্রেম ভালবাসা দিয়েই পৃথিবীতে এরা পাওয়া না পাওয়ার মাধ্যমে ইতিহাস গড়ে গেছেন। শিহরিত লোমের গোড়ায় সুইসম পানি- মুক্তার দানার মতো দেখায় চাঁদের আলোয়। সবই পাই স্মৃতির আঙ্গিনায়। শুধু তাসনীম নেই। অর্থহীন পড়ে থাকে জীবন। এখনও আমি খুঁজে বেড়াই ওকে আমার মাঝে। ওর দেয়া চিঠি ও ছবিগুলি বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি। বিধাতার অমোধ নিয়মকে মেনে নিয়েছি।
রাতে আশরাফের মন খারাপ দেখে বুঝতে পেরে তার প্রিয় ছোট বোন মাকছুদা জিজ্ঞেস করে, ভাইয়া তোমার কি হয়েছে আমার কাছে বল। অনেক পিড়াপিড়িতে বলতে বাধ্য হয়। মাকছু ঘটনা সম্পূর্ণ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আশরাফ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করে না। সারাক্ষণ দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতর শুয়ে শুয়ে মনের মানুষকে নিয়ে গল্প লিখে আর শুয়ে থাকে। কারো সাথে কোন কথা বলে না।
ডাক্তার দেখানো হলো আশরাফকে, ডাক্তার বলল আশরাফ মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। তাই সে রাতে ঘুমাতে পারে না। প্রতিটি সুস্থ মানুষের ঘুমের প্রয়োজন প্রতিদিন ৬-৭ ঘন্টা। তা না হলে কিডনির সমস্যাই বেশি হয় এবং অতিরিক্ত রাত জাগার কারণে সে মারাও যেতে পারে।
আশরাফ এখন যে অবস্থায় আছে, সে যেকোনো সময় স্ট্রোক করতে পারে। তাই তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অনেক প্রয়োজন।
অতিরিক্ত রাত জাগার কারণে আশরাফ তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। তার ভেতর একটি মেয়ের প্রতিচ্ছবি আঁকা আছে। আর সেই মেয়েটিকে আশরাফ অনেক বেশি ভালবাসে। হয়তো বা মেয়েটি আশরাফের জীবনে না আসার ঘোষণা দিয়েছে পারিবারীক কারণে। তাই সারাক্ষণ শুধু মেয়েটিকে নিয়ে ভাবে। এই ভাবনা থেকে আশরাফকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন তাকে দূরে কোথাও ঘুরে আসা। ডাক্তার উপদেশ দিয়ে চলে যায়।
কিন্তু আশরাফকে আর ফেরানো গেল না। সে তার কথা রেখেছে। সারা জীবন একা থেকেছে আর জীবন সাঙ্গ করেছে।
বিষয়: বিবিধ
১৫৩৭ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন