ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের সাথে একদিন
লিখেছেন লিখেছেন ইকুইকবাল ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৩:৪৯:২১ দুপুর
যে লক্ষ্য নিয়ে এদেশের মানুষ ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়েছিল সে লক্ষ্য আজও অর্জন করতে পারেনি
------------------------------- ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন
ইকবাল হোছাইন ইকুঃ আব্দুল মতিন একজন ভাষা সৈনিক। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে জীবনবাজী রেখে লড়াই করেছেন। মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে পৃথিবীতে যে সকল আন্দোলন এ যাবতকালে সংগঠিত হয়েছে, তার মধ্যে বাঙ্গালীর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলন শ্রেষ্টতম। যার কারণে ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
তাঁর জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম ধুবালীয। তার বাবার নাম আব্দুল জলিল। তিনি একজন কৃষক ছিলেন। মায়ের নাম আমেনা খাতুন। তিনি ছিলেন পরিবারের প্রথম সন্তান। জন্মের পর তাকে পরিবারের সবাই আদর করে গেদু নামে ডাকতো।
১৯৩০ সালে তাদের গ্রামের বাড়ী নদী ভাঙনে (যমুনা) বিলীন হয়ে যায়। এসময় তাদের পরিবার খুব অসহায় হয়ে পড়ে। তার বাবা আবদুল জলিল জীবিকার সন্ধানে ভারতের দার্জিলিং যান। সেখানে জালাপাহারের ক্যান্টনমেন্টে সুপারভাইস স্টাফ হিসেবে একটি চাকরি খুঁজে পান।
বর্ণমালার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছে। ১৯৩২ সালে আব্দুল মতিন শিশু শ্রেণীতে দার্জিলিং-এর বাংলা মিডিয়াম স্কুল মহারানী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শুরু। ১৯৩৩ সালে যখন তার বয়স ৮ বছর তখন তার মা মারা যায়। মহারানী স্কুল থেকে তিনি প্রাইমারী পড়াশোনা শেষ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি দার্জিলিং গভর্মেন্ট হাই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে এনট্রান্স পাসের স্বীকৃতি অর্জন করেন। ঐ বছর তিনি রাজশাহী গভর্মেন্ট কলেজে আই এ ভর্তি হন। ২ বছর পর ১৯৪৫ সালে তিনি এইচ এস সি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন। কিছুদিন পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি বৃটিশ আর্মির কমিশন র্যাঙ্কে ভর্তি পরীক্ষা দেন। দৈহিক আকৃতি, উচ্চতা আত্মবিশ্বাস আর সাহসিকতার বলে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কমিশন পান। এরপর তিনি কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালো গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে তিনি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন। দেশে আসার পর তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অব আর্টস (পাশ কোর্স) এ ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন কোর্স শেষ করেন এবং পরে মাস্টার্স করেন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন বিভাগ থেকে।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে এবং রাজপথের সবখানে। ৫২’ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস। ওই দিন সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়।
২০ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংযের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। সকালের দিকে ১৪৪ ধারা ভংগের ব্যাপারে ছাত্র-রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে যান এবং ১৪৪ ধারা ভংগ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন।
বেলা ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সময় ধরে উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভংগের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় বাংলার দামাল ছেলেরা দমনমূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ ১১৪ ধারা ভঙ্গ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মিছিল নিয়ে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয়। অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবীতে আন্দোলোন তীব্র হয়ে উঠে। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যামপাস। বুলেট আর লড়াই শুরু হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিক উদ্দীন, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন।
ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন কে পঞ্চাশের দশক থেকে ‘ভাষা মতিন’ বলে ডাকা শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লেখক বদর উদ্দিন উমর, বশির আল হেলাল সহ আবুল কাশেম ফজলুল হক, হাবিবুর রহমান শেলী, মুস্তফা নুরুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, কে জি মুস্তফা তাদের লেখায় ‘ভাষা মতিন’ ব্যবহার করেন। ভাষাসংগ্রামী কাজী গোলাম মাহবুব, মাহবুব আনাম , আবদুল গফুর, হাসান ইকবাল, এম আর আখতার মুকুল, কে জি মুস্তফা, আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রমুখ তারাও ‘ভাষা মতিন’ হিসেবে সম্বোধন করেন। যার কারণে এখন সকলের কাছে তিনি ভাষা মতিন হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছেন।
সাধীনতা যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি আধিপত্যবাদ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্ঠা করেন।
লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি কিছু বইও লিখেছেন। এই বইগুলো তাঁর চিন্তা, চেতনা, রাজনীতি, দর্শন ও সত্ত্বাকে ধারণ করে চলেছে। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী-জীবন পথের বাঁকে বাঁকে, গণ চীনের উৎপাদন ব্যবস্থা ও দায়িত্ব প্রথা, প্রকাশকাল : ১৯৮৫, ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, প্রকাশকাল : ১৯৯১, আব্দুল মতিন ও আহমদ রফিক, বাঙালী জাতির উৎস সন্ধান ও ভাষা আন্দোলন, প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৫। সম্প্রতি ভাষা মতিনের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন মাসিক বিক্রমপুরের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ইকবাল হোছাইন ইকু।
ইকবাল হোছাইন ইকুঃ ভাষা আন্দোলনের লক্ষ অর্জিত হয়েছে মনে করেন?
ভাষা মতিনঃ আমাদের ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য আজও অর্জিত হয়নি। যে লক্ষ্য নিয়ে এদেশের মানুষ ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়েছিল সে লক্ষ্য আজও অর্জন করতে পারেনি। ৭১ এ দেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন হলেও আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।
ইকবাল হোছাইন ইকুঃ বর্তমান প্রজন্ম সম্পর্কে কিছু বলেন?
ভাষা মতিনঃ লেখা-পড়ার কোন বিকল্প নাই, আমাদের শিক্ষিত হতে হবে, ছেলে- মেয়েদের লেখা-পড়ায় আরো উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বাংলা ভাষা সর্বস্তাে চালু রাখতে হবে। কোন অপশক্তি যেন এই বাংলা ভাষাকে বিকৃত করতে না পারে সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। বর্তমান সরকারকে এ বিষয়ে আরো বেশি নজর দিতে হবে। তাদের সাথে নিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১২৬৭ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন